প্রেমাসক্তি পর্ব ৩

#প্রেমাসক্তি
#পর্ব__০৩
#অদ্রিতা_জান্নাত

ফোনের শব্দ পেয়ে ধরফরিয়ে উঠে বসলাম ৷ চোখটা হালকা লেগে গিয়েছিল ৷ চোখ কচলে ফোন হাতে নিয়ে দেখি আপু ফোন করেছে ৷ তাড়াতাড়ি রিসিভ করে বলতে লাগলাম,,,,,,,,

ইশিতা : হ্যালো, আপুই ওখানে সব ঠিক আছে তো?

ওপাশ থেকে আপু বলতে লাগল,,,,,,

আপু : আগে বল তুই ঠিক আছিস তো? ঠিক মতো পৌঁছিয়ে গেছিস তো? কোনো সমস্যা হয় নি তো?

ইশিতা : আরে শান্ত হ ৷ আমি ঠিক আছি ৷ কোনো প্রবলেম হয় নি ৷ তোরা ঠিক আছিস? বাপি কিছু বলে নি তো?

আপু : বাপি অনেক রেগে আছে তোর উপর ৷ জায়গায় জায়গায় লোক পাঠিয়ে দিয়েছে ৷ তুই একটু সাবধানে থাকিস ৷ ঢাকায় আসার চিন্তা করিস না একদম ৷

ইশিতা : কিন্তু আপুই এভাবে তোদের ছাড়া আমি যে আর পারছি না ৷

আপু : একটু কষ্ট কর বোন ৷ টাকা লাগলে বলিস পাঠিয়ে দিব ৷

ইশিতা : পরেরটা পরে আগে বল বাপি তোদের কিছু বলে নি তো? আম্মুর উপর রাগারাগি করে নি তো?

আপু : অল্পই করেছে ৷ আর শোন নিজের খেয়াল রাখবি ৷ কোনো ঝামেলার সাথে নিজেকে জড়াবি না একদম ৷ এখন রাখি ৷ কেউ দেখলে সমস্যা হবে ৷ সাবধানে থাকিস ৷

ইশিতা : আম্মুর খেয়াল রাখিস আপুই ৷

আপু : আচ্ছা চোখের পানি ফেলবি না একদম ৷ বুঝেছিস?

ইশিতা : আমার বুঝি কষ্ট হয় না?

আপু : সহ্য করতে শিখ ৷ আল্লাহ হাফেজ ৷

বলেই ফোন রেখে দিল ৷ ফোনের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে নিজের চোখ মুছে নিলাম ৷ কখনো বাড়ি থেকে এভাবে আলাদা একা থাকি নি ৷ এই প্রথম যতটা কষ্ট হচ্ছে ততটাই চিন্তাও হচ্ছে ৷ আর কত এভাবে লুকিয়ে থাকবো? একদিন না একদিন তো বাপি পেয়েই যাবে ৷ সেই দিন কি হবে আমার?

ফোনটা চার্জে দিয়ে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নিচে চলে গেলাম ৷ এই রাস্তায় একটাও মানুষ নেই, শুধু আমি একা ৷ এখন একা থাকতেই ভালো লাগছে আমার ৷ তাই আর বেশি কিছু না ভেবে চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম ৷ হঠাৎ আমার সামনে দুইটা বাইক এসে থামলো ৷ ভ্রু কুচকে একবার সামনে তাকিয়ে পাশ কেটে যেতে নিলেই ওড়নায় টান পরলো ৷ পেছন ফিরে দেখি একটা ছেলে আমার ওড়নার একপ্রান্ত ধরে আছে ৷ আমি এখনো শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওদের দিকে৷

সব ছেলেগুলো বাইক থেকে নেমে আমার চারপাশে ঘুরতে লাগলো ৷ সেটা দেখে আমি বললাম,,,,,,,,

ইশিতা : পথ ছাড়ুন ৷

ছেলেগুলো একে অপরের দিকে তাকিয়ে জোরে হেসে উঠলো ৷ তারপর আমার ওড়না ধরে আবার টান দিল ৷ নিজের সব শক্তি দিয়ে ঠাস করে একটা থাপ্পর দিয়ে দিলাম ৷ পাশের ছেলেটা আঙ্গুল তুলে বলতে লাগল,,,,,,,,

—- এই তোর সাহস তো কম না ৷ ওর গায়ে হাত তুলিস?

ইশিতা : ওর গায়ে হাত তুলেছি দেখে আপনার খারাপ লাগছে এখন যদি আপনার গায়ে হাত তুলি কেমন লাগবে?

—- এই এই…

আর কিছু বলার আগেই কষিয়ে একটা চড় দিলাম ছেলেটাকে ৷ পিছন থেকে আরেকটা ছেলে টেনে আমাকে তার দিকে ঘুরিয়ে মুখের সামনে একটা পেপার ধরলো ৷ পেপারে আমার ছবি দেয়া আর তার উপরে এভাবে লেখা যে যদি কেউ আমাকে কোনো জায়গায় দেখে তাহলে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিতে তাহলে যে ধরিয়ে দিবে সে যা চাইবে তাই পাবে ৷ পেপারটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছেলেগুলোর দিকে তাকালাম ৷ শেষমেষ পেপারেও? ছেলেটার হাত থেকে পেপারটা নিয়ে নিলাম ৷ সেটা দেখে সামনের ছেলেটা বলতে লাগল,,,,,,,,,,,,,,

—- কি? যাবে নাকি পুলিশের কাছে?

ইশিতা : নননা ৷ আপনারা আপনাদের রাস্তা মাপেন ৷ সামনে থেকে সরুন ৷

—- তোমাকে তো ছাড়া যাবে না ৷ যদি ছেড়ে দেই তো যা ইচ্ছা তা পাবো না ৷

বলেই ছেলেটা আমার হাত ধরতে নিলে, ছেলেটার হাত অন্য কেউ ধরে আটকিয়ে দিল তাকে ৷ পাশে তাকিয়ে দেখি ইশান ৷ চোখ মুখ সব লাল হয়ে আছে রাগে ৷ ছেলেটার হাত ঝাটা দিয়ে সড়িয়ে দিয়ে মুখের মধ্যে জোড়ে একটা ঘুষি দিল ৷ মুখ থুবড়ে পরে গেল সে ৷ আমার হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে ওনার সঙ্গে মিশিয়ে বলতে লাগলেন,,,,,,,,,

ইশান : তোরা যাবি? নাকি এর মতো তোদের এরকম অবস্থা করতে হবে? কোনটা?

রাগে ওনার মুখ অসম্ভব লাল হয়ে গিয়েছে ৷ আমারই ভয় লাগছে এখন ৷ ছেলেগুলা চুপচাপ চলে গেল ৷ ইশান আমার হাত ধরে টেনে কিছুটা দূরে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে ধমক দিয়ে বলতে লাগল,,,,,,,

ইশান : একা একা বের হয়েছো কোন সাহসে?

ওনার ধমকে কেঁপে উঠলাম আমি ৷ চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি ৷ উনি আবার বলতে লাগলেন,,,,,,,,

ইশান : কথা বলছো না কেন? নরমালি টাইমে তো কান ঝালাপালা করে দাও ৷ এখন কথা বের হচ্ছে না কেন? দিয়ে আসবো আবার ছেলেগুলার কাছে?

ইশিতা : আআরে আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? আমার হাঁটতে ইচ্ছা করছিল তাই আমি বের হয়েছি ৷ ইচ্ছা করে ওই ছেলেগুলোর কাছে গিয়েছি নাকি?

ইশান : যাও হোটেলে যাও ৷

ইশিতা : একটু পরে…

ইশান : এখন যেতে বলেছি তো নাকি?

আমি মাথা নাড়িয়ে সামনে আগাতেই ইশান ডেকে বললো,,,,,,

ইশান : এদিকে এসো ৷

ইশিতা : কি?

ইশান : হাতে ওটা কি দেখি?

আমি হাত পিছনে নিয়ে বললাম,,,,,,,

ইশিতা : ওওওটা দেখে আপনি কি করবেন? আমি বরং যাই ৷

ইশান : দিতে বলছি দাও ৷

ইশিতা : আমি…

ইশান : দিবে কিনা? (জোরে ধমকে)

পেপারটা ওনাকে দিলাম ৷ উনি পেপারটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষন দেখে বললেন,,,,,,,

ইশান : যাও এবার ৷

ইশিতা : আপনি আবার আমাকে ধধরিয়ে দিবেন না তো?

ইশান : না দিব না যাও ৷

ইশিতা : সসত্যি তো?

ইশান : তো কি মিথ্যা বলবো? তো চলো তোমাকে পুলিশের হাতে দিয়ে আসি আমাকে বিশ্বাস না হলে ৷

ইশিতা : না না বিশ্বাস হয়েছে তো ৷ এখন যাই আমি ৷

বলেই পিছনে ঘুরে হাঁটা শুরু করলাম ৷ কি ভয়ংকর ছেলেরে বাবা ৷ ইচ্ছা করছিল এক ঘুষিতে নাক ফাটিয়ে দেই ৷ এখন যদি আমাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়? না বাবা দূরে দূরে থাকতে হবে এই ছেলের থেকে ৷
এসব ভাবতে ভাবতে নিজের রুমে চলে এলাম ৷

___________

পরেরদিন…
নিজের রুমে এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করছি আমি ৷ শুধু একটা কথাই ভাবছি এখানে এলাম অথচ ঘুরবো না? কিন্তু কীভাবে ঘুরবো? ওই ছেলেটা তো বাহিরে বের হতেই না করেছে আমাকে ৷ এখন বের হলে না জানি আবার কি করবে?

কি একটা ছেলে, চিনি না, জানি না আসছে আমাকে আদেশ করতে ৷ ধুরর ৷ রুমে বসে থাকতে বোরিং লাগছে আবার বাহিরেও যেতে পারছি না ৷ তাই বেলকনিতে চলে গেলাম ৷ বেলকনিতে গিয়ে দেখি পাশের বেলকনিতে ইশান হেঁটে হেঁটে কার সাথে কথা বলছেন আর হাসছেন ৷ কিছুক্ষন পর ফোন রেখে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,,,,,,,,

ইশান : তুমি এখানে?

ইশিতা : তার আগে বলুন আপনি কেন এখানে?

ইশান : আমার রুম আমি থাকবো না তো কে থাকবে?

ইশিতা : আমার ক্ষেত্রেও সেইম ৷ এখন আমি বাহিরে গেলাম ৷ না করতে পারবেন না ৷

ইশান : আমি আবার কখন না করলাম? যেখানে খুশি যাও ৷

ইশিতা : আপনিই তো কাল বললেন একা একা বেরোতে না ৷ আজ আবার অস্বীকার করছেন?

ইশান : ওহ বলেছি বুঝি? যাও যাও ৷

ইশিতা : ওহ বলেছি বুঝি? যাও যাও ৷ (ভেঙিয়ে)

ইশান : এই এভাবে কথা বলছো কেন?

ইশিতা : এই এভাবে কথা বলছো কেন?

ইশান রেগে বললো,,,,,,,,

ইশান : আরেকবার ভেঙ্গাবা তো থাপ্পর খাবা ৷

ইশিতা : আরেকবার ভেঙ্গাবা তো থাপ্পর খাবা ৷

বলেই ফিক করে হেসে দিলাম ৷ তারপর বললাম,,,,,,

ইশিতা : থাকুন আপনি আমি একটু ঘুরে আসি ৷

বলেই ইশিতা রুমে চলে গেল ৷ এদিকে ইশান নিজে নিজেই বলতে লাগল,,,,,,,

ইশান : এই মেয়েটার মাথায় কয়টা তার ছিড়া কে জানে? কয়টা না আই থিংক সব গুলাই ৷

ইশিতা বেলকনিতে উকি দিয়ে বললো,,,,,,,,,,

ইশিতা : জ্বী না আমার না ৷ আপনার, আপনার গার্লফ্রেন্ডের, আপনার এক্স গার্লফ্রেন্ডের, তারও এক্স দ্যান আপনার বউয়ের, এক্স বউয়ের সব গুলার মাথার তার ছিড়া ৷ তাদের তার ঠিক করে তারপর আমার মাথার তারের চিন্তা করিয়েন ৷ হুহ ৷

বলেই ইশিতা চলে গেল ৷ ইশান হা করে তাকিয়ে রইল ৷ কি বললো কিছুই ওর মাথায় ঢুকলো না ৷ আর কিছু না ভেবে ও নিজেও বেরিয়ে গেল ৷

________

রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি ৷ এখানকার কিছুই তো চিনি না আমি ৷ তো কোথায় আর যাবো? তাই দাঁড়িয়ে আছি ৷ কোনো গাড়ি আসলে যেতে পারতাম ৷ কিন্তু এখানে কোনো গাড়িই তো দেখতে পেলাম না ৷

বেশ কিছুক্ষন পর আমার সামনে একটা জিপ এসে থামলো ৷ কিছু বলার আগেই ইশান আমার সামনে এসে বললো,,,,,,,,

ইশান : উঠো ৷

ইশিতা : কিইই?

ইশান : সারাদিন এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে? তো থাকো আমি একাই ঘুরে আসি ৷

বলেই জিপে উঠে গেলেন ৷ আমি আশেপাশে একবার তাকিয়ে বলতে লাগলাম,,,,,,,

ইশিতা : আরে ওয়েট ওয়েট আমিও যাবো ৷

বলেই কোনো রকমে জিপে উঠে বসলাম ৷ তারপর ইশানের দিকে তাকিয়ে বললাম,,,,,,,

ইশিতা : কোথায় যাচ্ছি?

ইশান : দেখতে থাকো ৷

ইশিতা : আগে বললে কি হয়?

ইশান : ওখানে গিয়েই দেখো ৷ একটু অপেক্ষা করলে তো আর কিছু হবে না না?

আমি আর কিছু বললাম না চুপ করে রইলাম ৷ জিপটা চলতে লাগল নিজ পথ ধরে ৷ প্রায় দুই ঘন্টা পর জিপ থামলো ৷ ইশান আমাকে নিয়ে নেমে সামনে এগিয়ে গেলেন ৷ আমি শুধু হা করে আশেপাশে দেখছি ৷ অসম্ভব সুন্দর চারপাশটা ৷ ইশান আমাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন ৷ সিঁড়িটা পাহাড় কেটে কেটে বানানো হয়েছে ৷ দেখতেও অনেক সুন্দর ৷ সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠার পর দেখি এখানে একটা রিসোর্ট ৷ রিসোর্টের ভিতরে ঢুকে ইশান রুম বুক করতে গেলেন ৷ আমি ঘুরে ঘুরে চারপাশটা দেখছি ৷ যত দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি ৷

হঠাৎ আমাকে পিছন থেকে ইশান টেনে তার দিকে ঘুরিয়ে বলতে লাগলেন,,,,,,,,

ইশান : একটু কি স্থির থাকতে পারো না?

ইশিতা : আমি আবার কি করলাম?

ইশান : তুমি তো সাধু ৷ কি আর করবা? রুমে চলো এখন ৷

বলেই আমাকে একপ্রকার টেনে নিয়ে গেলেন ৷ একটা রুমের লক খুলে নিজে ভিতরে ঢুকে আমার উদ্দেশ্যে বললেন,,,,,,,,

ইশান : বাহিরেই দাঁড়িয়ে থাকবে? নাকি ভিতরে আসবে?

আমি এগিয়ে গিয়ে বলতে লাগলাম,,,,,,,

ইশিতা : এখানে কেন রুম বুক করলেন? আর আমার রুম কোথায়?

ইশান : এখন ঘুরতে ঘুরতে রাত হয়ে যাবে ৷ রাতে জিপে করে হোটেলে ফিরা রিস্ক ৷ তাই একদিনের জন্য এই একটাই রুম বুক করেছি ৷

ইশিতা : একটা মানে? আপনার সঙ্গে থাকতে হবে আমায়?

ইশান : তুমি চাইলে রিসিপশানে যেয়ে চেক করতে পারো ৷ এই রিসোর্টে এই একটাই রুম খালি ৷ আমি তো এখানেই থাকবো ৷ তুমি কি করবা সেটা তুমি জানো ৷

ইশিতা : আজিব ৷ আমি থাকবো না আপনার সাথে ৷

ইশান : তো যাও কে না করেছে? এটা পাহাড়ি এলাকা ৷ সব জায়গা নির্জন ৷ সহজে কোনো গাড়িই রাস্তায় পাওয়া যায় না ৷ এখন তুমি একা একা কি করবে? সেটা শুধু তুমিই জানো ৷

রাগে আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে ৷ ইশানকে ধাক্কা দিয়ে সামনের থেকে সরিয়ে রুমের ভিতরে চলে গেলাম ৷ চারপাশটা দেখে বেলকনিতে চলে গেলাম ৷ বেলকনির গ্রিল গুলো ভেজা মেঘের স্পর্শে ৷ আমি ওখানে যেতেই হালকা ভাবে মেঘ ছুঁয়ে গেল আমায় ৷ এরকম হওয়ায় খুশিতে আমার চোখে পানি চলে এলো ৷ হাত বারিয়ে আরো ছোঁয়া নিতে লাগলাম ৷

ইশিতার পাশে ইশান দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৷ হাতে হাত গুজে ইশিতার দিকে তাকিয়ে আছে ও ৷ ইশিতার হাসি, কাজকর্ম দেখে ইশানও হাসছে আর একদৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে ৷

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here