প্রেমের পরশ পর্ব -০১

১.
‘তোর লজ্জা নেই ছোটলোকের মতো আমাদের বাড়িতে পড়ে আছিস? অবশ্য ছোটলোকদের তো লজ্জা বলতে কিছু নেই।’

নিজের চাচাতো ভাই আমানের মুখে এমন অপমানজনক কথা শুনে ছোয়ার চোখে জল চলে এলো। কিন্তু ছোয়া কাদল না। ছোটবেলা থেকে নিজের মনের অনুভূতি গুলোকে খুব সুন্দর করে আড়াল করতে জানে মেয়েটা। তাই সে আমানের কথা শুনেও না শোনার ভান করে নিজের কক্ষের দিকে অগ্রসর হয়। যাওয়ার সময় শুনতে পায় আমান বলছিল,
‘থার্ড ক্লাস মেয়ে একটা। এমন মেয়েদেরকে আমার খুব ভালো করেই চেনা আছে। পড়ালেখার নাম করে শহরে এসেছে, কিন্তু আসল উদ্দ্যেশ্য তো এখানে আমাদের থেকে বিনা পয়সায় রাক্ষসের মতো খাওয়া।’

এত অপমান আর সহ্য হচ্ছিল না ছোয়ার। তাই সে রুমে এসে দরজা বন্ধ করে তার বাবাকে কল করল। একটু পরেই শাহাদ হোসেন ফোনটা রিসিভ করতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল ছোয়া। শাহাদ হোসেন নিজের মেয়ের কান্না শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। গতকালই তো মেয়েটাকে পড়াশোনার জন্য নিজের বড় ভাইয়ের কাছে শহরে পাঠালেন। এরমধ্যে কি এমন হলো যে তার মেয়ে এভাবে কাদছে। সেটা বুঝতেই পারছেন না। শাহাদ হোসেন বললেন,
‘কাদছিস কেন ছোয়া? তোর কি কোন অসুবিধা হয়েছে?’

ছোয়া তার বাবার কাছে কিছু লোকাতে চায় না। তাই ছোয়া বলল,
‘তুমি কেন আমাকে এখানে পাঠালে আব্বু? আমি তো বলেই ছিলাম আমি হোস্টেলে থাকব। আমি তো আসতে চাইনি এখানে।’

শাহাদ হোসেন এবার একটু আচ করতে পারলেন ব্যাপারটা। চিন্তায় ভাজ পড়ল তার কপালে। তিনি বললেন,
‘ওখানে কেউ কি তোকে কিছু বলেছে?’

‘কিছু বলার আর বাকি রাখেনি। আমান ভাইয়া আমায় কি বলেছে জানো? আমি নাকি ছোটলোক, এখানে নাকি বিনা পয়সায় রাক্ষসের মতো গিলতে এসেছি। এসব কথা শুনতে আমার ভালো লাগছে না আব্বু। তুমি তো আমায় আত্মসম্মানবোধ সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছ আব্বু। তাহলে তুমি বলো এত অপমানিত হওয়ার পরেও কি এখানে আমার থাকা উচিৎ?’

শাহাদ হোসেন কিছু মুহুর্তের জন্য সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তিনি তো কত ভরসা করে নিজের বড় ভাইয়ের কাছে মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন। মেয়েটা তো চেয়েছিল আলাদা ভাবে হোস্টেলে থাকতে। শুধুমাত্র ছোয়ার নিরাপত্তার কথা ভেবেই তিনি শহরে থাকা নিজের বড় ভাই আব্দুল হোসেনের কাছে পাঠিয়েছেন নিজের একমাত্র অতি আদরের মেয়েকে। শাহাদ হোসেন গ্রামে একটি মুদি দোকান চালান। মোটামুটি স্বচ্ছলতা আছে তার। সেখানে তার মেয়েকে এভাবে অপমানিত হতে হয়েছে ব্যাপারটা তার ঠিক হজম হলো না। তিনি ছোয়াকে বললেন,
‘তুই নিজের জামা কাপড় সব গুছিয়ে রাখিস মা। আমি গিয়ে তোকে নিয়ে আসব। এত অপমানিত হয়ে তোকে ওখানে থাকতে হবে না।’

ছোয়া কল কে’টে দিল। তখনই সে দরজার কাছে একটি শব্দ শুনতে পেল। কেউ তার দরজায় নক করছে। ছোয়া নিজের চোখের জল লুকিয়ে দরজা খুলতে গেল৷ দরজা খুলতেই চোখে পড়ল দরজায় তার চাচি জান্নাতুল খাতুন দাড়িয়ে আছেন। ছোয়াকে দেখেই তিনি মৃদু হেসে বললেন,
‘তুমি তো সকাল থেকে এখনো কিছু খাওনি। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে ব্রেকফাস্ট করে নাও। তারপর তো আবার ভার্সিটিতেও যেতে হবে।’

জান্নাতুল খাতুনের এমন সুন্দর ব্যবহার দেখে ছোয়া বরাবরই অভিভূত। তার চাচা-চাচি, চাচাতো বোন আলিয়া সবাই তার সাথে অনেক ভালো ব্যবহার করে। শুধু আমানই কেন জানি তাকে একদম সহ্য করতে পারে না। এর কারণ অবশ্য ছোয়ার অজানা।

নিজের চাচির করা মিষ্টি ব্যবহারের চেয়েও ছোয়ার মাথায় এখন আমানের করা খারাপ ব্যবহার গুলো ঘুরছে। তাই সে বেশ রূঢ়ভাবে বলল,
‘আমি কিছু খাবো না বড় মা। বিনা পয়সায় এভাবে রাক্ষসের মতো খাওয়ার ইচ্ছা আমার নেই।’

জান্নাতুল খাতুন বেশ অবাক হলেন ছোয়ার এমন কথায়। মেয়েটা এমনিতে খুব শান্তশিষ্ট, চুপচাপ। খুব একটা কথা বলে না। সেই মেয়েটা এমন হঠাৎ কেন এভাবে রেগে গেল সেটা বুঝতে অবশ্য বেশি বেগ পেতে হলো না তাকে। নিজের ছেলেকে বেশ ভালোই চেনেন তিনি। তাই জান্নাতুল খাতুন সেসব আন্দাজ করেই বললেন,
‘আমান কি আবার তোমাকে কিছু বলেছে? তুমি তো জানোই ছেলেটা ওমনই।’

ছোয়া জান্নাতুল খাতুনকে জড়িয়ে ধরল। হঠাৎ এভাবে জড়িয়ে ধরায় জান্নাতুল খাতুন হচকচিয়ে গেলেন। পরক্ষণেই হাত বুলিয়ে দিলেন ছোয়ার মাথায়। ছোয়া নিজের চাচিকে বলল,
‘আমি এখানে থাকব না বড়মা। আব্বুকে বলেছি তিনি এসে আমায় নিয়ে যাবেন। তোমার ছেলের এত বাজে কথা আমি সহ্য করতে পারবো না।’

জান্নাতুল খাতুন বলার মতো কিছু খুজে পেলেন না। ছেলেটা অতি আদরে বাদর হয়ে গেছে৷ ছোটবেলায় আব্দুল হোসেনের কারণে একটুও শাসন করতে পারেন নি ছেলেকে। তাই এখন সে মাথায় উঠে গেছে। আব্দুল হোসেনও এখন নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর!

২.
আব্দুল হোসেনের সামনে পকেটে হাত গুজে স্বাভাবিক ভাবে দাড়িয়ে আছে আমান। আব্দুল হোসেন সেই কখন থেকে আমানকে বকে যাচ্ছেন। কিন্তু আমান যেন কোন কিছু পরোয়াই করছে না। বরঞ্চ সে নিজের বাবাকে বলছে,
‘যদি তোমার ভাষণ শেষ হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে এখন কি আমি আমার রুমে যেতে পারি?’

আব্দুল হোসেন রেগে গেলেন নিজের ছেলের এমন কথায়। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে পাশে থাকা একটি ফুলদানি সজোরে ফেলে দিয়ে বললেন,
‘নিজের বাবার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানো না? আর কি বলেছ তুমি ছোয়াকে? যেই কারণে ও এভাবে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাইছে? কান খুলে শুনে রাখো এটা আমার বাড়ি। ছোয়া এখানে থাকবে, খাবে যা খুশি করবে তার খরচ আমি দেবো। তোমাকে সেসব নিয়ে না ভাবলেও চলবে। নিজে তো এখনো আমার টাকায় চলো। আর বড় বড় কথা।’

আমান তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
‘আমি তো ভুল কিছু বলিনি। আর তুমি নিজের ভাইয়ের মেয়ের হয়ে সাফাই করো না তো। আমার ভালো লাগছে না ঘুমাতে গেলাম।’

আব্দুল হোসেনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমান নিজের রুমে চলে গেল। জান্নাতুল খাতুন নিজের স্বামীর সামনে এসে বললেন,
‘দেখেছ এসবই হচ্ছে তোমার অতি আদরের ফল। ছোটবেলায় যখন শাসনের প্রয়োজন ছিল তখন তো ছেলেটাকে একটু শাসন করোও নি বরং আমি কিছু বললে আমাকে শাসিয়েছ। এখন তার ফল ভোগ করো।’

আব্দুল হোসেন বলেন,
‘না এভাবে সবকিছু চলতে পারে না। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই আমাদের ছেলেটাকে সামলাতে হবে।’

ইতিমধ্যে শাহাদ হোসেন সেখানে চলে আসেন। তাকে দেখে আব্দুল হোসেন ছুটে যায়। বলে,
‘শাহাদ তুই! আজকে যে আসবি সেটা তো একবারও বললি না। আগে বললে আমি নিজে গিয়ে তোকে নিয়ে আসতাম।’

শাহাদ হোসেন বলেন,
‘সেসবের কোন দরকার নেই ভাইয়া। তুমি আমাদের জন্য যথেষ্ট করেছ। আমি আমার মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি।’

তন্মধ্যে ছোয়া নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে হাজির হলো সেখানে। তার পেছন পেছন আলিয়াও এসেছে। সবেমাত্র দশম শ্রেণীতে পড়ে আলিয়া। তবে মেয়েটা অনেক ভালো। ছোয়ার সাথে তার অনেক ভাব। ছোয়াকে এভাবে ব্যাগ নিয়ে আসতে দেখেই আলিয়া তার পেছনে এসেছে। সে নিজের মায়ের কাছে সব শুনেছিল। তাই ছোয়ার কাছে নিজের ভাইয়ের হয়ে ক্ষমাও চেয়েছে।
ছোয়া এসে নিজের বাবার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘আমি তৈরি আব্বু। চলো আমরা এখন যাই।’

আলিয়া ছোয়ার হাত থেকে একপ্রকার টেনে ব্যাগগুলো নিয়ে নিলো। অতঃপর ঠোট উল্টিয়ে বাচ্চাদের মতো বলল,
‘প্লিজ ছোয়া আপুনি তুমি যেও না। কাল রাতে আমরা কত সুন্দর একসাথে গল্প করে কা’টিয়ে দিলাম। তুমি আমাকে কত পড়া বুঝিয়ে দিলে। তুমি চলে গেলে আমার ভালো লাগবে না। আব্বু-আম্মু তোমরা কিছু বলো।’

আব্দুল হোসেনও বলেন,
‘ছোয়া কোথাও যাবে না এখানেই থাকবে।’

কিন্তু ছোয়া বা শাহাদ হোসেন কেউই সেসব কথা শুনতে নারাজ। বিশেষ করে ছোয়ার তো একদমই ইচ্ছা নেই এত অপমানিত হওয়ার পরেও এখানে থাকার।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

#প্রেমের_পরশ
#পর্বঃ১
#লেখিকাঃদিশা_মনি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here