#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_১৬
মায়া সোফাতে নিজেকে গুটিয়ে শুয়ে পড়ে। অনেক্ষণ কাদাঁর ফলে মায়া খুব তাড়াতাড়িই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। সামরানের ঘুম আসছে না। এই আলোতে সামরান শেষ কবে ঘুমিয়েছে মনেও নেই। সেখানে আজ আলোতে ঘুমানোর চিন্তা করা মানেই বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই না। এপাশ ওপাশ করতে থাকে ছেলেটা। ঘুম কিছুতেই আসছে না। হাতের ব্যাথাটাও বেড়েছে। ব্যান্ডেজের জায়গায় হাত বুলিয়ে হাসল সামরান। ভাগ্যিস ঝাপ দিয়েছিল নাহলে মায়ার এত আদর যত্ন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হত। বিছানা ছেড়ে উঠে বসে পড়ে সামরান। বালিশ পেছনে লম্বা করে দাড় করিয়ে হেলান দিয়ে বসে। এক দৃষ্টিতে ঘুমন্ত মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে সামরান। চোখে পাতা ফুলে গেছে। এই গরমেও মায়া নিজের গায়ে একটি বিশাল কাথাঁ মুড়িয়ে নিয়েছে। এর লজিক সামরান বুঝলো না। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে আছে। কপাল,ঠোঁটের উপরে,থুতনিতে বিন্দু বিন্দু ঘামেরা নিজেদের আসর পেতেছে। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেল সামরান। মায়ার সামনে গিয়ে বসে পড়ে। পকেট থেকে রুমাল বের করে মায়ার ঘাম মোছার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল মায়ার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। রুমাল কে শক্ত করে চেপে ধরলো সামরান। উঠে দাঁড়িয়ে যায়। দু কদম পিছিয়ে যায়,
— বিয়ে তো আপনার হবেই। আপনি যেহেতু বিয়েই বেছে নিয়েছেন বিয়ে হবে। হোক আপত্তি কি? শুধু…… হাসল সামরান। পিছিয়ে যেতে যেতে বিছানা অবধি গিয়ে বসে পড়ে।
–আপাতত আমার ঘুমানো উচিৎ। প্রচুর ঘুম আসছে। এই ঘরে ঘুমানোর সুবর্ণ সুযোগ আমি মিস করতে চাই না। বলেই আশে পাশে কি যেন খুঁজতে থাকে। মায়ার একটি স্কার্ফ দেখে হাসলো সামরান। হাত বাড়িয়ে স্কার্ফটা নিল। শুয়ে স্কার্ফটা মুখের উপর দিলো। যাতে আলো চোখে না পড়ে। তারপর সামরান নিজের ঘুমিয়ে গেল।
ভোরের আলো ফুটেছে। রাতের অন্ধকারের অবসান ঘটিয়ে প্রভাতিকরণের আবির্ভাব ঘটেছে ধরণীর বুকে।
সূর্যের সোনালি বর্ণের কিরণ কাঁচের জানলা ভেদ করে মায়ার মুখে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে গেল মায়ার। চোখ জোড়া ফুলে গেছে। ব্যাথাও করছে। কোনো মতে চোখ খুলে নিজেকে সোফায় দেখে খানিক অবাক হলো। তারপর বিছানায় চোখ পড়তেই দেখলো একজন পুরুষ মানুষ শুয়ে আছে। এক লাফে উঠে বসে পড়ে মায়া।
–আমমার রুমে এএটা কে? আমারই বিছানায় কিভাবে এল? হায় আল্লাহ!! হঠাৎ মনে পড়ে কাল রাতে সামরানের কথা। জিহ্বা কামড়ে কপাল চাপড়াল মায়া। উঠে দাঁড়িয়ে যায়। ধীর পায়ে সামরানের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সামরানের মুখে স্কার্ফ দেখে মায়ার ভ্রু কুঁচকে এল।
— এ কেমন ঘুম? আমার স্কার্ফ কেন পেঁচিয়ে রাখলো।
মায়া হাত বাড়িয়ে স্কার্ফটা নিয়ে নিল। আলো সামরানের মুখে পড়তেই সামরান একহাতে মুখ ঢেকে নেয়। ঘুম ঘুম কন্ঠে একরাশ বিরক্তি প্রকাশ করলো সামরান।
— মা ঘুমাতে দাও না। কেন এমন করছো?
–আয়হায় রে উনি ভাবছে আমি ওনার মা। আমি আপনাকে চাইলেও ঘুমাতে দিতে পারবো না স্যার কেউ দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। বিড়বিড় করে কথা গুলো শেষ করে সামরানের মাথায় হাত রাখলো মায়া।
–স্যার!স্যার! সকাল হয়ে গেছে আপনাকে যেতে হবে।উঠুন না। স্যার!!!!
মায়ার কন্ঠ শুনে সামরান চোখ মেলে তাকালো। মায়াকে দেখে হাসি মুখে শোয়া থেকে উঠে বসল
— গুড মর্নিং।
–গুড মর্নিং। আপনার যেতে হবে।
সামরান ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিল,
–তাড়িয়ে দিচ্ছেন কেন? চা কফি কিছু তো অফার করুন।
মায়ার মুখ অটোমেটিক হা হয়ে গেল। দৃষ্টি ভরা আতংক নিয়ে আশে পাশে তাকালো,
–দেখুন এটা কিন্তু মেহমানদারী করার সময় একদম না। কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে প্লিজ যান।
সামরান উঠে দাড়াল,
— আজ তাড়িয়ে দিচ্ছেন। একদিন নিজেই সবার সামনে এই রুমে নিয়ে আসবেন।
— আপনি আসুন। মায়ার চোখে পানি টলমল করছে। সামরান যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। আবার এক পা পিছিয়ে মায়ার সামনে এসে কানের কাছে গিয়ে বলে,
— আমার রাতে ঘুমটা বেশ ভালো হয়েছে। দিনটাও অনেক ভালো কাটবে। ধন্যবাদ আপনাকে আমার রাত দিন দুটোই এত মধুর করে দেওয়ার জন্য।
মায়া সামরানের মুখের দিকে তাকালো। সামরান হেসে ব্যালকনি দিয়ে বেরিয়ে যায়।
মায়া এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এই মানুষটাকে মায়ার এত ভালো কেন লাগে? কথা বার্তায় মায়া বার বার জড়িয়ে যায়। বিছানায় তাকাতেই দেখলো রক্তের দাগ।
–ইশশশ!!আমি তো হাতের কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলেই গেছি। এমন কেন আমি? নিজের গালে নিজেই চড় বসালো মায়া।
সকালে উঠে সামরান কে পেল না সেলিনা মালিক। থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছেন সোফায়। সামরান কে ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে যান সেলিনা মালিক।
–কোথায় ছিলে সারারাত?
— বাহিরে..
–ফ্রেশ হয়ে এসো কথা আছে।
–আমারও আছে।
–কি?
— যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছ। আমি তাকে দেখতে চাই।
–বিয়ের দিন দেখো। বলেই সেলিনা মালিক যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন।
–আমি বিয়ের আগেই দেখবো। নাহলে আমি বিয়ে করবো না।
— কি বললে?পেছন ফিরে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন সেলিনা মালিক
— হ্যা। দ্বিতীয়বার একই ভুল আমি করতে চাই না। আর আশা করি তুমিও করবে না।
–ঠিক আছে ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি তোমাদের মিট করার ব্যবস্থা করছি।
–হুম। বলেই সামরান চলে গেল।
_______________
কলিংবেল বাজতেই দরজা খুলে দিল সেলিনা মালিক। কাউকে না দেখে দ্বীর্ঘশ্বাস নিয়ে পেছনে ফিরে দাড়ালো।হঠাৎ একটি কন্ঠস্বর শুনে থমকে দাড়ালো সেলিনা মালিক।
–মা!!
কন্ঠস্বরটি কর্ণকুহরে পৌছাতেই সেলিনা মালিক এক মুহুর্ত ও দেরী করলেন না। পেছনে ফিরে তাকালেন। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে শেহেরজাদ। শেহেরজাদকে দেখে সেলিনা মালিক দুহাতে মুখ চেপে ধরল।
–শেহের!
— কেমন আছো?
সেলিনা মালিকের ঠোঁট কাপঁছে। গলা ধরে আসছে। তিনি যেন ভুলেই গেছে কিভাবে কথা বলতে হয়।
–কেমন আছো বলবে না?
–ভেতরে আয়!
শেহেরজাদ পুরো বাড়ি একবার দেখে নিল। তারপর ভেতরে পা রাখার আগে সিমিকে নিজের পাশে এনে দাড় করালো। সিমিকে দেখে সেলিনা মালিক হেসে দিলেন।
–সিমি!
দুজনেই ভেতরে প্রবেশ করলো। দুজনকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো সেলিনা মালিক। শেহেরজাদ সেলিনা মালিককে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। ৪বছর পর আজ মায়ের স্পর্শ পেয়ে শেহেরজাদ যেন পাগল হয়ে গেছে।
আফজাল মুনির গম্ভীর মুখ নিয়ে বসে আছেন।
–আমি ব্যর্থ হয়ে গেলাম। ওর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ভেবেছিলাম ভালোবাসার নাম করে ওকে আমি নিয়ে আসবো। কিন্তু সেটা হয়ে উঠলো না। চোখের সামনেই লক্ষ লক্ষ টাকা হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
— আহহ!রাহাদ অস্থির হবে না। আমরা সবাই তো চেষ্টা করেছি এবার বাকিটা স্যার কে বলা উচিৎ। আমি স্যার কে বলবো। আর স্যার যদি একবার এই ব্যাপারটাতে আসেন তাহলে পৃথিবীর কোনো শক্তি তাকে সেভ রাখতে পারবে না।
–কিন্তু স্যার কি দেখবেন এই ব্যাপারটা। না মানে যাকে কোনো দিন কেউ দেখলোই না সে কিভাবে কি? আজ অবধি আমিই দেখলাম না। সোফায় হেলান দিয়ে বসে বলে রাহাদ।
–আমিও দেখিনি। শুধু ভয়েস শুনেছি। উনি নিজে না চাইলে ওনাকে কেউ দেখবেনা। যাইহোক আমি স্যার কে বলে দেখি।
–হুম দেখুন।
শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে সিড়ি দিয়ে নামছে সামরান।
— মা তাড়াতাড়ি খেতে দাও..
সামরানের কন্ঠ শুনে শেহেরজাদ পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে গেল। সেলিনা মালিক ইশারায় সিমিকে ভেতরে যেতে বলেন। সিমি ভেতরে চলে যায়। সেলিনা মালিক আড়াল হয়ে যায়।
ড্রয়িংরুমে এসে সামরান অচেনা এক লোককে দেখে অবাক হলো। হাতে ঘড়ি লাগিয়ে দুহাত প্যান্ট এর পকেটে রাখে,
–এক্সকিউজ মি? কে আপনি?
শেহেরজাদ ধীর পায়ে সামনে ফিরলো। শেহেরজাদকে দেখে সামরান দুপা পিছিয়ে গেল। এ কাকে দেখছে সে? চোখেরই সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে একটা সময় সে সামরানের প্রাণ ছিল। তারই ছোট ভাই শেহেরজাদ মালিক। মাত্র ১৫মিনিটের বড় ছোট। হ্যা সামরান আর শেহেরজাদ জমজ। সামরান শ্যামবর্ণ আর শেহেরজাদ ফর্সা রঙের অধিকারী। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামরান। অস্ফুটস্বরে বলে উঠে,
–ভাইইই!!
শেহেরজাদ মুহুর্তেই হেসে দেয়। সামরান কে জড়িয়ে ধরে। সামরান নিজেও জড়িয়ে ধরতে হাত তুলে কিন্তু হঠাৎ কিছু মনে পড়াই সামরানের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। শেহেরজাদ কে আর জড়িয়ে ধরলো না সামরান। শেহেরজাদকে নিজের থেকে সরিয়ে দূরে সরে আসে সামরান। কঠোর কন্ঠে বলে,
–এক্সকিউজ মি!
— ভাই!
–আমার কোনো ভাই নেই। ছিলো তবে এখন নেই। আজ থেকে ৪বছর আগে এক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। বলেই সামরান বাহিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
— আমি মরি নি। তুই আমাকে মেরে ফেলেছিস। তুই ইচ্ছে করে আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিস। অন্যের করা ভুলের দায়ভার আমি কেন নেব? কেনন?
সামরান থমকে দাড়ালো,
–নিজের দোষ দেখতে শিখুন মি.মালিক। আর আপনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। এটাই সত্যি।
— কি বললি সম্পর্ক নেই? এটা কি? (নিজের চেহারা দেখিয়ে বলে শেহেরজাদ)কি এটা? আমি তোর প্রতিচ্ছবি। তুই তো বলতি আমি তোর আয়না। তাহলে আজ কেন?
–সেই আয়না ভেঙে গেছে।
–এত কথা কোত্থেকে শিখলি তুই?
— শিখতে হয়। বলেই হালকা হাসে সামরান।
সেলিনা মালিক বেরিয়ে আসে। সেলিনা মালিক কে দেখে শেহেরজাদ অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো।
— মা দেখেছো। ও আমাকে আবার অবহেলা করছে। আমি কিন্তু ওর থেকে এটা আশা করিনা মা। আমি এত দিন পর এসেছি ও কেন আমার সাথে এমন করছে।
–এখানে আপনার কেউ নেই। যার সাথে কথা বলছেন সে আমার মা। আপনার না। তাই তাকে মা বলে ডাকা বন্ধ করুন।
— বাহহহ!!তুই এবার আমার মা ও নিয়ে নিলি। কি সুন্দর। আমার জন্য তো কিছু ছাড়।
সামরান এগিয়ে আসে।
–একটা সময় ছিল,যখন সবকিছু কারো হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে ছেড়ে উঠে আসতাম। কিন্তু সে একদিন বুঝিয়ে দিল তার কাছে আমি কিছুই না। আমার থেকেও মূল্যবান,গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তার আছে। যার সামনে আমি ফিকে পড়ে গেলাম। তাই এখন আর কারো জন্য নিজের কিছু ছাড়ি না আমি। বলেই সামরান সেলিনা মালিকের দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেল। সেলিনা মালিক তাকিয়ে রইল সামরানের যাওয়ার দিকে।
বিঃদ্রঃ দিয়ে দিলাম আজ দুটো ধামাকা। এক রাহাদের আসল রুপ। আর শেহেরজাদের আসল পরিচয়। এখনো অনেক কিছুই পরিষ্কার হয় নি। আশা করি শেষ পর্যন্ত পাশে থাকবেন। আজকের পর্ব কেমন লাগলো গঠনমূলক মন্তব্য করে পাশে থাকুন ধন্যবাদ❤️
চলবে??