প্রেম পায়রা ২ পর্ব ১৮

#প্রেম_পায়রা (২)
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_____১৮

বাতাসের তালে তালে তিথির এলোমেলো চুলগুলো সম্পদের চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে। অপ্রকাশিতব্য ভালো লাগায় চোখ বন্ধ করে নিল সে। খোলা আকাশের নিচে চমৎকার এক দুপুর হাতছানি দিল যেন! ব্যস্ত সড়ক দিয়ে চলমান রিকশার হর্ণের শব্দ, চারপাশের কোলাহল কিছুই কর্ণগোচর হলো না। কল্পনায় স্পষ্ট এক শহর দেখতে পেল। সবুজের সমারোহে সমৃদ্ধ এক শহর। সেই চিরসবুজতার মাঝে আঁচল বিছিয়ে শুয়ে আছে আরেক এভারগ্রিন রমণী। এত এত সবুজের সমারোহ ফিকে হয়ে গেছে তার সজীবতার কাছে। প্রকৃতির মতো স্নিগ্ধ, সুন্দর আর পবিত্র সে রমণীর হাত আঁকড়ে ধরে আছে গৌড় বর্ণের এক পুরুষ। তাদের মুখে বিস্তৃত হাসির প্লাবন। সেই হাসিতে সামিল হয়েছে বিস্তীর্ণ পথ-ঘাট আর প্রকৃতি।

রিকশা ব্রেক কষতে সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়লো সম্পদ। চোখ খুলে দেখলো রিকশা চেয়ারম্যান বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। অতি সহজেই প্রত্যক্ষ বাস্তবতার টানে আকৃষ্ট হয়ে পড়লো সে। কল্পনার রেশ কেটে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। মাথা ঘুরিয়ে তিথির দিকে তাকালো। তার শ্বাস নেওয়ার একমাত্র কারণ, তার অতিমাত্রার সাধারণ দিনগুলো অনিন্দ্য সুন্দর ও স্মরণীয় করা ও তার মনের শহরের আধিপত্য স্থাপনকারী এই মেয়েটি পাশে থাকলে তার প্রতিটি মুহূর্ত কল্পনার চেয়েও সুন্দর কাটবে।

২২.

সারা বিকেল ঘুম দিয়ে সন্ধ্যার সময় তিথির ঘুম ভাঙলো। গ্রামজুড়ে ততক্ষণে গাঢ় অন্ধকার নেমেছে। রুমটাও অন্ধকারে নিমজ্জিত। চোখ খুলে চারপাশে এত অন্ধকার দেখে ভয় পেয়ে গেল। অভ্যন্তরীণ হিম রন্ধ্রে রন্ধ্রে কম্পন ধরিয়ে দিল। হাত পা নাড়াতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। এতটা দূর্বল লাগছে যে চট করে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারলো না। নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইলো। চোখ বন্ধ করতে রুমে আলো জ্বলে উঠলো। এতক্ষণে জমে থাকা শরীরে আস্তে আস্তে প্রাণ ফিরে এলো।

‘ঘুম ভাঙলো?’

সম্পদের কন্ঠস্বর পেয়ে তিথি দূর্বল ভাবে চোখ মেলল। চোখের সামনে চিন্তিত একটা মুখ আবিষ্কার করলো। তার দিকে ঝুঁকে আছে। চোখের চাহনিতে কেমন বিষণ্ণ একটা ভাব। সম্পদের কপালের চামড়া ফেটে বেরিয়ে এসেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে যার সবটা তিথির শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। সে মাথাটা একটু সরিয়ে নিল। বলল,

‘এত হাঁপিয়ে উঠেছেন কেন? কোথা থেকে আসলেন?’

‘আমার বাবাকে তো চিনোই! জোর করে হাঁটতে নিয়ে গিয়েছিল। গ্রামের সব মুরুব্বিদের সাথে কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠেছি। সারা বিকেল হাঁটতে হয়েছে। বাহিরে প্রচুর গরম। আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। বাবাকে চা স্টলে রেখে চলে এসেছি। তোমার শরীরের কি অবস্থা? একটু বেটার ফিল করছো?’

‘একটু না! অনেকটাই বেটার লাগছে।’

সম্পদ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। চেহারা থেকে বিদঘুটে চিন্তার কালো ছায়াটা সরে গেল। এক হাতে কপালের ঘাম মুছে বলল,

‘শাওয়ার নিয়ে নাও। আমি কাউকে দিয়ে খাবার পাঠাচ্ছি। জয়েনড ফ্যামিলি আমাদের। আমি চাইলেও সবসময় তোমার কাছাকাছি থাকতে পারবো না। বড়রা সবাই থাকবে।’

‘কাছাকাছি থাকতে বলিনি তো।’

তিথির উত্তরে সম্পদ ধাক্কার মতো খেল। স্বভাবের দৃঢ়তায় সহজে ধাক্কাটা সামলে নিল। মেকি হেসে বলল,

‘সেটাই! তুমি তো চাও না আমি কাছাকাছি থাকি। কিন্তু তোমার চাওয়াতে আমার কিচ্ছু আসে যায় না তিথি। আমি আমার নিয়মে চলি। ফ্রেশ হয়ে নাও।’

‘আপনি রেস্ট নিন। ক্লান্ত লাগছে।’

তিথি বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। তৎক্ষনাৎ মাথার মধ্যে মৃদু পাক দিয়ে উঠলো। সম্পদের চোখে পড়ার আগে নিজেকে সামলে নিল। শরীরের ভেতর বিষাদের এক ধারাস্রোত বয়ে চলল। অবসাদে ছেয়ে গেল দেহটা। সম্পদকে টের পেতে দিল না।

‘আপনি অন্য সবার সাথে গিয়ে সময় কাটান। আমার জন্য খাবার রুমে আনতে হবে না। আমি ফ্রেশ হয়ে নিজেই বাহিরে যাচ্ছি। রান্নাঘরে গিয়ে খেয়ে নিবো।’

‘এত কথা না বলে আগে ফ্রেশ হয়ে নাও।’

‘হুঁ!’

‘তিথি, তোমাকে এখনো উইক লাগছে। ওয়াশরুমে হেঁটে যেতে পারবে? নাকি আমি…..’

‘আমি পারবো!’

মুহুর্তে তিথি ভেতরে যেন অলৌকিক ক্ষমতার একটা দীপ্তি অনুভব করলো। সম্পদের তোয়াক্কা না করে হেঁটে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ পর দরজায় টোকা পড়তে চমকে গেল সে৷ উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

‘কে?’

‘ড্রেস ভেতরে নিবে না? শাওয়ার শেষ করে কি পড়বে?’

এতক্ষণ তিথি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। ড্রেসের কথা মনে পড়তে নিজের মাথায় চাটি মারলো। লজ্জিত মুখে দরজা খুলল। দেখলো সম্পদ ড্রেস হাতে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচন্ড ঘাবড়ে গেল সে। সম্পদের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পেল না। পোশাকটা টেনে নিয়ে ফের দরজা বন্ধ করলো।

ভেজা চুল মুড়িয়ে নিঃশব্দে দরজা খুলল তিথি। রুমে উঁকি দিয়ে স্বস্তি পেল। সম্পদ রুমে নেই। সম্পদের সাথে কিছুটা দূরত্ব রেখে সর্বদা চলার চেষ্টা করছে সে। সম্পদের ভাবভঙ্গি, হাবভাব দেখে সে সঙ্কিত। সম্পদ পুরুষ মানুষ। তার সাথে গভীর প্রণয়ে আবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়৷ কিন্তু সম্পদের ছেলেমানুষীকে সে বাড়তে দিতে চায় না। সম্পদের আবেগ দিয়ে লালন করা উদ্ভিদ সে তরতাজা করতে চায় না। দু-একটা সুন্দর সুন্দর কথা বলে সম্পদের আবেগকে প্রশ্রয় দিতে চায় না। সম্পদ তার থেকে ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে। তার মতো ব্যবহৃত একজন সম্পদের পাশে একদম বেমানান।

পুরুষ মানুষের মন! ভালোবেসে কাছে টেনে কিছুদিন পর ছুঁড়ে পেলে দিতে কারো কারো বিন্দুমাত্র অনুশোচনা হয় না। সম্পদ এখন তাকে দায়িত্বের খাতিরে বা আবেগ থেকে গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু বছর দুই পরে যদি তার মনে হয়, সত্যিই সে তিথি নামক মেয়েটার চেয়ে যোগ্য কাউকে ডিজার্ভ করে। তার চেয়ে সুলক্ষণা, শিক্ষিতা, সৌন্দর্যমন্ডিত কোনো মেয়ে পেয়ে তাকে যদি দূরে ঠেলে দেওয়ার ইচ্ছে জাগে? সম্পদের যদি কখনো তার প্রতি সৃষ্ট হওয়া মুগ্ধতা কেটে যায়? গভীর রাতে তাকে জড়িয়ে ধরে যদি মনের মাঝে প্রশ্ন জাগে, ঠিক এইভাবে অন্য কোনো পরপুরুষ মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরেছিল? তখন যদি তার প্রতি ঘৃণা জন্মে?

ঘৃণা জন্মানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। একটা মানুষের প্রতি আরেকটা মানুষের মুগ্ধতা চিরদিন থাকে না। মানুষের মনটা আকাশের মতো ক্ষণে ক্ষণে রঙ পাল্টায়। ভাসমান মেঘের টুকরোর মতো আষাড়ে মেঘ, শ্রাবণের মেঘ, বর্ষার মেঘের মতো কত মানুষের আবির্ভাব ঘটে এই মনের আকাশে। তবুও কি আকাশ এত এত মেঘের ভেলার ভিড়ে এক টুকরো মেঘকে সারাজীবন প্রাধান্য দিয়ে যাবে? হয়তো কেউ কেউ দেয়, আবার কেউ কেউ দেয় না!

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তিথি। মানুষের ধর্ম হচ্ছে কণার মতো। সর্বদা অস্থির। এই অস্থির মন নিয়ে তবুও সে দ্বিতীয় বার কারো প্রেমে পড়তে চায়। যে তার জীবনের বিভীষিকাময় কালো অধ্যায় গুলো চিরতরে মুছে দিবে। দ্বিতীয় বার সে কাউকে ভেঙ্গে চূড়ে ভালোবাসতে চায়। কিন্তু সে এতদিনে বুঝতে পেরেছে প্রথমবার আঘাত পাওয়ার পর দ্বিতীয় কারো প্রেমে পড়া সহজ নয়। খুব কঠিন একটা কাজ। জীবনে প্রথম বার সে কাউকে সমস্ত অন্তর দিয়ে, হৃদয় বিশ্বাস করেছিল। অথচ কত বড় ধোঁকা খেল। প্রথম বার আঘাত পা-ওয়ার সাথে সাথে তার ভেতরের মুগ্ধ হওয়ার অনুভূতি, আশ্চর্য হওয়ার অনুভূতি, কারো প্রেমে পড়ার অনুভূতি! সব অনুভূতি পঁচে, গলে, মরে গেছে। তার মরে যাওয়া, নিষ্প্রাণ অনুভূতির বাগানে কেউ দ্বিতীয় বার ফুল ফুটাতে সক্ষম হবে?

‘তিথি, মা!’

ভারীক্কি কন্ঠ শুনে তিথি দরজার পানে তাকালো। সম্পদের মাকে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এই মানুষটাকে অল্প দিনের পরিচয়ে ভীষণ পছন্দ করে ফেলেছে সে।

‘ভেতরে আসুন মা।’

সাজেদা বেগম রুমে ঢুকলেন। তার হাতে খাবারের প্লেট। প্লেটটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে তিথির দিকে এগিয়ে এলেন। তিথি হাস্যোজ্জ্বল মুখে শুধাল,

‘কেমন আছেন মা?’

‘আমি ভালো। তোমার শরীর কেমন এখন? মাথা ব্যথা কমেছে?’

‘হুঁ। এখন ঠিক আছি। গাড়িতে উঠলে মরার মতো হয়ে যাই। আসার পথে আরো খারাপ অবস্থা হয়েছিল। কত বার যে বমি করেছি!’

সাজেদা বেগম জহুরি চোখে তিথিকে পরখ করলেন। তিথির স্বাস্থ্য আগের থেকে একটু ভালো মনে হচ্ছে। মোটা না হলেও চেহারায় আলাদা একটা ঔজ্জ্বল্যতা ফুটে উঠেছে। মুখের দিকে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। তার গায়ের রঙ এতো উজ্জ্বল ছিল না। তাছাড়া চেহারায় আলাদা একটা মাধূর্যতা জেগে উঠেছে। যেটামাত্র মাতৃকালীন সময়ে মেয়েদের চেহারায় ফুটে উঠে। তিনি মনে মনে ক্ষীণ সন্দেহ পোষণ করলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে তিথিকে কিছু জিগ্যেস করলেন না। হাসিমুখে তিথিকে বিছানায় বসিয়ে দিলেন। খাবারের প্লেট আনতে তিথি আড়ষ্ট স্বরে বলল,

‘ড্রয়িং রুমে গিয়ে খেয়ে নিতাম আমি। এত কষ্ট করলেন কেন আপনি?’

‘তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। স্নেহা, মারিয়া রান্নাঘরে রয়েছে। দেখি কি করে।’

‘ঠিক আছে। আমি খাওয়া শেষ করে আসছি।’

সাজেদা বেগম তিথির মাথায় হাত রাখলেন। তিথির চুলের পানিতে বিছানা ভিজে যাচ্ছিল। তিনি পাশ থেকে টাওয়াল টা হাতে নিয়ে মুছতে লাগলেন। মমতা মাখিয়ে বললেন,

‘অবেলায় গোসল করেছ আবার চুল ভেজা রেখেছ। অসুস্থ হওয়ার ফন্দি আঁটছো?’

বহুদিন পর তিথি খিলখিল করে হেসে ফেলল। শ্বাশুড়ির প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞতা অনুভব করলো। তার শ্বাশুড়ি মা সেই যুগের মেয়ে। ১৯৮৮ বন্যায় যে বছর মাঠ, ঘাট প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল, জনজীবনে নেমে এসেছিল ঘোর বিপদ আর বিপর্যয়, সেই বছর তিনি তিনটে লেটার মার্ক নিয়ে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন। অনেক মেধাবী হওয়ার পরো তাঁকে আর পড়ানো যায় নি। ম্যাট্রিক পাসের কিছুদিন পরেই তিনি সম্পদের বাবার সাথে প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েন। দ্রুত বিয়েও করে ফেলেন। এই মমতাময়ী, শিশুসুলভ মনের অধিকারী মানুষটাকে তিথি ভীষণ মান্য করে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here