প্রেম পড়শী পর্ব -১৩+১৪

#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_১৩
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]

পুরোবাড়ি সুনশান ঘুমন্ত। এর মাঝে থেকে থেকে শোনা যাচ্ছে জয়তুননেসার চিৎকার।
তিনি না থেমে বলেই যাচ্ছেন একাধারে,
-“আব্বা! আমার কোলে ফিরা আয়। আল্লাহ আমার হায়াত তোরে দিয়া দিক।”

কলোনির মানুষ জড়োসড়ো হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তার ডাকা হয়েছিল, আর সে মাহফুজ সাহেবকে মৃত ঘোষণা করে দেন। মৃত্যুটা হয়েছে ভোররাতের দিকে, ঘুমন্ত অবস্থায়। শরীরটা নিথর হয়ে পড়ে আছে।

নাজমা স্বীয় স্বামীর একপাশে দাঁড়িয়ে কেবল তাকে দেখছে। সে চোখে হাহাকার নেই, আফসোস নেই। কান্নারাও শুকনো; আসছে না। সে দু’চোখ ভরে শেষ দেখাটা দেখে যাচ্ছে। নাফসিনকে নুরশীনের সাথে রুমে রেখে এসেছে, বেরোতে মানা করেছে। নিজ তলার ভাড়াটিয়ার মেয়ে দুটো নাফসিন-নুরশীনের সাথে বসে আছে। নুরশীন বুঝতে পারার সাথে সাথেই মেয়ে দুটোকে নাফসিনের খেয়াল রাখতে বলে মাহফুজ সাহেবের রুমে চলে এলো। প্রিয় বাবাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে অবাক হলো। বোঝার বয়স তার হয়েছে। কান্না পেল খুব। বাবাকে উঠতে বলার তাগিদ দিতে ইচ্ছে করল। তবুও বাবার কাছে গেল না। মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নাজমা ওর দিকে তাকাতেই ও ঠোঁট উলটে ফোঁপাতে লাগল।

নাজমা মলিন চোখে তাকিয়ে বলল,
-“আসতে বারণ করেছিলাম না?”

নুরশীন ঝাপটে ধরল নাজমাকে। বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“বা-বা!”

নাজমার সহজ উত্তর,
-“কিচ্ছু হয়নি।”

সবাই স্বান্তনা দিচ্ছে। কিন্তু সেগুলো নুরশীনের কানে লাগছে না। সে হাউমাউ করে কেঁদে যাচ্ছে। নাজমা মাহফুজ সাহেবকে দেখছে, একহাতে নুরশীনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মুখ দিয়ে ক্রমাগতভাবে উচ্চারণ করে যাচ্ছে মুখস্ত শব্দটা,
-“কিচ্ছু হয়নি, কিচ্ছু না।”

এতদিন কেবল নিজেকে বলেছিল, আজ মেয়েকেও বলল। কিচ্ছু হয়নি! আসলেই কি কিছুই হয়নি?
নুরশীনের কান্না আস্তে-ধীরে থামে। হেচকি উঠে যায়। বয়স সবে এগারো। আর এতেই মেয়েটা অনেক কিছু বুঝে ফেলেছে। বাবার জন্য এতদিনের ভালোবাসাটা কান্নারূপে বেরিয়ে আসার পরই চাপা রাগটা তা দমিয়ে ফেলল। পুরো দমে নিজেকে শান্ত করে নাজমাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল।

কলোনির মানুষরা কত কথা বলছে! মাস খানেকের ব্যবধানে স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যু হলো। পরের পক্ষের স্ত্রী বিধবা হওয়াতে চোখের জল ফেলেছে না। মেয়েও খানিক কেঁদে শান্ত হয়ে গেল। বড়ো মেয়ে বাবার লাশটা অবধি দেখতে এলো না।

এদিকে রূশী আর রুমা হতবিহবল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পরিস্থিতি প্রতিকূলে। আত্মীয়সজন বলতে যারা ছিল, দুপুরের আগেই চলে এলো সবাই।

______
রঙ্গন এত মানুষকে পাশ কাটিয়ে সোজা মোহর রুমে ঢোকে। মোহ বারান্দার মেঝেতে বসে আছে। হাঁটু দু’টো বুকের সাথে ঠেকানো। মাথাটা হেলে দেওয়া দেয়ালে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে শুকিয়ে গেছে, কার্ণিশের শুষ্কতাতে তা স্পষ্ট।

মোহকে এতটা স্থির থাকতে দেখে রঙ্গন স্তব্ধ বনে গেল। এলোমেলো পায়ে মোহর সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। মোহর চোখ গেল রঙ্গনের দিকে। কিছু বলল না।

রঙ্গন মোহর গালে মাথায় হাত রাখল। ভরসার হাতটা পেয়েই মোহ বলে উঠল,
-“সবাই বেইমান। সব স্বার্থপর। মানুষ হয়ে জন্মে এখন নিজের প্রতি ঘেন্না আসছে।”

রঙ্গন অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল। মোহ রঙ্গনের হাতটা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলে বলল,
-“রঙ্গন! আমার কান্না করা উচিত, তাই-না?”
-“হু-উম।”
-“আশ্চর্য, আমার কান্না পাচ্ছে না!”

তবে কি মোহর অন্তর পুড়ছে? শোনা যায়—কষ্টের আগুন ভেতরটা স্পর্শ করে ফেললে, যন্ত্রণারা আর গা-ছোঁয়া হয় না। রঙ্গনকে চুপচাপ নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মোহ এগিয়ে গেল। কণ্ঠে এক রাশ যন্ত্রণা এনে বলল,
-“রঙ্গন, আমায় একটু জড়িয়ো ধরো। আজ থেকে সত্যিকার অর্থেই তুমি ছাড়া আমার কেউ রইল না।”

রঙ্গন দূরত্ব মেটাল। মোহকে বুকে চেপে ধরে বলল,
-“চলো, আঙ্কেলকে দেখে আসবে।”

মোহর অবিচল জবাব,
-“না।”
-“কেন?”
-“স্বার্থপরদের মুখ দেখা পাপ।”
-“মোহ, এটা শেষ দেখা।”
-“শেষ দেখা, প্রথম দেখা বলে কিছু হয় না, রঙ্গন। মন থেকে উঠে গেলে, ওই দিনটাই অপর মানুষটার জন্য আমাদের জীবনের শেষ দিন হয়।”

রঙ্গন আরও কিছু বলতে গেলে, মোহ রঙ্গনকে ছেড়ে সরে এলো। অসম্ভব শক্ত নারীটি রঙ্গনের চোখে চোখ রেখে বলল,
-“আমার এখন আর তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যাও।”
-“মোহ..”
-“ওদিকটা সামলাও।”

রঙ্গন বুঝতে পারল—মোহ প্রিভিসি চাইছে। কিছু কিছু মানুষ নিজের দূর্বলতা সজ্ঞানে কাউকে দেখাতে চায় না। মোহর ভেতরে কেমন লাগছে, রঙ্গন তা রিলেট করতে পারছে। মোহকে তবুও আরেকবার বলল,
-“চলো, বাবাকে দেখে আসবে।”
-“আমার কোনো বাবা নেই।”

মোহর কাঠকাঠ জবাব। রঙ্গন ফোন বের করে রুমাকে কল দিয়ে বলল,
-“রুমটা খালি করাও, মা। সবাইকে ড্রইংরুমে নিয়ে যাও।”

তারপর মোহকে প্রায় টেনে দাঁড় করাল। হাতটা নিজের হাতের ভাঁজে রেখেই বলল,
-“কেবল ৫-মিনিট।”
-“রঙ্গন, আমার ইচ্ছে করছে না।”
-“তবুও যাবে, চলো।”

রঙ্গন মোহর হাত ধরে এগোতে লাগল। হাতে টান লাগায় মোহ নিজেও অনিচ্ছাকৃত এগোচ্ছে। এবার আর বাঁধ সাধল না। রঙ্গনের পায়ের সাথে পা মিলিয়ে এগোতে লাগল। প্রতিটা দেয়াল তার শৈশবের গান গাইছে। এই-যে, রুমের দরজা! মাহফুজ সাহেব রোজ বাড়ি ফিরে সবার আগে এই দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেন। আর বলতেন, ‘মামনি, আমি ফিরেছি। আসো, একটু সুখ-দুঃখের গল্প করি।’

রোজ ফেরার পথে মোহর জন্য ফুচকা আনতেন; মোহর বায়না নয়, তবে এতে মাহফুজ সাহেবের স্বস্তি ছিল। মোহ অবাক হয়ে এগোতে থাকে। সময় পরিস্থিতিকে ঠিক কীভাবে পালটে দিতে পারে। মোহর অসম্ভব রকমের বুক কাঁপছে। মনে মনে ফরিয়াদ করে উঠছে,
‘বাবা, তুমি কী করেছিলে এটা? কেন করেছিলে? আমি তোমার জন্য কান্নাও করতে পারছি না।’

মোহ রুমে পৌঁছে নিথর শরীরটার দিকে তাকানোর আগে একবার চারপাশ দেখল। জয়তুননেসাকে অন্যরুমে রাখা হয়েছে, তিনি সেন্সলেস হয়ে গেছেন। নাজমা আর নুরশীন দরজার কিনারায় দাঁড়িয়ে। রুমা আর রূশী আরেকপাশে। মোহ রঙ্গনের থেকে হাত ছাড়িয়ে বাবার কাছে গেল।
তার মনে পড়ছে বিগত ক’দিনের কথা। বিগত ক’দিন সে মাহফুজ সাহেবকে এড়িয়ে গেছে। মাহফুজ সাহেবের চোখের প্রবল আকুতি সে অবশ্যই শুনতে পেরেছে।

মোহ সামনে বসল। মিনিট তিনেক তাকিয়ে থাকল। চোখের তারায় ভাসছে সেই তিন সদস্যের ছোট্ট পরিবারটি। মোহ স্বল্পভাষী। তাই কথাগুলো তার বাবাই তার সাথে বেশি বলত। বার বার বলত,
-“মোহ মামনি, শোনো। যে-কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দশবার ভাববে। এরপর গিয়ে সব বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। তোমার একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য সারা জীবন আফসোস করা লাগতে পারে। স্বল্পভাষী মানুষদের আফসোস হয় সবচেয়ে বেশি। তারা নিজের অনুশোচনার গল্পটা কাউকে বলতে না পারার দুঃখে আজীবন কাতর।”

এই কথাগুলোর সাথে মোহ সংযোগ স্থাপন করতে পারছে। মোহর তখন মনে না এলেও, এখন খুব মনে হচ্ছে। মনে পড়ছে কিছু কথা,
-“তোমার আফসোসটুকু কী ছিল? বলতে না পারা? ওটা আফসোস না, শাস্তি ছিল। কিন্তু আমি তোমাকে এভাবে দেখতে চাইনি। আব্বু, আমার ছোটোবেলার আব্বু হয়ে যাও না! আমার নিজের আব্বু। আল্লাহ! আমি শেষদিনগুলোতে তোমাকে আব্বু ডাকতে পারিনি, আজও পারছি না। তুমি কেন করলে এরকম? আব্বু, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কান্না পাচ্ছে না।”

মোহ আর তাকিয়ে থাকতে পারছে না, উঠে ছুটে চলে গেল নিজের রুমে। দরজা বন্ধ করে দিয়ে ফোঁপাতে লাগল। তার সাজানো গোছানো ছোট্ট পরিবারটা ভেঙে গেল। শেফা থাকলে আজ এতটা একা লাগত না। তার বাবা কী করে পারল তাদের সাথে বেইমানি করতে? কেন করেছে? কেন আরেকটা বিয়ে করল? কে বলবে এখন এসব?
মস্তিষ্ক খারাপ হতে লাগল।

দাফনকাজ শেষে দুপুরের পর রঙ্গন ফিরল। মোহকে জোর করেও কিছু খাওয়াতে পারল না। মেয়েটা নিজেকে রুমবন্দী করে নিয়েছে। রাতে যখন রুম থেকে বেরোল, তখন সব যেন স্বাভাবিক। কোনো রকমের অস্বাভাবিক আচরণ করল না সে। চুপচাপ নিজের মতো এসে খেয়ে নিল। তারপর রুমে গিয়ে দুটো স্লিপিং পিল নিয়ে ঘুম দিলো।

_____
সকালে মোহ ঘুম থেকে উঠল দুপুর দুটোর পর। মাথাটা ভারি ভারি লাগছে। কালকের দিনটা মনে পড়তেই সে আবার চোখ বুজে নিল। বন্ধরত চোখের পাতায় দু’জন মানুষের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত; মাহফুজ সাহেব আর শেফা।

মোহ দ্বিতীয়বার চোখ খুলে উঠে বসতে গেলে, পাশে রঙ্গনকে খেয়াল করল। কোমল গলায় বলল,
-“দরজা লাগানো ছিল!”

রঙ্গন শুয়ে আছে। কপালের ওপর হাত, চোখ দুটো বন্ধ। সেভাবে থেকেই বলল,
-“ডিপ্রেসড একটা মেয়ে অ্যাবনরমাল বিহেভ করে সারারাত একা ঘরে ছিল, আর সকালে দরজা খুলছিল না। তাকে ওভাবেই ফেলে রেখে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরব?”
-“হু?”

রঙ্গন চোখ খুলল। ভয়াবহ লাল তার চোখ। ত্বরিতে মোহর কাছাকাছি এসে বলে উঠল,
-“একটা থাপ্পড় মেরে হ্যাঁ/হুঁ ছুটিয়ে দেবো। সকালে দরজা খুলছিলে না বলে কলিজা শুকিয়ে গেছিল আমার। এক্সট্রা কি দিয়ে ভেতরে এসে দেখি মেডিসিন গিলে মরার মতো ঘুমাচ্ছ। একেবারে মেরে দিই?”

মোহ মলিন চোখে রঙ্গনকে দেখল। রঙ্গনের বুকের বাঁ-পাশটায় আঙ্গুল ঠেকিয়ে বলল,
-“এইখানটায় আমি ছাড়া অন্য কেউ এলে—আই সোয়্যার, আমি তোমাকে মেরে দেবো।”

চলবে…#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_১৪
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]

-“একটা থাপ্পড় মেরে হ্যাঁ/হুঁ ছুটিয়ে দেবো। সকালে দরজা খুলছিলে না বলে কলিজা শুকিয়ে গেছিল আমার। এক্সট্রা কি দিয়ে ভেতরে এসে দেখি মেডিসিন গিলে মরার মতো ঘুমাচ্ছ। একেবারে মেরে দিই?”

মোহ মলিন চোখে রঙ্গনকে দেখল। রঙ্গনের বুকের বাঁ-পাশটায় আঙ্গুল ঠেকিয়ে বলল,
-“এইখানটায় আমি ছাড়া অন্য কেউ, আই সোয়্যার, আমি তোমাকে মেরে দেবো।”

রঙ্গন নির্নিমেষ চোখে মোহকে অবলোকন করল। মেয়েটার মাঝের তেজটা বেড়েই চলেছে, যেখানে কালকের ঘটনায় তার নেতিয়ে পড়ার কথা! মেয়ে মানুষ অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে। তারা সব কিছু স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে জানে, ঠিক তেমনই মিনিটের ব্যবধানে মানিয়ে নিতেও জানে।
রঙ্গনের ইচ্ছে হলো, মোহর বাবার ব্যাপারে সবটা মোহকে জানাতে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে দমিয়ে ফেলল। এ-বিষয়টাকে এখানেই ক্লোজ করে দেওয়াই ভালো।

মোহ উঠে ফ্রেশ হয়ে এলো। ফিরে রঙ্গনকে বেডশিট গোছাতে দেখল। মোহ পাশকাটিয়ে ডাইনিংয়ে চলে এলো। আত্মীয়-স্বজনে গিজগিজ করছে বাড়িটা। মোহর ফুপি ও কাকারাও এসেছে। মোহকে দেখে ক’জন এগিয়ে এলো। বিভিন্নভাবে স্বান্তনা দিতে লাগল। মোহর সেগুলোর খুব একটা প্রয়োজন পড়ছে না। সে কিচেন থেকে খাবার বেড়ে এনে ডাইনিংয়ের চেয়ার টেনে বসে খেতে লাগল।

মোহর এরূপ আচরণে বাকিরা মুখ কুঁচকে বিভিন্ন কথা-বার্তা বানাতে লাগল। অনেকে তো এ-ও বলছে—বাপের সম্পত্তি যেন পরের পক্ষের বাচ্চারা না পায়, এজন্য সব লিখে নিয়ে বাপকে মেরে দিয়েছে মোহ নিজেই। কী স্টুপিড কথা-বার্তা!

মোহ আপন তালে খাওয়া শেষ করল। হাত ধুয়ে আবার রুমে ফিরে যেতে গেলে, তার কাকি আটকে ফেলে। চতুর চোখে তাকিয়ে বলে,
-“মোহনা, কিছু কথা আছে তোমার সাথে।”

মোহ তার দিকে তাকাল, নিজ স্বভাবে আবৃত থেকেই বলল,
-“বলুন।”
-“আমার সাথে চলো।”

রেনু মোহর হাত ধরে তাকে একটু ভেতরের দিকে নিয়ে এলো। এখানে লোক সমাগম নেই। রেনু আশপাশটা দেখে মোহকে শুধাল,
-“নাজমা আসার পর আমরা যেদিন এসেছিলাম, সেদিন কি তোমাকে সাবধান করিনি?”

মোহর মনে পড়ে গেল সেই দিনের কথাটা। নাজমা এ-বাড়িতে আসার পরই কাকা-কাকিরা এসেছিল। রেনু মোহকে অনেক বুঝিয়েছে। সব কিছু মেনে নিতে অবশ্য বলেনি, কিন্তু কারো সাথে কোনো ঝামেলা করতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। মোহ এমনিতেও কোনো ঝামেলা করত না।

রেনু আবার বলল,
-“ভাইয়ার মারা যাওয়ার পেছনে কোনোভাবে তোমার হাত তো নেই, মোহনা?”

মোহর হাত একেবারেই নেই বললে ভুল হবে। অতিরিক্ত মানসিক চাপে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের কারণে মাহফুজ সাহেবের মৃত্যু হয়েছে। আর সেই মানসিক চাপটার ৮০-শতাংশ মোহর দেওয়া।

মোহ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
-“তা কেন মনে হলো?”
-“কারণ তোমার বাবা খুব ফিট একজন মানুষ ছিলেন। এভাবে অকালে চলে যাওয়ার মানেই নেই!”

মোহ হাসতে লাগল,
-“আমার আম্মুকেও তো এত জলদি হারানোর কোনো মানে ছিল না। তবুও হারালাম। তবে কি আমার বলা উচিত—আম্মুর মৃত্যুটাও রহস্য। আচ্ছা, আপনার সাথে পেঁচিয়ে লাভ নেই। খুলেই বলি। আমার কি ভাবা উচিত—আম্মুকে খুন করা হয়েছে? আমার আব্বু খুন করেছে?”

-“তোমার আব্বু-আম্মুর মাঝের বন্ডিংটা তুমি জানো, মোহনা। তারা একে-অপরকে সামান্য আঘাত দিয়েও কোনো কথা বলতে জানে না।”

-“আমার আব্বুকে আমি এতকাল নিজের একার আব্বু জানতাম। শেষমেষ তো ঠিকই দেখলাম—তাকে ডাকার জন্য আরও দু’জন আছে।”

-“মৃত মানুষের প্রতি এত অভিযোগ?”
-“ঠিক অভিযোগ না। চাপা ক্ষোভ। আরও একশ মরন মরলেও, এই ক্ষোভগুলো যাবে না, কাকিমা।”

-“মানুষটা আর নেই, রাগটা কমাও!”
-“মানুষটা আমার অস্তিত্বে মিশে আছে। যতদিন মনে থাকবে, ততদিন রাগগুলো নামবে না। এদিকে তাকে ভোলাটাও অসম্ভব।”

রেনু গভীর শ্বাস ফেলে বলল,
-“রাগটা তবে ভেতরে ভেতরেই দেখাও। বাইরে খানিকটা মূর্ছা যাওয়ার অভিনয় করো। বাইরের মানুষের সামনে কেন নিজের রাগ প্রকাশ করবে? এরা তোমার মনের ব্যথা বুঝবে না। তুমি যা দেখাবে, এরা তাই দেখবে। এরা তোমার দেখানোর ওপর ভর করে মনগড়া কাহিনি বানাবে।”

মোহ সরু চোখে তাকায়। রেনু আবার বলে,
-“তুমি কি জানো—এরা তোমাকে খুনি বানিয়ে দিচ্ছে? তুমি তোমার বাবার মৃত্যুতে কাঁদোনি বলে, এরা তোমাকে তারই মৃত্যুর দায়ী বানাচ্ছে। তোমাকে একা নয়। নাজমাকেও এরা ছাড়ছে না। আমি জানি—ভাইয়ার মৃত্যুটা কীভাবে হয়েছে। কিন্তু এরা ভাবছে, তোমাদের পারিবারিক কূটকৌশলে লোকটার মৃত্যু হয়েছে। কতটা হীন ভাবনা, ভাবতে পারছ?”

মোহ থেকে থেকে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলে,
-“পারছি।”
-“এজন্য বলছি—স্বাভাবিক আচরণ করো।”
-“আমি কি অস্বাভাবিক আচরণ করছি?”
-“অবশ্যই। এখন তোমার উচিত কান্না করা। সেটাই স্বাভাবিক। আর তুমি তা করছ না।”
-“আমার কান্না না পেলে কী করব?”
-“নাটক করবে। নাটক করে কাঁদবে। মেয়েরা অভিনয়ে নিঁখুত হয়।”
-“পারব না, দুঃখিত! এতে যার যা ইচ্ছা ভাবনা হয়, ভাবুক।”

রেনু থেমে যায়। মোহর মাথায় হাত রেখে বলে,
-“মোহনা, আমি তোমায় বিয়ে করাতে চাই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই আম্মার সাথে এই নিয়ে কথা বলব। তোমার কী মতামত?”

মোহনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-“এ-নিয়ে ভাবতে হবে না আপনাদের।”
-“কেন? পছন্দ করা আছে?”
-“আছে।”
-“কে?”
-“সময়মতো আয়োজন সমেত জানিয়ে দেওয়া হবে।”
-“অপেক্ষায় রইলাম।”

______
মাহফুজ সাহেবের মৃত্যুর পরের সাতদিনের স্তব্ধতা কাঁপিয়ে তুলল পুরো কলোনি। চারপাশে নানান গুঞ্জন! বলা যায়, আলোচনার শীর্ষে অবস্থান করছে এই বাড়ির ঘটনাগুলো। পান থেকে চুন খসলেও তা নিয়ে হয় বিস্তর বৈঠকী গল্প।

একটা মিটিং হ্যান্ডেলের জন্য মাহফুজ সাহেবের দেশের বাহিরে যাওয়ার কথা ছিল। তাঁর স্থানে সময়মতো রঙ্গন চলে যাবে। সপ্তাহখানেক পর ফিরবে। সব প্যাকিং শেষে রঙ্গন এ-বাড়িতে এসে মোহর রুমে গেল। এ-কয়দিন বাড়িতে মানুষ ভর্তি হওয়ায় মোহর কাছ ঘেঁষাটাও কষ্টসাধ্য ছিল।

মোহ কাউচে নিজের পুরোনো ডাকবাক্সটা নিয়ে বসে ছিল। অসংখ্য রঙ-বেরঙের চিঠি আর চিরকুট সেন্টার টেবিলে এলোথেলোভাবে ফেলে রাখা। মোহ একটা একটা করে দেখছে। পুরোনো স্মৃতি অন্তরে শান্তির হাওয়া সৃষ্টি করে, অতীত থেকে তৈরি সেই হাওয়া বর্তমানের অস্তিত্বশীল অগ্নিকে বাড়িয়ে দেয়। মোহর অবস্থা অনেকটা তেমনই।

রঙ্গন রুমে এসে দরজা আটকে দিলো। মোহর সামনের টেবিলের কাগজগুলো একপাশে সরিয়ে সেখানে বসে পড়ল। মোহ শুধিয়ে উঠল,
-“হঠাৎ এলে?”

রঙ্গনের ঠোঁটের আগায় এনে রাখা জবাবটা সে দিলো,
-“আমাদের প্ল্যান করে কিছু হয়নি।”

মোহ দু’দিকে মাথা নাড়ায়,
-“তা বটে!”
-“মোহ, তুমি তো জানোই আমাকে সিঙ্গাপুর যেতে হবে।”
-“হুম..”
-“সন্ধ্যার পর ফ্লাইট।”
-“ওহ! একটু পরই তো বেরোবে তবে!”

মোহর দায়সারা কথাবার্তা রঙ্গনের আজ ভালো লাগছে না। রঙ্গন হ্যাঁচকা টানে মোহকে নিজের উরুর ওপর এনে বসাল। এক হাত কোমরে স্থির ও অন্য হাত ক্রমাগত মোহর গাল ও গলার সন্ধিক্ষণে স্লাইড করে যাচ্ছে। মোহ নিজের ভার রাখতে রঙ্গনের কাঁধের কাছের টিশার্টটি আঁকড়ে ধরেছে। রঙ্গন ঘন ঘন শ্বাস ফেলে বলল,
-“তোমাকে না ছুঁয়ে থাকতে পারি না, তোমার কি আমার থাকা না-থাকাতে কিছু আসছে-যাচ্ছে না?”

মোহ হিমায়িত চোখে তাকিয়ে রয়। তাতে রঙ্গন আরও খানিকটা জোর প্রয়োগ করে দূরত্বটা মিটিয়ে নেয়। মোহ বলে উঠে,
-“সামাজিক স্বীকৃতি হিসেবে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান চাই।”

রঙ্গন হতাশ হয়ে বলে,
-“তোমার বাবা মারা গেছে ক’দিন আগেই। এখন সম্ভব নয়, সোনা।”
-“কেন সম্ভব নয়?”

এই প্রশ্নটা করার মতো অবুঝ মোহ নয়। রঙ্গন তা জানে। আর প্রশ্নটা থেকে পাওয়া উত্তরে প্রেক্ষিতে যে মোহ ধারালো কিছু একটা বলবে—তারও আন্দাজ রঙ্গনের আছে।

রঙ্গন মোহর সমগ্র মুখে চোখ বুলিয়ে বলল,
-“তোমার অনুভূতি সম্পর্কে কেবল তোমার কাছের মানুষরাই বুঝবে। সমাজ মজা নিতে এক চুল ছাড়ও দেবে না।”
-“সেই সমাজের তোয়াক্কা আমি করি না, যেই সমাজ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে পারে না অথচ বিপদে ঠেলে দিতে দু’বার ভাবে বা। সেই সমাজকে এই মোহ তোয়াক্কা করে না, যেই সমাজ মোহনার চাঞ্চল্যকে মোহর নিশ্চুপতায় পরিণত করতে চেয়েছিল..খানিকটা সাফল্য পেয়েছেও!”

কথাগুলো কতটা গভীর ছিল তা আপাতদৃষ্টিতে খেয়াল করে বোঝার উপায় নেই। রঙ্গন চাক্ষুষ বান্দা, সদাজাগ্রত চোখে তাকিয়ে রইল। মোহ তা খেয়াল করে হেসে ওঠে। যেই হাসিতে প্রাণ নেই, নিঃসন্দেহে সেই হাসি ভয়ঙ্কর; মৃত হাসি মৃত মানুষ অপেক্ষা অধিক ভয়ঙ্কর।

রঙ্গনের যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে প্রায়। সে মোহর কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল। ফিসফিসিয়ে বলল,
-“তোমাকে ছাড়া আমি এক দণ্ড স্বস্তিও পাই না। মোহ, আমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব তোমার।”

মোহ নরম গলায় মিনমিনে আওয়াজে বলল,
-“হু..”

রঙ্গন একই ভঙ্গিতে ফের বলল,
-“টেক কেয়ার অব্ ইওয়োর হার্ট, মাই লাভ!”

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here