প্রেম পড়শী পর্ব -১৫+১৬

#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_১৫
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]

“অয়স্কান্ত না-কি প্রাণ?
কিংবা অভ্রান্ত? আর সহসা অধিকার!
কী বলে ডাকি তোমায়? তোমায় বরং আমি আমার ‘নিজস্বতা’ বলেই ডাকি, কেমন?

অসংবেদনশীল নিজস্বতা,
বিশেষণটির জন্য তোমার খারাপ লাগলে, আমি খানিকটাও বিচলিত হব না। তোমার খারাপ লাগা অবশ্যম্ভাবী। কেননা তুমি থমকেছ আমার মতন পাষণ্ডীর প্রমত্ততায়। কেননা আমি নিষ্ঠুর, আমি উগ্র, আমি ক্রূরমতি, আমি অকরুণ, আমি যন্ত্রণাপদ, আমি হৃদহীনা।
আর?
আমি অসুখ, আমি সঁজীবনী,
আমি বিচ্ছেদ, আমি আসঙ্গী।
আমি অবিনাশী, আমিই বিনাশিনী।

মধ্যাস্থে আমি কদর্য। অথচ, তুমি আমার হীন হৃদয়ের এক ভারি দুঃসাহস।
তুমি আমার ত্রপিত কায়ার দুর্বিনীত কৃতি..
তুমি আমার ত্রপিত কায়ার বেহায়াপনা, ঔদ্ধত্য, আস্পর্ধা, চপলতা, ধৃষ্টতা।
আমি অভিশঙ্কী। অন্যথায় ধ্রুব, অবধারণীয়।
আমি তত্রাচ, স্বল্পোক্তিপ্রবণীয়। আমি অধিষ্ঠিত, অস্তিত্বশীল।

তুমি অতীতকে আঁকড়ে থাকা সম্মুখে দণ্ডায়মান কাল; তমসাচ্ছন্ন, ক্ষীণালোকীয়। আমি বিদ্যমান, ঘটমান; অঁজিষ্ণুর ন্যায় নিশিত।
তুমি সুহৃৎ। আমি দ্বীষৎ, আমি মৃত্যু।
তুমি স্থির। আমি তোমার স্থিরত্বের মাঝের বিস্তর চঁচলতা, অধীরতা।
উপসংহারে আমি তোমার নিষিদ্ধতা, আমি তোমার নিজস্বতা। যেমনটা আমার ক্ষেত্রে তুমি খানিকটা।
আর আমি দুযতি,
উদ্দীপ্ত আগুনের শিখার মাঝেও স্থির নীলত্বের ছায়া বিদ্যমান। ওটা তুমি।

ইতি
তোমার প্রতিমুখ!
২২/১১/২০১৯ (মঙ্গলবার)”

রঙ্গনের যাওয়ার পর মোহ ডাকবাক্সের চিঠিগুলো নিয়ে বসেছিল। এই চিঠিটা ছিল রঙ্গনকে দেওয়া তার অষ্টম চিঠি। রঙ্গন এটা হাতে হাতে পেয়েছিল। মোহ সেদিন চিঠিটা রঙ্গনের মুখের সামনে নাড়াতে নাড়াতে বলল,
-“বাবুসাহেব, চিঠি এসেছে। পড়তে চান?”

রঙ্গন ততদিনে অসন্দিগ্ধ—চিঠি পেতে হলে, তাকে অবশ্যই কিছু দিতে হবে। তাই অজ্ঞতা না দেখিয়ে মাথা উপর-নিচে নেড়ে বলল,
-“বিনিময়ে কী চাই?”

মোহ ভাবলেশহীন জবাব দেয়,
-“গাড়ি চালানো শেখাতে হবে।”

রঙ্গন চকিতে বলে ওঠে,
-“তুমি আন্ডার এইটিন..”

মোহ নির্বিকার,
-“তো? জীবনে শখ-আহ্লাদ বলে কিছু নেই নাকি?”
-“তা কখন বললাম?”
-“তবে আটকাচ্ছ কেন?”
-“তোমার সেফটির প্রসঙ্গ এলে, আমি যে-কোনো কিছুতে ফুলস্টপ টেনে দিতে পারি।”

মোহ সরু চোখে তাকিয়ে বলে,
-“তো তোমাকে কে বলল—ড্রাইভিং শেখা খুবই আনসিকিউরড কিছু?”

রঙ্গন পালটা শুধায়,
-“কথার প্যাঁচে না ফেলে একদম শেষ মাথায় গিয়ে ঝেড়ে কাশো।”

মোহ সত্যি সত্যি খানিকটা কেশে বলল,
-“শিখিয়ে রাখো, এখন হুটহাট গাড়ি নিয়ে বেরোব না।”
-“তোমাকে বিশ্বাস করব বলছ?”
-“আমি শত ভুল করলেও, আমাকে অবিশ্বাস করার তোমার কোনো ওয়ে নেই, রঙ্গনদা। একচ্যুয়ালি তুমি পারবেও না।”

রঙ্গন হেরে গিয়ে অবশেষে বলল,
-“ওকে, শেখাব। এবার চিঠিটা দাও।”

মোহ চিঠিটা আলগোছে খানিকটা দূরে সরিয়ে বলল,
-“আমার শেখা হয়ে গেলেই পাবে। হাতে হাতে কাজ হবে। হু?”

তারপর আর এই চিঠিটা রঙ্গনকে দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি বারান্দা বলে, একে-অপরকে অজস্র চিঠি, চিরকুট ছোঁড়া হতো সময়ে-অসময়ে। মোহ সে-সবই এই ডাক বাক্সে রেখে দিয়েছিল। ক’টা চিঠি তার নিজের লেখা, যা রঙ্গনের হাতে যায়নি এখনও। এই চিঠিটাও সেরকম একটা। মোহ তড়াক করে উঠে দাঁড়াল।

বারান্দায় গিয়ে গলার আওয়াজটা খানিক উঁচুতে তুলে ডাকল,
-“র-ঙ্গ-ন!”

রঙ্গন বেরোবে বেরোবে মুহূর্তে মোহর আওয়াজ পেয়ে বারান্দায় ফিরে আসে। মোহ চিঠিটি হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়, তা সামনের বারান্দাটিতে পড়া মাত্র মোহ বলে ওঠে,
-“উড়ো চিঠি, তাকে বলে দিয়ো। প্রেম নোঙরের নাবিক বানানোতে ড্রাইভিং না শেখানোর ক্ষমা মঞ্জুর হলো। অবশেষে তার দ্বার গোড়ায় তার সম্মানীটা পাঠালাম। চার বছর পুরোনো চিঠি কিন্তু! ফিরতি চিঠি তৈরির সংকল্প যেন পড়া মাত্র গাঁথা হয়!”

রঙ্গন চিঠিটা নিয়ে নিল। মোহ ঘুরে রুমের ভেতর চলে এলো। রঙ্গন চলে গেল ঘন্টার মাঝেই। মোহ চিঠিগুলো গুছিয়ে ফের বাক্সবন্দী করে কেবিনেটে তুলে রাখল। কাউচে বসল। সেন্টার টেবিল থেকে পানির বোতল নিল। অর্ধেকটা খেয়ে জায়গামতো রেখে গা এলিয়ে দিলো। গরম লাগছে, এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিলো। অন্তস্তলের অস্থিরতা মোহ অনুভব করতে পারছে।
ভাবপ্রবণতারা রাজত্ব চালাচ্ছে সর্বক্ষণে, সর্বাঙ্গে। কানের কাছ দিয়ে এগোতে থাকা অগ্নিসখেরা গুন-গুন করছে,
-“রঙ্গন নেই, রঙ্গন নেই..”

মোহ অস্থিরতা ক্রমে বাড়তে থাকে। সে হাঁসফাঁস করতে লাগে। হাঁটু মুড়ে ফ্লোরে বসে পড়ে।
থরথর করে কাঁপতে লাগে। হাত-পা কাঁপছে, বুকের ভেতরটা কাঁপছে। দমবন্ধকর লাগছে। এতদিন রঙ্গনের পাশে থেকে আর নিজেকে সময় দিতে পারেনি। অতিমাত্রায় ফর্সা হওয়ায়, কাঁদলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দৃঢ়; তাই কাঁদেনি।
আজ মোহর নিজেকে সময় দিতে ইচ্ছে করছে, কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আস্তে-ধীরে ফোঁপাতে লাগে। কান্নারা যখন আওয়াজ তুলতে লাগল, মোহ কামড়ে ধরল নিজের হাত। পুরো শরীর থমকে থমকে উঠছে। মোহ থামে না। মনে মনে বিলাপ করতে লাগে,
-“আব্বু, আ-ব্বু! আম্মু! আব্বু-আম্মু! কই? তোমরা কই? আমি কী দোষ করেছিলাম? এতটা অসহায় কেন লাগে? আল্লাহ! মরে যাচ্ছি!”

বিশ্বাসের পর্দা যখন হুট করেই ছিঁড়ে যায়—অনুভূতিরা তখন হোঁচট খায়, আবেগ গা ঝেড়ে পালায়। এতদিন সেই নির্বিকারত্ব নিয়ে মোহ এগোলেও, এখন আর পারল না। হয়ে উঠল বাঁধভাঙা।

কাঁদতে কাঁদতে মোহ ফ্লোরেই পড়ে রইল, একসময় ঘুমিয়েই গেল। তখন বাজে বিকেল চারটে।

______
রঙ্গন পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে মোহকে হোয়াটসঅ্যাপে কল করল, তখন এ-দেশে রাত দুইটা। মোহ ঘুমিয়ে। মেঝেতে ফোন ভাইব্রেট করছে। মোহ ঘুমের মাঝেই চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল। মাথাটা প্রচণ্ড ভার হয়ে আছে। শীত শীত লাগছে। এদিকে এসির টেম্পারেচার বাড়ানো, ফ্লোরে সমগ্র গা, বাইরে বৃষ্টি; আবহাওয়াও হীম। এমনিই অল্পতে সর্দি বাঁধানোর এক চমৎকার গুন মোহনা আফরিনের আছেই। তার ওপর এ তো, নিজেকে অসুস্থ করার জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন।

দু’বার রিং হতেই মোহ সচকিত হলো। মাথা সামান্য উঁচিয়ে ফোন খুঁজল। পেল বিছানা ঘেঁষে। ডিস্প্লেতে চকচক করছে সাধের পুরুষটি, “নিজস্বতা!”

পাশে একটা অগ্নির ইমোজি। মোহ সবসময় রঙ্গনকে বলত,
-“তোমাকে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা লাগে রঙ্গন, মাঝে সাঝে! তুমি খানিকটা ছুঁলেই আমার দেহে দহন ঘটে। আমি মোহিনী, অগ্নিকন্যা। আগুনে আগুন লাগে না, আমি বরঞ্চ ঠিকই থাকি। তবে তোমাকে ছাই বানিয়ে দিতে ইচ্ছা করে।”

রঙ্গন তাতে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মোহর থেকে দূরত্ব বাড়ায়। মেয়েটার চোখে জ্বলজ্বল করে কামনার আগুন। রঙ্গন তা হতে নিজেকে খানিক সরিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। প্রিয় নারীর এহেন চাহনি উপেক্ষা করা কোনো সাধারণ পুরুষের সাধ্যে নেই। এদিকে রঙ্গন অসাধারণ। সে শুষ্ক চুমুতেই মনের চাহিদা মেটাত। দেহেরটার সময় হয়নি এখনও।

চতুর্থ রিং হতে গেলে মোহ কল রিসিভ করল। আধ-ভাঙা আওয়াজে বলে উঠল,
-“উম, পৌঁছেছ?”

রঙ্গন প্রশস্ত হেসে বলল,
-“ফ্রেশ হয়েই কল দিলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলে, না? ওয়াজিহ্ মেজবাহ খুব সরি, ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্য। এবার উঠে মুখ ধুয়ে কফি বানিয়ে আনো, খানিকটা কথা বলি।”

মোহ নিজের আওয়াজটা ঠিক করতে পারছে না। গলায় উশখুশ করছে। সামান্য গলা ঝেড়ে বলল,
-“উম, ওকে।”

ওপাশ থেকে ভেসে এলো রঙ্গনের আতংকিত আওয়াজ,
-“মোহ, তুমি ঠিকাছ?”
-“ঠিকাছি।”
-“তবে আওয়াজ এমন শোনাচ্ছে কেন? ঠাণ্ডা লেগেছে?”
-“হুম।”
-“হঠাৎ? মোহ?”
-“কিছু না, রঙ্গন। তেমন কিছু না।”
-“কিছু না বলছ? এদিকে তো কথাই বলতে পারছ না! কী মারাত্মক অবস্থা!”

মোহ হাসে সামান্য। রঙ্গন গম্ভীরমুখে বলে উঠল তখন,
-“মোহ, তুমি কেঁদেছ?”

মোহ অস্বীকার করতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল। এই ছেলেটা তাকে এত বোঝে কেন? দুনিয়ার সবার কাছ থেকে মোহ নিজেকে লুকোতে পারলেও, দু’জনের কাছে কখনই পারেনি। শেফা আর রঙ্গন। মোহ মেঝেতে বসে বিছানায় মাথা হেলে দিলো। কলটা স্পিকারে রেখে এক হাতে সামনে ধরে রাখল।
রঙ্গন ফের বলল,
-“মোহ!”

মোহ মলিনমুখে শুধায়,
-“হু-উম?”
-“কেঁদেছ?”
-“জিজ্ঞেস কোরো না। তোমাকে মিথ্যে বলতে কষ্ট লাগবে।”

রঙ্গন প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল। ইচ্ছে করল সব ছেড়েছুড়ে এখনই ফিরতে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। তাই বলল,
-“আচ্ছা, ফ্রেশ হয়ে এসো।”
-“ঠিকাছে।”
-“মোহ, শোনো!”
-“কী?”
-“তুমি খোলসে আবৃত থেকো না, অন্তত আমার সামনে। আমি তোমাকে ততটুকুই বুঝতে পারি, যতটুকু তুমি বুঝতে দাও। এর বাইরে খানিকটাও আমার সাধ্যে নেই।”

মোহ হাসে। অশ্রবণীয় কিছু কথা মোহ মনে মনে আওড়ায়,
-“রঙ্গন, একটা মানুষকে পুরোপুরি বোঝা যায় না। আর মোহকে বোঝা কোনো মানুষের সাধ্য না। মোহকে বুঝে গেলে, পৃথিবীতে ‘ভালোবাসি’ শব্দের ব্যবহার খুব কমে যেত। এত বড়ো অন্যায় মিছে অনুভূতিরা মানতে পারত না। তাই মোহ ধরা-ছোঁয়ার বাইরের কিছু।”

চলবে..#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_১৬
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]

কাটল আরও তিনদিন। মোহ শেফা-মাহফুজের রুমে এলো হঠাৎ করে। মাহফুজ সাহেবের মারা যাওয়ার পর আর এ রুমে কেউ প্রবেশ করেনি। জয়তুননেসা ছেলে শোকে রোজ মোনাজাতে কাঁদেন। নাজমা চুপচাপ নিজের রুমে বসে থাকে। নুরশীন-নাফসিন নিজেদের পড়ালেখা নিয়েই ব্যস্ত। ওদের স্কুলে যাওয়া-আসাটা রূশীর সাথেই হয়। নাজমা স্বাভাবিকের মাঝেও অস্বাভাবিক। স্বামী যত বড়ো অন্যায়কারীই হোক না কেন, কোনো স্ত্রী-ই তার শোক কাটাতে কার্পণ্য করবে না।

মোহ এলোমেলো রুমটার আনাচে কানাচে দেখতে লাগল। মায়ের শাড়িগুলো গোছাচ্ছে, আলাদা করছে। নিজের রুমে নিয়ে রাখবে। ওদিকে মাহফুজ সাহেবের জিনিস ছুঁয়েও দেখছে না। শেফা কঠোর ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন নারী ছিল। নিজের কোনো জিনিস কাউকে ছুঁতে দিত না। সাধের পুরুষ হোক কিংবা অবহেলায় এক কোণায় পড়ে থাকা পুরোনো ডায়েরিগুলো। যা তার, তা একান্ত তার নিজের। নিজের মেয়ে ব্যতীত কেউ এসবে হাত দিতে পারত না।
সে-সময় মোহ ছিল খানিকটা আলাদা গোছের মানুষ। সামনে অমূল্য সম্পদ ফেলে রাখা হলেও, মোহ তা উলটিয়ে দেখত না।
মেয়েটা আজ শেফার সব জিনিস স্পর্শ করছে। আটকানোর কেউ নেই। শাড়িগুলো বিছানার ওপর রাখার পর, বাকিসব খুঁজছে। কাবার্ড থেকে কিছু পুরোনো ফোটো অ্যালবাম আর ডায়েরি পেল। সেগুলোসহ শাড়িগুলো নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।

বিছানার ওপর এলোমেলোভাবে সব ফেলে মোহ অ্যালবামগুলো দেখছে। সবগুলোয় সিরিয়াল নম্বর দেওয়া। ৫-টা অ্যালবাম। একটাতে শেফা-মাহফুজের ভার্সিটি লাইফের সব ছবি, আরেকটাতে বিয়ের পরের সব ছবি। ৩ আর ৪-নং অ্যালবামে মোহর ছোটোবেলার সব ছবি, তাদের তিনজনের একত্রিত ছবি। আর ৫-এ হুটহাট তোলা কিছু ছবি। মোহ শেষের দিকে শেফা-মাহফুজের একসাথে তোলা ছবি পেল না। বোধহয় বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন সাধও মিটে গিয়েছিল।

মোহ ডায়েরি ধরল। এগুলোর কিছু কিছু হিসেব নিকেশের ডায়েরি। মোহ দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল। একটা একটা করে সবগুলো ডায়েরির পেইজ উলটোতে লাগল। মাঝে মাঝে শেফার ছোট্টো একটা দুটো চিরকুট বেরোচ্ছে। লেখাগুলো এরকম,
-‘আমাদের মোহনা আমাদের সুখ। আমাদের দুঃখ মিটেছে, মোহনার আব্বু।’

-‘বাপের বাড়ি যাচ্ছি। রাগ নামলে ফিরব। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া কোরো। ফিরে যেন নেমে যাওয়া রাগ আবার না বাড়ে!’

-‘অফিস থেকে ফেরার সময় আমার জন্য জবা এনো। ১১টি জবা। আমাদের প্রণয়ের আজ ১১ বসন্ত।’

-‘আমি রেগে আছি। শিঘ্রই রাগ ভাঙাও। লাইব্রেরি রুমে আছি আমি, এসো।’

এরকম আরও অনেক চিরকুট। মোহ মুগ্ধ হয়ে দেখছে। হিসেবের ডায়েরির ভাঁজে থেকে এসব চিরকুট সরিয়ে মোহ আলাদা করছে। করতে করতেই, হুট করেই একটা খুব পুরোনো ডায়েরিতে মোহর হাত থমকে গেল। কাগজগুলো রঙচটা।
প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা,

“মাহফুজের শুভ্রাণী..”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২৩ এপ্রিল, ১৯৯৪

মোহ নড়েচড়ে বসল। তার মায়ের ডায়েরি লেখার সখের ব্যাপার হতে সে সম্পূর্ণ অপরিচিত। সবগুলো পেইজ স্লাইড করে বুঝল, ডায়েরিটি বড়ো গোপন কিছু। একে পড়তে হবেও গোপনভাবে।
উঠে নিয়ে বিছানায় ফেলে রাখা সব কিছু কাউচের ওপর এনে ফেলল। দরজাটা আটকে আবারও আগের স্থানে গিয়ে বসে পরের পেইজ ওলটাল,

“আমাদের বন্ধুত্বের তিন বছর শেষে আমাদের প্রণয়ের আজ প্রথম বর্ষ।”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১৭ আগস্ট, ১৯৯৫

“মাহফুজ ভীষণ অন্তর্মুখী। আমি ওকে বুঝতে পারি না। ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল খুবই ভিন্নভাবে। কলেজের চতুর্থ দিন ও প্রথম কলেজে এসে আমাকে সিনিয়র মনে করে বসে। জিজ্ঞেস করে,
-‘আপু, সাইন্স এ সেকশনের ক্লাস কোনটা?’
আমি অবাক হই। এই ছেলে আমাকে আপু ডাকে কেন? উত্তরটা খুঁজে পাই তৎক্ষনাৎ। আমাকে সিনিয়র ভেবেছে কি না! আমি গভীর শ্বাস ফেলে রুম দেখিয়ে দিই।

ও ক্লাসে গিয়ে শেষের দিকের একটা বেঞ্চে বসে পড়ে। পাশাপাশি বেঞ্চে আমি বসেছিলাম। আমাকে দেখে তখন চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে। নিজের ভুল ধরতে পেরে নিশ্চুপ থাকে। আমি মনে মনে একচোট হাসি। এরপর থেকে যে-কোনো কিছুতে আমি ওকে খোঁচাই। বারে বারে বলি,
-‘এই ছেলে! আপুকে সালাম দাও। সুন্দর করে বলো, আসসালামু আলাইকুম, আপু। অভদ্রতা করবে না।’

মাহফুজ এড়িয়ে যায়। আমি পিছু ছাড়ি না। অনেকটা জোর জবরদস্তি করেই বন্ধু হয়ে যাই। ওর সব বিষয়ে এই সরু নাকটা গলাতে থাকি। তারপর একদিন অনুভব করি, ওর মনে আমার জন্য কিছু একটা চলছে। এই কিছু একটা হচ্ছে ভিন্ন কিছু একটা। আমি আশ্চর্য হই না। বিষয়টা হতে আমি অবগত ছিলাম। আমার মনে সেই বিখ্যাত উক্তিটি সর্বদা ছিল—একটি ছেলে আর একটি মেয়ে কখনও কেবল বন্ধু হয়ে থাকতে পারে না। জীবনের শেষদিনে এসে হোক কিংবা ক্ষণিকের জন্য, প্রেমে অবশ্যই পড়বে।

তখন আমাদের ইন্টারমিডিয়েট কম্পলিট হয়েছে। কারোরই পাবলিকে চান্স হয়নি। দু’জনেই প্রাইভেটে ভর্তি হলাম। অনার্সের প্রথম বর্ষটা যখন শেষের পথে, তখন গিয়ে বলে বসি,
-‘এই ছেলে! আমাকে পটাচ্ছ না কেন?’

মাহফুজ সোজাসাপটা জবাব দেয়,
-‘পটানোর জন্য কী করতে হবে?’
-‘আমাকে ইম্প্রেস করতে হবে।’
-‘তুমি কি বলতে পারো, তুমি ইম্প্রেসড হওনি এখনও?’

আমি মানা করতে পারি না। মাহফুজ সব বুঝে গা দুলিয়ে হাসে। অসভ্য একটা! মূলত সেদিন থেকেই শুরু হলো আমাদের প্রেমের সম্পর্ক। বয়স বাড়ছে। স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছি মানে আমার বিয়ের বয়স পেরোচ্ছে। তাই পরিবার থেকে বিয়ের জন্য জোর করা হচ্ছে। এদিকে আমি নিজেকে মাহফুজের জন্য যত্নে রাখছি। আমাদের এত এত স্মৃতিগুলো সব কলমে ফুটিয়ে তুলছি, পাছে না এসব ভুলে যাই!”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২৪ আগস্ট, ১৯৯৬

লেখাটা এখানেই শেষ। এরপর দু’পৃষ্ঠা ওলটানোর পর আরও কিছু লেখা ভেসে এলো। মোহ পড়তে লাগল আবার,

“ডায়েরি লেখার অভ্যেস নেই। তাই অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে করলেও, শব্দ মেলাতে পারি না। আমার মনে হয় না ডায়েরিটা জীবনে পুরোটা লেখা হবে! ইশ! ডায়েরি, তুই কত্ত মোটা! আমি এত লিখব কীভাবে?”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬

“আজ মেজাজটা প্রচুর খারাপ হয়েছে। অসভ্যটাকে ইচ্ছে করছে থাপড়ে চেহারা নষ্ট করে দিতে। আমারই বান্ধবীর সাথে ক্যান্টিনে বসে হাহা-হিহি করে? সাহস কত! কাল ওকে কী যে করব!”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
৩ অক্টোবর, ১৯৯৬

“প্রচণ্ড খারাপ মেজাজ নিয়ে মাহফুজের মুখোমুখি হলেও, আজ একটা দারুণ ঘটনা ঘটেছে। ক্যাম্পাসের একদম মাঝখানে মাহফুজকে দিয়ে কানে ধরে ওঠ-বস করিয়েছি। রোদে পুরো মুখটা কী লাল হয়ে গেছিল ওর! মায়া লাগছিল, এদিকে মজাও লাগছিল খুব। ওর ওই অসহায় ফেইসে প্রতিবার আপডাউনের সাথে একবার করে সরি শোনার জন্য হলেও অভিমান করাটা আমার ওপর আপাতদৃষ্টিতে বাধ্যতামূলক হোক!”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
৪ অক্টোবর, ১৯৯৬

“আজ পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল আমাকে। মায়ের ওপর খুব রাগ ঝেড়েছি। আমাকে না বলেই কীভাবে সরাসরি বাসায় লোক আনে? আমাকে শোপিস ভেবেছে? মানুষ এনে দেখিয়ে বেড়াবে? উফ! ভাবতেই তো গা গোলাচ্ছে। মহিলাগুলো কেমন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল! বিশেষ করে ওই চারচোখা ভুড়িওয়ালা লোকটা। চোশমা উঁচিয়ে যেভাবে দেখছিল, ইয়াক! ওটা কোনো মাল হলো? এর একটা হেস্তনেস্ত না করলে তো শান্তি পাচ্ছি না। গা জ্বলে যাচ্ছে।
ওহ-হ্যাঁ! লোকটা না-কি হাইস্কুলের মাস্টার। কাল মাহফুজকে বলব—এটার একটা ব্যবস্থা করতে। মাহফুজ কিছু করতে না পারলে, মাহফুজের ব্যবস্থা করে দেবো আমি।”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১১ অক্টোবর, ১৯৯৬

“মাহফুজ বেঁচে গেল আমার হাত থেকে! চারচোখার এক চোখের কাঁচ ভেঙে গেছে। শুনলাম গোবরে মুখ থুবড়ে পড়েছে। আমার শান্ত-শিষ্ট চিন্তাবিদের কাজ ছিল এটা, আমি বুঝতে পেরেছি। সেই সুবাদে তাকে আমি একটা ট্রিট দেবো ভাবছি।”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১৪ অক্টোবর, ১৯৯৬

“মাঝে মাঝেই মাহফুজ আমাকে স্বর্ণলতা ডাকে, শুভ্রাণী ডাকে। আমার কী যে শান্তি লাগে! মনের ভেতর প্রজাপতি ওড়ে। আমি বাইরে থেকে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চাই। পুরুষমানুষ প্রেমিক হিসেবে এমনই ভালো। সবসময় সে দিতে থাকবে।
আমার মতে, এদিক থেকেও সেরকম কিছু পেলে, তার আর ধরে রাখার জোর থাকবে না। তার মনে হবে—আ-রে! ও তো আছেই। সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার যত যা করা লাগে, ও-ই করবে। আমার এত কিছু না করলেও চলবে। এভাবে সম্পর্কটা একপাক্ষিক দেখা যেতে পারে, হয়ে যেতে পারে। কথাটা আংশিক মিলে গেলেও সমস্যা।”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
৭ নভেম্বর, ১৯৯৬

“মাহফুজের সাথে আজ বোরকা পরে পুরো শহর ঘুরেছি। কী স্নিগ্ধ অনুভূতিগুলো! ছেলেটা এত যত্ন নিতে কোত্থেকে শিখল? আমার চোখ দেখলে পুরো আমিটাকে পড়ে ফেলে। মূলত এজন্যই আজ অবধি ভালোবাসি বলার প্রয়োজন পড়েনি আমার। আমার চোখে তাকালেই সে মুচকি হাসে।
সেদিন তো বলেও দিলো,
-‘শুভ্রা, শোনো! তোমার চোখ আমাকে খুব শাসায়। যেন, এ-ই আমি কিছু করলাম। তো এ-ই সে আমায় মেরে দেবে।’

প্রিয় পুরুষ যদি সে নারীর চোখের ভাষা পড়তে পারে, তবে হাত বাড়িয়ে কাছে টানার প্রয়োজন নারীটির পড়ে না; চোখ হয়ে মন পড়তে ক’জনই বা পারে? সে আদর্শবান প্রেমিক! সে আমায় প্রেম শিখিয়েছে, বিনিদ্র রজনী চিনিয়েছে, অস্থিরতায় সুখ দেখিয়েছে। তার প্রেমেতে অন্ধ বানিয়েছে। আমি অনমনীয়, নিজেকে ধরে রাখতে জানি। তার আগেতে নিজেকে দেখি। তার কাছে নিজের সুখ পাই বলেই আমি আছি, থাকি। এক্ষেত্রে আমি স্বার্থপর বটে।”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২৩ মে, ১৯৯৭

“মাহফুজ! আমার মাহফুজ! এত সুখ, এত শান্তি! এত কিছু আমার কপালে ছিল?
বেশি আবেগী হওয়া শুভ্রার জন্য নিষিদ্ধ। তাই আসো, আবেগ কমাই। কাটাকাটি করি।
মাহফুজ, তোমার এতটুকু ভালোবাসার বিনিময়ে আমি আজীবন তোমার। শোধবোধ, ওকে?”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১৮ জুলাই, ১৯৯৭

মোহ এটুকু পড়ে চোখ বুজে নিল। ডায়েরিটা বুকের ভেতর চেপে ধরল। সময় নিয়ে পাতা ওলটাল,

“চতুর্থ বর্ষে ভর্তি হলাম দু’জন। আমি প্রায়শই সিনিয়র, জুনিয়র, পাড়ার এলোথেলো প্রায় অনেকের প্রপোজাল পেলেও, মাহফুজ পায় না। অন্তত আমি দেখিনি। এত নজর রেখেও একটা পিঁপড়ের নজর ওর ওপর পড়তে দেখলাম না। এদিকে ও সুদর্শন বটে। কেন কেউ প্রপোজ করে না? আগে খানিকটা হ্যাংলা টাইপের দেখতে হলেও, এখন তো শরীর আকর্ষণীয়। একদম পার্ফেক্ট ম্যান লাগে। আমারই মাঝে মাঝে হিংসে হয় ওকে। কী ফিট!
সেবার নানুমার সাথে তার বাবার বাড়ি বান্দরবানে বেড়াতে গিয়ে একটা পানীয় খেয়েছিলাম। নামটা মনে পড়ছে না। মাহফুজকে দেখলেই আমার সেই পানীয়র কথা মনে পড়ে যায়। ঘোর লেগে যায়। ওহ হ্যাঁ, ওটার নাম মহুয়া ছিল।”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২১ ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৮

“বাড়ি থেকে প্রচুর প্রেশার পাচ্ছি। আব্বার সাপোর্ট পেলেও, আম্মা বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগে গেছে। রোজ নতুন নতুন সম্বন্ধ আসছে। সমবয়সী বলে মাহফুজকে তারা মানবে না। এতদিন বিভিন্নভাবে এড়িয়ে গেলেও, এবার আম্মা আমার থেকে পছন্দ হয়েছে কি না শুনতে চায়নি। নিজেরাই আলাপ করে বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেলেছে। আমি জানি না কিছুই। আম্মা বলল, শরীরটা খারাপ তার। কাল যেন ভার্সিটিতে না যাই। আমি তাই মেনেছি। একটু আগে শিহাব আমার কাছে খবর পৌঁছাল। কাল আমাকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে। দেখতে আসবে বলতে, পছন্দ করে রেখেছে, কাল বিয়ে পড়িয়ে উঠিয়ে দেওয়া হবে। পরে অনুষ্ঠান করবে।
এত বড়ো খেলা খেলল? আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে পড়ার অভ্যেসটা আমার আগে ছিল না, এখন হয়েছে। মাহফুজকে টেলিফোন করে যে জানাব, তারও উপায় নেই!

মাহফুজের ওপর খুব রাগ হচ্ছে। ছেলেটা আমাকে এত ভালোবাসে কেন? আম্মা যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছে, সে দেখতে-শুনতে বেশ ভালো, সরকারি চাকরি করে। ব্যাক্তিত্বও সুন্দর। তবুও আমি বিয়েটা করতে পারছি না। অবশ্যই মাহফুজের জন্য! কোনোমতে বিয়েটা থেকে রক্ষে পাই, ফাজিলটাকে আচ্ছা মজা দেখাব! আমাকে বশ করে রেখেছে! সাহস কত!”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১১ আগস্ট, ১৯৯৮

চলবে…

[ডায়েরির বেশ ক’টি পর্ব থাকবে। এর মাঝে রঙ্গন-মোহর শৈশব, মাহফুজ বিষয়ক বিভিন্ন সত্য থাকবে। আমার কল্পনায় শেফা চরিত্রটি বেশ অমায়িক! যেন মোহর সেকালের রূপই শেফা! মোহকে জানতে হলে, শেফাকে পড়ুন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here