প্রেম পায়রা ২ পর্ব ১৯

#প্রেম_পায়রা (২)
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____১৯

বহুদিন পর তিথি খিলখিল করে হেসে ফেলল। শ্বাশুড়ির প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞতা অনুভব করলো সে। তার শ্বাশুড়ি মা সেই যুগের মেয়ে। ১৯৮৮ সালের বন্যায় যে বছর মাঠ-ঘাট প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল, জনজীবনে নেমে এসেছিল ঘোর বিপদ ও বিপর্যয়, সেই বছর তিনি তিনটে লেটার নিয়ে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন। অনেক মেধাবী হওয়ার পরো তাঁকে আর পড়ানো সম্ভব হয়নি। ম্যাট্রিক পাসের কিছুদিন পর সম্পদের বাবার সাথে প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েন। দ্রুত বিয়েও করে ফেলেন। এই মমতাময়ী, শিশুসুলভ মনের অধিকারী মানুষটাকে তিথি ভীষণ মান্য করে।

‘এবার খাবার খেয়ে নাও!’

তিথি সাজেদা বেগমের দিকে ঘুরে বসলো। স্মিত হেসে বলল,

‘আপনি খেয়েছেন মা?’

‘আমাদের সবার খাওয়া শেষ। তুমি খাবার শেষ করে বাইরে এসো। সবাই তোমার সাথে কথা বলার জন্য পাগল হয়ে গেছে। স্নেহা কতবার রুম থেকে ঘুরে গেছে।’

‘আসছি আমি।’

সাজেদা বেগম মাথা নেড়ে রুম থেকে বের হলেন। তিথি খাবারের প্লেট হাতে বিছানায় বসলো৷ প্লেটের চারপাশে হরেক রকমের ভর্তা। এর সবগুলো সম্পদের পছন্দের। এতগুলো দিন সম্পদের সাথে একত্রে থেকে তার পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে আংশিক ধারণা হয়েছে।

ছোট্ট করে ভাতের লোকমা করে তিথি মুখে পুড়লো। মুখের খাবারটুকু পাকস্থলীতে পৌঁছানোর আগেই সম্পদ চোরের মতো রুমে ঢুকলো। দরজা টা ভিড়িয়ে দিয়ে অতি সন্তর্পনে পা ফেলে এগিয়ে এলো। তিথি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলো,

‘আপনি এভাবে চোরের মতো হাঁটছেন কেন?’

সম্পদের ভেতর কোনো চঞ্চলতা কাজ করলো না। তিথির কাছাকাছি এসে সে থেমে গেল। পাশ থেকে পানির গ্লাসটা তুলে নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করলো। শূন্য গ্লাসটা পূর্বের জায়গা নামিয়ে রেখে বলল,

‘তোমায় খাওয়া কতদূর?’

‘এই তো শুরু করেছি।’

সম্পদ কিছু না বলে বিছানার এক পাশে বসে পড়লো। তিথি কিছুক্ষণ সময় নিল। তারপর মিনমিন করে বলল,

‘আপনি খেয়েছেন?’

সম্পদ যেন এই প্রশ্নটার অপেক্ষা করছিল। এক লাফে তিথির মুখোমুখি এসে বসলো। নিজের হাত দুটো গুটিয়ে নিয়ে বলল,

‘খেয়েছিলাম। কিন্তু এরপর অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়েছে। অনেক কিছু ঘটে গেছে। এখন ক্ষুধায় পাকস্থলীর অস্তিত্ব টের পাচ্ছি না। তুমি কি তোমার খাবারটা শেয়ার করতে ইচ্ছুক?’

তিথি কয়েক সেকেন্ড বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলো। সম্পদের কপালের পাশের ক্ষত শুকিয়ে গেছে। কিন্তু দাগটা এখনো জ্বলজ্বল করছে। চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করলো সে। শুঁটকি ভর্তা দিয়ে ভাতের লোকমা করে সম্পদের দিকে বাড়িয়ে দিল। সম্পদ মুখে খাবার নেওয়ার সময় পূর্বের মতো তিথির উদ্দীপিত অনভিজ্ঞতা আবিষ্কার করলো। তিথি ঠিকমতো মুখে খাবার পুড়ে দিতে পারে না। ঠোঁটসহ আশপাশে খাবারের কণা লেগে যায়। তবুও সে হাজার বছর এই মেয়েটির আনাড়ি হাত দিয়ে খাবার খেতে চায়।

‘আপনি এখানে এসেছেন কেউ কিছু মনে করবে না? আপনি নিজেই কিন্তু বলেছেন জয়েনড ফ্যামিলি!’

খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সম্পদ টিস্যু দিয়ে মুখ পরিষ্কার করছিল। মুখ মুছে সে বলল,

‘কেউ জানে না!’

‘জানে না মানে?’

‘স্নেহাকে বলেছি আমি মাসুদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। রাতে ফিরবো। কিন্তু যাইনি। সবার অগোচরে এক ফাঁকে রুমে ঢুকে পড়েছি।’

‘মাসুদ কে?’

‘মাসুদ আমার ছোটবেলার বন্ধু। কাল দেখা করবো ওর সাথে।’

তিথি ছোট্ট করে ‘ওহ’ বললো। গ্রামে আসার পর থেকে তার বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ছে। ফুপির কথা মনে পড়ছে। কিন্তু সম্পদ তাদের বাড়িতে যাবে কি না বা তাকে যেতে দিবে কি না সেটা নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। সম্পদকে সরাসরি জিগ্যেস করবে কি না তা নিয়েও দ্বিধায় ভুগছে। দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ করে তিথি নিচু স্বরে বলল,

‘শুনছেন?’

ছোট্ট একটা শব্দ! অথচ তাতেই সম্পদ বুকের ভেতর প্রবল ধাক্কা খেল। হৃদপিণ্ডে তীব্র বেগে কিছু একটা ছুটে চলল। মুখের খাবারটুকু কোনো রকমে ঢোক গিলে সে উঠে দাঁড়ালো। যত দ্রুত সম্ভব তিথির সামনে থেকে সরে পড়া দরকার!

২৩.

মাঝরাত! অন্ধকারে রাতের নির্জীবতা বিদ্যমান। দক্ষিণের জানালা দিয়ে বাতাস প্রবেশ করছে। গ্রামের শীতল বাতাস। শরীরে কিছুটা কাঁপুনি সৃষ্টি করছে। ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা নিয়ে তিথি ঘুমানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ঘুম আসছে না। আপাতত সে নতুন এক ভোরের জন্য অপেক্ষা করছে। সম্পদের পাশে স্থির হয়ে রয়েছে সে। ভেতরটা জ্বরগ্রস্তের মতো কাঁপছে। কেমন অস্বস্তিকর অবস্থা। অস্থিরতা নিয়ে ভোরের পাখির অবিশ্রান্ত প্রহর ঘোষণার অপেক্ষায় রয়েছে সে।

সম্পদ ক্রমাগত নড়াচড়া করে যাচ্ছে। এমন অস্থির একজনের পাশে মরাকাঠের মতো ঘুমানোর ভান ধরে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠছে তিথি। মনে হচ্ছে যুগের পর যুগ সে অভিনয় করে যাচ্ছে। ভেতরে চেপে রাখা উৎকন্ঠা এক সময় প্রবল বিরক্তিতে রূপ নিল। আর সহ্য করতে পারলো না। একলাফে বিছানায় উঠে বসলো। বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন করলো,

‘এমন নড়াচড়া করছেন কেন আপনি? ঘুমাতে পারছি না তো!’

আবছা অন্ধকারে সম্পদ ধপ করে চোখ খুলল। সে জেগে ছিল! দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল,

‘তুমি ঘুমাতে পারছো না কেন?’

‘পাশে কেউ এভাবে অবিরত নড়াচড়া করলে ঘুমাবো কি করে?’

‘আমি উঠে যাচ্ছি। তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো।’

তিথি চুপসানো স্বরে বলল,

‘উঠে কোথায় যাবেন?’

‘কোথাও না! রুমেই হাঁটাহাঁটি করবো। তুমি ঘুমাও!’

সম্পদ গা থেকে কম্বল সরিয়ে ফেলল। তিথি কিছুক্ষণ সম্পদের মুখপানে চেয়ে রইলো। সম্পদ বিছানা ছেড়ে উঠার বন্দোবস্ত করতে সে উৎকন্ঠিত স্বরে বলল,

‘ঘুম আসছে না কেন আপনার? কিছু হয়েছে? কোনো ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত?’

সম্পদ পূর্বের মতো দেহটা বিছানায় মেলে দিল। তিথির মুখোশ্রীর দিকে তাকালো। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারলো না। মৌনতা ভেঙে বলল,

‘আমার বোধ হয় জ্বর এসেছে।’

তিথির উৎকন্ঠা দ্রুত সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করলো,

‘সে কি! জ্বর এসেছে?’

চিন্তিত মুখে সে সম্পদের দিকে এগিয়ে গেল। শশব্যস্ত হয়ে শীতল হাতটা কপালে ছুঁইয়ে রাখলো কিছুক্ষণ। তারপর বিস্মিত কন্ঠে বলল,

‘জ্বর নেই তো!’

তিথির হাত ঠেলে সম্পদ উঠে দাঁড়ালো। অহেতুক হাসার চেষ্টা করে বলল,

‘জ্বর আসতে যাবে কোন যুক্তিতে? এমনি মজা করলাম। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।’

তিথির উত্তরের অপেক্ষা না করে দ্রুত লম্বা বারান্দার দিকে এগোল। বারান্দার পশ্চিমের কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। বাহিরে হু হু বাতাস বইছে। বাতাসের তালে তালে গাছের পাতা দুলে যাচ্ছে। বারান্দার এক পাশ দিয়ে সামনের বিস্তীর্ণ খোলা ধানক্ষেত চোখে পড়ে। ধানের সবুজ পাতা অন্ধকারকে হার মানিয়ে জ্বল জ্বল করছে। সেদিকে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থাকতে থাকতে সম্পদ বুকের ভেতর জ্বলুনি অনুভব করলো। কেমন একরাশ শূন্যতা ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত দেহজুড়ে। ধরা গলায় ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,

‘আমার হৃদয়ে ভীষণ জ্বর। চূর্ণ, বিচূর্ণ করা হাঁড়কাপানো জ্বর। অথচ তুমি টের পেলে না। তুমি বরাবরের মতো কাছাকাছি এলে, চিন্তিত হলে। কিছুক্ষণ ইতি-উতি করে কপালে হাত রাখলে। কিয়ৎক্ষণ মৌন রইলে। অতঃপর কপাল কুঁচকে বললে, জ্বর নেই তো!

কত সহজে তুমি বলে দিলে জ্বর নেই। আমি অসুস্থ নই। শরীরের নিরুত্তাপ তুমি ঠিক টের পাও। তাহলে হৃদয়ের উত্তাপ কেন টের পাও না? ছলকে পরা রক্তের উষ্ণতা কেন ছুঁতে পারো না? তুমি যখন চার আঙুল দিয়ে কপাল স্পর্শ করলে, আমার হৃদয়ের কাঁপুনি যে দ্বিগুণ হলো তা বোধগম্য হয়নি?

আমার হৃদয়টা জ্বরে পুড়ে পুড়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছে। সকল প্রকার ওষুধ ব্যর্থ হচ্ছে। পোড়া ক্ষত নির্মুলের সকল ফরমুলা যে তোমার হাতে! তুমি বরাবর বলতে, তোমার ঘ্রাণশক্তি প্রখর। তাহলে হৃদয় পোড়ার গন্ধ কেন পাও না? কেন আমার অসুস্থ হৃদয়ের ক্ষত ছুঁয়ে দেখো না? আমার দীর্ঘশ্বাস গুলো বাতাসে মিশে যে কটু গন্ধ ছড়ায় তা পঞ্চইন্দ্রীয় জানান দেয় না? দিলে দিব্যি সেই বাতাসে ফুসফুস ভরো কি করে? একবার কি আমার অসুস্থ হৃদয়ের কথা মনে পড়ে না? আমার তোলপাড় করা হৃদয়ের জ্বর তোমার হৃদয়ে একটুও উত্তাপ সৃষ্টি করে না? নাকি তুমি সত্যি সত্যি কখনো আমার জ্বরের উত্তাপ টের পাও না?

তিথি! তুমি হৃদয় অবধি কেন পৌঁছাতে পারো না বলো তো? হৃদয়ের জ্বর মাপার থার্মোমিটার তুমি কবে আবিষ্কার করবে?’

কাছাকাছি কোথাও বাঁদুরের পাখা ঝাপটানির শব্দ ভেসে এলো। সম্পদের ঘোর কাটলো। বুঝতে পারলো অনিশ্চয়তা ভরা এক রাত দ্রুত শেষ হতে যাচ্ছে। নতুন এক ভোরের সূচনা হতে যাচ্ছে। এই ভোরটাও কি রোজকার মতো হবে নাকি তিথি তার প্রতি একটু অনুরাগ প্রকাশ করবে তা সে জানে না। তিথি তাকে যতই অবজ্ঞা করুক, তবুও সে মেয়েটার প্রতি নিভৃত আসক্তিতে মোহাচ্ছন্ন।

এক হাতে মাথার চুলগুলো ঠিক করলো সে। পরণের টিশার্ট টেনেটুনে রুমে ঢুকলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here