#প্রেম_পায়রা (২)
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_____১২
আস্তে করে মাথাটা বাম পাশে ঘুরালো সম্পদ। সঙ্গে সঙ্গে পিলে চমকে উঠলো তার। তিথি বিছানায়? তার পাশে শুয়ে আছে? চোখ ডলে আবার তাকালো সে। নিজের চোখকে ভুল প্রমাণিত করতে পারলো না। তিথি সত্যি সত্যি তার পাশে শুয়ে আছে। কিন্তু দুজনের মাঝে যথেষ্ট দূরত্ব। তবুও সম্পদের ভেতরে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গেল। এতদিন বুকের ভেতর থাকা জড় হৃদপিণ্ডটা ফের জীবন ফিরে পেল। নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য ক্রমশ সেটা বাড়তে থাকলো। সম্পদ মুচকি হাসলো। মাথাটা সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে তিথির দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিল।
তিথি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। এত শান্তির ঘুম সম্পদ কাউকে ঘুমাতে দেখেনি। তার নিজের ঘুমও হারাম হয়ে গেছে এই মেয়েটা তার জীবনে আসার পর থেকে। প্রথম বার যখন তিথির দূর্ঘটনার কথা শুনেছিল সেদিনের অনুভূতি আর ইদানীং কার অনুভূতি সম্পূর্ণ আলাদা। একই মানুষের বুকের গহীন থেকে উৎপন্ন হওয়া দুই রকমের আলাদা অনুভূতি। দুই মেরুর যেন! তখন তিথির দিকে তাকালে তার চোখ জ্বলে উঠতো। মনে হতো উত্তপ্ত কোনো বস্তুর দিকে তার চোখ পড়লো। এক দগ্ধ আগুনে মন পুড়ে উঠতো। কিন্তু এখন তিথির মুখের দিকে তাকালে দু চোখে মুগ্ধতা এসে ভর করে। কি সুন্দর, স্নিগ্ধ আর পবিত্র এ মুখ! এই মুখের দিকে তাকালে প্রশান্তি অনুভব হয়। ভালো লাগার শীতলতায় ছেয়ে যায় মন-জমিন। দু চোখে ঘোর লেগে আসে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ও মুখের দিকে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে জনম জনম। শুধু চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে!
ঘুমের মধ্যে তিথির ঠোঁটটা হালকা প্রসারিত হলো। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো স্পষ্ট কিন্তু ক্ষীণ একটা হাসির রেখা। সম্পদ প্রচন্ড রকম খুশি হলো। কতদিন পর তিথির মুখে অল্প একটু হাসি দেখতে পেল। অবশেষে তিথির দুঃস্বপ্ন গুলো কি পিছু ছাড়লো? সে প্রায় রাতে দেখেছে ঘুমের মধ্যে তিথি দুঃস্বপ্ন দেখে তার থেকে উত্তরণের জন্য আকুপাকু করে। মেয়েটার কপাল কুঁচকে আসে বার বার। এই প্রথম সে তিথির ঠোঁটের কোণে হাসি দেখলো। এক চিলতে মিষ্টি হাসি। ভালো লাগলো এটা ভেবে যে তিথি নতুন করে সুখস্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। ঘুমের মধ্যে তার কুঁচকানো কপালের জায়গা হাসি ফুটে উঠছে। তপ্ত শ্বাস ফেলে সম্পদ হাতটা বাড়িয়ে দিল তিথির দিকে।
মাথার এক ইঞ্চি উপরে হাতটা নিতে সম্পদের মুখটা চুপসে গেল। চোখে মুখে এসে ভর করলো কৌতূহল। মনে প্রশ্ন জাগলো কোন স্বপ্ন দেখে তিথি ঘুমের মধ্যে হাসলো? কে ছিল তার স্বপ্নে যে তাকে এত মধুর করে হাসতে বাধ্য করলো? মনের অতলে উৎপন্ন হওয়া প্রশ্নের কোনো উত্তর না পেয়ে মন খারাপ হয়ে গেল তার। বিষন্ন কন্ঠে বলল,
‘তোমার স্বপ্নে কে ছিল তিথি? বলো না!’
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। তিথির মাথার উপরের হাতটা সরিয়ে আনলো। তিথির স্বপ্নে যে-ই থাকুক, সে মেয়েটার প্রতি কৃতজ্ঞ। বরাবরই জীবন সম্পর্কে ভীষণ উদাসীন ছিল সে। তার অন্ধকার আর নিঃসঙ্গতায় ভরপুর জীবনটাতে মেয়েটা ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে। এখন বেঁচে থাকার সঠিক মানে খুঁজে পেয়েছে। এখন তার হাজার জনম বাঁচতে ইচ্ছে হয়। হাজার জনম শুধু এই মেয়েটাকে পাশে রেখে বাঁচতে ইচ্ছে হয়।
নিজের ভাবনাতে নিজেই চমকে উঠলো সম্পদ। এসব কি ভাবছে সে? সে কি শুধু মেয়েটার প্রতি দূর্বল? নাকি ইতোমধ্যে ভালোবেসে ফেলেছে? অসম্ভব! দ্রুত তিথির থেকে চোখ সরিয়ে নিল। দু হাতে নিজের গাল স্পর্শ করলো সে। ওয়াশরুমে যেতে হবে। কিন্তু এভাবে ভাঙা পা নিয়ে একা যাওয়া সম্ভব নয়। কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হলো তার। ফের তিথির দিকে তাকালো। তিথি কাঁদার মতো ঘুমিয়ে আছে। সম্পদ চাচ্ছে না, এই ঘুমটা নষ্ট করতে। নিজে নিজে উঠার চেষ্টা করলো। গায়ের উপর থেকে ব্লাঙ্কেট সরিয়ে ফেলল। সাবধানে সুস্থ পা টা ফ্লোরে রাখলো। এরপর সুবিধা করতে পারলো না। ভাঙা পা’টা ফ্লোর ছোঁয়ার আগেই ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো সে।
ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়লো তিথি। কয়েক সেকেন্ড শূন্য দৃষ্টিতে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করলো। সম্পদের ফ্লোরের উপর এক পায়ে দাঁড়ানো দেখে হুড়মুড় করে বিছানা ছেড়ে নামলো। ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,
‘আপনি মানুষ হবেন কবে? আমাকে ডাকতে হয় না?’
সম্পদ অস্ফুট স্বরে বলল,
‘তুমি ঘুমাচ্ছিলে।’
‘তো? আমি কি সারাজীবনের জন্য ঘুমিয়েছিলাম? ডাক দিলে উঠতাম না?’
সম্পদ কিছু বলল না। ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। ব্যান্ডেজ করা পায়ের দিকে চেয়ে আসসোস হলো। ওয়াশরুমে যাওয়ার ব্যাপারটা মাথায় ছিল না। এখন কি করবে সে? এ ক্ষেত্রে তিথির সাহায্য নিতেও কেমন লজ্জাবোধ হচ্ছে।
সম্পদকে নিশ্চুপ দেখে তিথি কপাল কুঁচকে বলল,
‘বসে পড়লেন কেন? কোথায় যেন যাওয়ার প্লান করেছিলেন। যাবেন না?’
সম্পদ অসহায় মুখে ওয়াশরুমের কথা উচ্চারণ করতে পারলো না। শুধু বাম হাতের একটা আঙুল তুলে ওয়াশরুম নির্দেশ করলো। তিথির কুঁচকানো কপাল শিথিল হলো। কিন্তু কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। শুষ্ক গলায় বলল,
‘উঠে পড়ুন। আমি নিয়ে যাচ্ছি।’
তিথি এগিয়ে এসে তার বাহু চেপে ধরলো। তিথির উপর ভর রেখে সম্পদ এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। হতাশ সুরে বলল,
‘আমায় জায়গা তোমার পা ভাঙলে এত কষ্ট করতে হতো না তোমার। আমি ইজিলি কোলে তুলে এখানে ওখানে নিয়ে যেতে পারতাম। কত কষ্ট করতে হচ্ছে আমায়।’
‘আপনি কি এখন আমার কোলে উঠতে চান?’
সম্পদ থতমত খেল। ওয়াশরুমের পাল্লায় সামান্য ভর ছেড়ে দিল। বলল,
‘আমি সেটা বলিনি। বললাম যে তোমার পা ভাঙলে…… ‘
‘আপনি চান যে আমার পা ভেঙ্গে যাক?’
‘আরে না! উল্টোপাল্টা বুঝো কেন তুমি? দেখি দরজা বন্ধ করো তো।’
তিথি সম্পদের হাত ঢিলে করলো। কনফার্ম হওয়ার জন্য বলল,
‘পারবেন তো?’
‘হুঁ!’
অগত্যা তিথি তার হাত ছেড়ে দিল। ওয়াশরুমের দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে সরে এলো। লম্বা একটা হাই তুলে বিছানায় বসলো। কতদিন পর এত গভীর ঘুম ঘুমাল! কতগুলো রাত পর আজ প্রথম সে দুঃস্বপ্নের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে। আজ কোনো দুঃস্বপ্ন সে দেখেনি। কিন্তু কেন দেখেনি? এই কেন’র উত্তর খুব সহজে মিলল। গতকাল রাতে সম্পদের শরীরের কন্ডিশন নিয়ে ভীষণ চিন্তায় ছিল সে। কোনো ধরনের দুঃশ্চিন্তা করার সুযোগ হয়নি। মস্তিষ্কের সবটা জুড়ে সম্পদের অসুস্থতা ছিল। তার জীবনের দূর্ঘটনা ভাবার সময় ছিল না। সেজন্য হয়তো সাউন্ড স্লিপ হয়েছে। মনে মনে সম্পদের প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করলো সে।
‘তিথি!’
ওয়াশরুমের ভেতর থেকে সম্পদের ডাকে তিথির টনক নড়লো। দৌঁড়ে গেল সে। পাল্লা সরিয়ে দিতে সম্পদের ভেজা মুখ নজরে এলো। ইতোমধ্যে অল্প বিস্তর হাত-মুখ ধুয়ে ফেলেছে সে। কিছুটা কুঁজো হয়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা। তিথি একটু স্বস্তি পেল। গতকাল সম্পদ দাঁড়াতেই পারছিল না৷ কিন্তু আজ অন্তত এক পায়ে দাঁড়াতে পারছে।
সে সম্পদকে ধরে এনে বিছানায় বসিয়ে দিল। আধ শোয়া করে শুইয়ে দিল। শুকনো টাওয়াল এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘কপালের ব্যান্ডেজ ভিজে নি তো?’
‘নাহ! আয়নায় দেখে তারপর মুখ ধুয়েছি।’
‘ঠিক আছে।’
তিথি সরাসরি সম্পদের ঠোঁটের দিকে তাকালো। ঠোঁটের কোণা কালচে হয়ে গেছে। ক্ষত শুকিয়ে যাচ্ছে। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সম্পদ ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেল। বলে উঠলো,
‘কি দেখছো?’
‘কিছু না!’
বলে তিথি ঘুরে দাঁড়াল। ফ্লোরের বিছানা পত্র তুলতে গিয়ে তার মনে পড়লো মাঝরাত থেকে সে সম্পদের পাশে শুয়ে ছিল। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো তার। বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। সম্পদের জ্বরের কথা মনে পড়লো। চিন্তিত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো,
‘আপনার শরীর কেমন? জ্বর আছে?’
সম্পদ কপালে হাতের উল্টো পিঠ ছুঁইয়ে বলল,
‘কই? না তো!’
তিথি আর কিছু বলল না। সম্পদকে ওয়াশরুমে নেওয়ার সময় কোনো তাপমাত্রা অনুভব করেনি। তার মানে জ্বর ছেড়ে গেছে। চুপচাপ বিছানা পত্র গুছিয়ে ফেলল। তারপর রুমের এক কোণায় রেখে আসলো৷ দরজার দিকে এগোতে বলল,
‘আমি রান্না করে আনছি। বিশ্রাম নিন।’
১৬.
দুপুরের কাঠফাটা রোদে ভেসে যাচ্ছে শহর। সারাদিনের ব্যস্ত শহর কিছুটা ঝিমিয়ে এসেছে যেন। সামনের রাস্তায় তেমন গাড়ি নেই। রাস্তার ডানপাশে একটা খালি রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। রিকশাওয়ালা বিরস মুখে সিগারেট টেনে যাচ্ছে। নিজের রুমের জানালা দিয়ে স্পষ্ট সব দেখতে পেল তিথি। দুপুরবেলা শাওয়ার নেওয়ার পর থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছে সে। ভেজা চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে আছে। জানালা দিয়ে ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। বাতাসে চোখের সামনে দুলতে থাকা চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিল। ব্যস্ত নগরী দেখতে দেখতে এতক্ষণ পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করছিল সে। এখন সরে পরা দরকার। ভেজা চুল হাত দিয়ে ঝেড়ে সরে আসতে নিল। হুট করে তার চোখ গেল রাস্তার অপজিটের কান্তা ভিলার উপর। বহুতল ভবনটার চার তলায় একটা পুরুষ অবয়ব দেখতে পেল। অবয়বটার দৃষ্টি তার দিকে সেটা বুঝতে তিথি ভীষণ আহত হলো। প্রচন্ড মন খারাপ হয়ে গেল তার। না জানি কখন থেকে বা কবে থেকে মানুষটা তাকে এভাবে দেখছে। কোন পুরুষ মানুষের দৃষ্টি তার সহ্য হয় না। ঘৃণায় শরীর গুলিয়ে উঠলো। দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেল সে।
কিছুক্ষণ পর চোখে মুখে পানি দিয়ে বের হলো। আড়াল থেকে জানালার পর্দা টেনে নিল। মুখ মুছে ড্রয়িং রুমে বসলো। সম্পদের রুমের দিকে এক পলক তাকালো। সম্পদকে দুপুরের খাবার খাওয়ানো হয়েছে। মেডিসিন দেওয়া হয়েছে। আপাতত ঘুমাতে বলে সে বের হয়েছিল। সময় কাটানোর জন্য সে টিভি অন করলো। সবেমাত্র রিমোট হাতে নিয়েছিল সে। দু তিনটা চ্যানেল পাল্টাতে সম্পদের ডাক কানে এলো। অত্যন্ত মোলায়েম স্বরে ডেকে যাচ্ছে,
‘তিথি? তিথি?’
সম্পদ তাকে খুব একটা নাম ধরে ডাকে না। কিন্তু মাঝে মধ্যে হুটহাট নাম ধরে ডাকলে তিথি পুলকিত অনুভব করে। ভেতরটা ভালো লাগায় ছেয়ে যায়। মন নেচে উঠে! আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।
‘তিথি? এই তিথি? শুনছো না কেন?’
সম্পদের হুড়মুড় ডাক তিথি অগ্রাহ্য করতে পারলো না। রিমোটটা কাউচের উপর রেখে উঠে দাঁড়ালো সে।
(চলবে)
কিছু কথা। জানি অনেকেই ‘অনুভবের প্রহর’ গল্পটার জন্য বেশি অপেক্ষা করেন। কিন্তু সেটা না দিয়ে শুধু ‘প্রেম পায়রা’ দেওয়ার চেষ্টা করি। সত্যি বলতে আমি নিজেও ‘অনুভবের প্রহর’ লিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। ওটার সম্পূর্ণ প্লট সাজানো শেষ। কিসের পর কি হবে সব। কিন্তু লেখার সময় হচ্ছে না। আর ‘প্রেম পায়রা’ বাধ্য হয়ে লিখতে হচ্ছে। কারণ গল্পটা একটা পাবলিক গ্রুপ আর তাদের পাবলিক পেইজে যাচ্ছে। সেখানকার রুলস হলো ডেইলি গল্প দিতে হবে। সেজন্য যেটুকু সময় পাই বাধ্য হয়ে ওটা লিখতে হয়। বুঝতে পেরেছেন সবাই? ইনশাআল্লাহ খুব দ্রুত সব ঠিক হয়ে যাবে। পরিশেষে, শুভরাত্রি।