#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_২৮
********
–আমার এই মন নদীতে অনেক অনেক প্রেম জমা আছে। শুধু মাত্র আমার ভালোবাসার মানুষের জন্য!!
নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে দু-হাত মেলে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে কথাটি বলে মায়া।
গাছের ছায়ায় বসে থাকা মায়ার বান্ধবীরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলো।ওদের হাসির শব্দ মায়ার কানে এলো।কিন্তু মায়ার সেদিকে মনোযোগ নেই।মায়া মন ভরে নদীর ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে ভেসে আসা বাতাস কে উপভোগ করছে।
হঠাৎ একটি মিষ্টি পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
–তোমার সেই মন নদীতে আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে যত্নে বানানো #প্রেমের_খেয়া ভাসাতে চাই। আর ইউ এগ্রি উইথ মি..?
মায়ার বান্ধবীরা বিস্ময় নিয়ে ফিরে তাকালো। সবার উদ্দেশ্য কন্ঠস্বরের মালিক কে তা দেখার?মায়া দু’হাত নামিয়ে নিলো।পেছনে ফিরতেই দেখলো কালো রঙের একটি শার্ট পরিহিত এক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।মুখে জুড়ে হাসি। মায়া বিরক্তি নিয়ে কপাল কুঁচকালো। বাতাসের ঝাপটায় চুল উড়ছে মায়ার। সামলানো মুশকিল। হাত দিয়ে চুল খোপা করতে করতে এগিয়ে এলো মায়া। ছেলেটির সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
–কি বললেন?
–ওহহ আবার শুনতে ইচ্ছে করছে বুঝি?দু-হাত পেছনে নিয়ে গিয়ে মায়ার দিকে ঝুকে বলে ছেলেটি।
মায়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।
–অচেনা একজন মানুষের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানেন না?চেনেন না জানেন না ওমনি এসে নিজের অসভ্যতা দেখিয়ে দিলেন?
–ম্যাডাম! আপনি যেটাকে অসভ্যতা বলছেন আমার দুনিয়ায় সেটাকে প্রপোজ বলে!!প্রেমের সম্বোধন বলে। মনের অব্যক্ত অনুভূতি সুযোগ বুঝে প্রকাশ করা বলে।
–স্টুপিডডড!বলেই মায়া পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। ছেলেটি ঘুরে দাঁড়ায়। চিৎকার করে বলে উঠে,
-আপনার মন নদীতে আমি আমার #প্রেমের_খেয়া ভাসিয়েই ছাড়বো।
মায়া পেছনে ফিরে তাকালো,
–জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতে নেই। কখনো পুরণ হয় না।বলেই লম্বা পা ফেলে মায়া চলে গেলো। মায়ার বান্ধবীরা মায়াকে অনুসরণ করে ছুটলো মায়ার পিছু।
ছেলেটি দাঁড়িয়ে রইলো। মুখে বাকা হাসির রেখা টেনে বললো,
–জেগে জেগে দেখাই ভালো। যে স্বপ্ন চোখের ঘুম হারাম করে দেয় তা পূরণ করার জেদ জন্মে ওঠে। পূরণ তো হবেই। কারণ স্বপ টা যে আমার। আপনি শুধু দেখতে থাকুন। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।
ঘুম ভেঙ্গে গেল মায়ার। হুট করেই উঠে বসে পড়লো। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে আছে। একটু আগে কি স্বপ্ন দেখলো মায়া। শুকনো ঠোঁট জোড়া জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিলো। এলোমেলো হয়ে থাকা চুল গুলো ঠিক করে নিলো। পাশে তাকাতেই দেখলো সামরান ঘুমাচ্ছে। মায়ার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। সামরান আর মায়া রাতে কাউচে্ই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। সামরান পরম যত্নে মায়াকে বুকে নিয়ে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়। মায়া একটু ঝুকে সামরানের মুখোমুখি হলো,
— একটু আগে স্বপ্নে যেই মানুষটি ছিলো সেটা আপনি ছিলেন। ইশশ! আপনার আর আমার দেখা যদি ওভাবে হতো। স্বপ্ন টা সত্যিই সুন্দর ছিলো। স্বপ্ন টা আমাকে এটা বুঝিয়ে দিলো যে আমার ভালোবাসার মানুষ মেঘবর্ণ ধারণকারী সামরান মালিক। একটু হাসলো মায়া। কিছু চুল সামনে এসে পড়ে এক হাতে তা কানের পাশে গুঁজে দেয়।
আপনি আমায় আমার অমতে স্পর্শ করলেন না। আমি দেখতে চেয়েছিলাম যে, আপনি…. থেমে যায় মায়া। আর কিছু বলে না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
আপনি পাশ করেছেন। ফুল মার্কস দেওয়াই যায় বলুন।
ধপ করে বারান্দার দরজার শব্দ শুনে চমকে উঠে মায়া। বাহিরে প্রচুর বাতাস বইছে। যার কারণে বারান্দার দরজা একবার বন্ধ হচ্ছে আর একবার খুলে যাচ্ছে। কাউচ্ ছেড়ে নেমে দাঁড়ায় মায়া। শাড়ির আঁচল ভাজ করে কাধে তুলে দেয়। বারান্দায় গিয়ে বাহিরে উঁকি দিতেই দেখলো বাহিরে বাতাসের সাথে হালকা বৃষ্টি ও হচ্ছে। একটু পরই হয়তো বৃষ্টির বেগ বেড়ে যাবে। বারান্দার দরজা বন্ধ করে দেয় মায়া। দরজা বন্ধ করে পেছনে ফিরতেই সামরান কে দেখে চমকে উঠে।
–আপপনি?
–আমাকে ছেড়ে কেন উঠে এলেন?
— না আসলে.. দরজা বন্ধ ককরতে এসেছি-ছিলাম।
–ওহহ। মায়ার দিকে একবার তাকালো সামরান। শাড়ির আঁচল কাধে তুলে রাখাতে কোমরের পাশ দেখা যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে মাথা ঘুরিয়ে একটি বড় শ্বাস নেয় সামরান। মায়া তা লক্ষ্য করে নিজের দিকে একবার তাকিয়ে সামরানের দিকে তাকালো। তারপর এক হাতে শাড়ি আরো সরিয়ে দিলো। সামরানের কাছে গিয়ে বলল,
–কি হলো?
–কিছু না। আসুন রাত অনেক হয়েছে।
সামরান চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মায়া সামরানের হাত ধরে ফেলে। সামরান পেছনে ফিরে হাতের দিকে একবার তাকিয়ে মায়ার দিকে তাকালো। সামরানের চোখ লাল হয়ে আছে। চেহারায় অস্থিরতার ছাপ স্পষ্ট।
–কি হলো?
–আমার না পায়ে ব্যাথা হচ্ছে বিছানা অবধি কিভাবে…
সামরান ভ্রু কুঁচকে নিলো।
–আচ্ছা কাউচে্ই শুয়ে পড়ুন।
মায়া কপাল ভাজ করে বলল,
–কেন? আমাকে বিছানায় নিয়ে যেতে আপনার কষ্ট হবে নাকি?
–রাত অনেক হয়েছে। এই রাতে….
–এত অযুহাত দিতে হবে না। বলুন যে আ আপনি আপনার বি বিছানায় আমাকে রাখতে চাইছেন না। কথা শেষ করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো মায়া। সামরান ভ্রু আবারো কুঁচকে নিলো। একটু এগিয়ে এসে মায়ার সামনে দাড়ালো,
–আপনি আমাকে আপনার মত বাচ্চা ভাবেন?
–উহুম! দুপাশে মাথা নেড়ে বলল মায়া।
— তাহলে? কি বোঝাতে চাইছেন?
— সহজে বুঝে নিলে এত কিছু করতে হয় না। মায়া একটু এগিয়ে এসে বলে। সামরান মায়ার কোমরে হাত রাখতেই মায়া চোখ বন্ধ করে নিলো। মায়াকে জড়িয়ে ধরে সামরান। সরে এসে চুমু দেওয়ার জন্য এগিয়ে যেতেই মায়া অস্ফুটস্বরে বলে উঠে,
–লাইট বন্ধ করে দিন।
সামরান থেমে গেল। মায়া অন্ধকারে ভয় পায় বলে সামরান মায়া এসেছে পর্যন্ত রুমের লাইট বন্ধ করে না। আজ মায়া নিজেই লাইট বন্ধ করতে বলছে? স্ট্রেঞ্জ!
এক হাতে মায়ার গাল স্পর্শ করে।
–আপনি না অন্ধকারে ভয় পান?
–আপনি আছেন তো, ভয় কিসের? সামরানের দিকে তাকিয়ে বলে মায়া
— বরবাদ করে দেবেন আপনি আমাকে।
–মন্দ হবে না। ফিক করে হেসে দেয় মায়া।
ঝাপটে জড়িয়ে ধরে সামরান মায়াকে। ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে নিলো মায়া। সামরানের বাধন এতোই শক্ত ছিলো যে মায়ার ব্যাথা অনুভব হলো। তারপর….
(তারপরের টা আর বর্ণনা না দেইই?😒)
সকাল বেলা ডাইনিং টেবিলে সেলিনা মালিক সবাইকে দেখতে পেলেও সামরান আর মায়াকে দেখতে পেলো না। সামাদ মালিক খুব ভোরে বাড়ি ফিরেছেন। এসে খানিকক্ষণ বিশ্বাম নিয়েছিলেন। খাওয়ার টেবিলে সামরান আর মায়া কে না দেখে সিমিকে ডেকে প্রশ্ন গলায় বললেন,
— সামরান আর মায়াকে দেখছিনা! কোথায় ওরা?
–আব্বা ওরা ঘুমাচ্ছে হয়তো!আমি ডাকতে গিয়েছিলাম কিন্তু ওরা ঘুমাচ্ছিলো।
–ওহহ। এসো তুমিও বসে পড়ো একসাথে খেয়ে নিই।
–খাবো আব্বা। আগে আপনারা খেয়ে নিন। হাসি মুখে বলে সিমি।
শেহেরজাদ এসে সামাদ মালিকের সামনাসামনি বসে পড়ে। ছেলেকে দেখে মৃদু হাসলেন সামাদ মালিক,
–কেমন আছো?
–ভালো আছি ড্যাড!
–তুমি কি আবার ফিরে যাবে?
–এখানে আসার আগ অবধি এটাই ছিল মাথায়,তবে এখন আর নেই। আর ফিরবো না। শেহেরজাদের কথায় সিমির মুখে খুশির ঝলক খেলে গেল।
–তাহলে ফ্যামিলি বিজনেস সামলাও। সামনেই আমার ইলেকশন আমি অনেক ব্যস্ত, সামরান কিছুদিন বাড়িতে সময় দিক। তুমি ব্যবসা সামাল দাও।
–আচ্ছা ড্যাড! তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। আমি আজ থেকেই জয়েন করবো।
–হুম।
–শুধু ব্যবসা সামলালে হবে? বিয়ে হয়েছে কয় বছর? এখনো নাতি-নাতনীর মুখ দেখলাম না। আর কত দিন অপেক্ষা করবো আমরা? সেলিনা মালিকের কথা শুনে শেহেরজাদ বিষম খেল। সবে মাত্র ছেলেটা পাউরুটিতে কামড় বসিয়েছিলো। মায়ের এহেন কথা হয়তো মেনে নিতে পারেনি। সামাদ মালিক চটজলদি পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন। শেহেরজাদ পানি শেষ করে মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে সিমির দিকে তাকালো। সিমি চোখ সরিয়ে নিলো। পরিস্থিতি সামাল দিলে শেহেরজাদ বলে উঠল,
–এখনো অনেক দেরি আছে। ভাইয়ের আগে আমি বাচ্চা নেব না।
–এটা কেমন কথা? সামরানের সবে বিয়ে হয়েছে।
–তাতে কি? আমি ভাইয়ের আগে যাচ্ছি না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো শেহেরজাদ। মুখ মুছে পেছনে ফিরতেই ফাইজার সাথে ধাক্কা লাগে। মুহুর্তেই শেহেরজাদের ফর্সা চেহারা লাল হয়ে উঠল। রাগী দৃষ্টিতে সিমির দিকে তাকালো।
–বাড়ি টা ডাস্টবিন হয়ে গেছে। ময়লা পরিষ্কার হলে বলো তারপর ফিরবো। অন্যথায় নয়। কারণ আমার নোংরা জিনিস খুব একটা পছন্দ না। খুব একটা কি একেবারেই পছন্দ না। ফাইজার দিকে তাকিয়ে দাতেঁ দাতঁ চেপে কথাটা বলে লম্বা পা ফেলে চলে গেল শেহেরজাদ। সামাদ মালিক উঠে ভেতরে চলে গেল। সেলিনা মালিক ও ভেতরে চলে গেল। সামরান আর মায়াকে না দেখে ফাইজা উপরে তাকালো। সামরানের দরজা বন্ধ দেখা যাচ্ছে।
–মায়া উঠে নি?
–নাহ ঘুমাচ্ছে দুজনই। তুই বোস খেয়ে নে। আমিও খাইনি। ওরা উঠলে খেয়ে নেবে।
–ওহহ!!
ঘুমের ঘোরেই মৃদু আর্তনাদ করে উঠল মায়া। মায়ার আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই সামরান তাড়াতাড়ি চোখ খুলে নেয়। ঘুমন্ত মায়ার মুখের দিকে তাকাতেই সামরানের কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো। পিঠে ছোপ ছোপ দাগ বসে গেছে। চকচকে মুখশ্রীতে নাকের ডগা লাল হয়ে আছে। সামরান মায়ার নাকের ডগায় চুমু খেল। মায়া আস্তে আস্তে চোখ খুলে নেয়।
–গুড মর্নিং!
–গুড মর্নিং! বলেই মায়া হেসে দিলো।
সামরান এগিয়ে গিয়ে মায়ার গালের সাথে গাল ঘষে দেয়,
–হাসলে অনেক সুন্দর লাগে অলকানন্দা।
–সকাল সকাল পাম না দিলেও চলবে। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে মায়া। সামরান একটু সরে আসে,
–আমি মিথ্যা বলিনা। সত্যি সুন্দর লাগে।
–হয়ে গেছে আপনার? এবার সরুন আমি উঠবো। অনেক বেলা হয়ে গেছে।
–আর একটু থাকুন। রেস্ট নিন!
–রেস্ট কেন? যুদ্ধ করিনি আমি যে রেস্টের প্রয়োজন হবে।
সামরান একটু এগিয়ে সরস গলায় বলল,
–‘যুদ্ধের থেকে কোনো অংশে কম হয় নি’ সামরানের এহেন কথায় মায়া লজ্জা পেয়ে গেল। সামরান কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।
–সরুন!!
সামরান দুহাত মাথার নিচে ভাজ করে রেখে শুয়ে পড়লো।
–আমাকে বিরক্ত করবেন না কেমন? আমি এখন উঠছিনা।
মায়া ভ্রু কুঁচকে তাকালো,
–নির্লজ্জ মানুষ!
সামরান গগন কাঁপানো হাসি হেসে গায়ে চাঁদর টেনে নিলো।
#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_২৯
অচেনা একটি বাড়ি! অনেক্ষণ ধরে বসে আছে ফাইজা। ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আছে সে। বার বার সিড়ির দিকে তাকাচ্ছে। কারো আসার নাম গন্ধ নেই। একরাশ বিরক্তি নিয়ে চায়ের কাপ তুলে চুমুক দিলো ফাইজা। সাথে সাথে দেওয়ালে টাঙানো বিশাল দেওয়াল ঘড়ি শব্দ করে বেজে উঠল। দেওয়াল ঘড়ির ‘টুং’ শব্দ শুনে খানিকটা চমকে উঠলো ফাইজা। ভ্রু কুঁচকে ঘড়ির দিকে তাকালো। হঠাৎ পেছনে কারো পায়ের শব্দ শুনে ফিরে তাকালো ফাইজা। টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে সিড়ি দিয়ে নেমে আসছে রাহাদ। রাহাদ কে দেখে উঠে দাড়ালো ফাইজা। রাহাদ এসে ফাইজার মুখোমুখি বসলো। ফাইজাকে ইশারায় বসতে বলে। সার্ভেন্ট এসে দাড়াতেই হাতের টাওয়াল দিয়ে দিলো রাহাদ। তারপর ফাইজার দিকে তাকালো,
— আই সি! শুনেছি আমি আপনার নামে। কিন্তু আমার কাছে কেন আসা?
–আই নিড ইউর হেল্প! রাহাদের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বলে ফাইজা।
রাহাদ ভ্রু নাঁচিয়ে একটু ঝুকে বসলো,
–কিভাবে হেল্প করতে পারি আমি?
–আপনার মায়া চাই তাইতো?
মায়ার কথা শুনেই রাহাদ ভ্রু কুঁচকে নিলো। সোজা হয়ে বসে সেন্টার টেবিলে পা তুলে দিলো,
–হঠাৎ এই কথা?
–আমি আপনার সম্পর্কে সব জানি। আপনি কে? কি করেন? সব.. আপনি আর আমি একই নৌকার মাঝি। আপনি মায়াকে চান আর আমি সামরান কে। ৪বছর আগে আমি সামরান কে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ এসে আমি বুঝতে পারছি আমার সামরানকেই চাই। কিন্তু মায়া থাকতে কিছুতেই তা সম্ভব না। আর আপনি তো মায়াকে চানই,আমি আপনাকে হেল্প করবো মায়াকে পেতে আর আপনি, আমায় হেল্প করবেন সামরানকে পেতে। কি করবেন তো?
–গুড প্রপোজাল! কিন্তু কাজ টা এত টা সহজ না। আমার এই পজিশন মায়া জানে না। আমি নিজেকে মধ্যবিত্তের স্তরে রেখে মায়ার কাছে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু না বন্ধুত্ব ছাড়া আমি কিছু পাইনি। তাকে ভালোবাসি এটা কিন্তু একদম না। সে আমার বিশাল টাকার খনি। সোনার হরিণ সে। তাকে পেলে আমার পজিশন এত উপরে যাবে, যা আমার ভাবনার বাহিরে৷ সামরান কে আপনি কিভাবে দূরে সরাবেন সেটা আপনি জানেন। বাট!আই নিড মায়া। এট এনি কস্ট!
–কিন্তু আপনি চাইলে সামরানকে দূরে সরানো কিন্তু কোনো ব্যাপার না।
ফাইজার কথা শুনে থমকে যায় রাহাদ। বাকা হাসি হেসে ফাইজার দিকে তাকায়,
–ওয়াওও!গুড অপশন। আমি বুঝে গেছি আমার কি করতে হবে। ইউ নো হোয়াট, এই মায়াকে পাওয়ার জন্য আমি ওর ফ্যামিলিকে ভয় ও লাগিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বিয়ের কথা যখন উঠবে তখন সুযোগ বুঝে আমি আমার প্রস্তাব রাখবো। এইটুকু বলেই রাহাদ সোফা ছেড়ে উঠে জানলার পাশে গিয়ে দাড়ালো। মৃদু বাতাসে দুলছে পর্দাগুলো। ফাইজা উঠে গিয়ে রাহাদের পেছনে দাড়ালো,
–তারপর কি হলো?
–তারপর আর কি? আমার সব প্ল্যান ভেস্তে গেল। বিয়ে হয়ে গেল সামরানের সাথে। পাশা উলটে গেল ইয়ার!! জানলার গ্রিলে ঘুষি বসালো রাহাদ। ফাইজা রাহাদের কাধে হাত রাখে। ফাইজার স্পর্শ পেয়ে রাহাদ পেছনে ফিরে দাড়ালো,
— এত কিছু শুধু ব্যবসার জন্য করছো? সরি করছেন!
–ইটস ওকে তুমি সম্বোধন করতে পারো।
–থ্যাংকস! যেটা বলছিলাম, শুধুই ব্যবসার জন্য? মায়ার মত মেয়েকে তোমার মনে ধরেনি? ভালোবাসা জাগে নি?
মাথা উঁচু করে হাসলো রাহাদ। রাহাদের হাসি দেখে ভ্রু কুঁচকালো ফাইজা।
–ভালোবাসা বলতে কিচ্ছু হয় না। আমাদের জন্য তো আরো না। আমরা শুধু বুঝি টাকা আর টাকা। বাই এনি চান্স যদি কাউকে দেখে ভালোলাগে তাহলে রাত তো আছেই। একটা রাতের জন্য তাকে কাছে আনা কোনো ব্যাপারই না বস।
–বুঝলাম। ঠিক আছে কথা তবে এটাই থাকলো। তুমি সামরান কে দূরে সরাবে। আর আমি মায়াকে।
–হুম।
অনেক্ষণ হলো শেহেরজাদ বাসায় ফিরেছে। প্রথমদিনে অনেক চাপ ছিলো কাজের। বাসায় এসেও ছেলেটা অফিসের কাজ নিয়ে বসে পড়ে। সিমি কফি দিয়ে যে চলে গেল আর এলো না। অনেক্ষণ সময় পার হওয়ার পরও যখন শেহেরজাদ সিমির দেখা পেল না তখন ল্যাপটপ বন্ধ করে নিচে গেল শেহেরজাদ। সিড়ি দিয়ে নামার সময় ড্রয়িংরুমে চোখ পড়তেই শেহেরজাদ স্তব্ধ হয়ে গেল।
লাল একটি কাপড়ে সিমির চোখ বাধা। পরনে সারা রঙের গোল সুতি গাউন,ওড়না সোফার উপরে রাখা। সেলিনা মালিক সোফায় বসে আছেন, আস্তে আস্তে হাত তালি দিচ্ছে। সিমি এত সুন্দর নাচতে পারে শেহেরজাদ জানতো না। এত বছরে এক বারো শেহেরজাদ বুঝে উঠতে পারেনি। চোখ বাধা অবস্থায় ও কত নিখুঁতভাবে নাচ করছে সিমি। ধীর পায়ে নেমে এল শেহেরজাদ। শেহেরজাদ কে দেখে মৃদু হাসি হাসলো সেলিনা মালিক।
সিমি নাচের তালে ছিলো। টেবিল থেকে কাচের গ্লাস পড়ে ভেঙে গেল। সিমি কাচের উপর পা রাখার আগেই শেহেরজাদ ফ্লোর এ হাত বিছিয়ে দিলো। সিমির পায়ের চাপ পড়ার সাথে সাথে শেহেরজাদের হাতের উল্টো পিঠে কাচ ঢুকে গেল। সাথে সাথে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটকে সারা ফ্লোরে ছড়িয়ে গেল। শেহেরজাদ চোখ কুঁচকে বন্ধ করে নিলো। সিমি তাড়াতাড়ি চোখের বাধন খুলে নিচে তাকাতেই শেহেরজাদের হাত দেখে আঁতকে উঠে। ফ্লোরে হাটু ভাজ করে বসে পড়ে। হাত ধরার আগেই শেহেরজাদ উঠে দাঁড়ায়। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের রুমের দিকে লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল। সিমি ফ্লোরে থাকা রক্তের দিকে তাকিয়ে রইলো। সেলিনা মালিক এগিয়ে এসে সিমির পাশে দাড়ালো,
–যা স্বামীর সেবা কর। তোর পা বাঁচাতে গিয়ে বেচারার হাত। মুচকি হেসে চলে গেল সেলিনা মালিক।
মায়া এতক্ষণ দেখছিলো। এতক্ষণে মায়া বুঝতে পেরেছে সিমি আর শেহেরজাদের সম্পর্ক ঠিক নেই। শেহেরজাদ সিমিকে নিয়ে যতটা অস্থিরতা প্রকাশ করে সিমি তার একভাগও না।
–এত বছরে ভালোবাসা জন্মালো না আপুহ্?যাকে ভালোই বাসিস না তার সাথে এতটা বছর কিভাবে কাটালি? মনে মনে কথা গুলো আওড়াতে থাকে মায়া। দৃষ্টি সিমির দিকেই স্থির।
নিজের হাতে নিজেই ব্যান্ডেজ করার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শেহেরজাদ। সিমি রুমে প্রবেশ করতেই তা দেখতে পেল। এগিয়ে গিয়ে শেহেরজাদের সামনে বসে সিমি।
–দিন আমাকে আমি করে দিচ্ছি।
–আমি পারবো।
–দিন না। বলেই শেহেরজাদের হাত নিজের হাতের মুঠোই নিয়ে ফু দিলো সিমি। তারপর আস্তে আস্তে ব্যান্ডেজ করতে লাগলো। শেহেরজাদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর বলল,
–এত ভালো নাঁচতে পারো কই আগে বলোনি তো?
সিমি থেমে গেল। শেহেরজাদের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো।
— এসব বলতে হবে কেন? এটা কোনো বলার কথা হলো নাকি? ব্যান্ডেজ করা শেষ হাত ছেড়ে দিয়ে ফার্স্টএইড বক্স গুছিয়ে রাখলো সিমি। শেহেরজাদ উঠে গিয়ে সিমির পেছনে দাড়ালো। ড্রয়ারে ফার্স্টএইড বক্স রেখে ফিরতেই শেহেরজাদকে দেখে একটু পিছিয়ে গেল,
–কি হলো? কিছু বলবেন?
— মা আজ সকালে কি বলল শুনেছো?
সিমি মাথা নিচু করে নিলো। শেহেরজাদ সিমির দুগালের পাশে হাত রাখে,
–এইবার আমাকে পূর্ণ করে দাও। আমি এই একটা জিনিসের অভাবে আছি। আমায় একটা বাবু দিয়ে দাও!
সিমি দৃষ্টি নত করে দাঁড়িয়ে রইলো। সিমিকে চুপ করে থাকতে দেখে শেহেরজাদ আবারো বলে উঠল,
–তুমি বাচ্চা নিচে চাও না? আমার বাচ্চা গর্ভে ধারণ করতে চাও না? আম–আমি এতদিম ভে–ভেবেছিলাম তুমি প্রস্তুত না তাই। কিন্তু তুমি তো.. কয়েক পা পিছিয়ে যায় শেহেরজাদ।
এই এত বছরে আমি একটু জায়গা তোমার মনে পেলাম না। তোমার এত ভালোবাসার মাঝে একটু ভালোবাসা আমায় দেওয়ার মত নেই? তুমি আমাকে ভালোবাসো না? সিমি চোখ তুলে তাকালো। শেহেরজাদ কথা গুলো বলতে বলতে পিছিয়ে যাচ্ছে।
–এমন না! আপনি শান্ত হোন..
–থাক(হাত উঁচিয়ে)। আমি বুঝেছি, বুঝেছি আমি। আমার স্পর্শ বাজে লাগে তোমার তাই না? আমার ব্যর্থতা এইভাবে তুমি আমাকে দেখিয়ে দিলে.. এত বছরে আমি একটু জায়গা করে নিতে পারলাম না। তোমার দুনিয়ায় আমার কোনো অস্তিত্বই নেই? আমি ব্যর্থ? হ্যাঁ –হ্যাঁ আমি ব্যর্থ। আজ–আজ থেকে আম–আমি তোমাকে আর স্পর্শ করবো না। আর না। খুব শীগ্রই আমি তোমাকে মুক্তি দিয়ে দেব। শুধু মাথায় রেখো, তোমাকে মুক্তি দেওয়ার পর আমি….. থেমে গেল শেহেরজাদ। সিমির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কঠিন কন্ঠে বলল,
— প্রস্তুত থেকো। খুব শীগ্রই মুক্তি পেতে চলেছো। কথা শেষ করে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল শেহেরজাদ।
সিমি ফ্লোরেই বসে পড়লো।
— আমার কি করা উচিৎ আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি এটাও জানি না আপনাকে আমি ভালোবাসি কি… চোখ থেকে অনবরত পানি ঝরতে থাকে৷
দুপুরে বের হয়েছিলো শেহেরজাদ এখনো ফেরে নি। রাত ১০টা বাজে। মায়া বারান্দায় বসে ছিলো। হঠাৎ ফোন বেজে উঠতেই দেখলো রাহাদের ফোন। হালকা হেসে ফোন রিসিভ করলো মায়া,
–হ্যালো কেমন আছো মায়া?
–এইতো ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
–ভালো। স্বামী পেয়ে আমাকে কি ভুলে গেলে?
–আরেহ না তুমি আমার বন্ধু তোমাকে ভুলতে পারি বলো? তো বলো খেয়েছো?
–হ্যাঁ খেয়েছি। কি করছো?
–বসে আছি..
–বিয়ে উপলক্ষে তোমাকে কোনো গিফট দেওয়া হয়নি। তাই ভাবলাম কিছু গিফট করি।
–তাই নাকি? কি দেবে গিফট?
–বাগানের দোলনায় রাখা আছে তোমার গিফট।
–তাই নাকি?
–হ্যাঁ যাও নিয়ে এসো।
–একটু দাড়াও।
মায়া এক দৌড়ে বাগানে গিয়ে দেখল দোলনায় একটি বড় বক্স। বক্সটা নিয়ে মায়া ফিরে এলো।
–এনেছি গিফট বক্স। কিন্তু এতে কি আছে?
–দেখো খুলে কি আছে।
–আচ্ছা দেখছি।
মায়া বক্সটা খুলে। ভেতরের কভার সরাতেই দেখলো একটি লাল শাড়ি।
–ওয়াওও!!সুন্দর তো..
–পছন্দ হয়েছে?
–হ্যাঁ আমার ফ্রেন্ড দিয়েছে বলে কথা।
–শাড়িটা এখনই একবার পরবে?
–এখন?
–হ্যাঁ কেন? আপত্তি থাকলে দরকার নেই।
–আপত্তি নেই দাড়াও একটু।
–আচ্ছা।
কিছুক্ষণ পর এসে মায়া ফোন আবার কানে ধরলো,
–এইই তুমি এখনো লাইনে আছো?
–হ্যাঁ তুমিই তো বললে দাড়াতে।
–ধুর! আম শাড়ি পরেছি তো।
–বাহহ! বারান্দায় আসো একটু।
–তুমি এখানে?
–হ্যাঁ তুমি আসলেই দেখতে পাবে।
–আচ্ছা। মায়া বারান্দায় গিয়ে দেখলো রাহাদ দাঁড়িয়ে আছে।
আসো না উপরে। বাড়ির সবার সাথে দেখা করে যাও।
মায়াকে দেখে রাহাদের দৃষ্টি আটকে গেল। লাল শাড়িতে মায়াকে অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে। বারান্দার মৃদু আলোতে মায়াকে মায়াবী লাগছে। মায়াবতী বলাই যায়।
–কি হলো? চুপ করে আছো যে।
–হ্যাঁ — না মানে। সুন্দর দেখাচ্ছে।
–আসো না বাসায়।
–অন্যদিন আসবো। আজ এমনিতেও দেরী হয়ে যাচ্ছে।
–ওহহ আচ্ছা ঠিক আছে।
–গুড নাইট..
–আল্লাহ হাফেজ…
চলবে….???