প্রেম পায়রা ২ পর্ব ২০

#প্রেম_পায়রা (২)
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___২০

একহাতে মাথার চুলগুলো ঠিক করলো সম্পদ। পরণের টিশার্ট টেনেটুনে রুমে ঢুকলো। বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলো তিথি ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। কতটা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। সম্পদের প্রচন্ড রকম হিংসে হলো! তিথির উপর, তিথির ঘুমের উপর। তার ঘুম কেড়ে নিয়ে, তার নির্ঘুম রাত্রিযাপনের একমাত্র কারণ হয়ে কত নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা!

তপ্ত শ্বাস ছেড়ে সে তিথির পাশে শুয়ে পড়লো। বাকি রাতটুকু ঘুমানো প্রয়োজন। না হলে ভোরবেলা মাথা ভার ভার লাগবে।

ডান কাত হয়ে দৃষ্টিটা তিথির আবছা মুখের দিকে ন্যস্ত করলো। একটু পর হাত বাড়িয়ে দিল তিথির পানে৷ তিথির মেলে রাখা বাম হাতটা স্পর্শ করে সে চোখ বন্ধ করলো।

চোখ বন্ধ করেও সম্পদ স্বস্তি পেল না। ছলকে পড়া রক্তের ঢেউ থামলো না। চোখ খুলে তিথির দিকে তাকালো। তিথি আর তার মাঝে বেশ খানিকটা দূরত্ব। এই দূরত্ব টুকু সম্পদ বিন্দুসদৃশ করতে চায়। বা তারচেয়েও কম! তিথির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে সে একটু কাছ ঘেঁষে এলো।

২৪.

সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে অনেক আগে। ভ্যাপসা গরমের মধ্যাহ্ন পেরিয়ে গেছে। রোদের ঝলকানি কোমল ও নরম হয়ে এসেছে। ফুরফুরে হাওয়ায় গাছের পাতাগুলো দুলছে। দুলছে দু পাশের ঝাউবন। স্নিগ্ধ হাওয়ায় শাড়ির আঁচল উড়ে চলেছে নতুন দিগন্তে। তিথি দু হাতে সেটা আঁকড়ে ধরে মাটির রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে। মুখে তার অপার হাসি। চোখ দুটো খুশিতে চকচক করছে। সেই চিরপরিচিত চেনা রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে পুরনো স্মৃতি গুলো মনে পড়ছে। সুখস্মৃতি, দুঃস্মৃতি! কিন্তু সব স্মৃতিই মূল্যবান। স্মৃতি মানেই বুকের গহীনের চিনচিনে সুখব্যথা!

গ্রামের মাটির চিকন রাস্তা। এদিক দিয়ে গাড়ি চলে না। তিথি হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। শেষ বিকেলের অপরূপ সৌন্দর্য্য মানসিক প্রশান্তি বয়ে আনছে। হঠাৎ বিমোহিত প্রকৃতি ছাপিয়ে কিন্নর একটা কন্ঠ কানে ভেসে এলো৷ মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটলো তিথির। দাঁড়িয়ে পড়লো সে। পেছন ঘুরে বলল,

‘কিছু বলছিলেন?’

‘বাসার কাছাকাছি এসে শরীরে কি ভর করলো তোমার? হুট করে হাঁটার গতিবেগ এত বেড়ে গেল কেন?’

চোখ সরু করে তিথি সম্পদের দিকে তাকালো। সম্পদ তার থেকে বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে৷ তার হাতে বড়সড় এক লাগেজ। লাগেজটা বয়ে নিয়ে আসতে যে তার কষ্ট হচ্ছে সেটা স্পষ্ট। কিন্তু তিথি কোনো সমবেদনা অনুভব করলো না। কারণ এই লাগেজের অর্ধেকের বেশি কাপড়চোপড়, জিনিসপত্র সম্পদের নিজের। সম্পদ যখন ব্যাগ গুছাচ্ছিল সে রীতিমতো টাসকি খেয়ে গেছে। কিন্তু কিছু বলে সুবিধা করতে পারেনি।

সম্পদ কাছাকাছি এসে দাঁড়াতে সে বলল,

‘আমি তো স্বাভাবিক গতিতে হাঁটছি।’

‘এটা তোমার স্বাভাবিক গতি মনে হয়? হাওয়ার উপর ভর দিয়ে উড়ে চলেছ! আমি দৌঁড়ে তোমার নাগাল পাচ্ছিলাম না।’

তিথি মৃদু হাসলো। সম্পদের মাথার চুলগুলো উপর দিকে ঠেলে রাখা। ফলস্বরূপ কপাল উন্মুক্ত। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে। তিথি দৃষ্টি সরিয়ে বলল,

‘লাগেজ আমি নিব?’

হাতের উল্টো পিঠে কপালের ঘাম মুছলো সম্পদ। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল,

‘তুমি ভাবলে কি করে তোমায় দিয়ে লাগেজ টানাবো? পৃথিবীতে কিছু কাজ সৃষ্টি হয়েছে শুধুমাত্র স্বামীদের জন্য। তুমি শুধু আস্তে হাঁটো।’

‘আপনি সামনে হাঁটুন তাহলে। আমি পেছন পেছন যাচ্ছি।’

‘পাশাপাশি চলো তিথি!’

সম্পদের কথায় তিথি কিঞ্চিৎ লজ্জিত হলো৷ সম্পদ হাঁটা শুরু করতে মাথা নিচু করে সে তার পাশাপাশি হাঁটা ধরলো। গ্রামের রাস্তা ধরে দু একজন বাজারে যাচ্ছে। তারা আড়চোখে তাকিয়ে রয়েছে। মধ্যবয়স্ক এক লোককে তিথি সালাম দিল। তার দেখাদেখি সম্পদও সালাম দিল। কুশলাদি জিগ্যেস করে আবার হাঁটা শুরু করলো।

কিছুদূর গিয়ে ডান দিকে বাঁক নিতে তিথির নিজের বাড়ি চোখে পড়লো। উত্তেজনায় চোখ ঝাপসা হয়ে এলো তার। একটু আগে বলা সম্পদের কথা মনে রইলো না। সম্পদকে পেছনে ফেলে প্রায় দৌঁড়ে বাড়িতে ঢুকে গেল।

বাড়ির ছোট্ট উঠোনে লাগেজ নামিয়ে রেখে সম্পদ হাঁপাতে লাগলো। বয়স্কা এক মহিলা প্লাস্টিকের চেয়ার এনে দিল। এই মানুষটাকে সম্পদ চিনে৷ তিথির ফুপি। সে সালাম দিয়ে চেয়ারে বসে পড়লো। আরেকটা চেয়ারে বসে পড়লেন উনি। স্মিত হেসে বললেন,

‘কেমন আছো বাবাজী?’

‘ভালো ফুপি। আপনি কেমন আছেন?’

‘আছি কোনো রকম। ছুটি কতদিনের তোমার বাবাজী?’

‘বেশিদিন হাতে নেই। আমাদের বাড়িতে কয়েকদিন থাকা হয়েছে। আপনার স্কুল কেমন কাটছে?’

‘আর স্কুলের কথা বলো না। বাচ্চা কাচ্চা পড়াতে পড়াতে মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। কবে জানি পাগল হয়ে যাই। গ্রামের বাচ্চাগুলো এত দুষ্ট! ওইদিন চতুর্থ শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছি। আচমকা চেঁচামেচির আওয়াজ পাই। গিয়ে দেখি ক্লাস ওয়ানের এক বাচ্চা কান্নাকাটি শুরু করেছে। সাথে বাচ্চার মা-ও চিল্লাফাল্লা শুরু করেছে। জাহিদ ছেলেটার ক্লাস চলছিল। অল্পবয়স্ক ছেলেটা কয়েক মাস হলো চাকরিতে জয়েন করেছে। আমি গিয়ে জিগ্যেস করলাম, কি হয়েছে জাহিদ? এত চেঁচামেচি কেন? জাহিদ উত্তর দিল না। চুপসানো মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। ফার্স্ট বেঞ্চে বসা বাচ্চা ছেলেটা কটমট করে জাহিদের দিকে তাকালো। চেঁচিয়ে বলে উঠলো, এই হারামজাদা আমাকে মারছে!
ভাবো একবার! বাচ্চা কাচ্চা পড়ানো কি যে ঝামেলা। সবসময় আতংকে থাকি। কখন কি বলে ফেলে! গ্রামের বাচ্চা কাচ্চা। বোঝই তো! মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছি দিন দিন।’

সম্পদ প্রতিত্তরে বলার মতো কিছু পেল না। তব্দা মেরে বসে রইলো। চোখ দুটো হন্নে হয়ে তিথিকে খুঁজে চলেছে। মনের আকাশে আশঙ্কার মেঘ দানা বাঁধছে। তিথি ফুপি সম্পর্কে আগে থেকে তাকে সতর্ক করেছিল। বাচ্চা কাচ্চা পড়াতে পড়াতে ফুপি কেমন যেন হয়ে গেছে। আর বেশিদিন তার কর্মজীবন নেই। রিটায়ার্ডের সময় হয়ে গেছে। সাথে মস্তিষ্কের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেল রিটায়ার্ড নিচ্ছে। যেটা সম্পদ খুব করে টের পাচ্ছে। ফুপির সামনে থেকে দ্রুত সরে পরা দরকার। না হলে কি না কি বলে ফেলবে।

২৫.

টিনশেড বিল্ডিং এর একেবারে কর্ণারের দিকের রুমটাতে সম্পদ বর্তমানে অবস্থান করছে। ইতোমধ্যে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে সে। উদ্বিগ্ন হয়ে রুমের দরজার দিকে চেয়ে রয়েছে। ভেতরে কেমন চাপা অস্থিরতা কাজ করছে তার। এ বাড়িতে নতুন সে। আজ দিয়ে তৃতীয় বারের মতো আসা এবং দীর্ঘ একটা সময় অবস্থান করা। সে মোটামুটি ইন্ট্রোভার্ট একটা ছেলে। সবার সাথে হাসি মাখিয়ে কথা বলতে পারে না। শুধু তিথি ব্যতিক্রম। একমাত্র এই একটি মেয়ের কাছে তার সব গোপন কথা, সব রহস্য, সব দুঃখবোধ, সব ব্যর্থতা জমিয়ে রাখতে দ্বিধা বোধ করে না।

স্থির হয়ে সে বিছানায় এসে বসলো। বিছানায় কফি কালারের ঝকঝকে বেডশিট বিছানো। দেখে বোঝা যাচ্ছে আজ প্রথম ব্যবহার করা হয়েছে। সে চোখের মণি ঘুরিয়ে সম্পূর্ণ রুমে নজর বুলালো। রুমে আসবাবপত্র তেমন নেই। কিন্তু ছিমছাম, সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা। সবচেয়ে বড় কথা রুমে এটাচড্ বাথরুম আছে। তাছাড়া রুমের হাওয়া পরিষ্কার। সে বুক ভরে শ্বাস নিতে পারছে।

ঘড়ির কাঁটা এগারোটার ঘর ছুঁই ছুঁই। গ্রামে রাত এগারোটা মানে গভীর রাত। ইতোমধ্যে সমস্ত গ্রাম নিশ্চুপ হয়ে গেছে। বাতাস শীতল হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। দূর দূরান্ত থেকে দু একটা রাত জাগা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। নিস্তব্ধতায় ঢেকে যাচ্ছে রাত। তবুও তিথির ফেরার নাম নেই। সম্পদ হাঁসফাঁস করতে করতে ফেনটা হাতে নিল। কল দিতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে ভাবনা পাল্টালো। মেসেজ অপশনে গিয়ে বাংলায় লিখলো,

‘কই তুমি? রুমে আসো!’

মেসেজ পাঠিয়ে পায়চারি শুরু করলো। বার বার স্ক্রিণের দিকে তাকালো তিথির উত্তরের আশায়। দরজার ওপাশে ধুপধাপ পা ফেলার শব্দে চমকে গেল সে। এত সহজে তিথি চলে এলো? একলাফে বিছানায় গিয়ে সুবোধ বালকের মতো বসে পড়লো সে। তার অস্থিরতা যেন তিথি টের না পায়! খুশিমনে দরজার দিকে তাকাতে চক্ষু ছানাবড়া। দরজা দিয়ে রুমে ঢুকলো তিথির কাজিন রিফাত নামের ছেলেটা। অল্প বয়সের বিচ্ছু একটা ছেলে। সম্পদ যতটুকু ছেলেটাকে চিনেছে তাতে যথেষ্ট বিরক্ত ও আতংকিত। সে বিস্ময় নিয়ে জিগ্যেস করলো,

‘এত রাতে তুমি এখানে কি করছো রিফাত?’

রিফাত এগিয়ে এলো। জ্বল জ্বল চোখে তাকিয়ে বলল,

‘আপনিই তো আসতে বললেন দুলাভাই।’

‘আমি? তোমাকে আসতে বলেছি? কখন?’

রিফাত পেছনে লুকিয়ে রাখা ডান হাতটা সামনে আনলো। হাতের মোবাইলটা উঁচু করে ধরতে সম্পদ ছোঁ মেরে ফোনটা নেওয়ার চেষ্টা করলো। পারলো না। বিস্ময় নিয়ে ফের বলল,

‘তিথির ফোন তোমার কাছে কেন?’

‘আমি গেম খেলছি৷ আপু বলেছে যতক্ষণ খুশি ফোন রাখতে পারি। ‘

‘খুবই ভালো। চমৎকার। অতি উত্তম! তুমি কোন ক্লাসে পড়ো যেন? ‘

‘কয়েকমাস পর ফাইভে উঠবো দুলাভাই।’

সম্পদ হতাশ চোখে তাকালো। তিথির ছোট কাকু ইউরোপের কোনো একটা কান্ট্রিতে থাকে। তার সঠিক জানা নেই। তিনি বিদেশে গিয়ে কতটা আপডেট হয়েছেন তা সম্পদ জানে না। কিন্তু তার বিদেশ যাওয়ার দরুণ বাচ্চা ছেলে যে স্মার্ট ফোনের সব শিখে গেছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না। সে গম্ভীর সুরে বলল,

‘রিফাত আমাকে দুলাভাই বলে ডাকবে না। শুধু ভাইয়া বলবে। কেমন?’

‘ঠিক আছে দুলাভাই।’

‘তোমার আম্মুর ফোনে গেম খেলবে না। তিথি আপুর ফোনেও না! বাচ্চাদের জন্য ফোন নিষিদ্ধ। মনে থাকবে? এখন যাও তাহলে।’

রিফাত হাসিমুখে প্রস্থান করতে সম্পদের চেহারায় মলিনতার ছাপ ফুটে উঠলো। তিথি কি তাকে ভুলে গেছে? এভাবে দূরে দূরে রয়েছে। একটু খবর নিচ্ছে না। দেখা দিচ্ছে না! অসহায় চোখে মুখে সে সে বিছানায় শুয়ে পড়লো। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ার সাথে সাথে সম্পদের চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো।

২৬.

মেয়েলি স্বরের চিৎকারের শব্দে সম্পদের ঘুম ছুটে গেল। বুকের ভেতর আঁতকে উঠলো। অভ্যাসবশত দ্রুত বিছানা হাতড়ে চমকে গেল। বিছানা খালি! তিথি নেই। মস্তিষ্ক সতর্ক হতে বুঝতে পারলো ওয়াশরুম থেকে মৃদ্যু চিৎকার ভেসে আসছে। ওয়াশরুমের দরজা হাট করে রাখা। সরু পথ দিয়ে লাল বাল্বের আলো ভেসে আসছে। সম্পদ তিথির নাম ধরে ডাক দিল। হন্তদন্ত হয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোল।

(চলবে)

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here