প্রেমের খেয়া পর্ব ৩২+৩৩

#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_৩২

তৃতীয় বারের মত মেয়রের আসনে আবারো বিপুলসংখ্যক পরিমাণের ভোট পেয়ে জয়লাভ করলেন সামাদ মালিক।
পুরো শহরে তার নামের জয়ধ্বনি হতে থাকে। পুরো শহর যেন এটাই চেয়েছিলো সামাদ মালিকই জিতুক। আর তিনি জিতেছেন ও। জনগণের জন্য কম কিছু করেন নি। জনগণ কে কোনো নেতা এত ভালোবাসে তা সামাদ মালিক কে না দেখলে বোঝা যাবে না। সমস্ত নিউজ চ্যানেল গুলো আজ সামাদ মালিকের দখলে। সব নিউজের মুখ্য বিষয় যেন সামাদ মালিকের জয়। হাতে থাকা ওয়াইনের গ্লাস বড় টিভির স্ক্রিনে সজোরে ছুড়ে মারেন আফফান মালিক। সামাদ মালিকের ছোট ভাই। নিজের ভাইয়ের জয় সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। শত চেষ্টা চালিয়েও তার জয় আটকাতে পারলো না। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো আফফান মালিক। সেন্টার টেবিলে লাথি দিতেই টেবিল ছিটকে দূরে পড়ে যায়। পুরো বাড়ির পরিবেশ স্তব্ধ হয়ে গেছে। আশে পাশে থাকা সার্ভেন্টরাও ভয়ে মাথা নিচু করে আছে। নিচে ভাঙচুরের শব্দ শুনে ইবাদ নিচে নেমে আসে। ড্রয়িংরুমের এলোমেলো অবস্থা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবার সামনে গিয়ে দাড়াঁলো ইবাদ,

–কি হয়েছে? এমন কেন করছো?

–তো কি করবো?আমার চোখের সামনে ও বার বার জিতে যাবে এটা আমি হতে দিবো?

–হতেই তো দিচ্ছো!

–কখনো না। অনেক হয়েছে। সামাদ মালিক এটা ভুলে গেছে যে, আফফান মালিক শরীরেও মালিক বংশের রক্ত বইছে। দুমড়ে মুচড়ে সব শেষ করে দেব আমি। আমিও দেখি এই জয়ধ্বনি কত দিন থাকে। সামাদ মালিকের সম্মান যদি ধুলোয় না মিশিয়েছি আমার নাম ও আফফান মালিক না।

— ভালো,এখন চলো তোমাকে কিছু দেখানোর আছে।

–কি? ভ্রু কুঁচকে তাকালেন আফফান মালিক।

–আগে চলো তো..

–চল।

মালিক হাউজে খুশির ঢল নেমেছে। আমীর মির্জা আর শেহনাজ ও এসেছে। বাড়িতে একটি পার্টি রেখেছেন সামাদ মালিক। সেখানে অনেক বড় বড় মান্যগণ্য ব্যাক্তিরা আসবে। বাড়ি ডেকোরেশন এর জন্য সকাল বেলায় লোক এসেছে। সামরাম আর শেহেরজাদ আজ অফিস যায়নি। বাড়িতে থেকেই দুইভাই কাজে সাহায্য করছে। বাড়ির বাহিরের দিকটা সাজানো হচ্ছে। সামরান আর শেহেরজাদ দুজনেই দেখিয়ে দিচ্ছে। সামাদ মালিক বেরিয়ে আসেন।
দুই ছেলেকে এক দেখে তিনি অনেক খুশি। শুধু আক্ষেপ একটাই সামরান এখনো সামাদ মালিককে বাবা বলে ডাকে না। একদিকে দাঁড়িয়ে ছেলেদের কার্জকলাপ পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি। শেহেরজাদের দুষ্টু দুষ্টু কথায় সামরান মাঝে মাঝে হেসে উঠছে। সামাদ মালিক দূর থেকে ছেলের হাসি দেখে নিজেও হাসছেন। ছেলেটার মুখে অনেকদিন তিনি হাসি দেখেন নি। সব আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে আসছে। দেখতে দেখতে সামরানের বিয়ের ছয়টা মাস পেরিয়ে গেল। এই ছয়মাসে একদিনে সামরানের এক রকম পরিবর্তন হয়েছে। সামরানের হাসির আওয়াজ শুনে ছাদে বসে থাকা সিমি আর মায়া রেলিংয়ের কাছে চলে আসে। সামাদ মালিক কে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মায়ার একটুও ভালো লাগলো না। সামরানের দিকে তাকাতেই দেখলো সামরান হাসছে। অথচ তার একটু দূরেই যে নিজের বাবা দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে খেয়াল নেই। মায়া মন খারাপ করে চলে আসতে নিলেই হঠাৎ থেমে গেল। ছাদের হাফ দেওয়ালে অনেক অনেক ফুলের টব রয়েছে। বিশাল ফুলের টব গুলোর দিকে তাকিয়ে মায়া একবার নিচের দিকে তাকালো। তারপর ফুলের টবের দিকে এগিয়ে গেল। মায়া কি করছে সিমি কিছুই বুঝতে পারেনি প্রথমে পরে বোধগম্য হতেই ছুটে মায়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো

–মায়া কি করবি তুই?

–আপু একবার রিস্ক নিয়েই নিই। কাঁপছে মায়ার কন্ঠস্বর।

–মায়া,এটা করিস না। হিতে-বিপরীত হলে? সিমির চোখ মুখে আতংক।

–দেখা যাক। আজ যা হওয়ার হবে। বলেই মায়া ৩টা ফুলের টব ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। ঠিক নিচেই দাঁড়িয়ে আছেন সামাদ মালিক। ফুলের টব ফেলে দিতেই সিমি চিৎকার করে ওঠে,

–মায়া!

উপর থেকে সিমির চিৎকার শুনে সামরান উপরে তাকালো। ফুলের টব পড়তে দেখে সামরানের মাথা নষ্ট হয়ে গেল,নিচেই যে তার বাবা দাঁড়িয়ে আছে। মুহুর্তের মাঝেই ঝড়ের গতিতে শেহেরজাদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো,

–বাবা সরে যাওও,

সামাদ মালিক সামরানের কন্ঠ শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। কি বলে ডাকলো সামরান? মায়া আরো কয়েকটা ফুলের টব ফেলে দিলো। কারণ প্রথমের টব গুলো অন্য পাশে পড়েছে। এইবারের টা ঠিক সামাদ মালিকের মাথা বরাবরই। ছুটে এসে সামাদ মালিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো সামরান। ফুলের টব থেকে কিছুটা বালি সামরানের চোখে পড়লো। সামাদ মালিক ছুটে এসে সামরানের চোখে ফু দিতে থাকে। পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে আলতো ভাবে মুছে দিতে দিতে ব্যস্ত সুরে বলে,

–ঠিক আছো তুমি? দেখি চোখে বালি পড়েছে হয়তো। শেহেরজাদ পানি এনে দিলে নিজের হাতে সামাদ মালিক সামরানের চোখে পানির ছিটিয়ে দেয়। চোখ খুলতেই সামরান কন্ঠে অস্থিরতা নিয়ে বলে,

–বাবা ঠিক আছো তুমি? কোথাও লেগেছে?

সামাদ মালিক এক দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছেলের চেহারার অস্থিরতার ছাপ আজ কেন জানিনা সামাদ মালিকের অনেক ভালো লাগছে। সামরান আবারাও বাবা বলতে গিয়ে থেমে গেল। এতক্ষণ নিজের বাবাকে বাবা বলে ডেকেছিলো এটা ভাবতেই সামরান বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে গেল। সামাদ মালিক হালকা হাসলেন। সামাদ মালিকের হাসি দেখে সামরান রুষ্ট সুরে বলল,

–হাসছো কেন তুমি? বাচ্চা তুমি? দেখে শুনে চলতে পারো না। নেক্সট টাইম নিজের খেয়াল নিজে রাখবে। কথাটা বলে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ভেতরে চলে গেল সামরান। সামাদ মালিক হাসলেন।

সিমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মায়ার দিকে,

–হ্যাঁ রে, তুই কিভাবে জানতি এটা কাজে দিবে?

–এটাই তো টেকনিক আপু। তুই বুঝবি না। আমি যাই স্বামীর সেবা কর আসি। বলেই মায়া চোখ টিপ মেরে হেসে চলে গেল। সিমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে গরম ভাপ দিতে থাকে সামরান। মায়া দরজায় দাঁড়িয়ে দরজায় টোকা দিলো,

— আসবো?

–হুম!

ভেতরে গিয়ে সামরান কে নিজের দিকে ফিরিয়ে হাতে থাকা রুমাল সামরানের চোখে চেপে ধরলো। সামরানের চোখ লাল হয়ে এসেছে।

–আসুন বসবেন।

সামরান কে বিছানায় বসিয়ে সামনে বসে পড়ে মায়া। সামরানের চোখে ভাপ দিতে থাকে। সামরান চোখ একবার বন্ধ করছে, আর একবার খুলছে। চোখ বন্ধ করে রাখায় সামরান কে দেখতে অনেক মায়াবী লাগছিলো। মায়া একটু এগিয়ে চোখের পাতায় চুমু দিলো। সামরান চটজলদি চোখ খুলে নিলো।

—আপনি…

–বাবাকে কেন বাবা বলে ডাকেন না?

–আজ ডেকেছি তো..

–বাবার খারাপ লাগে,আজ থেকে বাবাকে বাবা বলে ডাকবেন।

—আদেশ কাকে করছেন?

–আপনাকে। বলেই মায়া উঠে গিয়ে সামনে পা বাড়াতেই হাতে টান পড়ে। সামরান উঠে পেছন থেকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে। মায়া মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে বলে,

–আমি চলে গেলে কিভাবে থাকবেন?

–কষ্ট হবে অনেক।

–চলুন আমার সাথে।

–আপনার পড়া হবে না।

— কষ্ট যে হবে,সে বেলায়?

–আপনার জন্য এইটুকু করতেই পারি।

মায়া হাসলো।

—অনেক দেরী আছে। এক্সামের পর যাচ্ছি এখনই যাচ্ছি না।

–হ্যাঁ আমার কলিজে ছিঁড়ে নিয়ে যাবেন।

–এই একদম না। আপনি আমাকে পাঠাচ্ছেন আমি যেতে চাই নি।

–আমি ছায়ার মত আপনার পাশে থাকবো। চিন্তা করবেন না।

–জানি তো। সামরান মায়াকে সামনে ঘুরিয়ে নেয়। দুহাত মায়ার কোমরে রাখে। মাথা কাত করে মায়ার গালে চুমু দিলো। মায়া চোখ বন্ধ করে বলল,

–সবসময় সুযোগ বুঝে এসব করা কিন্তু ভালো না।

–আমার বউ।

–হ্যাঁ সেটাই তো বিপদ। সামরান ভ্রু কুঁচকে নিলে। মায়া হেসে উঠে।

সন্ধ্যায় সারা বাড়ি ঝলমল করছে। পুরো বাড়ি অসম্ভব সুন্দর ভাবে সাজিয়েছে। সামরান আর শেহেরজাদ অনেকক্ষণ আগেই নিচে চলে এসেছে। সামাদ মালিক এখনো আসেনি। সামাদ মালিক নেমে আসতেই সামরান গিয়ে সামনে দাঁড়ায়,

–কংগ্রেচুলেশন

–থ্যাংক ইউ। সামাদ মালিক সামনে এগিয়ে যেতেই সামরান ডাক দিলো,

—বাবা?
থমকে দাঁড়ালো সামাদ মালিক। পেছনে ফিরে সামরানের দিকে তাকালো। সামরান ইশারায় পাশে দেখাতেই দেখলো বিশাল স্ক্রিনে ভাসছে তাদের ফ্যামিলি ফটো। একের পর এক ছবি ভেসে উঠছে। সামাদ মালিক হাসি মুখে হাত বাড়িঁয়ে দিতেই সামরান এসে জড়িয়ে ধরলো। ছেলেকে জড়িয়ে নিয়ে সামাদ মালিক অন্যরকম এক প্রশান্তি অনুভব করলেন।

হঠাৎ বাড়ির দরজায় পুলিশ এসে দাঁড়ায়,
—মি. মালিক

সামরান কে সরিয়ে পেছনে তাকাতেই পুলিশ কে দেখে ভ্রু কুঁচকে নিলেন সামাদ মালিক।

–ইয়েস।

পুলিশ ইশারা দিতেই চারজন কন্সটেবল স্ট্রেচার এনে রাখে। স্ট্রেচারে কারো বডি রাখা। সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছে। উপস্থিতি সবাই ভ্রু কুঁচকে নিলো। সামাদ মালিক এগিয়ে এলেন,

–এটা কি অফিসার?

–স্যার লাশের গায়ে লিখে দেওয়া নাম্বার আপনার নাম্বার ছিলো।

–হোয়াটটট? সামরান এগিয়ে এলো।

–কার লাশ এটা?

–আপনারাই দেখুন।

পুলিশের কথায় শেহেরজাদ এগিয়ে এসে লাশের মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে দেয়। অন্যরকম একটা গন্ধে সবাই নাকে কাপড় চেপে ধরে। শেহেরজাদ গন্ধের কারণে দু কদম পিছিয়ে যায়। সামরান লাশের চেহারা দেখে পিছিয়ে গেল। মায়ার ভেতর‍টা মোচড় দিয়ে উঠলো।

–উনি তো…কথা শেষ করার আগেই ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো মায়া। লাশ ছেড়ে সামরান মায়ার কাছে ছুটে গেল।
#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_৩৩

লাশ কেউই শনাক্ত করতে পারলো না। যার কারণে পুলিশ লাশ নিয়ে চলে গেল। সামরান সেই যে মায়ার কাছে বসেছে এখনো উঠে নি। মেয়েটা ভয় পেয়ে তখন যে সেন্স হারালো আর কোনো খবর নেই। ভয় পেয়েই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে মায়া। ডাক্তারের সাথে সাথে সবাই রুম খালি করে দিয়ে বেরিয়ে যায়। সামরান পাশে গিয়ে বসে পড়ে। মায়ার পারিপাট্য মুখশ্রীতে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। বিন্দু বিন্দু ঘামের দেখা পেতেই সামরান এসি বাড়িয়ে দিল। বারান্দার দরজা খুলে দিলো। রুম অন্ধকার করে দিয়ে মায়ার পাশে গিয়ে বসে পড়ে। বাহির থেকে আলো এসে মায়ার মুখে পড়েছে। আবছা আলোয় রুম আলোকিত হয়ে আছে। মায়ার জ্ঞান ফিরে ধীরে ধীরে। মায়ার ঠোঁট নড়তে দেখে সামরান সোজা হয়ে বসলো।

–অলকান্দনা! শুনছেন আমার কথা?

–হুঁ! চোখ বন্ধ রেখেই মায়া অস্ফুটস্বরে জবাব দিলো

— ঠিক আছেন?

ধীর গতিতে চোখ মেলে তাকালো মায়া। সামরান কে দেখে মৃদু হাসলো। পরক্ষণেই লাশের কথা মনে পড়তেই ধপ করে উঠে বসে পড়লো মায়া। সামরান ভড়কে গেল।

–ক-কি হলো? ঠিক আছেন?

–লাশ টা..

সামরান মায়াকে জড়িয়ে ধরে।

–বাদ দিন। এসবে না জড়ানোই ভালো। মুখ খুললে হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। যেতে দিন।

সামরানের কথা শুনে মায়া সামরানের কাধে মাথা রেখে দিলো।

–মানুষ এতোটা নিষ্ঠুর কেন হয়?

–মানুষের জন্মই হয় নৃশংসতা দেখানোর জন্য।

মায়া সামরানের কাছ থেকে সরে আসে। এক হাতে সামরানের গাল স্পর্শ করে,

–কই আমার স্বামী তো এমন না।

সামরান মায়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর বলল,

— সবাই এক না। চোখে দেখা জিনিস সবসময় সত্যি নাও হতে পারে।

–চোখের দেখাও ভুল হয়। কিন্তু আমার দেখা এই আপনি তো ভুল না,তাহলে? সামরান মায়াকে জড়িয়ে ধরে কাধে চুমু দিলো।

–বাদ দিন না। (আমি কোনোদিন এটা বলতে পারবো না যে আমি সেই নিষ্ঠুর মানুষদের মধ্যে একজন,মাফ করবেন আমায়। আমি আপনাকে হারাতে চাই না।)

পার্টি তে যা হলো তার পর সামাদ মালিকের চিন্তা বেড়ে গেল। এসব কে করছে? কেন করছে? থানার ওসির সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে সামাদ মালিক। শহরের নিরাপত্তা বাড়িয়ে দিতে হবে। আর একটা খুন ও হতে দেওয়া যাবে না।

দেখতে দেখতে আরো ৪মাস কেটে গেল। পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলো। মায়ার পরিক্ষার কারণে এত দিন সামরান মায়ার আশেপাশেই ছিল। পাশে থেকে মায়াকে হেল্প করেছে পড়াতে। মায়ার এক্সাম শেষ, রেজাল্ট ও ভালো এসেছে। সামনেই ফাইনাল পরিক্ষা। মায়া ফাইনাল পরিক্ষার প্রস্তুতি নিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সামরান মায়াকে সারাদিন পড়াতেই ব্যস্ত রাখছে। মায়ার ব্যস্ততাই যেন সামরানের একমাত্র লক্ষ্য। সামরানের সামনেই বসে আছে আফজাল মুনির আর রাহাদ। সামরান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো এতক্ষণ, নিরবতা ভেঙে বলে উঠল,

–আমার বাড়িতে সেদিন সেই লাশ কে পাঠিয়েছে?

রাহাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো।

–আমরা না স্যার। আমরা কেন খামোখা এসব করবো।

–না করলে ভালো। করলে কিন্তু ফলাফল ভালো হবে না। তন্দ্রার খুন কে করলো আমি জানি না। যে করেই হোক খোঁজ নাও কে এর পেছনে জড়িত।

–স্যার সব হবে। আজকে সাপ্লাই যাবে একটু চেক করে নিবেন? আফজাল মুনিরের কথা শুনে সামরান উঠে দাঁড়ালো। যেতে গিয়েও থমকে গেল,

–নাহ আপনি চেক করে নিন। আমি আসছি। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সামরান বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো হঠাৎ ফোনের রিং বেজে উঠলো। রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে এক কন্ঠ,

–মি. মালিক কেমন আছেন?

–কে আপনি?

–আমি কে এটা আপাতত না জানলেও চলবে। আপনি আপাতত নিজের প্রাণ বাঁচান। আপনার ওয়াইফের কাছে সেই ভিডিও সেন্ড করা হয়েছে আপনার হাতে সময় আছ্র মাত্র দশ মিনিট। কাম অন মি. মালিক। আপনার ওয়াইফ যদি একবার ভিডিও টা ওপেন করে কি হবে জানেন? জাস্ট ইমাজিন। বলেই হেসে দিলো লোকটি।

সামরানের চোখ মুখের রঙ বদলে গেল মুহুর্তেই। এতক্ষণে চিনতে ব্যাতিক্রম হলো না কে ফোন করেছে। এর আগেও এই লোক অনেকবার ফোন করেছে। এই লোকের কারণেই সামরান নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই অন্ধকার জগতে রয়ে গেল। এর আগেও এই লোক মায়ার কাছে ভিডিও পাঠিয়ে সামরান কে জানিয়েছে। প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে সামরান মায়াকে আটকায়। প্রতিবার সামরান সফল হয়ে এসেছে। কিন্তু এইবার? কি করবে এইবার? সামরান কিছুই বুঝতে পারছে না। কান থেকে ফোন সরিয়ে দৌড় দিলো সামরান। গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিলো। হাতে সময় খুব কম। মায়া যদি একবার ভিডিও ওপেন করে তাহলে এতদিনের বলা মিথ্যে, এত দিনের সাজানো সবকিছুই নষ্ট হয়ে যাবে। হাজার হাজার মিথ্যে দিয়ে নিজের সত্যি আড়াল করে রেখেছে সামরান। তীরে এসে তরী ডোবাতে চায় না সামরান।

মায়া ফোন হাতে নিতেই কলিংবেলের আওয়াজ ভেসে আসে। ফোন রেখে দিয়ে দরজা খুলতে গেল মায়া। দরজা খুলতেই ক্লান্ত সামরান কে দেখে চমকে উঠলো মায়া।

–একি আপনি? ঠিক আছেন? কি হয়েছে।

–কিচ্ছু না আপনি ঠিক আছেন?

–হ্যাঁ আমি ঠিক আছি আমার কি হবে?

সামরান ঝাপটে জড়িয়ে ধরে মায়াকে। এই মানুষ টাকে সে হারাতে চায় না। কিভাবে থাকবে এই মানুষ কে ছেড়ে? দূরে যাওয়ার কথা ভাবতেই কলিজা মোচড় দিলো সামরানের।

সময় আপন গতিতে বয়ে চলেছে। দেখতে দেখতে মায়া আর সামরানের বিয়ের দুই বছর পূর্ণ হয়ে গেল। মায়া উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে। সিমি ৩মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মালিক হাউজে যেন খুশির ঢল নেমেছে। সামাদ মালিক মেয়র এর পদ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আসনে জয় লাভ করেছেন। সব কিছু দেখতে দেখতেই বদলে গেল। মায়ার আর সামরানের ভালোবাসার গভীরতা যেন আরো বেড়ে গেল।

রাত ৯টা বাজছে। সামরান বাসায় ফিরেছে। মেইন দরজা খোলা দেখে খানিকটা অবাক হলো। পুরো বাড়ি অন্ধকার। বাড়িতে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিলো সামরান। কয়েকবার সেলিনা মালিককে ডাকলো। কারো সাড়া শব্দ পেলো না সামরান। সিড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেল। রুমে প্রবেশ করতেই দেখলো পুরো রুমে অলকানন্দা ফুলে সাজানো। রুমের সাজসজ্জা দেখে সামরানের বাসর রাতের কথা মনে পড়ে গেল। হালকা হেসে এগিয়ে গিয়ে ফুল স্পর্শ করলো সামরান।

–এই ঘ্রাণে আমার মন ভরবে না। আমার অলকানন্দা কোথায়?

–এইযে আমি। মায়ার আওয়াজ শুনে পেছনে ফিরে তাকালো সামরান। লাল শাড়ি পরিহিত মায়াকে দেখে সামরান অধর কোণে বাকা হাসি হেসে এগিয়ে এলো।

–কি ব্যাপার?

মায়া সামরান কে জড়িয়ে ধরে বলল,

–হ্যাপি এনিভার্সারি।

–ওয়াও,আমি ভুলেই গেছিলাম।

–ভোলারই কথা। পুরনো হয়ে গেছি কি না।

সামরান মায়াকে কোমর ধরে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।

–কে বলেছে পুরনো হয়ে গেছেন?

–আমি, নাহলে মনে থাকতো।

–কে বলেছে মনে নেই?

–আপনি!

–পকেট থেকে একটি চেইন বক্স বের করলো সামরান। বক্স খুলতেই ভেতরে একটি গোল্ডের চেইন,চেইনের মাঝখানে বড় অক্ষরের S দেওয়া। চেইন দেখে মায়া বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে গেল।

–মনে ছিলো আপনার?

–থাকবে না কেন?
মায়াকে আর কিছু বলতে না দিয়ে হাত ধরে পেছনে ফেরালো সামরান। পিঠের উপর থেকে চুল সরিয়ে দিলো। চুল সরাতেই ফর্সা পিঠ সামরানের চোখ পড়লো। পিঠের উপর থাকা কালো বড় তিলটার উপর সামরান গভীর চুম্বনে ভরিয়ে দিলো। মায়া চোখ বন্ধ করে শ্বাস বন্ধ করে নিলো। ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে নিলো। সামরান চেইনটি মায়ার গলায় পড়িয়ে দিলো। তারপর মায়াকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পাশে শুয়ে পড়লো,

— এই দিনে আমার জীবনে আমি এমন একজন কে পেয়েছি যার জন্য পুরো দুনিয়াকে আমি কোরবান করে দিতে পারবো। সেই দিনটাকে কি করে ভুলে যাই? একটা জিনিস চাইবো দিবেন?

–বলুন।

–প্রাণ ভরে আমার অলকানন্দার ঘ্রাণ নিতে চাই। দিয়ে দিন!

এমন আকুল কন্ঠের ব্যাকুল সুর শুনে মায়া লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল। দুহাতে সামরানের গলা জড়িয়ে মিশে গেল সামরানের সাথে। সামরান এক হাতে আঁচল সরিয়ে দিলো। গলায় ওষ্ঠাধর চেপে ধরলো। এক হাত এগিয়ে মায়ার হাতের আঙুলের ভাজে ঢুকিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলো। গলা থেকে সরে এসে মায়ার গালে ওষ্ঠাধর ছোঁয়ালো সামরান। মায়া পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো। পরিক্ষার কারণে এত দিন দুজন এক ঘরে থেকেও অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। আজ আর এমন হবে না। আজ সব বাধ ভেঙে দুজনেই একে অপরের মাঝে মিশে যাবে। ভালোবাসার ছোঁয়ায় ভরিয়ে দেবে একে অপরকে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ুক ভালোবাসার উষ্ণ পরশ।

আজ মায়া চলে যাবে লন্ডনে। ব্যারিস্টারি কমপ্লিট করে তবেই ফিরবে। সামরানের অনেক ইচ্ছে মায়া ব্যারিস্টারের আসনে বসবে। সামরানের ইচ্ছের মর্যাদা দিতে গিয়েই নিজের ভালোবাসার মানুষদের ছেড়ে সূদুর অজানায় পাড়ি জমাবে মায়া। এয়ারপোর্টে সবাই এসেছে মায়ার সাথে। সবার কাছ থেকে মায়া বিদায় নিয়ে সামরানের সামনে আসতেই কান্নায় ভেঙে পড়লো,

–একদম কাদঁবেন না। আমার কিন্তু মত বদলে যাবে।

–বদলে যাক। আমি যেতে চাইনা। আমি পড়তে চাইনা ব্যারিস্টারি, আমাকে দূরে সরিয়ে দেবেন না প্লিজ।

সামরান দুহাতে মায়ার গাল স্পর্শ করে। কপালে চুমু দিয়ে বলে,

— অনেক দেরী হয়ে গেছে। আপনাকে যেতেই হবে। যেতেই হবে। নিজের স্বপ্ন আপনাকে পূরণ করতেই হবে। আপনি ফিরে আসুন আমি ততদিনে আপনার জন্য একটি সারপ্রাইজ গিফটের এরেঞ্জ করি।

–আমার কিচ্ছু চাই না।

–আমার চাই। আমার অলকানন্দার নাম। আমার অলকানন্দার নাম নিতেই সবাই কাঁপবে। আমি চাই।

মায়া সামরানকে জড়িয়ে ধরলো। সামরান নিজেকে শক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নাহলে যে হবে না। পারবে না মায়াকে যেতে দিতে। নিজের মনে পাথর চাপা দিয়ে নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে যাচ্ছে সামরান।

মায়া সরে আসে।

–আসছি। ভালো থাকবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন

–চিন্তা করবেন না। আপনার রেখে যাওয়া সমস্ত জিনিস আমি অনেক যত্নে আগলে রাখবো।

–আসছি। মায়া ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সামরান হাত ধরে নেয়। মায়া পেছনে ফিরে তাকালো,

–ফিরবেন তো?

–খুব শীগ্রই!

সামরান হাত টান দিয়ে মায়াকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো।

–আল্লাহ হাফেজ।

ভালোবাসার মানুষদের রেখে নিজের স্বপ্ন পুরণের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালো মায়া। সামরানের বুকের ভেতর খরা পড়েছে। মায়া না ফেরা পর্যন্ত যা রোধ হবে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। এই আকাশ পথেই আছে তার অলকানন্দা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়িতে গিয়ে বসে সামরান।
আসমানের দিকে একবার তাকালো,

–এইবার শুরু হবে আসল খেলা। আপনার অবধি কেউ পৌঁছাতে পারবে না। সেই সাধ্য কারো হবেই না। সবাইকে যদি জিবন্ত দাফন না করেছি আমার নাম ও সামরান মালিক না। চোখে সানগ্লাস পরে নেয় সামরান। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিলো।

চলবে??

( আসে জনগণস?🙄)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here