প্রেম পায়রা ২ পর্ব ২২

#প্রেম_পায়রা (২)
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_____২২

মুহূর্তে তার হাতের ভাঁজে থাকা তিথির আঙুল নড়ে উঠলো। সম্পদ চমকে মাথা উঁচু করলো। তিথি দূর্বল চোখ মেলে তাকালো। তিথির নিশ্চুপ নিরবতা সম্পদের শরীরেও কোথাও কাঁটার মতো বিঁধতে লাগলো৷ তার চোখ মুখে এক চোরাভাব বিদ্যমান! এভাবে লজ্জায় পড়তে হবে তা কল্পনায় ছিল না। তিথির নিষ্পলক চোখের দিকে চেয়ে সে দ্রুত বলল,

‘এখন কেমন লাগছে তিথি? ঠিক আছো তুমি?’

সম্পদের মুঠোর ভেতর আলগা হয়ে থাকা হাতটা তিথি সরিয়ে আনলো। সম্পদের চমকে উঠে সুরের শৃঙ্খলা আর চমৎকারিত্বে মুখে হাস্যোজ্জ্বল ভাব চলে এলো। বিড়বিড়িয়ে বলল,

‘আপনি কি করছিলেন এতক্ষণ?’

‘কিছু না! কি করবো? এই তোমার পাশে বসে ছিলাম।’

সম্পদের বজ্রাহতের মতো ঝটপট উত্তরে তিথি আনন্দ পেল। শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিশ্চুপ রইলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ প্রশ্ন করলো,

‘আমার কি হয়েছে?’

সম্পদ এই প্রশ্নের অপেক্ষা করছিল। বিনা বাক্যব্যয়ে তিথির ডান হাতটা পুনরায় স্পর্শ করলো। সে আপাতত তিথিকে এসব ব্যাপারে না বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিথির মনোকষ্টের সামান্য তম দীর্ঘশ্বাস পড়তে দিতে চায় না সে। চায় না তিথি পুর্নবার বিন্দুমাত্র কষ্ট পাক। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরে শুনলে শুনবে! মৃদ্যু হেসে সে বলল,

‘কোথাও কোনো অস্বস্তি হচ্ছে তিথি?’

‘না!’

‘গুড। এবার ঘুমাও তো!’

‘আপনি কি চলে যাবেন?’

‘তোমাকে এখানে রেখে চলে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।’

তিথি চোখ সরিয়ে নিল লজ্জায়। সম্পদের ছোট্ট একটা বাক্যে বুকের ভেতরটা আলাদা ভালো লাগায় ছেঁয়ে গেল। হৃদয়ে ভরসার স্থান সৃষ্টি করলো। খুশিতে অন্তরাত্মা দোলা দিয়ে গেল। ঠোঁট চেপে হাসি বন্ধ করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে গেল সে। নিচু স্বরে বলল,

‘আপনি একা কেন? আর মানুষজন কোথায়?’

‘কেউ কেউ বাড়ি চলে গেছে। তোমার মা, ফুপি, মারিয়া ভাবী হসপিটালে আছে।’

‘হুঁ!’

‘দেখা করবে?’

তিথি উত্তর দিল না। কয়েক সেকেন্ড ভেবে মাথা নেড়ে অসম্মতি প্রকাশ করলো৷ তার কেন যেন বুকের ভেতর সুখ সুখ অনুভূত হচ্ছে। সম্পদের হাতের মুঠোয় থাকা হাতটির দিকে এক পলক তাকালো। প্রথমবারের মতো নিজে থেকে আঙুল গুলো আঁকড়ে ধরে চোখ খিঁচে বন্ধ করলো। সম্পদ থম মেরে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো তিথির মুখাপানে। ভেতরের অনুভূতি গুলো জমে গেল যেন! দীর্ঘক্ষণ পর তার ঠোঁটের কোণে লজ্জা মিশ্রিত হাসি ফুটে উঠলো।

২৭.

ধানের সবুজ পাতা হলুদ হয়ে এসেছে। সবুজে সবুজ মাঠ জুড়ে এখন হলুদের ছোঁয়া। সোনালি ধানগুলো হাওয়ার তালে তালে দুলে বেড়াচ্ছে! মাটি অনেকটা শুষ্ক আর রুক্ষ হয়ে এসেছে। গ্রামের সবাই এখন ধান কাটায় ব্যস্ত। বর্ষার পানি আসি আসি! যতদ্রুত সম্ভব ধান ঘরে তোলা প্রয়োজন। শেষ বিকেলে বড় আমগাছ টার নিচে মোড়া পেতে বসে ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে ছিল তিথি। এর মধ্যে দেড় মাস কেটে গেছে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার আর ঢাকাতে যাওয়া হয়নি। অসুস্থ শরীর নিয়ে কেউ যেতে দেয়নি। সম্পদ একা-ই চলে গেছে।

দেড়-দেড়টা মাসের মধ্যে সম্পদ একবার গ্রামে এসেছিল। মাত্র দুই রাত ছিল। পরদিন চাকরির অযুহাত দিয়ে সেই যে শহরে পাড়ি জমিয়েছে। আর ফেরার নাম নাই! এসব ভাবতে তিথির মুখটা গম্ভীর হয়ে এলো।

উত্তপ্ত শ্বাস ছেড়ে সে মুঠোফোন বের করলো। গ্যালারিতে থাকা সম্পদের ছবিগুলো একের পর এক দেখতে লাগলো। কতগুলো দিন হলো মানুষটাকে সামনে থেকে দেখা হয় না! সম্পদের সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলো মাসনপটে সবসময় ভেসে উঠে। সে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। তবুও সম্পদ তাকে কেন নিজের কাছে নিয়ে যাচ্ছে না তা সে জানে না। ইদানীং তিথি খেয়াল করেছে সম্পদ তার সাথে ফোনে কথা বলার সময়ও কেমন তাড়াহুড়ো করে। ভালো মতো কথা বলতে চায় না। এমন ভাব করে যেন তার সাথে কথা বলার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে আছে।

তার বুকের ভেতর পুড়ে উঠলো। সম্পদ কি চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে? এই যে এতগুলো দিন মানুষটাকে দেখতে না পেয়ে সে কষ্ট পাচ্ছে, বুকের গহীনে পুড়ে উঠছে, সর্বক্ষণ তার কথা মনে পড়ছে, মানুষটার বড্ড অভাববোধ করছে এসব সম্পদের সাথে হচ্ছে না? এতগুলো দিন তাকে না দেখে কিভাবে রয়েছে সম্পদ? তার কথা কি একবারও মনে পড়ছে না? তিথির বুক ভার হয়ে এলো। চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।

সম্পদের প্রতি তার অনুভূতির কি নাম মে জানে না। শুধু জানে, পৃথিবীর এই একটি মানুষের কাছে সে সবচেয়ে নিরাপদ মনে করে। একমাত্র ভরসার স্থান পায়! এই একটি মানুষের কাছে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে না। নিজের সব কষ্ট, দুঃখ, সব অপরাধ, সব গ্লানি ঢেলে দিতে ইচ্ছে করে। এই একটা মানুষ তার একমাত্র কমফোর্ট জোন। তার একমাত্র সত্যি! সে এতদিনে বুঝেছে সবুজ আর সম্পদ সম্পূর্ণ দুই মেরুর মানুষ। একজন তাকে চুরমার করে দিয়েছে, জঘন্য ভাবে ঠকিয়েছে। আরেকজন তার ভেঙে চূড়ে যাওয়া ‘আমি’ কে পরম মমতায়, নিখুঁত শৈল্পিক হাতে জোড়া দিয়েছে। তার প্রতিটি ক্ষতের যত্ন নিয়েছে। ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার নোংরা শরীরকে পবিত্রতা দান করেছে। তার একমাত্র ভরসার স্থান হয়েছে। পুরুষজাতিকে নিয়ে যে বিদ্বেষ তার মনে জন্মেছিল তা গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিয়েছে। তার দূর্দিনে, অসময়ে পাশে থেকে প্রমাণ করেছে পৃথিবীর সব পুরুষ এক রকম নয়!

পুরুষ জাতির উপর দ্বিতীয় বার বিশ্বাস না করা দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় বদ্ধ থাকা তার মনে সম্পদ বিশ্বাসের, ভরসার শক্তপোক্ত খুঁটি স্থাপন করেছে। তিথি তাকে ভালোবাসে কি না জানে না। তবে এই দেড় মাসে বুঝে গেছে এই মানুষটাকে ছাড়া তার বেঁচে থাকা অসম্ভব। কখনো পারবে না সে! কখনো না! আর কিছুদিন মানুষটার থেকে দূরে থাকলে, না দেখতে পেলে সে নিশ্চিত দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে।

চোখের জল মুছে তিথি প্রথমবারের মতো নিজের অনুভূতির কাছে হার মানলো। নত স্বীকার করলো। স্মিত হেসে গোধূলির আবীর মাখা বিকেলে সে মেসেজ লিখলো। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাংলা অক্ষরে টাইপ করলো ‘আই মিস ইউ মি. প্রোপার্টি’! মি. প্রোপার্টি দিয়ে সেভ করা নাম্বারে পাঠিয়ে দিয়ে অশ্রুমিশ্রিত চোখে হাসলো সে৷ তাকে দেখে শেষ বিকেলের গুমোট প্রকৃতিও হেসে উঠলো।

২৮.

মাঝরাতে ফুপির রুমের দরজায় ধুপধাপ শব্দ হতে তিথির ঘুম ভেঙে গেল। হঠাৎ শব্দে ভয়ানক চমকে উঠলো। পাশ ফিরে ফুপিকে ডাক দিল। কিন্তু ফুপির কাঁদার মতো ঘুম ভাঙানো সম্ভব হলো না। কান একটু সতর্ক হতে দরজার ওপাশ থেকে মায়ের কন্ঠ ভেসে এলো। এতক্ষণে তিথির কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো। বালিশের চিপা থেকে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো রাত তিনটের কাছাকাছি৷ এত রাতে মা ডাকছে কেন?

অন্ধকারে ওড়না গায়ে জড়িয়ে সে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ক্ষীপ্র হাতে দরজা খুলতে মায়ের মুখটা দৃশ্যমান হলো। তিথি চিন্তিত স্বরে জিগ্যেস করলো,

‘এত রাতে ডাকছো কেন মা? কিছু হয়েছে?’

‘হ! হইছে!’

‘কি হয়েছে?’

তার মা উত্তর দিল না। তিথির ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। মাকে বেশ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। কিছু হলে তো এত স্বাভাবিক থাকার কথা নয়। সে পুনরায় কিছু জিগ্যেস করার চেষ্টা করতে তার মা হাসিমুখে বলল,

‘বাইরে আয় তো!’

মা চলে যাওয়ার পরও তিথি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এটা কি হলো? মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে এসব কি মশকরা শুরু করেছে? সে বিরক্তি নিয়ে মাথার চুল হাত খোঁপা করলো। চোখ মুছে বাইরে বের হলো। মাঝের উঠোন টুকু পেরিয়ে মায়ের রুমের দিকে পা বাড়াতে অন্ধকারে এক লম্বা পুরুষ অবয়ব স্পষ্ট উঠলো। তিথি চমকে বলে উঠলো,

‘কে?’

পুরুষ অবয়ব কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ রইলো। অতঃপর বিমোহিত সুরে উত্তর দিল,

‘মি. প্রোপার্টি!’

‘উনি কোথা থেকে আসবে?’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here