প্রেম পিয়াসী পর্ব -৩১+৩২+৩৩

#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা__মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব____৩১.

আজ বৃহস্পতিবার। ব্যস্ত নগরীর সবচেয়ে চা/পযু/ক্ত দিন যাকে বলে। গাদাগাদা ফাইলের মধ্যে ডুবে থেকেও কাজের অন্ত করা যেন দুঃসাধ্য ব্যাপার।
ঠিক একই ভাবে রাদেরও তাই। অফিসের সব কাজ শেষ করে বের হতে হতে রাত প্রায় ১টা বাজলো। আর বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় ২টা ছুঁই ছুঁই। বাসার মেইন গেট খুললো নতুন কাজের লোক মকবুল। আগের ছেলেটা পালিয়েছে দু’দিন হলো। সবই ঠিক ছিলো, কিন্তু কোনোভাবে সে জানতে পেরেছে রাদ একজন মা/ফি/য়া। আর একজন মা/ফি/য়া/র বাড়িতে থেকে সে কিছুতেই নিজের জীবনটা নিয়ে ছিনিমিনি করতে দিবেনা। মা/ফি/য়া মানে সে খুব ভালো করেই জানে। ছোট বেলায় বাংলা ছায়াছবির প্রতি তার ভীষণ ঝোঁক ছিলো। তাই ওসব মা/ফি/য়া কিংবা গু/ন্ডা কারোর ব্যাপারেই সে অবোধ নয়। তাই মা/ফি/য়া/র হাতে ম//রা//র পূর্বে বাক্সপেটরা গুছিয়ে পালিয়েছে। মা/ফি/য়া/দে/র এক আ/ঘা/তে/ই নাকি মানুষ কুপোকাত।

—-” ভাইজান, ভাবি আপনের আসার অপেক্ষা করতে করতে খাবার টেবিলেই ঘুমায় গেছে!”

মকবুল কথাটা বলতে বলতে গেট লাগালো। রাদ প্রচন্ড ক্লান্ত। যা তার হলদেটে চোখ জোড়া দেখেই বোঝা গেলো। তবে মকবুলের বলা কথাটা যেন ক্ষনিকের জন্য তার চোখ জোড়া সাদা করে ফেললো। কেননা, গত একমাসের ব্যবধানে সে এহেম চমকানো বানী শোনেনি। তার চাহনির মানে এমন ছিলো, যেন সে ভুল শুনেছে।

—-” তুমি ইলহামের কথা বলছো?”

নিজের কানকে অবিশ্বাস করে বড় চতুরতার সাথে কথাটা জিজ্ঞেস করলো রাদ। মকবুল মাথা ঝুঁকিয়ে উপর নীচ মাথা নেড়ে বলল,

—-” জে ভাইজান।”

মকবুলের দ্বিধাহীন স্বীকারোক্তিতে রাদের ভেতরটা কেমন শীতল হয়ে উঠলো। পরনের মোটা ব্লেজারটা অনেক আগেই খুলে হাতে নিয়েছিলো সে। বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে শার্টের হাতা দুটো ফোল্ড করে উঠিয়ে রেখেছে বেশ খানিকটা। কেবল গলার টাইটা-ই বাকি ছিলো। তবে সেটার কথা আর মাথায় ছিলোনা। অন্যমনস্ক অবস্থায় টাই-টা লুজ করে রেখেছে। হাতে ধরে রাখা ব্লেজার আর ব্যাগটা মকবুলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে রাদ দৌড়ে গেলো ডাইনিং এর দিকে। ইলহামের পরনে সকালের সেই কচুপাতা রঙের শাড়িটা। ডাইনিং টেবিলের উজ্জ্বল আলোয় রঙটা ঝেকে বসেছে ওর উপর। রাদ এসে দাঁড়ালো ইলহামের পেছনে। হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে ইলহাম। মাথার পেছনের চাঁদ সমান বড় খোঁপাটা আগলা হয়ে ঝুলে আছে পিঠের উপর। দেখে মুচকি হাসলো রাদ। ধীর পায়ে এগোতে এগোতে ফের টাইয়ে হাত দিলো। টাই-টা আরেকটু লুজ করে ইলহামের পাশের চেয়ারটা টেনে বসলো।

অতঃপর ডুব দিলো অতীতের পাতায়। ওদের যখন একদম নতুন নতুন বিয়ে হয়, তখন ইলহাম এমনটা করতো। খাবার টেবিলে বসে তার জন্য মধ্যরাত অব্দি অপেক্ষা করতো। আর অপেক্ষা করতে করতে ঠিক এভাবেই ঘুমিয়ে যেতো। অতঃপর রাদের উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে ঘুম ভাঙতো তার। হঠাৎ সামনে রাদকে দেখে সে কি ভ/য়া/ন/ক লজ্জা। কান মুলে বলতো, ইচ্ছে করে ঘুমোয়নি!

রাদ বুক ভরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তার ইচ্ছে করছে আজও ঠিক একই ভাবে ঘুম ভা/ঙা/তে তার প্রিয়দর্শিনীর। কিন্তু, কেন যেন চেয়েও সে ইলহামকে কাছে টেনে নিতে পারছেনা। তাদের মাঝে এক অদৃশ্য দেওয়াল দু’জনকে দু’জনের থেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে দিয়েছে। যে দূরত্ব কোনো মীরাক্কেলই পারে ঘুচিয়ে দিতে।

—-” ইলহাম! ইলহাম? এখানে ঘুমোচ্ছো কেন! ওঠো প্লিজ। রুমে গিয়ে ঘুমোবে। ওঠো?”

মৃদু স্বরে ডাকলো রাদ। কিন্তু ইলহামের কোনো হেলদোল নেই। সে বেঘোরে ঘুমচ্ছে। রাদ ওর এতো গভীর ঘুম দেখে মুচকি হাসলো। একদম ইচ্ছে করছেনা ওর ঘুম ভা/ঙা/তে। কি মায়াবী লাগছে মুখখানা। ইচ্ছে করছে ওকে বুকে আগলে নিয়ে সেও এখানে ঘুমিয়ে যাক। তবে এমন কিছুই করলোনা। বরং ইলহামকে অতি সাবধানে কোলে উঠিয়ে নিলো। ধীরপায়ে ওকে নিয়ে চলে এলো রুমে। আজ আর খাওয়া হবেনা। ইচ্ছেও করছেনা, আর পেটও ভরে আছে। ১১টার দিকে ডিনারের জন্য হালকা কিছু খাবার খেয়েছিলো সবাই। তখন রাদও খেয়েছে। তাই আজকের জন্য বাকি ডিনার স্কিপ করবে ভেবেই আরেকটু লেট করে ফিরেছে বাড়ি।

এদিকে ইলহামকে বিছানায় শুয়ে দিতে গেলে রাদ পড়ে ফ্যাসাদে। এক হাঁটুতে ভর দিয়ে ওকে বিছানায় শুয়ে উঠে আসতে নিলে ইলহাম ঘুমের ঘোরেই টেনে ধরে রাদের হাত। রাদ ছাড়াতে গিয়েও ছাড়ায় না। ইলহাম গত এক মাসে ভীষণ পাল্টে গেছে। যা একটু একটু করে নিঃশেষ করে দিয়েছে তাকে! তবে আজ কেন জানা নেই, রাদের মনটা অন্য কিছুর আভাস দিচ্ছে। মন বলছে, সবটা পূণরায় ঠিক হয়ে যাবে। আর অতি শীঘ্রই।

ইলহাম ঘুমের ঘোরে রাদের হাতটা ঝাপটা রেখে ওপাশ ফিরে গেলো। সে এখনও গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। এদিকে যে পৃথিবী এপাশ থেকে ওপাশ হয়ে যাচ্ছে সে খবর তার নেই। হাতে টান খেয়ে রাদ ইলহামের অনেকটু কাছে চলে গেলো। ইচ্ছে না হলেও বাধ্য ছেলের মতো নিঃশব্দে শুয়ে পড়লো ওর পাশে। বুকের ভেতরটা কাঁপছে তার। কেমন অসার হয়ে আসার মতো। ভেতরে ভেতরে স্বল্প পরিমান ভ/য় হচ্ছে, যদি ইলহাম উঠে পড়ে? যদি তাকে এই অবস্থায় দেখে? ব্যাপারটা কিভাবে নিবে ভাবতেই অস্থির হচ্ছে মন। তবে তার ভাবনাকে ভুল প্রমান করে দিয়ে হঠাৎ বলে উঠলো ইলহাম,

—-“এতো উসখুস করছেন কেন? কাছে আসলে কি আপনার বউ রাগ করবে নাকি?”

রাদ ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। এই মুহুর্তে ইলহামের কোনোরূপ কথাই সে আশা করেনি। ইলহাম তো বেঘোরে ঘুমচ্ছিলো! ঘটনা চক্রে সে এতোটাই চমকালো যে, ইলহাম তার হাতটা ছেড়ে দিতে সে বিছানা থেকে পড়ে গেলো মেঝেতে। তাকে এভাবে পড়ে যেতে দেখে আঁ/ত/কে উঠলো ইলহাম। লাফিয়ে উঠে বসলো শোয়া থেকে। অতঃপর হাত বাড়িয়ে চটজলদি টেনে তুললো রাদকে। রাদের হকচকানো মুখশ্রী এখনোও বিরাজমান। কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে সে। ইলহাম এবার না পেরে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতেই বলল,

—-” কি হয়েছে? ওমন করে কি দেখছেন!”

রাদ হাসফাস করা অবস্থায় ঢোক গেলে। কি হচ্ছে সবটাই তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ইলহাম রাদের অবস্থার আন্দাজ করে নিজের হাসি থামালো। শান্ত চাহনিতে রাদের ক্লান্ত মুখখানা একবার পরখ করে আস্তে করে নেমে এলো বিছানা ছেড়ে। রুম থেকে বের হতে হতে বলল,

—-” ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে নিন। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

এই বলে চলেও গেলো সে। কিন্তু রাদ এখনও স্থবির! স্তব্ধ তার মস্তিষ্ক! বি/কলাঙ্গ তার অনুভূতি। এখনোও ভেবে কুলাতে পারছেনা কি হচ্ছে।

আজ দুপুরের রান্না ইলহামই করেছে। বিশেষ করে রাদের পছন্দের সব খাবার। ডায়েরির পাতায় কেবল নিজের বাবা-মায়ের সম্পর্কেই নয়, বরং নিজের বিয়ে এবং নিজের স্বামীর সম্মন্ধেও জেনেছে ইলহাম। গত তিনবছর আগে এই পরিবারেই বউ হয়ে এসেছিলো সে। রাদের সঙ্গে তার সংসার, খুনসুটি এমন নানাবিধ রচনা নিজেই লিখে রেখেছিলো। কেননা, ওর এই রোগের কথা আর কেউ না জানলেও ও খুব ভালো করেই জানতো। এমনকি এটাও জানতো যে, খুব শীঘ্রই হয়তো সে তার সব কিছু ভুলে যাবে। রাদকে, মান্নাত বেগমকে! কাউকেই হয়তো আর মনে থাকবেনা। আর আখেরে হলোও তাই। কথাগুলো ভাবতেই ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যায় ওর। ওদের বিয়ের দিন ওকে পাঠানো সেই ছবি গুলোও যে ওর আর রাদেরই ছিলো। রাদ! মানুষটার কোনো অপরাধ না থাকা স্বত্বেও কতটা য/ন্ত্র/ণা সহ্য করেছে দিনের পর দিন। কোনোদিন এক ফোটা অভিযোগও যে করেনি মানুষটা।

ভাবতে ভাবতে চোখের কোন গলিয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরে গেলো অনায়াসে। অতঃপর আর সময় নষ্ট করলোনা। রাদের খাবার গুলো নিয়ে দ্রুত চলে গেলো রুমে।

রাদ ফ্রেশ হয়ে সবে বসলো বিছানায়। ঠিক তখনই খাবার হাতে রুমে ঢোকে ইলহাম। ইলহামকে দেখে অদ্ভুত করে তাকালো রাদ। কিন্তু ইলহামের মুখে স্বাভাবিক হাসি। যেন কিছু হয়নি। দুনিয়াও এপাশ ওপাশ হয়ে যায়নি। সবকিছু ঠিক আছে।

—-” পা তুলে বসুন। আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি।”

খাবার গুলো টি-টেবিলে রাখতে রাখতে বললো ইলহাম। রাদ বাধ্য ছেলের ন্যায় বিছানায় পা তুলে বসলো। তা দেখে ইলহাম মুচকি হেসে প্লেটে রাদের সমস্ত পছন্দের খাবার গুলো এক এক করে তুলে দিয়ে বলল,

—-” আপনার পছন্দের মাছটা আজ পায়নি মকবুল ভাই। পায়নি বললে ভুল হবে, পেয়েছিলো। কিন্তু সাইজ অনুযায়ী একটু বেশিই ছোট। আর আপনি তো ছোট মাছ একদমই খেতে পারেন না! তাই আমি বললাম, কাল ভোর ভোর বাজারে গিয়ে নিয়ে আসতে।”

—-” প..পছন্দের মাছ! আমার পছন্দের মাছের কথা তুমি কি করে জানলে? মা বলেছে?”

ইলহাম ভ্রু কুঁচকে তাকায়।

—-” মা কেন বলবে? আমি কি জানিনা নাকি!”

রাদ অবাক চোখে তাকায় ইলহামের পানে। চটজলদি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ইলহামকে টেনে আনে নিজের কাছে। অসহায় কন্ঠে জানতে চায়,

—-“ম..মানে কি! তোমার কি তবে সবটা মনে পড়ে গেছে?”

রাদের কন্ঠে কেমন আকুলতা। ঢের বুঝতে পারে ইলহাম। ও ভেবেই অবাক হয়, কতটা ভাগ্য নিয়ে এই মানুষটার বউ হয়েছিলো ও। নয়তো দেড় বছরেও মানুষটা কখনোও জোর করে ওকে কিছু মনে করাতে যায়নি। কতটা সহ্যশক্তি নিয়ে অপেক্ষা করে গেছে দিনের পর দিন।

—-” কি মনে পড়বে হু?”

—-” আমাকে! আমাদের দু’জনকে?”

—-” কি যে বলছেন না আপনি! আপনাকে কি আমি ভুলে গেছি নাকি?”

রাদ জবাব খুঁজে পায়না। সে ধরতে পারছেনা ইলহামের চতুরতা। কিছু যেন লুকাচ্ছে মেয়েটা।

—-” না! কিছু না।”

রাদ এখনও চায়না ইলহামের ব্রেনে কোনো প্রে/শার পড়ুক। যদি ওর অতীত মনে পড়ে যায় তাহলে ওর বর্তমান ভুলে যাওয়ার কথা। হয়তো সেটাই হয়েছে। হয়তো সেই মীরাক্কেলটি ঘটেছে। হয়তো তার প্রিয়দর্শিনীর অতীত মনে পড়েছে। আর ভুলেছে বর্তমান। তাই তো এতো কোমল হয়েছে সে তার প্রতি।

—-” এখনও দাঁড়িয়ে থাকবেন? খেতে বসবেন না? কত ক/ষ্ট করে রেঁধেছি জানেন? খেয়ে বলুন কেমন হয়েছে। আপনার দেরী করে বাড়ি ফেরার অভ্যাসটা আর বদলালো না। আপনি জানেন, আপনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছি আমি। আর বরাবরের মতো চোখ খুলে দেখি, আমি বিছানায়। আপনি পারেনও বটে!”

কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে গেলো ইলহাম। রাদ পূর্বের দৃষ্টিতে এখনোও তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ইলহাম নিজের কাজে ব্যস্ত হতে গেলে রাদ ফের ওকে টেনে এনে দাঁড় করায় নিজের সামনে। বাহুজোড়া আগলে ধরে কেমন ক্লি/ষ্ট স্বরে আওড়ালো,

—-“আর কখনোও ছেড়ে যাবেনা তো আমাকে?”

রাদের প্রশ্নে ইলহামের ভেতরটা ডুকরে উঠলো। আর কতটা আ/ঘা/ত, আর কতটা অসহায়ত্বতা চেপে রাখবে মানুষটা। পারছেনা সহ্য করতে, পারছেনা প্রকাশ করতে। ভালোবাসার কাছে মানুষ কতটা অসহায় হয়।

ইলহাম নিজের অনুভূতি গুলো বুঝতে দিলোনা রাদকে। রাদের প্রশ্নের বিপরীতে পায়ের উপর ভর দিয়ে রাদের ঠোঁট জোড়ায় একটা গাঢ় পরশ আকলো ইলহাম। রাদ চোখ জোড়া বন্ধ করে অনুভব করলো সেই গভীর ছোঁয়া। ফের জবাব দিলো ইলহাম,

—-” জানিনা, কতদিন বেঁচে থাকবো এই পৃথিবীর বুকে। তবে, যতদিন বাঁচব কেবল এই মানুষটার বাহুডোরেই বাঁচব। অন্যথায়, কোথাও নয়।”

#চলবে_____

[ বিঃদ্রঃ অনেকেরই অভিযোগ ছিলো কেন রাদ সবটা বলে দেয়নি ইলহামকে। এতো ঢং করার কি আছে এই সব। আশা করি আজকের পর্ব পড়ে আর অভিযোগ থাকবেনা।]#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব________৩২ ❤️

বেডের সাথে লাগোয়া জানলাএলটার পর্দা গুলো মৃদু বাতাসে উড়ছে। সেই সাথে ঝিরিঝিরি হাওয়াগুলো তেড়েমেড়ে ভেসে আসছে রুমের মধ্যে। ভোর ৫টা বাজে। ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে তীক্ষ্ণ শব্দে। ইলহাম চোখ মেলে তাকালো। মাথার কাছে বড় একটা জানলা। সেই জানলা থেকেই ভোরের সচ্ছ একটা ঘ্রাণ এসে নাকে বারি খাচ্ছে। বুক ভরে টেনে নিঃশ্বাস নিলো ইলহাম। এক প্রশান্তি হাতছানি দিয়ে গেলো সর্বাঙ্গে। পাশেই রাদ ঘুমোচ্ছে। একবার পাশ ফিরে তাকালো ইলহাম। একজন বিবাহিত মেয়ের বিয়ের পর বোধহয় এমন একটা দিনের শুরুই কাম্য থাকে। ইলহাম মনেমনে “আলহামদুলিল্লাহ” বলে উঠে বসলো। কাল রাতে সে রাদের বাহুডোরে গুটিশুটি মে/রে ঘুমিয়েছে। রাদ কিছু বলতে পারেনি, কিংবা কোনোরূপ প্রশ্নও করতে পারেনি। সেও অনুভব করেছে তার প্রিয় মানুষটার এমন পা/গ/লা/মো।

—-” এতো জলদি উঠে পড়লেন কেন?”

ইলহাম উঠে গোসল করে নিলো। কচুপাতা রঙের শাড়িটা পাল্টে পড়ে নিলো লাল টুকটুকে সুতির শাড়ি। লম্বা চুলগুলো বেয়ে এখনোও জল গড়াচ্ছে। ইলহামের টুংটাং করা শব্দে রাদেরও ঘুম ভে/ঙে গেলো। চোখ খুলতেই এমন মোহময়ী দৃশ্য দেখে তার তার দম ব/ন্ধ হওয়ার উপক্রম। রাদকে এমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে অবাক স্বরে উপরোক্ত কথাটা জিজ্ঞেস করলো ইলহাম। রাদ বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে আছে। গোলগাল চোখে পূর্বের ন্যায় চেয়ে থেকেই জবাব তৈরি করলো,

—-” অদ্ভুত সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভে/ঙে গেলো।”‘

রাদের কথার মানে যে ওকেই ইঙ্গিত করেছে সেকথা বেশ বুঝতে পারছে ইলহাম। তাই লজ্জা মিশ্রিত হাসলো। হেসে বলল,

—-” আচ্ছা, তাই নাকি?”

রাদ মাতাল হেসে বলল,

—-” একদম। কিন্তু ম্যাম, আপনি এতো ভোর ভোর সাওয়ার কেন নিলেন? ব্যাপার কি!”

বাজানো গলায় বলল রাদ। তবে এবার তার কথার ধরন ভিন্ন। বুঝতেই ভেতরটা কেমন করলো ইলহামের। লজ্জা পেলো আরেকটু খানি। কথা ঘোরাতে বলল,

—-” এমনি। আপনি উঠে ফ্রেশ হয়ে, নামাজ পড়ে নিন। আমি, আসছি।”

—-” কোথায় যাচ্ছো?”

—-” চা বানাবো। আজকের সূর্যোদয় আমরা একসাথে দেখবো। চা খেতে খেতে!”

—-” আচ্ছা বেশ। কিন্তু, তুমি নামাজ পড়বেনা?”

বিছানা ছাড়তে ছাড়তে বলল রাদ। ফের মনে পড়লো ইলহাম অসুস্থ। তাই আবার নিজেই কথা ঘোরাতে বলল,

—-” ও সরি! যাও, চা বানাও। আমি নামাজ পড়ে নিচ্ছি।”

ইলহাম মৃদু হেসে প্রস্থান করলো। রাদও চলে গেলো ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্য।

ঘড়িতে বোধহয় ৬টা বাজে। এখনও সূর্যোমামার দেখা নেই। চারপাশটা এখনও বেশ অন্ধকার বলে ঠাহর হচ্ছে। তবে সেভাবে অন্ধকার না। আকাশে মেঘেদের কোলাহল। মাঝেমাঝে ভোরের এই সময়টা পূর্বাকাশে মেঘেদের দর্শন মেলে। আজও তাই। ইলহাম একটা ছোট্ট ফ্লাক্স আর দুটো চায়ের কাপ নিয়ে রাখলো দোলনার পাশে। রাখতে রাখতে কাপের পাশে ট্রেতে রাখা চামচটা একটু সরে গেলো। পেছন থেকে হাতে চিনির ছোট্ট বৈয়ামটা নিয়ে এসে দাঁড়ালো রাদ। ইলহাম পেছন ফিরে রাদের হাত থেকে নিয়ে নিলো সেটা। ফের আরেকবার তাকিয়ে চোখের রাদকে ইশারায় বসতে বসলো দোলনায়। রাদ পড়নে নীল রঙের একটা টি-শার্ট। সেই সাথে মোটা ট্রাউজার। আর পায়ে বাসার স্যান্ডেল। টি-শার্টটা জিম করা শরীরে টাইট হয়ে লেগে আছে। সেটা একবার টেনেটুনে বসলো দোলনায়। ইলহাম আঁড়চোখে দেখলো চেয়ে। কিছু বলল না। সে চায়ের কাপে চা ঢেলে ২চামচ করে চিনি দিয়ে এককাপ তুলে দিলো রাদকে। রাদ কাপটা নিয়ে কিছু একটা ভেবে বলল,

—-” ডক্টরের কাছে যাবে আজ?”

রাদের প্রশ্নটা শুনলো ইলহাম। প্রশ্ন শুনে বুঝতে অসুবিধা হয়নি রাদ কেন ওকে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা বলল। ইলহাম নিজের কাপটা নিয়ে রাদের পাশে বসলো। অতঃপর বিনা বাক্যে চুমুক দিলো চায়ের কাপে। ফের রাদের ন্যায় ভাবুক কন্ঠে বলল,

—-” যাবো। তবে অন্য কারনে। আর আজ নয়।”

রাদও চুমুক বসালো কাপে। জবাবে বলল,

—-” অন্যকারনে মানে! নতুন কোনো প্রবলেম হচ্ছে না তো?”

রাদের কন্ঠে চিন্তা। ইলহাম ভেতরে ভেতরে লজ্জা পাচ্ছে। ও এই মুহুর্তে এই বিষয়ে কিছু বলতে চায়না রাদকে। তাই কথা ঘোরানোর তালে বলল,

—-” নতুন কোনো প্রবলেম নয়। পুরনো প্রবলেমই।”

রাদকে এবার আরও চিন্তান্বিত দেখালো। সে হাতের কাপটা নামিয়ে রাখলো ট্রে-তে। অতঃপর ইলহামের দিকে ঘুরে বসে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,

—-” পে/ইন কি বেড়েছে আগের তুলোনায়?”

ইলহাম ফ্যাকাসে মুখে দেখলো রাদকে। ও যে এই টপিকটা পাল্টাতে চায় এই মুহুর্তে। বুঝছেনা কেন মানুষটা!

—-” তোমার মুখটা এমন লাগছে কেন সুইটহার্ট! বলো কি হয়েছে? তুমি এমন কেন বলবে প্লিজ! নিজের কষ্টগুলো কেন এমন করে হাইড করো? এটলিস্ট মাকে তো বলতে পারো! পে/ইন বেড়েছে তাই না?”

রাদের ব্যাকুল কন্ঠে শিরশিরে এক অনুভূতি খেলে গেলো ইলহামের সর্বাঙ্গ জুড়ে। বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করছে ওর। অস্থিরতায় চা-টা আর খেতে পারছেনা। রাদ কথা গুলো বলতে বলতে হাত রাখলো ইলহামের পেটে। আলতো স্পর্শে ধরে রেখে বলল,

—-” কোনো পরে-টরে নয়! আজই যাবো ডক্টরের কাছে। এবার আরও বড় ডক্টর এপয়েন্ট করবো। তুমি একদম টেনশন করোনা।”

মানুষটা বড্ড অদ্ভুত রকমের ভালো। ইলহাম মনে মনে তৃপ্তিদায়ক হাসলো। রাদের ব্যাকুল নেত্রদয় ইলহামের ঠোঁট,নাক এবং চোখ বরাবর পায়চারি করছে। ভেতরে ভেতরে এক পবিত্র টান অনুভব করছে সে। যা মাঝখানে হারানোর পথে ছিলো একরকম। মাঝের একরাতে পূণরায় ফিরে এসেছে।

রাদের চোখজোড়ায় সেই অনুভূতিদের মেলা ধরতে পারলো ইলহাম। রাদ ব্যকুল নেত্রজুগল নিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে ইলহামের কাছে। ইলহাম একটু কাঁপলো ভেতরে ভেতরে। ওর মন অন্যকিছুর আভাস দিচ্ছে। রাদের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা সম্ভব নয় তার জন্য। তাই ফট করে চোখ নামিয়ে নিলো। তবে তাতে রাদের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন নেই। সে পূর্বের কর্মে অটল। ইলহাম এবার সত্যি সত্যি কাঁপছে। এই বুঝি রাদের উষ্ণ শীতল ছোঁয়া রুদ্ধ করলো তার ঠোঁটজোড়াকে। ভেবেই গলা শুঁকিয়ে আসছে। ঢোক গিলছে। নিঃশ্বাস ফেলছে ভারি ভারি। কিন্তু না, এমন কিছুই ঘটলোনা। বরং তাকে অবাক করে দিয়ে রাদ তার ললাটের ঠিক মধ্যিখানে ভালোবাসার ছোট্ট একটা পরশ একে দিলো। রাদের উষ্ণ ছোঁয়া এসে লেপ্টে গেলো তার ললাটের কেন্দ্রবিন্দুতে। ইলহাম পরম আবেশে চোখ জোড়া বুঁজে নিলো। এই ছোঁয়া তার হৃদয় হরন করে নিলো এক মুহুর্তেই। এতো শান্তি যেন ওর গোটা জীবনে হয়নি। এমন সুখকর অনুভূতিতে যখন সে উন্মাদ হয়ে ভাসছে ঠিক তখনই শুনতে পেলো এক মধুর বানী,

—-” একদম চিন্তা করোনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তো।”

ইলহামের বুকের ভেতরটা শীতল হয়ে গেলো এহেম শ্রুতিমধুর বানীতে। ওর ইচ্ছে করলো মানুষটাকে ঝাপটে ধরে বলতে,

—-“(কিছু হয়ে গেলেও আমার দুঃখ নেই। কারন আমার কাছে আপনি আছেন তো। আপনি কাছে থাকলে আমি হাসতে হাসতেও ম/র/তে পারি। ভালোবাসি। আমি আপনাকে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি।)

কিন্তু আক্ষেপ, ইলহাম কথাটা মনেমনে বলতে পারলেও মুখে কিছু বলতে পারলোনা। কে জানে, রাদ কিছু আন্দাজ করতে পারলো কি-না?

—-” আজ ঝুম-পাখির জন্মদিন। ভাবছি ওর জন্য একটা সারপ্রাইজ পার্টি করবো। কেমন হয়?”

চায়ের কাপটা উঠিয়ে ফের চুমুক বসালো রাদ। ইলহামের কথায় স্মিত হেসে মাথা দুলিয়ে বলল,

—-“খুব ভালো হয়। কি কি করতে হবে বলে দাও। সব এরেঞ্জ হয়ে যাবে।”

—-” সে না হয় হবে, কিন্তু আমার যে আপনাকে চাই!”

বাচ্চাসুলভ কন্ঠে কথাটা বলল ইলহাম। বলে ফের ঠোঁট উল্টে তাকালো রাদের পানে। ইলহামের এহেম আবদারে রাদ মুখে গরম চা নিয়েই বিষম খেলো। হুট করে কেশে উঠলো। রাদের কাশি ওঠাতে চমকে উঠলো ইলহাম। চিন্তিত নয়নে একবার দেখে চটজলদি নিজের চায়ের কাপটা পাশে রেখে রাদের পিঠ চাপড়াতে লাগলো। কাশতে কাশতে দাঁড়িয়ে গেলো বেচারা রাদ। দাঁড়ালো ইলহামও। ওর চোখেমুখে ভ/য়। অসহায় কন্ঠে বলল,

—-“ক.. কি করছেন! দেখে খাবেন তো!”

কাশি কমলো খানিকটা। রাদ গলা খাঁকারি দিলো বার কয়েক। অতঃপর ইলহামের দিকে তাকালো আঁড়চোখে। যেন কিছু বোঝেনি এমন কন্ঠে বলল,

—-” তোমার আমাকে চাই মানে! ব..ব্যাপার কি!”

এক ভ্রু নাচিয়ে শেষোক্ত কথাটা বলল রাদ। ইলহাম কতক্ষণ ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলো রাদের পানে। রাদের কথার ইঙ্গিত বুঝতে ওর কয়েক মিনিট সময় লাগলো। পরক্ষণেই লজ্জা মুষড়ে পড়লো রাদের সামনেই। রাদ বাঁকা হাসলো। হঠাৎ কিছু না বলে ইলহামের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,

—-” কি ফন্দি আঁটছো মনে মনে? সাবধান, আমি কিন্তু সব বুঝতে পারি!”

রাদের কথায় ইলহাম খিঁচে চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো। রাদটাও না, সুযোগের হাত ছাড়া করতে চায়না। সুযোগ পেলেই হলো।

—-“ধ্যাৎ! আ..আমি কি তা বললাম নাকি!”

—-” হু? তা বললে না মানে? কি বললে না?”

—-” ক..কিছুনা!”

ইলহামের পূণরায় বুক কাঁপছে দুরুদুরু। ওর যতদূর মনে পড়ে ইতিপূর্বে রাদই যতবার ওকে কাছে নিয়েছে। ও কখনোও নিজের থেকে নিজের উদ্যমে আগে হাত বাড়ায়নি রাদের দিকে। তবে আজ এমন কিছুই করতে যাচ্ছে। কিন্তু, ভবিষ্যৎ ভেবেই ওর পা এঁটে যাচ্ছে। জানেনা, আদৌ সবটা প্ল্যান মতো হবে কিনা!

____________

—-“হ্যাপি বার্থডে টু ইউ! হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি হ্যাপি হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার নিঝুম! হ্যাপি বার্থডে টু ইউ!”

চারপাশে করতালিতে হ্যাপি বার্থডের স্লোগান ভেসে আসতেই ঠোঁট জোড়ায় গাঢ় লাল লিপস্টিক দিয়ে সাজের ইতি টানলো ইলহাম। আজ মুখে বাহ্যিক কোন প্রসাধনী নেই বললেই চলে। কেবল গাঢ় কাজল এবং গাড় লাল লিপস্টিক। কপালের মাঝে লাল টিপটা ঠিক করে নিলো। হাতের লাল রেশমি চুড়ি গুলো ফের একবার বাজিয়ে নিলো। গলার ছোট্ট লকেটটা এবং কানের দুলটা একঝলক দেখে লজ্জা মিশ্রিত হাসলো। খোলা চুলে বেলীফুলের মালাটা শেষবারের মতো ঠিক করতে ভুললো না। সকালের ন্যায় বক্ষপিঞ্জরের আনচানে ভাবটা কেবল বেড়েই যাচ্ছে। বারাবর দম ব/ন্ধ হয়ে আসতে চাচ্ছে। এক অজানা অনুভূতি হৃদ মাঝারে লাগাতার ঠকঠক ঠকঠক করে বাজছে। এ যেন দরজায় করাঘাত করাকে বোঝায়।

সকালের ন্যায় শাড়ীটা লাল হলেও এবার আপাদমস্তক পুরোটা সিল্ক। তবে সফ্ট এবং অবশ্যই কমফোর্টেবল। এমন শাড়ি ইলহাম কেবল সচারাচরই নয়, কখনোই পড়েনা। তবে আজ পড়েছে একান্তই নিজের মানুষটার জন্য। ও জানেনা, ওর এমন রূপে রাদ ঠিক কতটা কাহিল হতে চলেছে। ইলহামের মতে এমন কন্ট্রোললেস শাড়ি কখনোও না পড়াই ভালো। কখন কোথা থেকে খুলে আসবে, জানা নেই।

নীচে যাওয়ার পূর্বে সজ্জিত কক্ষখানা পূণরায় একবার দেখে নিলো ইলহাম। ঘরের প্রতি কোনায় কোনায় গোলাপের মিষ্টি গন্ধে মৌ মৌ করছে। সে স্বার্থক হয়েছে মনের মতো সবটা সাজিয়ে তোলাতে। এবার, রাদের ফেরার পালা। রাত ৮ টা বেজে গেছে। এখনও ফেরার নাম নেই মানুষটার। বলেছিলো তো ৭টার মধ্যে ফিরে আসবে। এতো কিসের কাজ তার বুঝতে পারেনা ইলহাম। একটা দিন একটু জলদি ফিরলে কি হতো?

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে ওর। কিন্তু নিজেকে সামলে নিচ্ছে। আজকের মতো এমন একটা দিনে আর যাই হোক, মন খারাপ করা যাবেনা। ভাবতে ভাবতে জনসমাজে এসে দাঁড়ালো। আজ বাড়ির সবাই ভীষণ খুশি। সবচেয়ে বেশি খুশি নিহা। পাশাপাশি নিহার শাশুড়ীও। নিহার শাশুড়ী ভাবতেন ইলহাম এসে তার নাতনির ভালোবাসাটুকু নিজের দখলে নিয়ে গেছে। কিন্তু যখন বুঝতে পারলেন এমন কিছুই না, বরং ইলহাম আসাতে তার নাতনির আদরের একটা ভাগ বেড়ে গেলো তখন আর ইলহামকে অপছন্দ করে থাকতে পারলেন না।

#চলবে#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব________৩৩.

—-” ইলহাম!”

একটা পরিচিত ডাকে ইলহামের পা জোড়া দাঁড়িয়ে পড়লো। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে যখন পেছন মুড়ে তাকালো তখন যেন ব/জ্রাহত হলো তার দৃষ্টি। একরাশ ঘৃ/না জাঁতা দিলো মন পুকুরে। ওর সামনে কিছুটা অদূরে দাঁড়িয়ে আছে অন্তু। পড়নে লাল শার্ট আর কালো প্যান্ট। দৃষ্টি মলিন। চোখে মুখে উদাসীন একটা ভাব। পূর্বের চেয়ে অনেকটা পরিবর্তন অন্তুর। ইলহাম অবশ্য অন্তুর সেই পরিবর্তন দেখার মতো অবস্থায় নেই। তার গা ঘিনঘিন করছে ঘৃ/ণা! ইলহাম দাঁড়াতে চাইলোনা। অন্তুকে দেখেও ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্যোত হলে অন্তু ফের ডাকে,

—-” কেমন আছো, ইলহাম?”

ইলহাম প্রতিত্তোর করেনা সেই ডাকের। কাঠকাঠ গলাতে পাল্টা প্রশ্ন করে,

—-” তুমি এখানে কেন এসেছো? নতুন করে আবার কি ক্ষ/তি করার বাকি আছে তোমার!”

ইলহামের ঝাঁঝাল কন্ঠে মিইয়ে পড়লো অন্তু। মাথাটা নীচু করে কয়েক সেকেন্ড কিছু বললো না। অতঃপর বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নরম গলায় বলল,

—-” মানুষ যখন হারাতে শুরু করে তখন একে একে সব হারাতে থাকে। তাই বলে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। হয়তো ক্ষো/ভ কিংবা জে/দ থেকে তোমার আর রাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করেছিলাম! আবার তোমার মনে রাদের জন্য ঘৃ/ণা/র উদ্রেক ঘটানোর পেছনেও আমিই দায়ী ছিলাম। আজ এসব স্বীকার করাতে কোনো আক্ষেপ নেই বা গিল্টি নেই। তবে একটা বিষয়ে আক্ষেপ সারাজীবন থাকবে! আমি তোমাকে ভ/য়া/নক রকমের ভালোবাসলেও সেটা কখনোও নিজে ফিল করতে পারিনি। তোমাকে আগলে রাখতে পারিনি। আমার ভালোবাসার মানুষটিকে আমি আমার করে রাখতে পারিনি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও ইলহাম। জানি, আমার অপরাধ গুলো ক্ষমার অযোগ্য। তবুও বলবো, প্লিজ ইলহাম! আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি আমার ভুলগুলোর জন্য অনেক বেশি অপরাধবোধে ভুগছি। আজ থেকে নয়, প্রায় অনেকদিন ধরে। অবশ্য এর পেছনে রাদেরই কৃতিত্ব আছে। রাদ আমাকে সবটা না জানালে, না বোঝালে হয়তো আমি তোমাদের আরও অনেক বড় ক্ষ/তি করে ফেলতাম।”

প্রথমে ভীষণ ঘৃণা হলেও ক্রমে ক্রমে তা কুয়াশার ন্যায় কেটে যেতে লাগলো। ইলহাম ঢের বুঝতে পারছে অন্তুর কথাগুলো ওর মনের ঘৃ/ণা গুলো উপ্রে ফেলতে সার্থক হয়েছে। অন্তু বদলে গেছে, কথাটা যে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি! আর এই অবিশ্বাসযোগ্য সত্যিটাই ঘটছে ওর সামনে। ওর মুখে আর রা’ কাটলো না। অনেকটা সময় লাগলো কথা গোছাতে। অবাক কন্ঠে নরম গলায় বলল,

—-” মানে!”

ইলহামের অবাক করা কন্ঠটি অস্বাভাবিক লাগলোনা অন্তুর। সে মুচকি হাসলো ইলহামের পানে চেয়ে। বলল

—-” তুমি ঠিকই শুনেছো। এবার বলো, আমাকে কি একটাবার মাফ করা যায়না?”

—-” তুমি বদলে গেছো! অন্তু বদলে গেছে?”

—-” হ্যাঁ ইলহাম। সেই নোং/রা মস্তিষ্কের বিক/লা/ঙ্গ ছেলেটা বদলে গেছে। ইট’স হ্যাপেন্ড।”

ইলহাম মুখে হাত চাপলো। ওর হাতটা কাঁপছে হয়তো। খারাপ লাগায় নয়, বরং ভালো লাগায়। আনন্দে। রাদ এই মানুষটাকেও বদলে দিলো?

—-” এখন থেকে তুমি শুধুই আমার ভাবি। আমার ভাইয়ের একমাত্র মিষ্টি বউ। আমাদের মধ্যে কয়েকটা দিনের যে সম্পর্কটা হয়েছিলো সেটা একদম মনে রাখবেনা। ওটা একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যেও। আমিও ভুলে যাবো। আর হ্যাঁ, ঠিক তোমার মতো একটা মেয়ে খুঁজে দিও তো? বিয়ে করবো।”

বলে হেসে দিলো অন্তু। হাসলো ইলহামও। কতটা বদলে গেছে ছেলেটা। ভাবাই যায়না।

—-” আমার জবাবটা কিন্তু পেলাম না?”

—-” কি জবাব?”

—-” আমাকে ক্ষমা করার বিষয়টা! আচ্ছা, নো চাপ। আমাকে ক্ষমা করতে তোমার যত টাইম লাগে নাও। তবে হ্যাঁ, ক্ষমা কিন্তু আমার চাই-ই চাই। আজ হোক কিংবা কাল কিংবা আরও দশ বছর পর। তুমি আমাকে ক্ষমা না করলে যে আমি শান্তিতে নিশ্বাসও নিতে পারবোনা।”

অন্তুর কথা গুলো মনে দাগ কাটলো ইলহামের। মানুষ যখন নিজের ভুল গুলো উপলব্ধি করতে পারে, নিজের ভুল গুলো বুঝতে পারে এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কিছুই হতে পারেনা। এরপরও তাদের ক্ষমা না করাটা ভীষণ বোকামো। ইলহাম স্মিত হাসলো। অন্তুর দিকে একপলক দেখে বলল,

—-” আচ্ছা দশ বছর অপেক্ষা করতে হবেনা। এক্ষনি ক্ষমা করে দিচ্ছি। তুমি অশান্তির নিশ্বাস নিয়ে মনেমনে আমাকে বকবে তা কিন্তু হবেনা!”

ইলহামের কথা শুনে বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকালো অন্তু। পরক্ষনে আবার দুজনেই একসাথে হেসে উঠলো। অন্তু বলল,

—-” তুমি ভীষণ ভীষণ ভীষণ ভালো থেকো। আর আমার ভাইকে এত্তো এত্তো ভালোবেসো। আমি দূর থেকে দোয়া করবো তোমাদের জন্য।”

—-” দূর থেকে কেন? কাছ থেকেই করো। সমস্যা তো নেই।”

—-” কাছ থেকে আর বেশিদিন পারবোনা বোধহয়।”

—-” কেন!”

—-“আব.. চলে যাচ্ছি ইউএসএ-তে। ওখানে হায়ার স্টাডি শেষ করে একটা জব নিয়ে নিবো। বাকিটা জীবন ওখানেই কাটানোর ইচ্ছে!”

—-” এ বাবা! কেন? হায়ার স্টাডি করতে ইউএসএ পারি জামাতে হবে কেন? এখানে কি দোষ করলো? আর আমাকে যে এক্ষনি বললে,ঠিক আমার মতো কাউকে খুঁজে দিতে! সেটার কি হবে?”

অন্তু মলিন হেসে বলল,

—-” বেঁচে থাকলে সবই হবে। আপাতত এসবে জড়াতে চাইনা। আর এখানেও থাকতে চাইনা!”

—-” এই ছেলে, নিজেকে পরিবর্তন করেছো বলে কি এতো ভে/ঙে পড়তে হবে হ্যাঁ? তুমি আগেতো এমন ছিলেনা। বি স্ট্রং অন্তু। আমরা তোমার পর নই। তুমি এখানে থেকেই সব করবে। কোনো বিদেশ যাওয়া চলবেনা।”

অন্তু স্থির দৃষ্টিতে একবার দেখলো ইলহামকে। মেয়েটা অদ্ভুত ভালো। কত সহজেই একটা খারাপ মানুষকেও আপন করে নিতে পারে।

—-” আচ্ছা যাবোনা। তাহলে কিন্তু আমার জন্য সত্যি সত্যি মেয়ে চাই। ঠিক তোমার মতো ভালো।”

ইলহাম মুচকি হেসে বলল,

—-” ঠিকাছে। খুঁজে দিবো। নীচে যাবে তো? এসো।”

—-” হু। চলো।”

__________________

মানুষ যা চায় তা পায়না। আর যা পায়, তা চায়না। মানব জীবনের চাকাটা হয়তো ঠিক এমন গতিতেই ঘোরে। তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে থাকা ইলহামের মনটা এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতে চায়। শরীর তো অনেক পূর্বেই অসার হয়ে আসে। কিন্তু তবুও এতক্ষণ মনের জোরই অপেক্ষা করে গেছে প্রিয় মানুষটার। তবুও দেখা মেলেনি তার। নিঝুমের জন্মদিনের পার্টির ইতি ঘটে রাত ৯টায়। ইনভাইটে আসা সমস্ত মেহমানরা চলে যায় নিজেদের বাড়ি। অন্তুরাও ফিরে যায় দশটার দিকে। সারা সন্ধ্যে জনগনে গমগম করা ফ্লোর এখন নিস্তব্ধ। রাতের খাবার খেয়ে এতক্ষণে সবার এক ঘুম হয়েও গেছে। কিন্তু ইলহাম কিছু না খেয়ে লাগাতার অপেক্ষা করে গেছে রাদের।

রাদ ফিরলো রাত ৩টায়। আজকের দিনটা তার জন্য খুবই খা/রাপ কেটেছে। হাতে একের পর এক ঝামেলা এসে জুটেছে। আর সবগুলোরই সমাধান আজই করতে হয়েছে। এখানে বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের ঝা/মেলা তো ওখানে টাকা মা/ই/র খাওয়ার ঝা/মেলা। এতো এতো কাজের চাপে ইলহামকে দেওয়া কথা সে বেমালুম ভুলে গেছে। তবে যেই মুহুর্তে নেতানো গোলাপের ভ্যাপ্সা গ/ন্ধ এসে নাকে ঠেকলো ঠিক সেই মুহুর্তে মনে পড়লো আজ ইলহাম তাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছিলো। কথাটা মনে হতেই বুকের ভেতরটা কেমন কুঁকড়ে গেলো। রুমের মধ্যে এসে দাঁড়াতে তার আর বুঝতে বাকি রইলোনা, ইলহাম তার জন্য সারপ্রাইজ তৈরি করেছিলো। আর যা কেবল তার জন্য ন/ষ্ট হলো। কে জানে মেয়েটা ঠিক কতক্ষণ অপেক্ষা করেছে!

রাদ বিছানারা দিকে তাকালো। ড্রিম লাইটের আলোতে স্পষ্ট ভেসে আছে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সাজানো লাভ সেডটা। তার মাঝে রাদ এবং ইলহামের নামের প্রথম অক্ষর দুটো তীক্ষ্ণ এক ব্যা/থার সৃষ্টি করলো অক্ষিপটে। পুরো ঘর গোলাপের সাগর বলে ঠাহর হচ্ছে রাদের। এ যেন ঘর নয়, সর্গ। কিন্তু ইলহাম কোথায়!

রাদ হাতের ব্যাগ, ব্লেজার, ঘড়ি আর মানিব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে ব্যালকনির দিকে পা বাড়াতেই কিছু একটার সাথে হোঁ/চট খেয়ে পড়ে যেতে নিলে কোনো ভাবে সামলালো নিজেকে। নীচে তাকাতেই চমকে উঠলো রাদ। ইলহাম ফ্লোরে পড়ে আছে। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো তার। কি হয়েছে ওর? জটজলদি ইলহামকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলো রাদ। অস্থির হয়ে উঠলো তার ভেতরটা। ঠিকাছে তো তার ইলহাম? ভাবতে ভাবতে ঘরের লাইটগুলো জ্বালিয়ে দিতেই চোখ ধাঁধিয়ে এলো রাদের। পরক্ষণেই সামলে নিলো নিজেকে। নিজেকে ভুলে এবার ইলহামকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। ইলহামের কপালে গালে হাত দিয়ে দেখলো শরীরের টেম্পারেচারের বাড়াবাড়ি নেই। ঠিকই আছে। নার্ভও ঠিক চলছে। হঠাৎ রাদের চোখ ঝলকালো ইলহামের পড়নের শাড়িটায়। ঠোঁটের কড়া লাল লিপস্টিকে। খোলা চুলগুলোর সাথে ছেঁড়া কাঁচা ফুলের গাজরাটায়! এমনকি ইলহামের চোখের কোনে শুকিয়ে থাকা জলটুকুও চোখ এড়ালোনা তার। রাদ বুঝতে পারলো ইলহাম কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাকি সব ঠিকাছে। দুশ্চিন্তা করার মতো কিছু হয়নি। রাদ উঠে আবার লাইটটা অফ করে দিলো। শুধু জ্বালিয়ে রাখলো একটা ড্রিম লাইট। বিছানার উপর সাজানো গোলাপের পাপড়ি গুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করে গোসল করে চেঞ্জ করে নিলো। অতঃপর শোয়ার আগে ইলহামের কপালে ছোট্ট একটা ভালোবাসার পরশ একে ইলহামকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বার কয়েক দীর্ঘশ্বাসের পাহাড় ঠেলে ঘুমিয়ে পড়লো।

________________

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here