প্রেম পায়রা ২ পর্ব ২১

##প্রেম_পায়রা (২)
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_____২১

সরু পথ দিয়ে লাল বাল্বের আলো আসছে। সম্পদ তিথির নাম ধরে ডাক দিল। হন্তদন্ত হয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোল। দরজা ধাক্কা দিয়ে সরাতে বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। তিথি দেয়ালে হেলান দিয়ে পিঠ বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিচের সম্পূর্ণ মেঝেতে রক্তের ছড়াছড়ি। সম্পদ তোতলানো সুরে বলল,

‘এ-এত ব্লাড কো-কোথা থেকে আসলো?’

তিথির মুখ দিয়ে চিঁচিঁর মতো একটা শব্দ বের হলো৷ মুখে যন্ত্রণার ছাপ গভীর ভাবে ফুটে উঠেছে। সম্পদ দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তাকে দু হাতে আগলে নিল। তিথি নেতিয়ে পড়লো তার বুকের উপর। দাঁত চেপে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো। সম্পদ বুঝতে সক্ষম হলো না। তিথির পায়ের দিকে তাকাতে মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো তার। দু পায়ের পাতা দিয়ে রক্তের ধারা। শরীর কেঁপে উঠলো সম্পদের। বিচলিত কন্ঠে শুধাল,

‘তিথি কি হয়েছে? তুমি ঠিক আছো?’

তিথি মাথা নেড়ে না বোধক সম্বোধন করলো। তার শরীর ক্রমেই ঠান্ডা হয়ে আসছে। সম্পদ দ্রুত পাঁজাকোল করে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। রুমের লাইট অন করে তিথির কাছে এগিয়ে গেল। তিথির আতংকে জমে থাকা মুখটাতে রাজ্যের ভয়! পেট চেপে ধরে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছে। সম্পদের চোখে মুখে দিশাহারা ভাব। সবকিছু তার ভয়ানক কোনো দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে। নিজেকে উদ্ভ্রান্ত মনে হচ্ছে। কাঁপা কাঁপা হাতে পায়ের নিচের কাঁথাটা এনে তিথির গায়ে জড়িয়ে দিল। মাথায় হাত বুলিয়ে কম্পিত স্বরে বলল,

‘তিথি? কি হয়েছে? কোথায় কষ্ট হয়? বলো আমায়! পেট ব্যথা করে?’

‘আমার মাকে বা ফুপিকে ডাকুন সম্পদ।’

তিথির ভাঙা ভাঙা কন্ঠের উত্তর কানে যেতে সম্পদ তার চোখে মুখে হাত বুলালো। যেন ব্যথা মুছে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা। কিয়ৎক্ষণ পরে শশব্যস্ত হয়ে বলল,

‘আমি এক্ষুণি ডেকে আনছি।’

বলে সে দৌঁড়ে দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে গেল।

২৭.

ভোরের আলো ফুটেছে অনেক আগে। ঝলমলে রোদ নৃত্য করছে এ ধরায়। রাতের প্রকৃতির বেপরোয়া ভাব থিতিয়ে এসেছে। প্রকৃতিতে কেমন প্রেম প্রেম ভাব! ক্লিনিকের বারান্দায় হাত ছড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল সম্পদ। এতক্ষণে চেপে রাখা দুশ্চিন্তা গুলো মু্ক্ত করে দিল। অবশেষে অস্থির অবস্থা থেকে কিছুটা নিষ্কৃতি মিলল। তিথি এখন একটু সুস্থ।

চোখের দৃষ্টি চারপাশে ঘুরপাক খেতে লাগলো তার। বারান্দার নিচ দিয়ে গোটা চারেক কাঁঠাল গাছের চারা দেখা যাচ্ছে। চারাগুলোর মরণ দশা। দেখে বোঝা যাচ্ছে গাছগুলোতে কখনো পানি দেওয়া হয় না। তবুও কঠিন রসকষহীন মাটির বুকে শীর্ণ পাংশুটে গাছগুলো বেঁচে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে। শুষ্কবক্ষ কঙ্কালবশেষ গাছগুলো ধরণীর একটু কৃপার অপেক্ষা করছে হয়তো। সম্পদ হাসলো! তার জীবনে এতটা শুষ্কতা নেই! তিথি যতদিন তার পাশে আছে, কাছাকাছি আছে তার জীবনে কোনো শুষ্কতা ঠাঁই পাবে না। তার হাস্যমুখখানি যতক্ষণ সে দেখতে পাবে ততটা সময় তার কাছে স্পেশাল। খুবই স্পেশাল!

‘সম্পদ!’

সম্পদ ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছনে তাকালো। তিথির বাবা তরিকুল ইসলাম! সম্পদ তাঁর দিকে এগিয়ে আসলো। নিজেকে একটু ঠিকঠাক করে বলল,

‘হ্যাঁ বাবা! বলুন!’

তরিকুল ইসলাম হাতের রিপোর্টটা সম্পদের দিকে বাড়িয়ে দিল। ভারিক্কি কন্ঠে বলল,

‘রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। ডাক্তারের সাথে কথা বলতে হবে।’

‘আমি যাচ্ছি বাবা।’

‘ঠিক আছে।’

সম্পদ রিপোর্ট টা উল্টেপাল্টে দেখে হাঁটা শুরু করলো। গতকাল রাতে তিথির অবস্থা খারাপ দেখে দ্রুত স্থানীয় ক্লিনিকে নিয়ে আসা হয়েছিল। এখানে এনে কিছু টেস্ট করে, চিকিৎসা দিয়ে এখন একটু সুস্থ!

ডাক্তারের চেম্বারে বসে কুলকুল করে ঘামতে লাগলো সম্পদ। দুশ্চিন্তা গ্রস্থ চোখ দুটো বয়স্ক ডাক্তারের উপর ন্যস্ত। ফিনফিনে সাদা চুলের ডাক্তারটি গভীর মনোযোগ দিয়ে রিপোর্ট দেখছে। কিছুক্ষণ পর রিপোর্ট থেকে মুখ তুলে সম্পদের দিকে তাকালো। গম্ভীর কন্ঠে শুধাল,

‘রোগীর কে হন?’

‘হাজব্যান্ড!’

‘বিয়ের সময় সীমা কত?’

সম্পদ সহসা উত্তর দিল না। কিছুটা আতংকিত সে। তিথির হঠাৎ অসুস্থতার ব্যাপারে একটু আন্দাজ করেছে। তাকে চুপ থাকতে দেখে ডাক্তার বলল,

‘আপনার ওয়াইফ কনসিভ করেছিল। ভ্রুণের বয়স দেড় থেকে দুই মাসের কাছাকাছি। কিন্তু মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। এটা কি প্রথম বারের মতো? নাকি এর আগেও মিসক্যারেজ হয়েছে?’

সম্পদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মাথা দু হাতে চেপে ধরে আবার ছেড়ে দিল। শরীর এলিয়ে দিয়ে বলল,

‘প্রথমবারের মতো! আমাদের বিয়ের সময়সীমা দুই মাসের কাছাকাছি। ডক্টর আমার ওয়াইফ সুস্থ আছে তো?’

‘হ্যাঁ। সে এখন আশঙ্কামুক্ত। ব্লিডিং বেশি হয়েছিল। এক ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে। তবে দেরিতে হসপিটালে আনলে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতো। মিসক্যারেজের পর অনেকেই ডাক্তারের শরণাপন্ন হয় না। স্বাভাবিক ভাবে নেয়। কিন্তু এটা বড় ধরনের রোগ। নারীদেহের বিভিন্ন ইনফেকশন, হরমোনাল ইমব্যালান্স, ভ্রুণ স্থাপনে অসঙ্গতি আবার থাইরয়েড সমস্যার কারণে মিসক্যারেজ হয়।’

‘হুঁ! বুঝতে পেরেছি। ওকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে কবে?’

‘আজ বিকেলে অথবা কাল নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু রেস্টে রাখতে হবে দীর্ঘদিন৷’

সম্পদ মাথা নাড়লো। চোখ দুটো টেবিলে নিবদ্ধ তার। বুকের কোথাও পুড়ছে। কেন পুড়ছে সে জানে না! আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস হলো না। তাকে নিরব দেখে ডাক্তার নিজে থেকে বলল,

‘আপনার স্ত্রীর থাইরয়েড সমস্যা আছে৷ যাদের এ সমস্যা থাকে তাদের পিরিয়ডে অনিয়ম হয়। অনেক সময় থাইরয়েড সমস্যার কারণে মিসক্যারেজ হয়ে যায়। আপনার স্ত্রীর প্রথম বার-ই যেহেতু মিসক্যারেজ হলো, সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে মা হলে অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে৷ ভ্রুণের বয়স ২০ সপ্তাহ পর্যন্ত মিসক্যারেজ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। পুরোটা সময় খুবই সতর্ক থাকতে হবে। এখন থেকে কিছু ওষুধ সেবন করতে হবে। আর সাবধানে থাকতে হবে। না হলে মা হওয়া কঠিন!’

সম্পদ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। ডাক্তারের সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে সে বের হলো। তিথির কেবিনের পাশে সবাই চিন্তিত হয়ে বসেছিল। তার নিজের পরিবারের সবাই এসে পড়েছে। সে এগিয়ে গিয়ে সবাইকে আশ্যস্ত করলো।

২৭.

ছোট্ট একটা রুম। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দুপুরের কড়া রোদ আসছে। জানালার পর্দা টেনে দিয়ে সম্পদ বিছানার পাশে এসে বসলো। তিথি বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। তার মুখোচ্ছবি থেকে রাতের কালো ছায়াটা সরে গেছে। যেই ছায়াটা দেখে সম্পদ আঁতকে উঠেছিল। ক্ষণিকের জন্য তিথিকে হারানোর ভয় বুকে দানা বেঁধেছিল। এই মেয়েটিকে সে হারাতে পারবে না। কিছুতেই না!

তিথির বাম হাতে নরমাল স্যালাইন চলছে। ডান হাতটা সম্পদ স্পর্শ করলো। তিথির মুখপানে চেয়ে হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেল।

তিথির থাইরয়েড সমস্যা থাকুক বা যত বড়ো সমস্যা থাকুক না কেন সে তাকে কোনোদিন ছাড়তে পারবে না। সে কোনোদিন বাবা ডাক না শুনলেও এই মেয়েটিকে ছেড়ে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়৷ দীর্ঘ সাতাশটি বছর ছোটবড় যত অনুভূতি সে জমিয়ে রেখেছিল তার সবটা তিথি নিজের নামে করে নিয়েছে। তার হৃদয় নিংরানো ভালোবাসার প্রথম সাক্ষী, প্রথম অনুভূতি, প্রথম স্পর্শ, প্রথম ভালো লাগা এই মেয়েটি। তাকে ছাড়া তার পৃথিবী অস্তিত্বহীন।

চট করে কারো মায়ায় জড়ানো যায় না। একবার জড়ালে আর পিছু ফেরবার অবকাশ থাকে না। সে তিথি নামক মায়াজালে আটকে গেছে। তিথির হাজারো প্রত্যাখ্যান তাকে পুরনো সম্পদে পরিণত করতে পারবে না। তিথির মায়া কাটাতে পারবে না। পৃথিবীর এই একটা মানুষের প্রতি সে ভয়ংকর ভাবে দূর্বল। মস্তিষ্কের দিক দিয়ে, সচেতন-অবচেতন মনের দিক দিয়ে! এমনকি শারীরিক ভাবে, মানসিক ভাবে! তার সম্পূর্ণ ‘আমি’ টাই তিথির উপর দূর্বল।

সম্পদের মুখে স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠলো। মুখটা নিচু করে গভীর দৃষ্টিতে তিথির দিকে চেয়ে রইলো। তিথিকে নিয়ে সাজানো তার কল্পনার সাম্রাজ্যে মেয়েটির উপর সম্পূর্ণ অধিকার তার। শুধুমাত্র তার! কিন্তু বাস্তবের তিথির উপর তার অধিকার ফলাতে ভয় হয়! মেয়েটা যে তার অস্তিত্বের বড় দূর্বলতা!

তিথির হাতটা শক্ত করে মুঠোয় পড়লো সে। মুখটা আরো খানিকটা নিচু করলো। কিছু সময় অতিবাহিত হতে তিথির বন্ধ চোখের পাতায় ঠোঁটের গভীর স্পর্শ ছোঁয়ালো। মুহূর্তে তার হাতের ভাঁজে থাকা তিথির আঙুল নড়ে উঠলো। সম্পদ চমকে মাথা উঁচু করলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here