#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_১৫
দীর্ঘ ৯ঘন্টা ৩০মিনিট আকাশ পথে উড়ার পর বাংলাদেশের বুকে পা রাখলো সিমি, শেহেরজাদ। ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর পর সিমি চারপাশ তাকালো।
কত বছর পর নিজের দেশে এসেছে। কত বছর সবার থেকে দূরে ছিল..না জানি বাবা মা কেমন আছে? চোখে পানি টলমল করতে থাকে সিমির। শেহেরজাদ পাশে এসে দা। এক হাতে জড়িয়ে ধরে। শেহেরজাদের স্পর্শ পেয়ে সিমি ফিরে তাকালো। শেহেরজাদ মুচকি হাসলো,
–যাওয়া যাক!!
–হুম!
আজকে তারা হোটেলে থাকবে। কাল সকাল হতেই চট্টগ্রামের উদ্দেশ্য রওনা দিবে। সিমিকে রুমে রেখে বাহিরে গেল শেহেরজাদ। ক্লান্তি ছোটাতে সিমি গোসল করে নিল। গোসল করে বেরিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে আয়নার দিকে তাকাতেই দেখল শেহেরজাদ এসেছে। দরজা বন্ধ করে শেহেরজাদ ছুটে এসে সিমিকে জড়িয়ে ধরে। সিমির ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে দেয়। সিমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ার আগেই শেহেরজাদ কে বাধা দেয়।
— ককি করছেনননন?
— চুল গুলো কি ঠান্ডা!
–ভেজা তো তাই!
সিমির কথা শেষ হতেই এক টানে শেহেরজাদ সিমিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। সিমির দুহাত নিজের এক হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে নেয়। হাত পেছনে থাকায় সিমির মৃদু ব্যাথা অনুভব হলো। তারপরও কিছু বলল না সিমি। শেহেরজাদ হাত ধরে পেছনে টান দিতেই সিমি আরো সামনে চলে আসে। সিমির চেহারা ব্যাথাতুর ভাব স্পষ্ট। শেহেরজাদ অন্য হাত সিমির ঘাড়ে রাখে।
— টেল মি ওয়ান থিং?
— ববলুনন!!
— আমরা খুব শীগ্রই ফিরে যাবো। যাবো তো? শেহেরজাদের চোখ লাল হয়ে আছে। মুখে মৃদু হাসি। ভয়ংকর এই চেহারার সম্মুখীন এখনই হতে চাইছে না সিমি। কাপাস্বরে বলল,
–হহ্যা যাবোহ্!!
শেহেরজাদ সিমির পেছনে ধরে রাখা দুই হাত ছেড়ে দিল। হাত ছেড়ে দিতেই সিমি শেহেরজাদের বুকে লুটিয়ে পড়ে। ব্যাথায় প্রাণ যাই যাই অবস্থা হচ্ছিল। শেহেরজাদ সিমিকে ঘুরিয়ে পেছন দিক দিয়ে জড়িয়ে ধরে। আয়নায় দেখিয়ে বলে,
— আমার অনেক গুলো শখের জিনিসের মধ্যে একটা তুমি। মনে থাকবে?
–হ্যাঁবোধক মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো সিমি।
চোখ বন্ধ করে সিমির ঘাড়ে থুতনি ঠেকালো শেহেরজাদ। আয়নায় শেহেরজাদের চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল সিমি।
ছাদের রেলিংয়ে বসে আছে সামরান। এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ভেতরটা জ্বলছে। মায়ের কথা শোনার পর থেকে কিছুতেই শান্ত সামরান হতে পারছে না। কিভাবে বলবে মা কে সে অন্য কাউকে চায়।
–আমি কিভাবে অন্য কাউকে বিয়ে করবো? আমার দ্বারা এটা কিছুতেই হবে না। কিন্তু মা? একটি বড় নিঃশ্বাস টেনে নিল সামরান। যা হওয়ার হবে। অলকানন্দার আগে কিছু না। বলেই রেলিং থেকে ঝাপ দিল সামরান। নিচে পড়ে হাতের কুনুই কেটে গেল সামরানের। কাটা জায়গার দিকে তাকিয়ে হাসলো সামরান।
ছাদে বসে আছে মায়া। পাশেই রাহাদ। মায়া কেঁদেই চলেছে। সে বিয়ে করবে না। বিয়ের কথা শুনে রাহাদের অন্তঃকরণ বিষিয়ে উঠল। যাকে এত বছর ধরে ভালোবেসে এসেছে তাকে কি সে পাবে না। এইভাবে অন্যের হয়ে যাবে তার প্রিয়তমা? মায়ার কান্না দেখে একটু কাছে ঘেঁষে বসল রাহাদ।
— তুমি কেন কাদঁছো?
— আমি বিয়ে করবো না রাহাদ। আমি ওদের ছাড়া থাকতে পারবো না। ওরা কেউ কেন বুঝতে চাইছে না আমার কথা।
— আমি কি একবার কথা বলবো মায়া?
— না রাহাদ। দরকার নেই।
রাহাদ উঠে মায়ার সামনে হাটু ভাজ করে বসে। মায়ার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোই ধরে বলে,
–মায়া!!আমি কখনো বলতে পারিনি। আমি তোমাকে ভালবাসি মায়া। তুমি আমার থেকে দূরে সরে যাবে এই ভয়ে আমি এই কথা চেপে রেখেছি। কিন্তু আজ আর হয়ে উঠছে না। তুমি অন্য কারো হবে এটা দেখার পর যে কষ্ট হবে তার থেকেও বেশি কষ্ট তখন হবে যখন দেখব আমার এত দিনের স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে।
–কিসের স্বপ্ন?
–তোমাকে নিয়ে ঘর করার স্বপ্ন। আমার সাথে চলে আসো মায়া।
— না রাহাদ। আমি আপুর মত একই ভুল কখনো করবো না। আমি চাই না আম্মু আব্বু কষ্ট পাক। ওদের হাসি মুখের আগে আমার কাছে কিছু না। আমার খুশিও না। আর এসো না রাহাদ। চলে যাও। তুমি আমার খুব ভালো একজন বন্ধু। এর বেশি কিছুই না। চলে যাও রাহাদ।
মায়ার কথা শুনে রাহাদ উঠে দাড়ালো।
–যাচ্ছি মায়া। যদি কখনো মনে হয় আমাকে তোমার দরকার তাহলে একবার ডাকবে। আমি হাজির হয়ে যাবো। বলেই রাহার চলে গেল। রাহাদ চলে যেতেই মায়া নিচে বসে পড়ে। দুহাতে হাটু জড়িয়ে ধরে কাদঁতে থাকে। মায়ার কান্না শোনার জন্য কেউ কেন নেই? কেন কেউ দেখতে পাচ্ছে না অন্তঃকরণের রক্তক্ষরণ। কিভাবে থামাবে মায়া এই রক্তক্ষরণ।
গাড়ির হর্ণ এর শব্দ শুনে মায়া উঠে দাড়ালো। গাছের সাথে একটি গাড়ির ধাক্কা লেগেছে। মায়া ছুটে নিচে গেল৷ গাড়ির ড্রাইভিং সিটের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। গাড়ির দরজা খুলতেই সামরান কে দেখে মায়া পিছিয়ে যায়
–স্যার আপনি?
সামরানের হাতে রক্ত। হয়তো এক্সিডেন্টেই এমন হয়েছে। রক্ত দেখে মায়ার ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠলো।
— স্যার আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি আসছি। মায়া যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। সামরান মায়ার হাত ধরে নিল। হাতে টান পড়তেই মায়া পেছনে ফিরে তাকালো।
— যাবেন না।
–কিন্তু স্যার আপনার অনেকটা আঘাত লেগেছে।
–আমার গাড়িতে ফার্স্টএইড বক্স আছে। আপনি একটু হেল্প করুন।
–আচ্ছা বলেই মায়া ভেতরে আসতে চাইলে সামরান বাধা দিল। সামরান বেরিয়ে পেছনের সিটে বসে পড়ে। মায়াও ভেতরে উঠে বসে। তুলো তে স্যাভলন লাগিয়ে সামরানের হাতে কাটা যায়গায় চেপে ধরলো মায়া। সামরান মৃদু আর্তনাদ করে উঠল।
-লেগেছে না!আমি এত জোরে দিতে চাইনি। একটু জ্বালা করবেই। একটু সহ্য করুন। মায়া ফু দিতে থাকে। আস্তে আস্তে কাটা যায়গা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেয়। ব্যান্ডেজ লাগিয়ে সরিয়ে আসতে নিলেই সামরান মায়ার হাত ধরে নেয়।
–চলে যাবেন?
–এইভাবে এখানে থাকলে কেউ যদি দেখে সমস্যা হবে।আপনি আমার বাসায় চলুন। পারবেন আসতে?
–বাসায় কেউ দেখলে সমস্যা হবে না?
— আমার রুমে সকালের আগে কেউ আসবে না। আপনি আসুন। তবে হ্যা ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই চলে যাবেন কেমন?
— সামরান হাসলো।
আস্তে আস্তে পা টিপে অতি সাবধানে সামরান কে নিজের রুমে নিয়ে আসে মায়া। সামরান কে বেডে বসিয়ে মায়া পানি আনতে গেল। সামরান পুরো রুমটা দেখতে থাকে। ছোট্ট একটা রুমে হরেক রকমের কাগজের প্রজাপতি। আরো নানান রকমের হাতের বানানো জিনিসে ভর্তি। হয়তো মায়া নিজেই বানিয়েছে। সামরান উঠে আস্তে আস্তে পড়ার টেবিলের পাশে এসে দাড়ালো। একটি খয়েরী কভার এর ডায়েরি দেখে সামরান হাসলো। ডায়েরি টি হাতে তুলে নিতেই ভেতর থেকে একটা কাগজ পড়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে একটু ঝুকে কাগজটা তুলে নিল সামরান। কাগজে একজন মানুষের অর্ধস্কেচ। চোখ পর্যন্ত আকা হয়েছে। সামরান ভ্রু কুঁচকে তাকালো। স্কেচ হাতে নিয়ে পেছনে ফিরতেই ড্রেসিং টেবিল দেখে সামরান ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
এক হাতে স্কেচ আর দৃষ্টি আয়নার দিকে। একবার স্কেচ এর চোখ জোড়া আর একবার নিজের চোখ জোড়া দেখতে থাকে সামনার। মুখের হাসি প্রশস্ত হলো সামরানের।
মায়া রুমে প্রবেশ করতেই দেখলো সামরান আয়নার সামনে। সামরানের হাতে থাকা স্কেচ দেখে মায়ার অন্তরআত্মা কেঁপে উঠলো। আল্লাহ জানে কি ভাবলো?
সামরান মায়ার দিকে ফিরে তাকালো,
— এটা কি?
— সস্যার আসসলে আপনি যা ভাবছেননন তা ননা।
–তাহলে কি?
–আ….মায়া কিছু বলার আগেই দরজায় করাঘাত পড়ে। দরজার ওপাশ থেকে আমীরের শব্দ শুনে মায়া সামরানের দিকে তাকালো।
–আব্বুউউ!!
–এখন? কে যেন বলেছিল কেউ আসে না?
— এটা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার সময় না। ওটা আপনি পরেও দিতে পারবেন আপাতত লুকান।
–এখানে এমন কোনো জায়গা নেই। আশে পাশে তাকিয়ে বলে সামরান।
মায়া লুকানোর জায়গা খুঁজতে থাকে। হঠাৎ বাথরুমের কথা মনে পড়ে। সামরান কে বাথরুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় মায়া।
আমীর রুমে ঢুকে দেখলো মায়ার চোখ মুখ ফুলে আছে। এগিয়ে এসে মায়ার পাশে বসলো।
— আর কত কাদঁবি?
–……….,(চুপ মায়া)
— আমার মেয়েটা দেখতে দেখতে এর বড় হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি। তোর বিয়েতে না আমি অনেক আনন্দ করবো। আমার এক মাত্র মেয়ের বিয়ে। মায়াকে চুপ করে থাকতে দেখে আমীর উঠে দাড়ালো।
— ঘুমিয়ে পর রাত অনেক হয়েছে। বলেই আমীর চলে গেল। মায়া ফ্লোরে বসে পরে। হঠাৎ সামরানের কথা মনে পড়লো। বাথরুমের দরজা খুলে দিল মায়া।
বিয়ের কথা শুনে সামরান ওয়াশরুমের দরজায় মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বেরিয়ে এসে মায়ার সামনে দাড়ালো,
— আপনার বিয়ে সামনে?
–হুম। আজকেই জেনেছি।
— আপনি রাজি না?
— আমি এখনই বিয়ে করতে চাই না!
মায়ার চোখে পানি।
— কেন? কি কারণে?
— আমি পড়তে চাই। আমি এখনই বিয়ে করতে চাই না।
— এটাই কারণ?
–হুম।
— পাত্রপক্ষ যদি জানে বিয়ে আগে এমন এক রুমে,একটা পুরুষের সাথে রাত কাটিয়েছেন বিয়ে কিন্তু ভেস্তে দেবে।
–মায়া চমকে সামরানের দিকে তাকালো। আমি চাই না আমার ছোট আব্বুর সম্মানে আঘাত লাগুক।
— দু নৌকায় পা দিয়ে চলা যায় না।
— আমি এক নৌকা বেছে নিয়েছি আর সেটা হলো বিয়ের।
সামরানের হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এল। কিছু না বলে মায়ার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। দুহাত মাথার নিচে দিয়ে বলল,
— আপনি চাইলে পাশেই শুয়ে পড়তে পারেন আমার আপত্তি নেই।
মায়া একটু পিছিয়ে যায়।
–না আমি এখানে ঠিক আছি। আপনি ঘুমান।
— লাইট অফ করে দিন। এমন আলোতে আমার ঘুম আসবে না।
–কিন্তুউ!
–কিন্তু কি? মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে সামরান।
— আমি অন্ধকারে ভয় পাই। নতজানু হয়ে বলল মায়া।
— আই লাইক ইট। মজা করছিলাম। লাইট থাকুক আমারও অন্ধকারে ভালো লাগে না। বলেই চোখ বন্ধ করে নিল সামরান।
মায়া সামরানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
চলবে…….