প্রেমের পরশ পর্ব -০৩

#প্রেমের_পরশ
#পর্বঃ৩
#লেখিকাঃদিশা_মনি

আমানের চোখে আর ঘুম আসে না সেদিন রাতে। সারা রাত্রি নির্ঘুমই কা’টিয়ে দেয় সে। অতঃপর সে নিজের ভুলটা উপলব্ধি করতে পারে। ছোয়ার সাথে খারাপ ব্যবহার করা তার একদম উচিৎ হয়নি। কারণ এই পুরো ব্যাপারটায় ছোয়ার তো কোন দোষ। এটা তো জরুরি নয় যে, আমরা যাকে ভালোবাসব সেও আমাদেরকে ভালোবাসবে। ছোয়ার মনে আমানের জন্য অনুভূতি নাই থাকতে পারে। তাছাড়া আমান তো ছোয়াকে কোনদিন নিজের মনের কথাও মুখ ফুটে বলে নি৷ তাই হয়তো ছোয়া এ বিষয়ে কিছু ভাবে নি। আমানের মনে এই চিন্তাটাও আসে যে, সে তো ছোয়ার সাথে খারাপ ব্যবহার না করলেও পারত। তাহলে হয়তো ছোয়া এই বাড়ি ছেড়ে যেত না। আর এই বাড়িতে থাকলে ছোয়া সবসময় আমানের চোখের সামনে থাকত। আমান যথেষ্ট সুযোগ পেত ছোয়ার মনে নিজের জন্য অনুভূতি তৈরি করার। কিন্তু রাগারাগি করতে গিয়ে এখন হিতে বিপরীত হয়ে গেছে। এইজন্যই বলা হয় রাগ মানুষের শত্রু।

আমান ভেবে পায় না যে, এখন কি করবে। ছোয়া যে এখন তার থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। তাছাড়া ছোয়ার মনে আমানের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। রাগে নিজের গালে নিজেরই থা’প্পর মা’রতে ইচ্ছা করছে আমানের। আমান কিছুক্ষণ ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে অতঃপর সিদ্ধান্ত নিল আজই ছোয়ার সাথে দেখা করবে সে। ছোয়া আমানেরই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। আমান অনার্স তৃতীয় বর্ষ আর ছোয়া প্রথম বর্ষে পড়ে। আমান ভাবল ছোয়ার সাথে দেখা করে তার কাছে ক্ষমা চাইবে, অতঃপর তাকে ফিরে আসার অনুরোধ করবে। এতে হয়তো কাজের কাজ কিছু হলেও হতে পারে।

যেমন ভাবা তেমন কাজ। পরদিন সকালে উঠেই আমান ডাইনিং টেবিলে এসে নিজের মা মতিয়া বেগমকে খাবার দেওয়ার জন্য তাড়া দিতে থাকে। মতিয়া বেগম স্যান্ডউইচ তৈরি করে এনে আমানের সামনে রেখে বলে,
‘আজ তেমন কিছু করতে পারিনি। স্যান্ডউইচ করেছি৷ এটাই খেয়ে নে।’

আমান সাথে সাথে টেবিল থেকে উঠল। নিজের মায়ের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
‘তুমি তো জানো আমি স্যান্ডউইচ খাই না। আমি এখন যাচ্ছি। বাইরে থেকে খেয়ে নেবো।’

মতিয়া বেগম বলে ওঠেন,
‘আমান শোন আমার কথা। এভাবে না খেয়ে যাস না,,,আমান।’

আমান কর্ণপাত করল না সেসব কথায়। নিজের মতো চলে যেতে লাগল।

৫.
ছোয়া আজ একটু দেরি ভার্সিটিতে এসেছে। মন মেজাজ একদম ভালো নেই তার। মূলত জ্যামের কারণে দেরি হয়ে গেছে তার। এই নিয়েই বিরক্ত ছিল সে। ভার্সিটিতে এসে নিজের ক্লাসের দিকে যাচ্ছিল ছোয়া। এমন সময় আমান তার সামনে এসে দাড়ায়। এমনিতেই ছোয়ার মনের অবস্থা ভালো ছিল না। তার উপর আমানকে নিজের সামনে দেখে তার মন মেজাজ প্রচণ্ড রকমের বিগড়ে যায়। ছোয়া নিজেকে শান্ত করে আমানকে পাশ কা’টিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখন আমান পুনরায় তার সামনে গিয়ে পথ আটকে দাড়ায়। বিরক্তিতে ছোয়া নিজের নাক মুখ কুচকে ফেলে। অতঃপর খানিকটা রাগী গলায় আমানের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘কেন আমার পথ আটকে দাড়াচ্ছেন আপনি ভাইয়া? আমার ক্লাসের জন্য এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। আমাকে যেতে দিন।’

আমান কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে শুধু ছোয়ার মুখ পানেই তাকিয়ে ছিল। ছোয়ার দৃষ্টি ছিল মাটির পানে। কারণ ছোয়া মাটির দিকে তাকিয়ে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছিল। আমান শান্ত গলায় বলে,
‘সরি।’

আমানের গলা থেকে নিঃসৃত ধ্বনি ছোয়ার কানে আসতেই সে বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় আমানের দিকে। আমানকে দেখে মনে হচ্ছিল না যে সে বাধ্য হয়ে ছোয়াকে সরি বলতে এসেছে। কারণ আমানের থেকে সরি শুনে ছোয়ার মনে প্রথমে এসেছিল হয়তো তার চাচার জোরাজুরিতে সরি বলতে এসেছে। কিন্তু আমানের দিকে তাকাতেই সেই ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়। ছোয়া একটু সময় নিয়ে বলে,
‘আপনি কি সত্যি মন থেকে আমার কাছে ক্ষমা চাইছেন ভাইয়া?’

আমানের সরল স্বীকারোক্তি,
‘হুম। আমি মন থেকেই সরি বলছি। তোকে ওভাবে অপমান করা আমার উচিৎ হয়নি। পারলে আমাকে ক্ষমা করিস। আর আমাদের বাড়িতে ফিরে চল।’

ছোয়া মৃদু হেসে বলে,
‘কেউ যদি তার ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চায় তাহলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিৎ। তাই আমি আপনাকে ক্ষমা করেই দিতে পারি ভাইয়া। তবে আমি আর আপনাদের বাড়িতে ফিরতে পারবো না।’

আমান ব্যকুলতা ভড়া গলায় বলে,
‘আমি তো ক্ষমা চাইছি। তাহলে কেন ফিরতে পারবি না তুই?’

ছোয়া বরাবরই দৃঢ় মনোভাব সম্পন্ন। তাই সে স্পষ্টভাবেই বলে দেয়,
‘তুমি আমার সাথে করা ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়েছ, আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু ঐ বাড়িতে আমি আর ফিরবো না। কারণ সবার আগে আমার আত্মসম্মান।’

আমান বুঝল ছোয়া একবার যখন ঠিক করে নিয়েছে আর তাদের বাড়িতে যাবে না তার মানে যাবে নাই। তাই আমান আর জোর করলো না। ছোয়া যে তাকে ক্ষমা করেছে এটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করল।

এই ভাবনা থেকেই ছোয়ার সামনে থেকে সরে আসল সে। অতঃপর ছোয়া নিজের ক্লাসের দিকে হাটা দিল।

৬.
ক্লাস শেষে নিজের বান্ধবী নাদিয়ার সাথে ক্যান্টিনে বসে ছিল ছোয়া। নাদিয়া ও ছোয়ার সেই কলেজ লাইফ থেকে বন্ধুত্ব। ছোয়াদের গ্রামে ভালো কোন কলেজ না থাকায় তাদের গ্রাম থেকে একটু দূরে জেলা শহরের কাছাকাছি একটা কলেজে পড়ত ছোয়া। সেখানেই নাদিয়ার সাথে তার পরিচয় অতঃপর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ভাগ্য ভালো থাকায় তারা একই ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। নাদিয়াই মূলত ছোয়াকে হোস্টেলে সিট পেতে সাহায্য করেছে।

নাদিয়ার কাছে সে আমানের ক্ষমা চাওয়ার ঘটনাটা নিয়ে কথা বলছিল। নাদিয়াও বেশ অবাক হয়েছে ছোয়ার কথা শুনে। কারণ ছোয়ার মুখে আমানের যেই ব্যবহারের কথা শুনেছে তাতে আমানের এই আচমকা ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারটা নাদিয়ার কাছেও ঠিক হজম হচ্ছিল না।

নাদিয়া ছোয়ার দিকে অবাক চাহনিতে তাকিয়ে বলে,
‘তুই ঠিক বলছিস তো? আচ্ছা তোর আমান ভাইয়ার কোন যমজ ভাই-টাই নেই তো?’

‘আরে না। আমান ভাইয়ার কোন যমজ ভাই নেই।’

‘তাহলে কেসটা একটু জটিল। যেই ছেলেটা তোকে এমনভাবে অপমান করল যে তুই ঐ বাড়ি থেকে চলে আসতে বাধ্য হলি সেই তোর কাছে ক্ষমা চাইল আবার তোকে ফিরে যেতেও বলব। স্ট্রেঞ্জ না ব্যাপারটা?’

ছোয়া কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল,
‘আমি এখন আর এসব নিয়ে ভাবতে চাইছি না। সামনে আমাদের এক্সাম। এখন ভালো করে প্রিপারেশন নিতে হবে।’

নাদিয়া ছোয়ার দিকে তাকিয়ে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
‘তোর আর কি চিন্তা? তুই ভালো রেজাল্টই করবি। চিন্তা তো আমার মতো স্টুডেন্টের। সারাবছর চিল করে পরীক্ষার আগের রাতে পড়তে বসি। টেনেটুনে পাস করতে পারলেই বাচি আরকি।’

নাদিয়ার এমন খামখেয়ালি মাখা কথা শুনে ছোয়া বলে,
‘এবার একটু পড়াশোনায় মন দে বোন। আমাদের মা-বাবা কত কষ্ট করে আমাদের জন্য। আমাদেরকে নিয়ে তাদের কত স্বপ্ন। একবার ভেবে দেখ তো আমাদের বয়সী কতো মেয়েই তো পড়াশোনার সুযোগ পায়না। হয় তাদের বিয়ে হয়ে যায় নয়তো পারিবারিক অসামর্থ্যের কারণে তাদের পড়াশোনায় ইতি টানতে হয়। সেখানে আমরা যে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছি সেটাই অনেক। ভালো রেজাল্ট না করলে তো চলবে না।’

নাদিয়া ফোন বের করে ফোন টেপায় মনযোগ দেয় আর বলে,
‘জ্ঞান দিস না দোস্ত। আমার দ্বারা তোর মতো সারাদিন বইয়ে মুখ ডুবিয়ে থাকা সম্ভব নয়।’

ছোয়া নাদিয়ার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলে,
‘ছোটবেলায় আমার চিন্তাধারাও তোর মতো ছিল। একদম পড়াশোনা করতাম না। সারাদিন গ্রাম ঘুরে বেড়াতাম। তারপর যখন অষ্টম শ্রেণীতে জেএসসি পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করি তখন খুব ভেঙে পড়েছিলাম। কারণ আব্বু আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন থেকেই আমার মনে জেদ তৈরি হয়েছিল৷ তাই তো আমি তখন থেকে পড়াশোনায় মনযোগ দেই। আব্বু-আম্মুর একমাত্র মেয়ে আমি। আব্বুর অনেক স্বপ্ন আমাকে নিয়ে। এখন নিজের পায়ে দাড়িয়ে তার স্বপ্ন পূরণ করলেই আমি খুশি হবো।’

নাদিয়া ছোয়াকে প্রশ্ন করে,
‘অনেক ভালোবাসিস তুই তোর আব্বুকে তাইনা?’

ছোয়া গর্ব করে বলে,
‘ভীষণ ভালোবাসি। আব্বুর মেয়ে হতে পেরে আমি গর্বিত। আমার আব্বুর মতো আব্বু অনেক ভাগ্য করে কপালে জোটে।’

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here