প্রেমিক অপ্রেমিকের গল্প পর্ব -০৮

প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

|৮|

ঘড়ির কাটা টং টং শব্দ তুলে চারটের ঘরে আটকে গেল। আমি বিছানায় কম্বল মোড়ে বসে আছি। কনকনে শীতের রাত। ঠান্ডায় ঠক ঠক করে কাঁপছি। দু’ কম্বল জড়িয়েও উষ্ণতা পাওয়া যাচ্ছে না। আমি কম্বল থেকে অল্প হাত বাড়িয়ে শীত টুপি নিলাম। এলোমেলো পিঠময় ছড়িয়ে থাকা চুলগুলোকে কোনরকম হাত খোঁপা করে টুপি চাপালাম মাথায়। কোথা থেকে উড়ে এলো শুঁটকি পোড়া গন্ধ। আমি কপাল কুঁচকে ঘড়ির দিকে চাইলাম। মাথার ভেতরটা ঘড়ির কাটার মতোই ধ্রিম ধ্রিম শব্দ তুলছে। থেকে থেকেই বিষণ্ণ লাগছে। কিছুতেই মন ভালো করা যাচ্ছে না। আমি মন ভালো করার চেষ্টা ছেড়ে উদাস মুখে বসে রইলাম। ঢুলুঢুলু, বিষণ্ণ চোখদুটো নিয়ে নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে অসহায় বলে বিশ্বাস করে ফেললাম। বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হলদেটে কাগজগুলোর উপর গা এলিয়ে দিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম নিজেকে। ধ্রুবকে। আমার এই পরিস্থিতিকে।

ছেলেবেলা থেকেই অবাধ স্বাধীনতায় বড় হয়েছি আমি। বাবা আর দুই ভাইয়ের আড়ালে উপন্যাসের প্লট ভিন্ন অন্যকিছুর ভাবনা ভাবতে হয়নি। ১২,৭৪২ (কি.মি.) ব্যাসের এই বিশাল পৃথিবীতে বাস্তবতা, নির্মমতা থেকে বহুদূর নরম, আদুরে পুতুলটির মতো গড়ে তোলা হয়েছে আমায়। জ্যোৎস্নায় ঝলসে যাওয়া ওই চাঁদকে সবসময় চাঁদ বলেই মনে হয়েছে। মনের ভুলেও ঝলসানো রুটি মনে হয়নি। বাবা, ভাইদের কোমল প্রশ্রয়ে ভীষণ ছটফটে হয়েছি। জেদি হয়েছি। অধৈর্য হয়েছি কিন্তু কখনো কঠোর প্রতিরোধে নিজেকে ঢেকে ফেলতে পারিনি। চট করে সিদ্ধান্ত নিতে শিখিনি। বাবা আমার ইচ্ছে, অন্যায় আবদারগুলোকে মুক্ত পায়রার মতো ডানা মেলতে দিয়েছিলেন বলেই হয়তো নিজ ইচ্ছেকে প্রতিরোধ করতে শেখা হয়ে উঠেনি। প্রয়োজন হয়নি। তবে আজ প্রয়োজন হলো। মাথার উপর পরীক্ষার চাপ আর নতুন বইয়ের বাড়তি কাজ পড়তেই গড়গড় করে ভেঙে যেতে লাগলো প্রতিরোধ। ধ্রুব আর আমাকে নিয়ে চলা ওই ফিসফিসানো মন্দ কথা মনের উপরও চাপ ফেলল খুব। লেখালেখি, পরীক্ষা, দুশ্চিন্তা, সিদ্ধান্তহীনতা সব মিলিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লাম। এলোমেলো হয়ে গেল মন। সমস্যা সমাধানে অনভ্যস্ত আমি ঠিকঠাক তাল খুঁজে পেলাম না। বইয়ের পাতা, মনের পাতা সবই একাকার হয়ে অস্থির হয়ে উঠলাম। এই মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন থেকে বাঁচতে হুট করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, ধ্রুবর সাথে কথা বলব। সরাসরি কথা বলে সমস্যাগুলো একদম ঝাড় থেকে উপড়ে ফেলব। এভাবে ঘন্টা, সেকেন্ড গুণে গুণে বাঁচা সম্ভব না। এবার একটা সমাপ্তি দরকার। পুরো ঘটনাটার সুন্দর একটা উপসংহার দরকার। আমি বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলাম। প্রায় সাথে সাথেই ভুরভুর করে বাড়তে লাগল অস্থিরতা। কয়েক ঘন্টার বিলম্বও সহ্য হলো না। ধ্রুবর সাথে এই মুহূর্তে, এই সেকেন্ডে সব ঠিক করে ফেলতে ইচ্ছে হলো। আর এক মিনিটও দেরি না। এক মিনিটও না। আমি চঞ্চল পায়ে ঘরময় পায়চারি করতে লাগলাম। বুকটা ধুকধুক করছে। বুকের উপর বিশাল পাথর পড়লে যেমন হয়? তেমন ভাবেই হাঁসফাঁস করছে মন। বারবার মনে হচ্ছে, এখন। এই এখনই ব্যাপারটা সমাধান করতে না পারলে দমবন্ধ হয়ে যাবে। নিঃশ্বাস নিতে পারব না। আমার ভেবে রাখা যুক্তিগুলো ঠিকঠাক কাজে দেবে না। উত্তেজনা আর সিদ্ধান্তহীনতায় হাত-পা কাঁপতে লাগল। কী করব? কী করা উচিত? কিচ্ছুটি বুঝতে না পেরে অসহায় হয়ে গেল মুখ। চুলোয় বসানো অসময়ের চায়ের পানিটা গরম হওয়ার আগেই আরও একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। ভাইদের নীরব প্রশ্রয়ের নরম, আদুরে পুতুলটি আবারও একটা নির্বোধ ভুল করে বসল। মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের কুৎসিত খেলায় একরকম অসহ্য হয়েই ধ্রুব নামক মানুষটিকে ফোন লাগাল। ভাইদের ছোট্ট পুতুল! কাদামাটির মতো সরল মন! একটিবারও ঘড়ির কাটার দিকে খেয়াল করল না। এই ভীষণ অসময়ে সম্পর্কহীন, অচেনা পুরুষটিকে ফোন করা যায় না, এই ছোট্ট শাসনটুকু মনের কোথাও হালকা হাওয়ার মতোও উদয় হলো না। ফোনটা রিং হতেই অদ্ভুত এক উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপতে লাগল। অবাধ্য হৃদপিণ্ডটা বুনো টিয়াপাখির মতো খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইল বারবার। বামহাতে ওড়নার কোণাটা চেপে ধরে দরদর করে ঘামতে লাগলাম। গলা শুকিয়ে গেল। ফোনটা বেজে বেজে কেটে যেতেই ডান হাতের পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছলাম। কাঁপা হাতে দ্বিতীয় এবং শেষবারের মতো ডায়াল করলাম৷ কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে ঘুমু ঘুমু ভারী কন্ঠ ভেসে এলো। ভীষণ পরিচিতের মতো বলল,

‘ বলো।’

আমি চমকে উঠলাম। হঠাৎ করেই সব কেমন অগোছালো হয়ে গেল। ভারী জিহ্বা নেড়ে ছোট্ট একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারলাম না। ধ্রুব বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে আমার নীরবতা ভাঙার অপেক্ষা করল। তারপর গভীর শ্বাস ফেলে বলল,

‘ ফোনটা কী রেখে দেব?’

আমি আরও একবার কেঁপে উঠলাম। ধ্রুবর কন্ঠে সংশয়হীন অধিকারবোধের ছটায় কেঁপে উঠল বুক। গোছালো কথাগুলোও অগোছালো হয়ে গেল। ধ্রুবর অপ্রত্যাশিত স্থিরতায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। অসহায়বোধ করলাম। নিচু কন্ঠে বললাম,

‘ আপনার সাথে কথা ছিলো। জরুরি কথা।’

ধ্রুবর ঘুমু ঘুমু আদুরে কন্ঠটায় তখন আলতো গম্ভীর্যের ছটা। বলল,

‘ বলো।’

চুলোর উপর চায়ের পানিটা তখন অবিশ্রাম ফুটছে। গুরুগুরু শব্দটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে নিঃশব্দ, নিঝুম ঘরটাতে। আমি ঠান্ডা পড়ে যাওয়া কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে নাকের ঘাম মুছলাম। শক্ত কন্ঠে বললাম,

‘ ফোনে নয়। সরাসরি বলব। ফোনে বলা যাবে না।’

ধ্রুব গম্ভীর কন্ঠে খানিকটা কৌতুক মিশিয়ে বলল,

‘ কেন? প্রোপোজ ট্রোপোজ করতে চাইছ না তো আবার?’

এই পর্যায়ে এসে জড়তা কেটে গেল আমার। ফুঁস করে জ্বলে উঠে বললাম,

‘ বাজে কথা। আপনাকে প্রোপোজ করতে যাব কেন হঠাৎ? আই টোল্ড ইউ বিফোর, আপনার প্রতি আমার কোনো ইমোশন নেই। নেহাৎ একটা উটকো ঝামেলায় ফেঁসে গিয়েছি নয়তো….’

‘ নয়তো?’

আমি উত্তর দিলাম না। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

‘ আপনি একটু ছাদে আসুন। কথা আছে।’

ধ্রুব যেন হকচকিয়ে গেল। নিজের বিস্ময়টা আড়াল করে বলল,

‘ এখন?’

‘ হ্যাঁ। এখন।’

‘ কয়টা বাজে জানো?’

আমি অভ্যাসবশতই জেদ ধরা কন্ঠে বললাম,

‘ জানি না। আপনি আসুন।’

ধ্রুব ঘুম কাটিয়ে শান্ত, কঠিন কন্ঠে বলল,

‘ পাগলামো করো না নিশু। ঘুমুতে যাও। তোমার জরুরি কথাটা কাল শুনবো। গুড নাইট।’

ফোনের এপাশে নীরব অভিমানে ঠোঁট ফুলালাম আমি। ছেলেবেলা থেকে প্রশ্রয় পেয়ে পেয়ে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়া মনটা খুব ছেলেমানুষি কন্ঠে বলল,

‘ না। এক্ষুনি।’

‘ নিশু!’

ধ্রুবর ভারী, ভয় ধরানো কন্ঠে চুপ করে রইলাম আমি। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল,

‘ কাল কথা হবে।’

আমার হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল। নিছক সিদ্ধান্তহীনতা আর বাচ্চামোই ভর করে নিজেকে কতটা সহজলভ্য করে ফেলেছি বুঝতে পেরেই অনুশোচনায় জ্বলে উঠল বুক। নিজের হেঁয়ালিপনায় রাগ হলো, বিরক্তি এলো। কেন বারবার একই ভুল করি ভাবতে ভাবতেই পুরো পৃথিবীটাকে ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে হলো। ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে হলো নিজেকে। রাগ, অভিমান, অপমান সব মিলিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল শরীর। নিজের ভুলটুকো বুঝতে পারলাম। কিন্তু তারপর? তারপর কী? রেখো দেব? মেনে নেব পরাজয়? কিন্তু এমন রিজেকশনের জ্বালা কী আদৌ সহ্য হবে আমার? ‘না’ শুনতে না পারা মনটা নীরব ক্ষোভ নিয়ে বলল,

‘ উঁহু। এখনি। কাল কথা বলার হলে নিশ্চয় এখন ফোন করতাম না? আপনি আসবেন। এই মুহূর্তে আসবেন। ব্যস!’

ধ্রুব বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে গলায় শব্দ করে হাসল। আমি আমার বাদ বাকি আত্মসম্মানটুকু মুঠোয় নিয়ে হাঁসফাঁস করতে লাগলাম চূড়ান্ত অপমানিত হওয়ার ভয়ে। ধ্রুব যেন আমায় প্রাণ ভিক্ষা দিল। কোনোরকম ফোঁড়ন না কেটে সাধারণ কন্ঠে বলল,

‘ নিশু? তুমি কী বুঝতে পারছ, তুমি আমার সাথে কীভাবে কথা বলছ? ইউ আর বিহিভিং লাইক মাই গার্লফ্রেন্ড। সবার মতো আমিও কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি। তুমি সত্যি সত্যিই আমার প্রেমিকা নও তো?’

ধ্রুবর প্রশ্রয় ভেজা তরল কন্ঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। ঝুপ করে নিজের সত্তায় ফিরে গিয়ে বললাম,

‘ বাজে কথা বলবেন না। আসছেন কী আসছেন না?’

ধ্রুব হাসল। ধীরে ধীরে গাঢ় হলো তার হাসির আওয়াজ। হাসতে হাসতেই বলল,

‘ আমি মানা করলে কী তুমি কেঁদে ফেলবে, নিশু?’

আমি চমকে উঠলাম। মৃদু শাসনের কন্ঠে বললাম,

‘ আপনি!’

ধ্রুব তরল হেসে বলল,

‘ থাক। কান্নাকাটির দরকার নেই। আবিরের হাওয়ায় ভেসে আসা ভাবির জন্য এতটুকু রিস্ক নেওয়া যেতে পারে৷ সিঁড়িতে কোনোরকম আওয়াজ না করে আসো। ধরা খেলে বাঁচার চিন্তা ভুলে যেও। আমার নিজেরও বাঁচার সম্ভবনা নেই। তোমাকে বাঁচাতে পারব না।’

আমি উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলাম। ধ্রুব হাসি হাসি কন্ঠে ডাকল,

‘ নিশু?’

আমি সাড়া দিতেই হো হো করে হেসে উঠে বলল,

‘ কিছু না। আসো।’

আমি ঠোঁট ফুলিয়ে ফোন কাটলাম। ঝোঁকের মাথায় ফোন করে ফেলে যতটা অস্থির হয়েছিলাম। ধ্রুব রাজি হয়ে যাওয়াই আরও বেশি অস্থির হয়ে পড়লাম। ভয়ে, আতঙ্কে হাত-পা কাঁপতে লাগলো। হৃদপিণ্ড ছুটতে লাগলো দ্রুত। চুলোয় বসানো চায়ের পানি শুকিয়ে এসেছে। যেমনটা শুকিয়ে এসেছে আমার কন্ঠস্বর। আমি হাত বাড়িয়ে চুলোটা বন্ধ করে গোটা এক গ্লাস পানি ঢাললাম গলায়। এক চুমুকে সম্পূর্ণটা শেষ করে ঠান্ডা হয়ে আসা অসাঢ় পা নিয়ে ঘুমন্ত প্রিয়তার পাশে এসে বসলাম। দু’বার মৃদু ধাক্কা দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁকি দিলাম ওর গায়ে। প্রিয়তা ধরফর করে উঠে বসল। আমাকে হঠাৎ চিনতে না পেরে চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলো। তারপর আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,

‘ ভূমিকম্প টূমিকম্প হচ্ছে নাকি নিশু? আর্থকুয়াক হলে কুইক করে নেমে যেতে হয়। বসে আছিস কেন? চল, কুইক করে নেমে যাই।’

আমি কাঁদো কাঁদো চোখে চেয়ে ডাকলাম,

‘ প্রিয়?’

প্রিয়তা ফ্যাকাশে মুখে চাইল। আমার কান্না দেখে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,

‘ আমরা কী ভূমিকম্পে চাপা পড়ে মরে গেছি জান? এইটা কী জান্নাত? আমি যে এতো জলদি জান্নাতে এসে পড়ব ভাবতেই পারিনি। আল্লাহ কত দয়ালু! লাভ ইউ আল্লাহ। ইশ! আবেগে ভেতরটা কেমন টলমল করছে।’

প্রিয়তার অযথা কথায় অধৈর্য হয়ে পড়লাম আমি। কটমটে চোখে চাইলাম। ডান বাহুর উপর চটাস করে একটা চড় বসিয়ে বুঝিয়ে দিলাম তার অবস্থান। প্রিয়তা বাহুতে হাত বুলাতে বুলাতে আশেপাশে চাইল। আমি আবারও অসহায় কন্ঠে ডাকলাম,

‘ প্রিয়?’

প্রিয়তা এবার বিরক্ত হলো। অধৈর্য কন্ঠ বলল,

‘ ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছিস কেন?’

আমি ঠোঁট ফুলিয়ে চাইলাম। প্রিয়তা কিছুক্ষণ বিরক্ত চোখে চেয়ে থেকে নরম কন্ঠে শুধাল,

‘ কী হয়েছে জান? পেট ব্যথা করছে?’

আমি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে গোটা কাহিনিটা শুনাতেই বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল তার মুখ। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,

‘ তুই এই মাঝরাতে উনার সাথে দেখা করতে যাবি?’

আমি অসহায় চোখে চাইলাম। আমার অসহায় দৃষ্টি দেখেই ঝুপ করে নরম হয়ে গেল প্রিয়তার দৃষ্টি। আমার থেকেও অসহায় দৃষ্টি মেলে বলল,

‘ মন খারাপ করে না, সোনা। তোর তো কোনো দোষ নেই। আমাদের নিশুর বাপের টাকায় কেনা ফোন। সে যখন ইচ্ছে ফোন করবে। দোষটা তো ওই বেয়াদব ছোকরাটার। এতোরাতে ফোনটা রিসিভ করার কী দরকার ছিলো?’

প্রিয়তার বলার ভঙ্গি আর প্রশ্রয়ে হেসে ফেললাম আমি। আমার ছোট্ট, সুন্দর পৃথিবীতে যে গুটিকতক মানুষগুলো আমার মন খারাপে কেঁদে ভাসিয়ে দিতে পারে। অস্থির হয়ে পড়ে। আমাকে আগলে রাখার জন্য গোটা পৃথিবীর সাথে লড়ে যাওয়ার শক্তি রাখে। সেই মানুষগুলোর মাঝে এই ছোট্ট, সরল মেয়েটির নামটা জ্বলজ্বল করে উঠতেই শান্তিতে ভরে গেল মন। প্রিয়তা ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ চল। বেহুদা বসে থেকে লাভ নেই। ব্যাটাকে একটু মশলা মেরে আসি।’

আমি অবাক হয়ে বললাম,

‘ মানে?’

প্রিয়তা আমার ডান হাতটা টেনে ধরে বলল,

‘ মানে কিছুই না। তোর হয়েও না হওয়া প্রেমের জন্য এতটুকু ডেডিকেশন দেওয়া যেতেই পারে। তোর জন্য পাহাড়াদারও সই। তোদের প্রেমের ঘাটে আমি হবো দক্ষ পাহাড়াদার।’

ঘড়ির কাটাটা যখন সাড়ে চারটা ছুঁইছুঁই ঠিক তখনই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম আমরা। একদম নিঃশব্দ পায়ে, কচ্ছপের গতিতে পেরিয়ে গেলাম পাঁচ তলার সিঁড়ি। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ড নামক টিয়াপাখিটা যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করল। শুকিয়ে আসা কন্ঠনালীটা স্থবির হয়ে গেল নানা আশঙ্কায়। পাঁচ তলার সিঁড়ি পেরিয়ে ছাদের সিঁড়ি পেরুতেই চোখে পড়ল সচেতনভাবে খোলে রাখা দরজা। অনুভব করলাম ‘অপরিচিত হয়েও পরিচিত’ মানুষটির উপস্থিতি। প্রিয়তা আমার ডানহাতটা আলতো চেপে ধরে অভয় দিল। আমি বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে দরজাটা আলতো ধাক্কা দিতেই এক মুঠো ঠান্ডা হাওয়া ছুঁয়ে গেল আমার চোখ-মুখ। বুকের ভেতর অল্পবিস্তর সাহস জড়ো করে অবিচ্ছিন্ন অন্ধকারে পা বাড়ালাম। ধূ ধূ নীরব ছাদের নিস্তব্ধতা যেন চোখের পলকেই গ্রাস করল আমায়। কোথা থেকে ছুটে এলো গম্ভীর, শান্ত স্বর। মৃদু কেঁশে দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করে বলল,

‘ এইযে, এদিকে ম্যাডাম।’

আমি পাশ ফিরে চাইলাম। দক্ষিণের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘদেহী পুরুষটিকে দেখে ক্ষণিকের জন্য কেঁপে উঠলো মন। ধ্রুব আমায় দেখে মৃদু হাসল। হাতের ফোনটা পকেটে গুঁজে বুকের ওপর হাত মুড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালাম। ধ্রুব তার গম্ভীর, শান্ত চোখদুটো মেলে আমার ছোট্ট, কোমল মুখটির দিকে চেয়ে রইলো অপলক। ধ্রুবর এমন দ্বিধাহীন মাদক চাহনিতে এলোমেলো হয়ে গেলাম আমি। চোখদুটো সরিয়ে নিয়ে আড়চোখে চাইলাম। ধ্রুব তখনও অনড়, অবিচল।

‘ বলছো না যে?’

রাতের শেষ প্রহরে, ধূ ধূ নিস্তব্ধ ছাদে হঠাৎ ধ্রুবর কথায় চমকে উঠলাম আমি। অসচেতন কন্ঠে বললাম,

‘ হু?’

অনুসন্ধানী, তীক্ষ্ণ চোখদুটো আমার মুখের উপর মেলে রেখেই উত্তর দিলো ধ্রুব,

‘ যা বলতে ডাকলে। বলো, শুনি।’

আমি আলতো ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। মান্ধাতার আমলের মস্তিষ্কটা সাথে সাথেই ফিডব্যাক দিলো। ভয়াবহ দুঃসংবাদ দেওয়ার মতো জানাল, ডিয়ার নিশু? উই আর এক্সট্রিমলি সরি। মস্তিষ্কে হাইপোথ্যালামাসের নিঃসরণ মাত্রাহীনভাবে বাড়ছে। আমাদের হাতে কিচ্ছু নেই। এই দীর্ঘদেহী মানবটির সামনে শরীরের কোনো সিস্টেমই ঠিক রাখা যাচ্ছে না। তুমি বোধহয় তার প্রেমে পড়ে যাচ্ছ। এই পরম দুঃসংবাদ শুনে থমথমে মুখে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। শক্ত কন্ঠে বললাম,

‘ দেখুন… ‘

ধ্রুব আমায় থামিয়ে দিয়ে মাঝ পথেই বলল,

‘ কী দেখাতে চাও?’

ধ্রুবর কন্ঠে আদ্র কৌতুকের ছোঁয়া পেতেই ক্ষেপে গেল মন। ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললাম,

‘ ফাজলামো করছেন?’

ধ্রুব খুব নির্দোষ কন্ঠে বলল,

‘ ফাজলামো কেন করব? তোমার সাথে কী আমার ফাজলামোর সম্পর্ক? এমন একটা রাতে কী দেখাতে চাও তাই ভেবে চিন্তা হচ্ছিল। একটু পরই তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য উঠে পড়বে সবাই। বাইরে তোমার কাজিনও দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চয়। উল্টাপাল্টা কিছু…’

আমি ধমক দিয়ে বললাম,

‘ একদম চুপ।’

ধ্রুব মিটিমিটি হেসে বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ল,

‘ আচ্ছা।’

ধ্রুবর সেই হাসি দেখে আবারও বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম আমি। অধৈর্য, অসহায় চোখে চেয়ে থেকে একদম মুখস্থের মতো বলে গেলাম,

‘ দেখুন, ভাইয়া।’

ধ্রুব আকাশ থেকে পড়ার মতো অবাক হয়ে বলল,

‘ ভাইয়া ডাকছো কেন?’

আমি চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই গলায় শব্দ করে হাসল ধ্রুব। কোনোরকম নিজের হাসি থামিয়ে বলল,

‘ আচ্ছা, আচ্ছা বলো।’

আমি ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললাম,

‘ আপনার আর আমাকে নিয়ে যে রিউমারটা আগুনের গতিতে ছড়াচ্ছে তাতে আমার কোনো হাত নেই। আমি নিজেই ভুক্তভোগী এবং মহাবিরক্ত। এই শহরটা আমার ভীষণ প্রিয়। এজন্যই এই শহরে থাকা, পড়াশোনা করা। আমি এই শহরটা ছাড়তে চাইছি না। দু’দিন পর আমার এক্সাম অথচ আমি পড়াশোনাটা পর্যন্ত করতে পারছি না। আমার দমবন্ধ লাগছে, ধ্রুব। প্লিজ, আমায় আর দুশ্চিন্তা না দিয়ে একটা সমাধান বের করুন। আই রিকুয়েষ্ট ইউ!’

কথা শেষে চোখ তুলে ধ্রুবর দিকে চাইতেই খেয়াল হলো, কী অবলীলায় পাল্টে গেছে আমার সম্বোধন। আমার থেকে বয়সে এতোবড় একজন মানুষকে নাম ধরে সম্বোধন করেছি ভেবে নিজের মনেই চমকে উঠলাম। ধ্রুব আমার দিকেই চেয়ে আছে। অনুভূতিশূন্য, শক্ত মুখ। কপালের কুঞ্চনে গাম্ভীর্য। ধ্রুব আমার দিকে চেয়ে নিরুপায় হয়ে বলল,

‘ আমার কাছে এই মুহূর্তে কোনো পার্মানেন্ট সমাধান নেই নিশু। সমাধানটা তোমার কাছে। তুমি যতদিন এখানে থাকবে ততদিন এই গুজবের কোনো উপসংহার টানা সম্ভব হবে না। আমি তোমাকে ফোর্স করছি না। কিন্তু তোমার উচিত বাসাটা ছেড়ে দেওয়া। “আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড” বলে একটা কথা আছে। তুমি তাদের চোখের আড়াল হলেই ধীরে ধীরে সব ভুলে যাবে ওরা। নয়তো প্রতিনিয়ত তারা আমাদের খেয়াল করবে। আগ্রহ জন্মাবে। নতুন নতুন কথা উঠবে।’

আমি মাথা নোয়ালাম। ধ্রুবর মুখে আমার বাসা ছেড়ে দেওয়ার কথাটা শুনে কেমন এক মন খারাপে থম ধরে গেল বুক। তার অবলীলায় ছোঁড়া প্রতিটি বাক্যই নির্মমভাবে বুঝিয়ে দিল, আমার প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। আমি তার কাছে অনুভূতিহীন সমস্যা মাত্র! এমন উদ্ভট চিন্তায় নিজের মনেই চমকে উঠলাম আমি। মনকে এই প্রথম ভয়াবহভাবে শাসালাম। ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বললাম,

‘ বেশ! আমি বাসাটা ছেড়ে দেব।’

ধ্রুবর অপলক দৃষ্টিটা এবার একটু কাঁপল। মৃদু হেসে বলল,

‘ আমাদের একে অপরের সাথে আর কখনো কথা না বলাই শ্রেয়। অল দ্য বেস্ট, নিশিতা।’

ধ্রুবর মুখে আমার পুরো নাম শুনে টলমলে আবেগে ভরে গেল মন। পরমুহূর্তেই বোবা অভিমানে ঝুম হয়ে বললাম,

‘ থেংকিউ। ইউ ট্যুউ।’

ধ্রুব মাদক হাসল। কাছের এক মসজিদ থেকে আরও একটি নতুন দিনের আহ্বান আর এই অদ্ভুত সম্পর্কের বেদনাদায়ক সমাপ্তির ঘোষণা ভেসে আসতেই নড়ে উঠলাম দু’জনে। ঠোঁটের কোণে অহেতুক হাসি টানলাম। ধ্রুব নরম কন্ঠে বলল,

‘ তুমি নেমে যাও। আমি কিছুক্ষণ থাকব।’

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। ধ্রুব ঠোঁট টেনে হাসলো। আমি প্রিয়তাকে নিয়ে ঘরে ফিরে এসেই বিছানায় গা এলালাম৷ কম্বলে মুখ ঢাকতেই প্রচন্ড মন খারাপে ছেয়ে গেল মন। ধ্রুবর প্রতি রাগ হলো। জেদ হলো। কেন সে এতো নির্লিপ্ত আচরণ করলো? কতো অবলীলায় জানিয়ে দিলো তার সাথে কথা না বলার আদেশ। ধ্রুবর নির্লিপ্ততায় বুকের ভেতর শুরু হলো অপ্রত্যাশিত রক্তক্ষরণ। ধ্বংসাত্মক এক ঝড়। প্রিয়তা আমায় একটি কথাও জিজ্ঞেস করল না। কম্বলের নিচে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ ইট’স ওকে, জান।’

প্রিয় মানুষের প্রশ্রয়ে হঠাৎ কেমন ফুপিয়ে কেঁদে উঠল মন। কেন কাঁদলাম? কীসের দাবীতে এই চোখের জল? তা নিয়ে একবিন্দুও ভাবতে ইচ্ছে হলো না। প্রিয়তার উষ্ণ শরীরের ওমে ফিসফিসিয়ে বললাম,

‘ আই হেইট হিম, প্রিয়। আই হেইট হিম।’

প্রিয়তা হাসল। আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,

‘ আই নো, জান। ইউ শুড হেইট হিম। আই হেইট হিম অলসো।’

আমি আর প্রিয়তা চুপটি করে দিনের সবচেয়ে সুন্দর আহ্বান শুনলাম। পুব আকাশে ছড়িয়ে পড়া লাল আলোয় পাখিদের আনন্দ দেখলাম। হাজারখানেক দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ভীষণ অকারণে, ভীষণ অকারণ এক মানুষের জন্য অকারণ কাঁদলাম। ঘরে বাজার বলতে কিচ্ছু নেই। ছোট ভাইয়ার করে রাখা বাজার শেষ হয়েছে আজ দুদিন হলো। জমিলা আপা রান্না করতে এলেই চেঁচামেচি করবে ভেবেই ঝটপট উঠে পড়ল প্রিয়তা। আমাকে টেনেটুনে উঠে বসালো। অলস মন নিয়ে জীবনের প্রথমবার কাঁচা বাজারে যাব বলে তৈরি হলাম। আর তখনই অদ্ভুত এক কান্ড ঘটল। বাজারের ব্যাগ হাত বেরিয়ে পাঁচ তলার সিঁড়িতে পা রেখে জুতোর বেল্ট লাগাতে গিয়েই খেয়াল করলাম তিন জোড়া পা পথ না পেয়ে থমকে গেল আমার থেকে হাত খানেক দূরে। আমি ধীরে ধীরে চোখ তুলে চাইলাম।

# চলবে…..

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here