#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_১৭
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]
মাহফুজের ওপর খুব রাগ হচ্ছে। ছেলেটা আমাকে এত ভালোবাসে কেন? আম্মা যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছে, সে দেখতে-শুনতে বেশ ভালো, সরকারি চাকরি করে। ব্যাক্তিত্বও সুন্দর। তবুও আমি বিয়েটা করতে পারছি না। অবশ্যই মাহফুজের জন্য! কোনোমতে বিয়েটা থেকে রক্ষে পাই, ফাজিলটাকে আচ্ছা মজা দেখাব! আমাকে বশ করে রেখেছে! সাহস কত!”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১১ আগস্ট, ১৯৯৮
“কাকাতো বোন শিউলি আপুর কাছ থেকে সেদিন জেনেছিলাম, হাতের কোন অংশে ঠিক কীভাবে কতটুকু কাটলে কেবল চামড়া কাটে, রক্ত পড়ে; তবে রগে লাগে না।
শখের বশে শেখা কাজটা, আমার কাজে লেগে গেল। আমার রুমে কোনো ব্লেড বা ছুড়ি জাতীয় কিছু নেই। রান্নাঘর থেকে আনার উপায়ও নেই।
নতুন পেন্সিল শার্পনার থেকে ওটার ব্লেডটা উঠিয়ে নিলাম। তারপর হিসেব মতো হাতে সুন্দরমতো কাটা শুরু করলাম। খুব সাবধানে, যাতে রগে না লেগে যায়। আমি মরতে চাই না, নিজেকে ব্যথা দিয়ে তাদের খানিকটা ভয় দেখাতে চাই।
মাহফুজ! দেখো, তোমাকে পাওয়ার জন্য কতটা করছি! কষ্ট দিয়ো না এরপর, কেমন?”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১২ আগস্ট, ১৯৯৮
“বিয়েটা ভেঙে গেছে। আম্মা কথা বলে না আমার সাথে, আব্বাও না। বলতে গেলে বাড়ির আবহাওয়া অতিমাত্রিক ঠান্ডা। আর আমি তা এনজয় করছি। তিনদিন অসুস্থ হয়ে হসপিটালে এডমিট ছিলাম। আজই বাড়ি ফিরলাম। কাল ক্যাম্পাসে গেলে নিশ্চয়ই মাহফুজের চিন্তামাখা মুখটা দেখতে পাব!
মানসম্মানের ভয়ে আম্মা-আব্বা আমার ব্যাপারটা আত্মীয়-বন্ধুদের থেকে লুকিয়ে গেছে। তাই বেচারার কোনো উপায়ই ছিল না আমার সাথে যোগাযোগ করার। কাল দেখা হলে প্রথমে অস্থির হবে, পরে যখন দেখবে—আমি ঠিক আছি, তখন মুখ ফিরিয়ে বলবে,
-‘শুভ্রা, আগামী চারদিন আমার দেখা পাবে না। আমার রাগ নামতে চারদিন লাগবে।’
আমি হেসে ফেলব আনমনে। ইশ! ছেলেটা এত আদুরে! আমি এই আদুরে ছেলেটাতে মরতে রাজি।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১৫ আগস্ট, ১৯৯৮
“পৃথিবীর সবচেয়ে স্নিগ্ধ অনুভূতি হচ্ছে প্রিয় পুরুষের চোখ নিজেকে রানী হিসেবে দেখা। মাহফুজ আমাকে কত চায়, তা ও কখনও বলেনি আমায়, বলেও না। অথচ ওর প্রতিটি কাজে এই তীব্র চাহিদাটা প্রকাশ পায়।
কাল এক্সাম শেষে মাহফুজের সাথে যখন বউবাজারের সরু রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম, মাহফুজ বলে উঠল,
-‘শেফা, কথা আছে কিছু।’
ওর গম্ভীর মুখটা আগেই লক্ষ করেছি। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়নি। আমার ক্ষেত্রে মাহফুজ অনুভূতি প্রকাশে অতি সক্ষম ব্যাক্তি। যখন বলতে ইচ্ছে করবে ওর, ও বলবেই। আর ওর সময়টা হলো তখন।
ওর গম্ভীরতাকে ডিঙিয়ে গিয়ে আমি বললাম,
-‘শুভ্রা ডাকো তিনবার, তবে শুনব।’
মাহফুজ গভীর শ্বাস ফেলে বলল,
-‘বি সিরিয়াস।’
সিরিয়াস মুখ করে বললাম,
-‘দুইদিনের জীবনে এত কীসের সিরিয়াসনেস?’
মাহফুজের থমথমে চেহারারটার দিকে তাকালাম। তারপর খানিকটা থেমে আবার বললাম,
-‘১৯৯০ সালে নাজিরশাইল চালের কেজি ছিল ১৫ টাকা। এ-বছরে হলো ২১ টাকা। চালের ঊর্ধ্বগতি সম্পর্কে তোমার কি মতামত? বসে আলোচনা করব? আসো৷’
মাহফুজ অত্যাধিক শীতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর হুট করেই করে বসল সবচেয়ে অভাবনীয় কাজটি, আমার সামনে নতমুখী হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। আমি ত্বরিতে আশপাশ দেখলাম, সবাই দেখছে। দেখুক! সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে আমার মাহফুজের অনাবৃত ব্যবহারটা। ও কাঁপছে থেমে থেমে। তারপর হুট করেই বলে বসে,
-‘তোমাকে ছাড়া নিজেকে অস্তিত্বহীন লাগে, শুভ্রা! জীবনটাকে মরুভূমি আর তোমাকে এক ফোঁটা জল লাগে।’
আমি ওর অস্থিরতা বুঝতে পেরেছিলাম। সাত বছর ধরে তো কেবল ওর চেহারাটা দেখছি না, ওর স্বভাবের আদ্যোপান্ত আমার জানা। ছেলেটাকে ওভাবে কাঁপতে দেখেও আমার মজা লাগছে। ওকে কাঁদতে দেখলেও বোধহয় মজা লাগবে। তখন হয়তো বলে বসব,
-‘এই ছেলে! আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কাঁদো। ঝুঁকে কাঁদলে আমি দেখব কী করে?’
তখন ওর কান্না থেমে যাবে। অভিমান করবে নাকি? কী জানি! কিন্তু এসব বলা যেত না। মিষ্টি হেসে ওর গোছানো চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললাম,
-‘আমার প্রাণ!’
রানী রানী ফিল পাচ্ছি। উফ!”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১০ জানুয়ারি, ১৯৯৯
“সুখের দিনগুলো আলোর বেগে এগোয়। বসন্ত পেরোল আরও একটি। আমাদের দু’জনেরই মাস্টার্স শেষ। আমি প্রাইমারিতে একটা জব পেয়ে গেছি। ওদিকে মাহফুজ জব-টব করতে চাইছে না। এই ছেলেকে নিয়ে আমি কী যে করি! এখন ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হয়ে যাক! আমার সুখের নীড়ের দেখা পাওয়ার লোভ আর সামলাতে পারছি না।
আজ এতদিন পর ডায়েরিটা হাতে নিয়ে ভাবলাম, অনেক কিছু লিখব। বিগত এক বছরে আমার জীবনে কী কী হয়েছে, সব লিখব। কিন্তু আশ্চর্য! তেমন কোনো পরিবর্তনই আসেনি। মাহফুজের ভালোবাসা আগের মতোই আছে। আমি ওর চোখে এখনও নিজেকে বিশ্বসুন্দরী হিসেবে দেখতে পাই।
মাঝে মাঝে যখন আমি বিভিন্ন আলাপ জুড়ে দিয়ে হাহা-হিহি করি, তখন ঠিক কতটা মুগ্ধতা নিয়ে ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমি বুঝতে পারি।
আমি কখনও-সখনও খানিকটা কড়া চোখে তাকাতেই ও বলে, আমার রাগকে নাকি খুব ভয় পায়। অথচ আমার রাগ ও দেখেনি, ওকে দেখাইনি। আমি রাগলে উন্মাদ হয়ে যাই, অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ি। আর শেষে নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করি।
ছোটোবেলায় একবার আম্মা আমার গায়ে হাত তুলেছিল, অকারণে। আমি অনেক বোঝানো সত্ত্বেও আম্মা আমাকে বোঝেনি। চাপিয়ে দিয়েছিল মিথ্যে আরোপ।
আচ্ছা, যেখানে আমার দোষই নেই, সেখানে কেন শাস্তি পাব? এটা এক ধরনের ঘৃণ্য অপমান। আমি নিতে পারিনি। চুলোয় গরম পানি ছিল, তার ওপরে হাত ডুবিয়ে দিয়েছিলাম। কী সাংঘাতিক কান্ড! আম্মা সামনেই ছিল, তৎক্ষনাৎ আমার হাতটা উঠিয়ে ঠান্ডা পানিতে দেয়। তার আহাজারি এখনও কানে বাজে। অথচ আমি নাকি ছিলাম নির্বিকার। আমার সে রূপ দেখে সবাই মারাত্মক ভয় পেয়েছিল।
মাহফুজ তা জানে না। জানবেও না। ওকে তো ভালোবাসি। ভয় কেন দেখাব?”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
৪ আগস্ট, ২০০০
মোহ এ অবধি পড়ে অবাক হয়ে গেল। তার মাঝের যেই উন্মত্ততার স্বভাবটা, এটা সে তবে তার মায়ের থেকে পেয়েছে! মোহ ডায়েরিটা পড়তে পড়তে এতটাই তলিয়ে গিয়েছিল যে, তার মনে হচ্ছিল এটা সিনিয়র মোহ! এত মিল তাই?
অথচ মোহ নিজের মা’কে এতটা অশান্ত, অস্থির কখনই দেখেনি। তবে কি বিয়ের পর স্বভাবের পরিবর্তন হলো?
ভাবতে ভাবতেই মোহ পেইজ ওলটাল,
“আট বছরে এই প্রথম মাহফুজের কাছ থেকে কোনোরূপ সারপ্রাইজ পেলাম। আর সেটা যে এত বড়ো হবে, তা আমার কল্পনাতীত ছিল। পরিবারসহ আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে মাহফুজ। বয়স বেশি হয়ে গেছে বিধায় এখন আর আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসে না।
আম্মা প্রায়ই মরা কান্না কাঁদে। বিষয়বস্তু এ-ই—আমার মতো অর্ধবয়স্ক আনম্যারিড মেয়েকে কে বিয়ে করবে? অথচ আমার বয়স সামনের মাসে ২৬ হবে। বেশি হয়েছে কোথায়?
সে যাই হোক, বিয়ের প্রস্তাব যে এসেছে, এই অনেক ছিল আম্মার জন্য। আম্মা রাজি হবে বুঝে গেছিলাম। কিন্তু তবুও মনের ভেতর একটা আশংকা ছিল।
সেই খুঁতখুঁতানি দূর হলো এটা দেখার পর যে—আম্মা পারে না এখনই আমাকে বিয়ে পড়িয়ে উঠিয়ে দেয়!
তার মতে ছেলে দেখতে-শুনতে মাশাআল্লাহ! পরিবার ভালো, শিক্ষিত। সহায়-সম্পত্তি বেশ আছে। এমন পরিবারে আমাকে দিতে যে পারছে, এ-ই যেন আমার সাত কপালের ভাগ্য, বাণীতে আমার সহজসরল আম্মা।
অতঃপর আম্মার জানার পরিসীমা সংকীর্ণ রেখে আগামী মাসের ২৫ তারিখে আমার বিয়ের তারিখ ধার্য্য করা হলো।
বিঃদ্রঃ আম্মার মতে, অবশেষে তার পছন্দেই আমাকে বিয়ে করতে হলো! খোঁটা দিচ্ছে খুব! বলছে, সে-ই তো আমার পছন্দেই বিয়া করলি, তাও এত ঢং করলি ক্যান, বেয়াদব?
আমি ক্ষণে ক্ষণে কেবল হাসছি।
আজ আমার খুশির নেই সীমানা,
আজ আকাশে উড়তে নেই মানা..
আমার মাহফুজ!”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২১ সেপ্টেম্বর, ২০০০
“আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ! তার নামের তিন কবুল পড়লাম। তার বোনেরা এখন আমাকে তার ঘরে সাজিয়ে বসিয়ে রেখে গেল। একটু পরই ও আসবে। মেয়েরা দু’জায়গায় আটকায়; প্রেমিকের চোখে প্রেম দেখে, স্বামীর চোখে আসঙ্গ দেখে।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২৫ অক্টোবর, ২০০০
তারপর ডায়েরইটি খালি। মোহর মনে হলো—এখানেই শেষ। পরক্ষণেই নিজেকে থামাল। না! কোনোকিছুর সমগ্ররূপে শেষ নেই, শেষাংশ ধরে সবেরই আরেক শুরু আছে। মোহ বাকি ডায়েরিগুলো উলোটপালোট করে খুঁজতে লাগল। নাহ, আর ডায়েরি নেই। মোহর ধারণা, শেফার আরেকটা ডায়েরি থাকবে। থাকা অবশ্যম্ভাবী।
তখনই বিছানার ওপর সাইলেন্ট মোডে রিং হতে থাকা ফোনটায় চোখ গেল মোহর। ঘড়িতে বাজে দুপুর তিনটে। সকাল থেকে এসবেই আছে ও। একদমই সময়জ্ঞান ছিল না।
তড়িঘড়ি করে কল রিসিভ করতেই রঙ্গন বলে উঠল,
-“কী ব্যাপার, মিসেস? না কোনো কল, না ম্যাসেজ! ভুলে-টুলে গেলে?”
মোহ বড়ো করে দুটো শ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্থ করে ফেলে বলল,
-“সম্ভব নয়।”
রঙ্গন হাসে,
-“রুমে কী করছ?”
-“বুঝলে কী করে?”
-“নাফসিন বলল।”
-“ওর সাথে কনট্যাক্ট আছে?”
প্রশ্নটা করেই মোহ বুঝতে ফেলল, সে কতটা নির্বোধের মতো প্রশ্ন করেছে। যোগাযোগ থাকতেই পারে। স্বাভাবিক ব্যাপার!
মোহর প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না রঙ্গন, পালটা প্রশ্ন শুধাল,
-“সকাল থেকে খাওনি কেন?”
মোহ বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল,
-“ভুলে গেছি খেতে।”
-“আমার ফিরতে দেরি হতে পারে।”
-“তাই কী?”
-“নিজের খেয়াল রাখতে বলেছিলাম।”
-“রাখছিই তো।”
-“রাখছ না। দেখি শুকনো মুখটা! ভিডিয়ো কলে এসো।”
মোহ ক্যামেরা অন করল। রঙ্গন একটা ক্যাফেতে ছিল। মোহ রঙ্গনের মুখের দিকে তাকানোর আগেই চোখ চলে গেল তার ঘাড়ের পাশ কাটিয়ে পেছনের দিকটায়। একটা মেয়ে হাসি হাসি মুখ করে এগিয়ে এসে রঙ্গনকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। সঙ্গে খুবই উৎকণ্ঠিত গলায় কিছু বলল। ক্ষণিকে ঘটা ঘটনাটিতে মোহ-রঙ্গন, দু’জনেই হকচকিয়ে গেল। রঙ্গন হতবিহ্বল হয়ে ত্বরিতে কল কেটে দিলো। মোহ ফোনটা একই ভঙ্গিমায় ধরে স্থির বসে আছে। মস্তিষ্কশূন্য হয়ে পড়েছে তার। কী হলো এটা?
চলবে..#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_১৮
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]
মেয়েটা তখনই ছেড়ে দাঁড়াল রঙ্গনকে। পিছে ঘুরে তুশিকে দেখতে পেয়ে রঙ্গনের চোখ-মুখ বিকৃত হলো। ভেতর থেকে অসহনীয় একটা নিঃশ্বাসের সাথে অশ্রবণীয় কিছু আওয়াজে ভেসে এলো,
-“আল্লাহ! রক্ষা করো!”
সে কথা তুশির শোনা হলো না। সে ভীষণ রকমের উত্তেজিত হয়ে বলল,
-“মেজবাহ, তুমি এখানে? আমি অনেকক্ষণ ধরে তোমাকে নোটিস করছিলাম। ফাইনালি যখন চিনতে পারলাম, তখন তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না! কত বছর পর দেখা! দেখো কান্ড! আমি খুশির ঠেলায় বকবক করে যাচ্ছি। আর তুমি তো আরও দুই ধাপ ওপরে। এত খুশি হয়েছ যে, একটা শব্দও বলছ না!”
রঙ্গন অপ্রস্তুত হলো। সে জানে তুশি কিছুটা গায়ে পড়া টাইপের মেয়ে। তবুও এ মুহূর্তে এসে কিছু বলতে পারছে না। তুশি তার ভার্সিটির এক বড়ো ভাইয়ের আদরের বোন ছিল আর ওদেরই ক্যাম্পাসে পড়ত। তখন থেকেই রঙ্গনকে তুশি পছন্দ করত। এদিকে রঙ্গনের তখন মোহর সাথে গোপনে প্রেম চলে, তাই সে এসবে জড়ায়নি। এতে তুশির মনটা ভেঙে যায়। তারপর একদিন বিয়ে করে এখানে সেটেল হয়ে যায়।
রঙ্গন অনেকটা ভেবে তুশিকে বলল,
-“হাজব্যান্ড কোথায়?”
তুশি জানাল,
-“ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আসবে। এসো, বসি এদিকটায়।”
এ-ই বলে রঙ্গনের হাত ধরতে নিল। রঙ্গন নিজেকে ধরার সুযোগ দিলো না, একটু সরে এসে বলল,
-“দিলে তো আমার সংসারে ঝামেলা বাঁধিয়ে!”
-“ওমা! আমি কী করলাম?”
-“তোমাকে কতবার বলেছি, এভাবে হুটহাট জড়িয়ে ধরবে না! আমি অতটাও ফ্রেন্ডলি নই। তাছাড়া আমার বউ কলে ছিল। দেখে কী যে মনে করল!”
চোখ পিটপিট করে তিশা বলল,
-“আব্.. আচ্ছা সরি! অত চেতছ কেন? বেশি এক্সাইটেড হয়ে গেছিলাম দেখে। শুধু শুধু বকছ!”
-“বকছি?”
অবাক হয় রঙ্গন। তা দেখে তুশি হেসে ফেলে বলে,
-“একসময়ের ভালোবাসা ছিলে তুমি আমার। তাই একটু-আধটু বেপরোয়া হয়ে পড়েছিলাম। মাইন্ড কোরো না। আসো, বসে এক কাপ কফি খাই।”
-“না, এখন না। মোহ কী না কী ভেবে বসে আছে! ওর ডাউট ক্লিয়ার করি আগে।”
____
রঙ্গন মোহকে টানা কল দিয়েই যাচ্ছে। মোহ রিসিভ করছে না। কল দিতে দিতে গাড়িতে করে হোটেলে ব্যাক করল। ঘেমে-নেয়ে একাকার সে। এমন সময় মোহ কল কেটে দিয়ে ভিডিয়ো কল দিলো।
রঙ্গন রিসিভ করতেই স্ক্রিনে মোহকে দেখতে পেল। জাম রঙা একটা সুতির থ্রি-পিস পরে আছে। ওড়না অবহেলায় পড়ে আছে বিছানার অন্য প্রান্তে। চুলগুলো উঁচুতে কাটা দিয়ে বাঁধা। কোলের ওপর কুশন, আর কুশনের ওপর প্লেট। মোহ ফোনটা সামনে রেখে বলল,
-“সরি, ডাইনিংয়ে ছিলাম। তাই ফোন ধরতে পারিনি।”
রঙ্গন সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
-“সত্যি?”
-“মিথ্যে বলছি না।”
-“শোনো, মোহ! ওই মেয়েটা আসলে..”
-“কিছু বলা লাগবে না।”
অবাক হয় রঙ্গন,
-“কেন?”
-“কারণ তোমায় আমি বিশ্বাস করি।”
এই এক কথা! রঙ্গনের বুকের ওপর থেকে পাথর সরাতে এই এক কথাই যথেষ্ট ছিল। রঙ্গন হেসে বলল,
-“এত বোঝো কেন?”
-“কীজানি!”
খেতে খেতে মোহ জবাব দিলো। রঙ্গন সামান্য মাথা দুলিয়ে বলল,
-“তবুও তোমাকে এক্সপ্লেইন করতে চাই। নিজের শান্তির জন্য।”
-“বলো।”
-“ও আমাকে পছন্দ করে।”
-“আচ্ছা।”
-“জ্বলছে না?”
-“না।”
-“কেন?”
-“কারণ তুমি তো আমারই। সবভাবে আমার।”
-“এত বিশ্বাস?”
-“সেটা তুমিও জানো—তুমি এক নারীতে আসক্ত না থাকলে, তোমার এমন অবস্থা করব যে তুমি বাকি জীবন কোনো নারীর দিকেই চোখ তুলে তাকাতে পারব না।”
রঙ্গন হেসে দিলো। গলার টাই আলগা করে ব্যাকসিটে গা এলিয়ে দিয়ে বলল,
-“আই মিস ইউ!”
মোহর খাওয়া শেষ। পানির গ্লাস খালি করে বলল,
-“কবে ফিরবে?”
-“নেক্স্ট ফ্রাইডে।”
-“আচ্ছা।”
আর কিছুক্ষণ কথা বলে মোহ ফোন রেখে দিলো। এরপর প্লেট কিচেনে রেখে মায়ের রুমে চলে এলো। কাবার্ডের সবকিছু খুঁজল। কোথাও কিছু পাচ্ছে না। ড্রয়ারগুলোর চাবি কোথায়, তা-ও জানা নেই। সাইডবক্সগুলোর ভেতর খুঁজতে লাগল। সেখানে চাবি পেল অনেকগুলো। এগুলো কাবার্ডের ড্রয়ারেরই চাবি। তবে সবগুলো ড্রয়ার খুললেও, কিছুই পেল না। ফিরে চলে গেল।
রাত আড়াইটা বাজে, অথচ মোহর চোখে ঘুম নেই। কানের মাঝে কিছু কথা বাজছে!
-“সত্যের দুইটা দিক থাকে। একটা প্রকাশিত সত্য, অন্যটি লুকায়িত সত্য। কল্পনা করো কিছুটা এরূপভাবে—যেরূপভাবে তুমি কখনও কল্পনাও করতে পারতে না।”
অনেকবার ভাবল মোহ কথাটা। তারপর উঠে গেল। পুনরায় শেফার রুমে এলো। বেড সাইড বক্সের নিচ দিয়ে খুঁজল। সোফার কুশনের ভেতর থেকে শুরু করে, ড্রেসিংটেবিলের পিছনে। শেষে আবার কাবার্ডের সামনে এলো। ড্রয়ারগুলো পুনরায় খুলল। এবার আলগা ড্রয়ারগুলো বের করে ফ্লোরে রাখল। সব যখন এলোমেলো করে শেষ হলো, তখন মোহর চোখ গেল এক ড্রয়ারের খাঁজের ওপরের দিকের কিছু একটা। মোহ হাতাহাতি করে বুঝল, এটা আরও এক ড্রয়ার। আর এটায় চাবি না, লাগবে পিন। ৪ ডিজিটের একটা পিন। মোহ ফার্স্টে দিলো ৪৪৪৪, এটা শেফার প্রিয় সংখ্যা। খুলল না। মোহর বার্থ ইয়ার দিলো, ২০০২। এতেও খুলল না। সবার বার্থ ইয়ার দেওয়া শেষে ১৯৯২ থেকে ক্রমানুযায়ী পিন দিতে লাগল। আর তা খুলল ২০০৮ সেট করার পর। বেরিয়ে এলো কিছু কাগজসহ একটা ডায়েরি।
মোহর হাত কাঁপছে। সে ডায়েরিটা নিয়ে পুরো রুম তাড়াহুড়োর মাঝে গুছিয়ে নিজের রুমে চলে এলো। তারপর ডায়েরি খুলল। প্রথম পাতাগুলোতে বৈবাহিক জীবন নিয়ে লেখা, মোহর জন্ম নিয়ে লেখা। মোহ আধো আধো বুলিতে কীভাবে ডাকে, কী করে! এসবই।
“আমার সোনাই কথা বলতে শিখেছে। কী মিষ্টি করে আম্মাহ ডাকে! তার চেয়েও মিষ্টি করে ডাকে মেজুবা! আর মেজবাহ তো সারাদিন পড়াশোনা ছেড়ে সোনাইকে নিয়ে ব্যস্ত। কাল কথার ছলে রুমা আপা বলে উঠল,
-‘আমার ছেলে তাহলে নিজের জন্য মেয়ে নিজেই পছন্দ করে রেখেছে! নিজ হাতে বড়ো করে তুলছে! এলেম আছে বলতে হবে!’
আপার কথা শুনে মুচকি হাসলাম। বিষয়টা ধরতে পেরে বললাম,
-‘ওরা বড়ো হোক, আপা। ওদেরটা ওরাই বুঝে নেবে। আমাদের উচিত হবে না এখনই ওদের ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নেওয়া। যদি তোমার ছেলে কিংবা আমার মেয়েটা অন্য কাউকে পছন্দ করে বসে?’
আমার কথায় আপা সায় দেয়। তবে দু’জনকে একত্রে আমার খুব ভালো লাগে। আমি খুব চাইব, ওরা এভাবেই থাকুক।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১ ফেব্রুয়ারি, ২০০৬
“আমার ডায়েরিতে ইদানিং মেয়ের চেয়ে বেশি ছেলেটা অগ্রাধিকার পাচ্ছে। বাচ্চা ছেলে! বয়স মাত্র ১৩ বছর। আর স্কুলে কি-না নিজের আলাদা গ্যাং বানিয়ে নিয়েছে! কী সাংঘাতিক! সেই গ্যাং নিয়ে ক্লাসের সবাইকে জুলুমের ওপর রাখে। কাল গার্জিয়ান মিটিং হলো। মেজবাহ এসে আমাকে বলে,
-‘মামনি, একটু কষ্ট কইরা আমার কলেজ থেইকা ঘুইরা আইসো। আবহাওয়া ভালো লাগব। সাথে মামার ঝালমুড়িটা হেব্বি! একবার খালি যাইয়া কইবা—তুমি ওয়াজিহ্ মেজবাহর লোক। আনলিমিটেড ফ্রি পাইবা! নামের একটা জোর আছে, বুঝছ?’
আমি কড়া চোখে তাকিয়ে বলি,
-‘মেজবাহ! শুদ্ধ বলবে। এসব কী ভাষা?’
মেজবাহ মুখ কুঁচকে বলে,
-‘আমি কি তোমার লগে সিরিয়াস আলাপ পারতাছি? যেমনে কইতাছি, কইবার দেও। এডিতে যেই শান্তি আছে, অন্যডিতে পাইবা?’
আমি শ্বাস ছাড়ি থেকে থেকে। ছেলেটা একদম অসম্ভব! দুই পরিবারের কেউ অশুদ্ধ বলি না, অথচ এটা? তারপরই খেয়াল হলো, ও আমাকে ওর স্কুলে ঘুরতে যেতে বলেছে। আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ছেলেটা দৌড়ে চলে গেল, বন্ধুরা এসে গেছে ওর।
আমি বুঝেছি, আবারও স্কুলে কিছু একটা ঘটিয়েছে আর গার্জিয়ান ডেকেছে। ওর বাবা-মা বিষয়টা জানে না, জানলে বকবে-মারবে; যেগুলো ও সহ্য করবে না। বাড়ি ছেড়ে বন্ধুর বাসায় গিয়ে থাকবে। এজন্য এসব আমিই হ্যান্ডেল করি।
ও রোজ কিছু না কিছু করবে, আর সপ্তাহ শেষে আমি যাব। এখন প্রিন্সিপাল ওকে শোধরানোর বিভিন্ন উপদেশ দেওয়াও বাদ দিয়ে দিয়েছেন। আমি যাই, তিনি প্রোগ্রেস রিপোর্ট হাতে তুলে দেন। নাহ, সবেতেই ভালো মার্ক্স! এক্সামের সব সাবজেক্টের সাথে মারপিট, চুলোচুলি সবেতেই প্লাস এসেছে। অতঃপর প্রিন্সিপাল ম্যাম আর আমি দু’জনেই দু’জনের দিকে তাকিয়ে ভদ্রতাসূচক হেসে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। বিষয়টা এখন অতিমাত্রায় স্বাভাবিক। কবে যেন টিসি ধরিয়ে দেয়, সেটাও অস্বাভাবিক নয়।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১১ মার্চ, ২০০৬
“আজ মাহফুজকে কত করে বললাম, মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে যাব! সে নাকি ব্যস্ত, অফিসে ঢেড় কাজ! কাজেরে গুলি মারি। এত কাজ কেন করবে? প্রচুর মন খারাপ হলেও, পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিতে সক্ষম আমি। আজ-কাল এসব যেন দুধ-ভাতের মতোই সাধারণ। মাহফুজ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ইদানিং আমার দিকে অকারণে তাকায় না। মুগ্ধতা কমে এসেছে বোধহয়। কবে যেন মিটে যায়! দীর্ঘশ্বাস আসে।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২৬ মার্চ, ২০০৬
“বন্ধুত্বের ৩ বছর, প্রণয়ের ৬ বছর, পরিণয়ের ৩ বছর শেষে পূর্ণতাপ্রাপ্ত (মা হওয়া) ৩য় বর্ষ পেরোল। মোটে ১৫ বছর। একটা মানুষের মনে স্থায়িত্ব করে নেওয়ার জন্য ১৫ বছর কি যথেষ্ট নয়? নাকি একজনের মন থেকে উঠে যাওয়ার জন্য ১৫ বছর যথেষ্ট? আমার কলিজা কাঁপে ইদানিং। আশ্চর্য! মাহফুজের চোখ এখন আর আমায় খোঁজে না।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২১ নভেম্বর, ২০০৬
চলবে..