প্রেমের খেয়া পর্ব ৩৪

#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_৩৪

রুমের দরজা খুলে যেতেই মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে থাকা মেয়েরা আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালো। একটা রুমে অনেকগুলো মেয়ে। সবার হাত পায়ে শক্ত বাধন। পরনের কাপড়ের অবস্থাও খুব একটা ভালো না। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল দেহের মানুষটিকে দেখে মেয়েগুলো চোখ বন্ধ করে নিলো। কারণ তারা জানে এখন কি হবে। এতদিন যা হয়ে এসেছে তাই হয়তো হবে। কিছু কিছু মেয়েরা ভয়ে পিছিয়ে গেল। মেয়েদের এমন অবস্থা দেখে সামরানের নিজেকে কিছুক্ষণের জন্য পশু মনে হলো। এই পৈশাচিক কাজের সাথে নিজেও জড়িত আছে ভাবতেই সামরানের নিজেকে চরম পাপী মনে হলো। মেয়েদের গালে আচড় কামড়ের অসংখ্য দাগ। সামরান মেয়েদের সামনে কোনোদিন আসেনি। যত মেয়েদেরই সাপ্লাই হয়েছে কেউ সামরান কে দেখেনি। কিন্তু বাকিরা যে মেয়েদের সাথে এমন নারকীয় আচরণ করে তা সামরানের বুঝতে বাকি রইলো না। মেয়েদের ঘৃণা করতে করতে যে সামরান এত নিচে নেমে যাবে তা সে বুঝতেই পারলো না। ধীর পায়ে মেয়েদের দিকে এগিয়ে গিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো।

–আমি আপনাদের ক্ষতি করতে আসিনি। আমায় ভুল বুঝবেন না। আমি আপনাদের ভালো করতে এসেছি। নিয়ে যেতে এসেছি আপনাদের। যাবেন আমার সাথে? আমি আপনাদের সবাইকে যার যার পরিবারের কাছে পৌঁছে দেব। যাবেন?

মেয়েরা সামরানের দিকে তাকিয়ে রইলো। কথা বলার শক্তি তাদের নেই। সবার চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। আর অসহায় দৃষ্টিতে সামরানের দিকে তাকিয়ে আছে। সামরান বুঝতে পারলো। লম্বা শ্বাস টেনে বলল,

–উঠে দাঁড়ানোর শক্তি আছে। পারবেন উঠে দাঁড়াতে? আমি সাহায্য করবো। সামরানের কথায় মেয়েরা নড়ে-চড়ে উঠলো.. সামরান মাথা নিচু করে হাসলো। চোখে তার পানি টলমল করছে। আস্তে আস্তে মেয়েদের হাত পায়ের বাধন খুলে দিলো৷ মেয়েরা উঠে দাঁড়াতে চাইলো। কয়েকজন মেয়ে অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালো। সামরান তাদের নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। বিশাল মাইক্রোবাস নিয়ে এসেছে সামরান। ওদের গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে ভেতরে গেল। ৪জন মেয়ে একেবারেই উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখে না। সামরান তাদের সামনে গিয়ে বসে পড়লো।

–মাফ করবেন। আর কোনো উপায় নেই। বলেই একটি মেয়েকে কোলে তুলে নিলো। এইভাবে পরপর চারটি মেয়েকেই গাড়িতে তুলে দিয়ে ড্রাইভার কে বলল,

–এদের হাসপাতাল নিয়ে যাবে ঠিক আছে? হাসপাতালে আমার লোক আছে। বাকিটা তারা দেখে নেবে। একটা কথা মাথায় রাখবে,গাড়ি এখান থেকে স্টার্ট দিলে সেই গাড়ি শুধু হাসপাতালের সামনেই থামবে। এর ব্যাতিক্রম যদি হয়েছে তোমার রুহের মায়া ছেড়ে দিও। ড্রাইভার মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।

–ফাস্ট!! ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলো। সামরান কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বাড়িটির দিকে তাকালো।

আফজাল মুনির এসেই রাহাদ কে কষিয়ে চড় বসিয়ে দিলো।

–স্টুপিড! কোনো ধারণা আছে তোমার ওখানে কত টাকার মাল ছিলো। কোন আক্কেলে তুমি বাড়ি খালি রেখে বের হলে। এখন আমি ক্লাইন্ট কে কি জবাব দেব। স্যার জানলে কি বলবে? তোমার মত মানুষ এর কাছ থেকে এটা আশা করিনি আমি।

রাহাদ রেগে গেল। আফজাল মুনিরের কলার চেপে ধরলো।

–তোর সাহস কি করে আমার গায়ে হাত তোলার। আমি তোর গোলাম না। মেয়েগুলো পালানোর মত অবস্থায়ই ছিলো না। যারা উঠে দাঁড়ানোর শক্তি রাখেনা তারা পালিয়ে যাবে ইম্পসিবল।

–ইউ আর রাইট। যারা উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখে না তারা একা একা পালিয়ে যাবে এটা অবিশ্বাস্য।

সামরানের কথা শুনে পেছনে ফিরে তাকালো সবাই। সামরান কে দেখে আফজাল মুনির থরথর করে কাঁপতে থাকে।

–স–স্যার!

–ওয়েট! আমি বলছি। বলেই চেয়ার টেনে চেয়ারে বসে পড়লো সামরান। রাহাদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামরানের দিকে। সামরান রাহাদের দিকে তাকিয়ে হাসলো।

–ওই রুমে একজন ওয়েট করছে তাকে এদিকে নিয়ে আসুন। সামরান বলার সাথে সাথে রাহাদ ভেতরের রুমে প্রবেশ করতেই দেখলো ফাইজা। ফাইজা কে দেখে রাহাদ চমকে উঠলো। হাত পা বাধা অবস্থায় পড়ে আছে।
হাত পায়ের বাধন খুলে দিতেই ফাইজা উঠে দাঁড়ালো।
ফাইজা বেরিয়ে এসে সামরানের সামনে দাঁড়ালো।

–আপনি বুদ্ধিমান আশা করি বুঝেছেন।

সামরানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে রাহাদ বুঝতে পারলো।

–আপনি মেয়েদের পালাতে সাহায্য করেছেন?

–হ্যাঁ করেছি। আপত্তি আছে?

–স্যার আপনি? বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে গেল আফজাল মুনির।

সামরান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ফাইজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো,

–কি চেয়েছিলে? আমার সব নষ্ট করে দিবে? আমার অলকানন্দা কে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবে? আমি তা হতে দিবো? এটা ভাবলে কি করে যে আমি সব ছেড়ে দিলেও ওই মেয়েটাকেও ছেড়ে দেব? যার মাঝে আমি আমার শান্তি খুঁজে পেয়েছি তাকে ছেড়ে দেব? যাকে দেখার পর থেকে আমি নিজেকে ভালোবাসতে শিখেছি তাকে ছেড়ে দেব? এটা হয়?

–আমার একটা ভুলের জন্য তুমি আমায় এইভাবে দূরে সরিয়ে দিতে পারো না। সামরান আমাকে নিজের করে নাও বিশ্বাস করো আমি কোনো অভিযোগের সুযোগ তোমার দেব না। মায়া তো এখন নেই। আমাকে সুযোগ দাও। সামরানের অনেক কাছে এসে বলে ফাইজা। সামরান ফাইজা কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।

–বেঁচে থাকলে তবেই তো। আজ এই মুহুর্তে আমি সব শেষ করে দেব। এই রাজ্য আমি গড়েছিলাম এই রাজ্য ও আজ আমি ধ্বংস করে দেব নিজের হাতে। সামরান কথা শেষ করতেই অনেক গুলো লোক এসে দাঁড়ায়। এরাই ক্লাইন্ট। আজকে সাপ্লাইয়ের লাস্ট ডেট ছিল। একটু আগে বলা সামরানের একটা কথাও কেউ বুঝতে পারলো না। ক্লাইন্ট কে দেখে সামরান হাসি মুখে পেছনে ফিরে তাকালো। দরজা খোলার শব্দে সবাই চমকে তাকালো। কয়েকজন গার্ড এসে সবাইকে বেধে ফেলে। ক্লাইন্টদেরও বেধে তাদের সাথে দাঁড় করিয়ে দিলো। তারপর সামরান ইশারা দিতেই গার্ডরা চলে গেল। ডান পকেট থেকে একটি রিমোট বের করে সামরান। রিমোটের দিকে তাকিয়ে সামরান হাসলো।

–আজ সব শেষ। সব!

–স্যার এমন করবেন না। প্লিজ অনুরোধ করছি। আমাদের এত বড় শাস্তি দিবেন না।

–এতদিন অনেক সুযোগ ছিলো।।কিন্তু হলো কি? সামরানের শান্ত চাহনি।

–সামরান তুমি আমাকে কিসের শাস্তি দিচ্ছো? ভয়ার্ত কন্ঠে বলল ফাইজা।

সামরান হাসলো।

–স্যার আপনি ভুলে যাচ্ছেন এই কাজের সমান ভাগীদার আপনিও।

সামরান মুখ তুলে তাকালো।

–আসলেই আমিও সমান ভাগীদার। আমার শাস্তি তো আমার বিচারক দেবে। আমার ব্যারিস্টার। আমার ফাসি মঞ্জুর করবে। আমি তার অপেক্ষায় আছি। গুড বাই। পিছিয়ে যেতে যেতে বেরিয়ে যায় সামরান। ভেতর থেকে সবার চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসে।

সামরান রিমোটের বাটনে ক্লিক করতেই ব্লাস্টের বিকট শব্দ হয়। দাউদাউ করে জ্বলছে সামরানের চোখের সামনে আগুন। সামরান রিমোটটা আগুনে ফেলে দিয়ে একটি বড় শ্বাস টেনে নিলো।

কানে থাকা ফোন সজোরেছুড়ে মারে অজ্ঞাত ব্যাক্তি।

–সব এভাবেই শেষ হতে পারে না। এখনো গেম বাকি। তুমি যদি ভেবে থাকো খেলা শেষ তাহলে তো হলোই না। তোমাকে এই জগতে আমি আটকে এমনি এমনি রাখিনি। আমার কাজেই রেখেছি। আমার কাজ শেষ হয়নি তো? তাহল? সব এত তাড়াতাড়ি শেষ হবে না, আমি হতেই দেব না। সামরান মালিক ফাসির দড়িতে ঝুলবে,আর তার জন্য যদি সামাদ মালিককে মরতে হয় তাই হবে। ছেলের জন্য এইটুকু কি সে করতে পারবে না। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।

৬বছর পর.…..

লন্ডনে এখন শীতকাল। চারদিকে কুয়াশায় ছেয়ে আছে। ফ্লোরেন্সা গরম কফির মগ হাতে নিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই দেখলো এদিক ওদিক ছুটছে মায়া। লাগেজ গোছাচ্ছে।
ফ্লোরেন্সা ট্রে রেখে নিজের কফির মগ হাতে তুলে নিলো।

–মায়া এদিক ওদিক ছুটছিস যে?

–আরে ফ্লোরা আর বলিস না। আমার আজকে ফ্লাইট আর আমি এখনো প্যাকিং করিনি। লাগেজে কাপড় রাখতে রাখতে বলে মায়া

–সেকি আমার তো প্যাকিং সেই কবে শেষ। আমি জানতাম তুই এমনই করবি। তুই এদিকে আয় বোস আমি তোকে গুছিয়ে দিচ্ছি। মায়াকে টেনে সোফায় বসিয়ে দিলো ফ্লোরেন্সা। আলমারি থেকে কাপড় নিতে গিয়ে একটি ফাইল চোখে পড়লো ফ্লোরেন্সার।

–এটা কি রে মায়া?

–সুপ্রিম কোর্ট থেকে হাইকোর্ট বিভাগে একটি কেসের জন্য নিয়োজিত করেছে তারই পেপারস। কফির মগে চুমুক দিয়ে বলে মায়া।

–কিহ্? তুই কি বাড়িতে যাবি না। চোখ বড় বড় করে বলে ফ্লোরেন্সা

–আরে যাবো তো। তবে আমি যে যাচ্ছি এটা কাউকে জানাইনি। আমিতো বিগত এক মাস ধরে বাড়িতে কথাই বলি না। সবাইকে সারপ্রাইজ দেব এই আশায়। আগে গিয়ে কোর্ট জয়েন করবো তার পর বাড়ি যাবো।

–এত কিছু কবে করে ফেললি তুই? আমি কিছুই জানতাম না।

–আস্তে আস্তে করেছি। সময় লেগেছে।

–এক মাস ধরে যে কথা হয় না খারাপ লাগে না?
মায়া কফির মগে চুমুক দিতে গিয়েই থেমে গেল। উঠে গিয়ে সামরানের ছবির ফ্রেম হাতে তুলে নেয়,

— ৬টা বছর দূরে আছি এতে কষ্ট কি কম হয়েছে?

–উনি সত্যিই লাকি রে। তোদের ভালোবাসা দেখলে ইচ্ছে করে মরে যেতে।

–মরে যা। বলেই খিলখিলিয়ে হেসে দেয় মায়া।

–ধুর! শোন এইবার গেলে কিন্তু বেইবি নিয়ে নিবি।

–আগে যেতে তো দে।

–মায়া?

–হুম।

–কেন জানি না মনে হচ্ছে বাংলাদেশে গেলে তুই বিপদে পড়বি।

–তা তো পড়বোই। না জানি আমার শ্যাম পুরুষ কতটা মায়াবী হয়েছে। ওনাকে দেখতে দেখতে আমি কত বিপদে পড়েছি হিসেবের বাহিরে। কতবার তরকারি কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলেছি। আমাকে বিপদে ওনার গায়ের রঙই ফেলায়।

–আচ্ছা বুঝলাম। প্যাকিং শেষ এখন?

–এখন আর কি বেরিয়ে পর। ফ্লাইটের জন্য দেরী হয়ে যাচ্ছে চল চল। ফ্লোরেন্সা কে নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে মায়া

চলবে??

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here