প্রেম পিয়াসী পর্ব -৩৪+৩৫+৩৬

#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_______৩৪.

সেই রাতের আজ তিনদিন পেরিয়ে গেলো। আজ ঠিক ওমনই এক রাত। তবে এর আয়োজন আজ ইলহাম করেনি। বরং রাদ নিজে করেছে। অবশ্য ইলহাম এর কিছুই জানতোনা। সেদিনের পর থেকে ইলহাম অভিমান করে একদমই কথা বলেনি রাদের সঙ্গে। রাদ অনেক ভাবে মানানোর চেষ্টা করেছে তাকে। কিন্তু ইলহাম ভীষণ অভিমানী। তার অভিমান হাজার চেষ্টার পরেও ভা/ঙেনি।

বাড়ির সকলের ডিনার রাত ১১টার মধ্যেই সম্পন্ন হয়। আজও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ডিনার সেরে সবাই চলে গেলে ইলহাম আর শিরিন মিলে সবটা গুছিয়ে রাখে। অতঃপর তারা চলে যায় যে যার ঘরে। ইলহাম শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকতেই এক বি/কট শব্দে চমকে উঠলো। সঙ্গে ভ/য়ে/র বহিঃপ্রকাশে দিলো এক চিৎকার। দরজার কপাট ধরে ভ/য়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো বেচারী। হঠাৎ দূর থেকে কারোর হাসির শব্দ ভেসে আসতেই চোখ মেলে তাকালো ইলহাম। রাদ কোমরে হাত চেপে দৈ/ত্য/দের মতো হাসছে। যা দেখেই ইলহামের রা/গ উঠে গেলো ১৪০ডিগ্রিতে। পরক্ষণেই চোখে পড়লো ওর সামনে একটা লাল ফাটা বেলুন পড়ে আছে। অর্থাৎ ওর ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে এই বেলুনটা ফেটেছে। কিন্তু এতো রাতে ঘরে বেলুন এলো কোথা থেকে? নিঝুম নিয়ে এসেছিলো কি? মনে পড়ছেনা।

কিন্তু না, ঘরটা ভালো করে দেখতেই ইলহামের চোখ বড়বড় হয়ে আসে। রাদের পেছনে লাভ সেডের বেলুন গুলোর পাহাড় উঠেছে যেন। ইলহাম অবাক দৃষ্টি মেলে একটু একটু করে এগোতে লাগলো। ঘরটা আজ নিজের ভোল পাল্টে নিয়েছে একদম। এতসব করলো কে? আর করলোই বা কখন?

রঙ বেরঙের মোমবাতি গুলো কত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। অন্ধকার ঘরে কতটা ভ/য়া/ন/ক সুন্দর লাগবে ভেবেই পুলকিত হলো ওর মন। ঠিক এমন মুহুর্তে শাড়ির আঁচল ভেদ করে উন্মুক্ত উদরে একজোড়া হাতের গভীর ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলো ইলহাম। ঘাড়ের কাছে তার গরম নিশ্বাস আঁচড়ে পড়তে শিরশির করে কেঁপে উঠলো সর্বাঙ্গ। রাদ ওর ঘাড়ে থুঁতনি রেখে আকুল আবেদন করে বলল,

—-” প্রিয়দর্শিনীর অভিমান গলাতে কি একটা সুযোগও পাবোনা?”

ইলহামের মনে পড়লো সেদিনের কথা। ঠিক এমন করেই অপেক্ষা করেছিলো সে। কিন্তু মানুষটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো তাকে। তবে আজ কেন সে ধরা দিবে তাকে? একদম দিবেনা।

মনে মনে পন করে রাদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সরে গেলো ইলহাম। অর্থাৎ, সে কোনো সুযোগ দিবেনা তাকে। রাদ অসহায় চোখে তাকালো ইলহামের পানে। কেমন অভিমান নিয়ে দূরে সরে গেলো! সে তো হাজার বার স্বীকার করেছে, এই ভুল আর কখনোও করবেনা সে। আর কখনোও লেট করেও বাসায় ফিরবেনা।

—-” সুইটহার্ট! আই এম সরি! প্লিজ এবার অন্তত ক্ষমা করে দাও? প্লিজ? এই দেখো আমি আবারও কান ধরছি..”

বলতে বলতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো রাদ। কানে হাত দিয়ে বাচ্চাদের ন্যায় ঠোঁট উল্টে চোখ পিটপিট করে তাকালো। যা দেখে হাসি পেয়ে গেলো ইলহামের। তবুও মনটাকে শক্ত রেখে ঠিক অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।

রাদ আর পারলোনা চুপ থাকতে। উঠে দাঁড়িয়ে এসে দাঁড়ালো ইলহামের সম্মুখে। অসহায় কন্ঠে বলল,

—-” এত্তো অভিমান? একবার কথাও বলবেনা! সত্যিই বলবেনা? দেখো, এরপরও কথা না বললে আমি কিন্তু উল্টো পাল্টা কিছু করে ফেলবো! তখন আমাকে দো/ষারোপ করতে এসোনা।”

ইলহাম তবুও চুপ করে রইলো। সে কথা বলবেনা তো বলবেইনা। যাই হয়ে যাক!

তবে রাদও তার কথা রাখলো। আর দু-তিনবার চেষ্টা করলো ইলহামকে কথা বলাতে। কিন্তু ব্যর্থ হলো বরাবরের ন্যায়। তাই সে হুট করে বিনা বাক্যে কোলে তুলে নিলো ইলহামকে। ইলহাম আঁ/তকে উঠে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করতে করতে অবশেষে মুখ খুললো। রা/গান্বিত গলায় বলল,

—-” আরে হচ্ছে টা কি! নামান আমাকে! নামান বলছি, আমি পড়ে যাবো। নামান প্লিজ।”

রাদ বাঁকা হেসে বলল,

—-” কথা বলার টাইম ওভার। সরি টু স্যে। এবার যা হবে চুপচাপ মেনে নিবে।”

—-” মামু বাড়ির আবদার নাকি! নামান আমাকে।”

ক্ষি/প্ত স্বরে প্রতিবাদ জানালো ইলহাম। কিন্তু তবুও রাদের হেলদোর নেই। এখন যা হবে সত্যিই সব মানতে হবে ইলহামকে। রাদ ইলহামকে কোলে নিয়েই চলে গেলো ওয়াশরুমের দিকে। রাদের কান্ড দেখে ঘাবড়াতে লাগলো ইলহাম! একটু বেশি হয়ে গেলো না তো? মনেমনে প্রশ্ন করলো নিজেকেই!

রাদ আকস্মিক ইলহামকে নামিয়ে দিলো ভেজা স্যাঁতসেঁতে বাথটবের উপর। ইলহামের শকের উপর শক খেয়ে চলেছে। হচ্ছে টা কি তার সঙ্গে? চাচ্ছেটা কি মানুষটা? কিন্তু কোনো জবাব মেলেনা।

রাদ চুপচাপ নিজের কাজ করে যাচ্ছে। ইলহামকে শেষ বারের মতো চমকে দিয়ে বাথটবের কলটা ছেড়ে দিলো। মিনিট গড়াতেই বাথটব ভরে উঠলো ঠান্ডা জ্বলে। ইলহাম আঁতকে উঠলো আরও একবার। জলে জুবুথুবু বাথটবে অর্ধেক শরীর ভিজে গেলো ইলহামের। সে চাইলেও উঠে যেতে পারছেনা। কারন তাকে জো/র করে আঁটকে রেখেছে রাদ। সেও ভিজছে ওর হাতপা ছোড়াছুড়িতে। তবুও যেন কিছু যায় আসেনা।

প্রায় দশ মিনিট এভাবেই কাটলো জলের মধ্যে। একপর্যায়ে ঠান্ডায় হাড়কাঁপানো শীত এলো ইলহামের। রাদ বুঝতে পেরে ওকে পূণরায় কোলে তুলে উঠিয়ে নিলো ওখান থেকে। ইলহাম ঠান্ডায় কাঁপছে থরথর করে। যা দেখে রাদের বেশ মজা হচ্ছে। সে মিটমিট করে হাসছে।

—-” নাও, চেঞ্জ করে এটা পড়ে নাও।”

একটা কালো সিল্ক শাড়ী নিয়ে এসে ইলহামের হাতে ধরিয়ে দিয়ে কথাটা বলল রাদ। ইলহাম ক্ষেপা দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। যা দেখে রাদ বাঁকা হেসে বলল,

—-” চাইলে পড়িয়ে দিতে পারি। আই ডোন্ট মাইন্ড এক্টচুয়েলি!”

কথাটা বলতে দেরী হলেও তার হাত থেকে শাড়ী তোয়ালে ছো মে/রে কেড়ে নিয়ে ওয়াশরুমের দরজাটা ধপাশ করে বন্ধ করতে দেরী হলোনা ইলহামের। রাদ শব্দ করে হেসে উঠলো ইলহাম এরূপ কান্ডতে। ভেতরে বসে রা/গে ফুঁসছে ইলহাম। কি ভেবেছে কি উনি? যা খুশি তাই করবেন? যত্তসব!

এই সুযোগে নিজের ভেজা টি-শার্ট আর ট্রাউজার পাল্টে একটা কালো শার্ট আর আর কালো প্যান্ট পড়ে নিলো চটজলদি। পুরো ঘরের ডেকোরেশনটায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো কাঙ্ক্ষিত মানুষটার। তবে তাকে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলোনা। তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে হাজির হলো ইলহাম। কালো সিল্ক শাড়িটা পুরো বসে গেছে ওর শরীরে। যেন এই শাড়ির একমাত্র কর্ণধার ইলহামই হতে পারে। ইলহাম রাদের সামনে এসে দাঁড়ালে রাদের মুখ থেকে আর কথা বের হলোনা। একধ্যানে কেবল দেখেই যাচ্ছে তার প্রিয়দর্শিনীকে।

রাদের এমন অদ্ভুত চাহনিতে বুকের ভেতরের ধকধকানি দিগুন হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে ইলহাম। রাদের চোখে বেশিক্ষণ চেয়ে থাকার সাধ্য হলোনা ওর। চোখ নামিয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে ধাতস্থ করলো নিজেকে। এবার ও কিছু বলতে চায় রাদকে। বলতে চায় কয়েক দিন যাবত মনের ভেতর চেপে রাখা কথা গুলো। কিন্তু কিভাবে বলা যায়? কোথা থেকে শুরু করা যায় বুঝে উঠতে পারছেনা।

ইলহামের ভাবনাগুলোর ইতি ঘটলো খানিক উষ্ণ ছোঁয়ায়। কেঁপে উঠে খানিক আবদ্ধ হয়ে পড়লো নিজের মাঝেই। ভেজা ললাটে ঠোঁট ছুঁইয়েছে রাদ। ভেজা উষ্ণ ছোঁয়া।

—-” রাদ?”

—-” হু?”

ইলহাম ডাকলো রাদকে। রাদ ওর ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে পেঁচাতে পেঁচাতে অন্যমনস্ক গলায় জবাব দিলো। ইলহাম বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমতাআমতা করে বলল,

—-” আ..আপনাকে কিছু বলতে চাই!”

—-” হু, বলো?”

—-” এভাবে না। এদিকে বসুন।”

ইলহাম রাদের হাত ধরে তাকে ছোট্ট টুলের উপর বসিয়ে দিলো। অতঃপর ও মেঝেতে বসতে নিলে রাদ চটপট দাঁড়িয়ে গিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ধরে ফেললো ওকে। তার জায়গায় ওকে বসিয়ে দিয়ে বকার সুরে বলল,

—-” তুমি কেন নীচে বসছো!”

এই বলে নিজেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো ওর সামনে। ওর হাতদুটো মুঠোবন্দি করে নিয়ে বলল,

—-” বলো এবার। কি কথা?”

—-” আসলে…”

—-” কি হয়েছে!”

—-” আমি আমার মায়ের মৃ/ত্যু/র ব্যাপারে একটা ক্লু পেয়েছি।”

রাদ অবাক চোখে তাকালো,

—-” কি বলছো!”

—-” হু। জানেন, রনো আঙ্কেল নামে কেউ একজন আছে। যাকে মা সবটা জানাতে বলেছিলো। এমনকি আমিও তার নামে কিছু কথা লিখেছিলাম। জানিনা কে উনি, কোথায় থাকে..”

—-” রনো!”

রাদের কপালের মাঝে ভাজ পড়লো। ইলহামের কথার মাঝেই সে প্রশ্ন করলো। ইলহাম হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলল,

—-” হু। রনো!”

—-” কাল দেখছি ব্যাপারটা। এবার চুল গুলো মুছে দেই? ঠান্ডা লেগে যাবে তো!”

রাদের শেষোক্ত প্রশ্নে ইলহাম লজ্জা মিশ্রিত হেসে ঘাড় কাত করে উঠে দাঁড়ালো। রাদ চোখের ইশারায় উল্টো ঘুরে দাঁড়াতে বললে বিনা বাক্যে ঘুরে যায় উল্টো দিকে। ক্ষনেই সম্মুখের মস্ত বড় আয়নাটায় ভেসে উঠে দুই কপোত-কপোতীর প্রতিবিম্ব। রাদ বেশ মনোযোগ দিয়ে চুল মুছতে লাগলো ইলহামের। আর ইলহাম বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো তাকে। কালো শার্টে এর পূর্বে রাদকে কখনোও দেখেছে কিনা মনে পড়ছে না ওর। আজই হয়তো প্রথমবারের মতো কালো শার্ট পড়লো রাদ। গৌরবর্ণ দেহে কালো যেন এক অনন্য রূপ পেলো। ক্লিন সেভ গালে একটা লাল গোটা দেখা গেলো। যা দেখে কপালটা কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেলো ইলহামের। ওমনি পেছন মুড়ে শা/সন করা গলায় বলল,

—-” এতো এতো কাজের প্রেশার আর রাত জাগার ফল দেখুন কি হয়েছে। গোটা উঠে গেছে গালে। ওমা, কপালেও যে আছে দেখছি!”

ইলহামের কথার সূত্র ধরে ঘাড় কাত করে আয়নায় নিজেকে একবার দেখলো রাদ। আসলেই তো। আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বাধ্য ছেলের ন্যায় বলল,

—-” এগুলো আগের। এখন তো আমি ভালো হয়ে গেছি।”

—-” আচ্ছা? তাই নাকি! তা কি ভালো হয়েছেন শুনি?”

—-” এই যে জলদি জলদি বাড়ি ফিরি, কাজের প্রেশার একদম নেইনা। আর…”

—-” আর?”

—-” আর…”

ইলহাম ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ মুখে তাকিয়ে আছে। রাদ আকস্মিক ইলহামের গালে একটা চুমু খেয়ে বলল,

—-” আর, বউ সোহাগি হয়ে গেছি।”

রাদের এমন কাজে লজ্জার বান যেন উপচে পড়লো ইলহামের উপর। স্ট্যাচু হয়ে গেলো জায়গাতেই। রাদ ওর অবস্থায় হেসে ফেললো। ইলহাম লজ্জায় কাদাকাদা। রাদের সামনে থেকে ফুড়ুৎ করে উড়াল দেওয়ার সমস্ত ফন্দি শেষ করে উড়াল দিতেই ক্ষপ করে তার হাতটা ধরো নেয় রাদ। ইলহামের কি হয়েছে জানেনা সে নিজেই। রাদ একটু কাছে এলেই এক অদ্ভুত অনুভূতি নেচে বেড়ায় সর্বাঙ্গে। বিদ্যুতায়ন ঘটে যেন।

—-” সত্যি বললাম কিন্তু!”

রাদ ইলহামকে একটানে নিয়ে এলো নিজের খুব কাছে। ইলহামের কোমড় জড়িয়ে একচোখ টিপে কথাটা বলে পরক্ষণেই। ইলহাম মাথা নীচু করে রইলো। যা দেখে রাদ ওর কোমড় পেঁচিয়ে একটু উঁচিয়ে ধরলো নিজের মুখোমুখি। ইলহাম বাধ্য হয় এবার রাদের দিকে তাকাতে। রাদ মোহিত নয়নে পায়চারি করছে ইলহামের ঠোঁটে, গালে, কপালে। কয়েক মুহুর্তে এভাবেই কেটে গেলে রাদই আবার বলে ওঠে,

—-” তুমি আমার স্নিগ্ধ রজনী, সুইটহার্ট। তুমি আমার সূর্যলোকের শীতল পরশ। তুমি আমার ক্লান্তির সমাপ্তি। তুমি আমার সুখ! তুমি আমার অবসর। তুমি আমার অভিলাষ, তুমি আমার স্পৃহা। তুমি আমার সব। সব সব সব। একদমই সব।”

রাদের মোহনীয় কন্ঠে কথা গুলো জাদুর মতো টেনে আনলো ইলহামকে। ইলহাম নিজের অজান্তেই রাদের অধর জুগল আঁকড়ে ধরলো। ঘটনার আকস্মিকতায় রাদ কয়েক লহমা স্তব্ধ থেকে সাড়া দিলো সঙ্গীনির ডাকে। একটু একটু করে খালি হতে শুরু করলো তাদের বিরহের ভরাট কলসি। একই সূত্রে একটু একটু করে ভরাট হতে শুরু করলো তাদের ভালোবাসার খালি কসলি। অতঃপর বাস্তবিকেই ইলহাম রাদের সূর্যলোকের শীতল পরশ হলো। অতঃপর ভোর হলো। অতঃপর সূর্য উঠলো।

#চলবে#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_______৩৫.

দেখতে দেখতে ৮মাস পেরিয়ে গেলো কোনো এক বসন্তের ন্যায়। আবহাওয়ার পরিবর্তন হলো। এখন না গরম না ঠান্ডা। মাঝেমাঝে তুমুল বর্ষন। এরই মাঝে খবর ছড়ালো ইলহামের প্রেগন্যান্সির সাত মাস শুরু হয়েছে।

রাদের পরিবারে এখন দুঃখ নামের জিনিসটি একদম নেই বললেই চলে। আছে কেবল সুখ, সুখ আর সুখ। আরেকটু খানি সুখের আবির্ভাব হয়েছে ইলহামের মা হওয়ার খুশিতে। আজ ইলহামের প্রেগন্যান্সির সাত মাসের খুশিতে আত্মীয়দের দাওয়াত দিয়ে একটু ভালোমন্দ খাওয়ানোর ইচ্ছে পোষণ করেছেন মান্নাত বেগম। ইলহামেরও মায়ের ইচ্ছেতে সম্পূর্ণ মত আছে। বাদ বাকি সবাই হ্যাঁ বলে সম্মতি দিলে রাদও সম্মতি দেয় অবশেষে। কেননা, তার লোকজনের গ্যাদারিং এ ভীষন আপত্তি এই মুহুর্তে। সে চেয়েছিলো ইলহামের প্রেগন্যান্সির এমন একটা স্টেজে সে একটু নিরিবিলি থাকুক। পুরো সময়টা নিজের জন্য বরাদ্দ করুক। নিজের বাচ্চার জন্য নিজেকে স্থির রাখুক। বেশি দৌড়ঝাঁপ, কাজবাজ ওর জন্য ঠিক নয়। এমনিতেই সুযোগ পেলে কাজ করতে শুরু করে দেয়। কারোর কথা শুনেনা। এমনকি রাদের কথাও নয়। তবে শেষ অব্দি সবার অনুরোধে সেও রাজি হয়ে গেলো।

১২টা বাজতেই সকল আত্মীয়স্বজনরা আসা শুরু করে দিয়েছে। রাদের চাচা-চাচিও এসেছে। সঙ্গে অন্তু, অনন্যা আর প্রণয়। রাদের চাচা-চাচি অর্থাৎ রাজিয়া এবং মিলাদ পূর্বের চেয়ে অনেকটা বদলে গেছে। অবশ্য এর পেছনে তাদের ছেলে অন্তুর অবদান। দিনে দিনে অন্তুর মাঝে যে পরিবর্তন তারা দেখেছিলো তাতে বাধ্য হয়েছিলো রাদের উপর থেকে সমস্ত রা/গ অভিযোগ সরিয়ে নিতে। অবশ্য তাদের রাগ এবং অভিযোগের আসলে কোনো কারনই আর খুঁজে পায়নি তারা। মেয়েজামাই সুখে আছে, ছেলেও তার কাজ নিয়ে দিব্যি দিন পার করছে। তাহলে আর কিসের দুঃখ তাদের।

—-” ব্রো?”

অন্তু হাস্যজ্বল মুখে এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করে ঝাপটে ধরলো রাদকে। রাদ মুচকি হেসে ওকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,

—-” কেমন আছিস?”

—-” ভালো। তোরা?”

—-” আমরাও ভালো। ওদিকের খবর কি?”

রাদ শেষোক্ত প্রশ্নটা একটু চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো অন্তুকে। অন্তুকে রাদকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ টিপে বলল,

—-” প্ল্যান সাকসেসফুল।”

—-” কিসের প্ল্যান সাকসেসফুল? তোরা কি ঘোল পাকাচ্ছিস আমার অগোচরে?”

বলতে বলতে এগিয়ে এলো প্রণয়। রাদ ওকে দেখে একবার চোরা চোখে তাকালো অন্তুর পানে। অন্তুও তাই। পরক্ষণে দু’জনেই বেমালুম ভুলে গেলো কিসের প্ল্যান সাকসেসফুল। কথার তাল ঘুরিয়ে শুরু করলো তিন বন্ধুর ফাজলামো। একই সঙ্গে শুরু হলো তাদের হাসাহাসি। হাসাহাসির মাঝেই এসে উপস্থিত হলো ইলহাম আর অনন্যা। তাদের মাঝে ভাগ বসাতে অনন্যা বলে উঠলো,

—-” আমাদের রেখে কি নিয়ে এতো হাসাহাসি হচ্ছে শুনি? আমাদেরও একটু বলো!”

অনন্যার গলা পেয়ে তিনজনেই একসাথে পেছন মুড়ে তাকালো। অনন্যার পাশে ইলহামকে দেখে রাদের চোখে মুখে ফুটে উঠলো প্রশান্তির হাসি। হাত বাড়িয়ে তার প্রিয়দর্শিনীকে কাছে টেনে এনে দাঁড় করালো। ফের অনন্যার উদ্দেশ্য বলল,

—-” হচ্ছিলো তোর বরের কথা। ও তোর প্রেমে পড়ার আগে আমাদের অলওয়েজ গান শোনাতো ও নাকি চারটা বিয়ে করবে। একটা ফরজ কাজ আদায় করা কত সওয়াব ভাব। এখন দেখছি, বেচারা একটা বিয়ে করেই হাঁপিয়ে উঠেছে। বলছে, তোকেই নাকি সামলাতে পারছে না। আবার চারটা বিয়ে কি করে সামলাবে!”

রাদের কথায় অন্তু ফিক করে হেসে দিলো। এদিকে প্রণয় অসহায় মুখ করে তাকালো রাদের দিকে। সুযোগ বুঝে ফাঁ/সি/য়ে দিলো বেয়াদবটা। রাদ মিটমিট করে হাসছে। অনন্যা রা/গি চোখে তাকিয়ে দাঁত কটমট করে বলল,

—-” আচ্ছা তাই নাকি? প্রথমত আপনার চারটা বিয়ে করার সখ ছুটাবো। এরপর আমাকেও সামলাতে শেখাবো। দাঁড়ান আপনি..”

এই বলে অনন্যা প্রণয়ের দিকে তেড়ে যেতেই প্রণয় ‘না’ বলে দিলো এক দৌড়। অনন্যাও ছুটলো তার পিছুপিছু। ওদের কান্ড দেখে হো হো করে হাসতে লাগলো অন্তু আর রাদ। সঙ্গে তাল দিলো ইলহামও। হাসতে হাসতে হঠাৎ থেমে গেলো ইলহাম। ব্যা/থা/য় অদ্ভুত রকমের গো/ঙা/নি দিয়ে আচমকা রাদের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে উঠলো রাদ আর অন্তু। দু’জনের মস্তিষ্কেই আ/ঘা/ত হানলো ইলহামের অবস্থা দেখে। তবে অন্তুর রিয়াক্ট করার পূর্বে রাদই রিয়াক্ট করতে পারলো। ভ/য়ার্ত গলায় ইলহামের বাহু আগলে নিয়ে বলল,

—-” কি হয়েছে ইলহাম! লেবার পে/ই/ন হচ্ছে?”

—-” ভাই, ওকে নিয়ে বসাতে হবে আগে! ফাস্ট।”

অন্তুর কথায় রাদের মস্তিষ্ক সতর্ক বার্তা পৌঁছালো তাকে। ইলহামকে সাবধানে নিয়ে বসালো সোফায়। ইলহাম তখনও গো/ঙি/য়ে যাচ্ছে। বড়বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। যেন শ্বাস উঠেছে। একই সঙ্গে দরদর করে ঘামছে। অন্তু আর কিছু না ভেবে চটজলদি পানি নিয়ে এলো। পানিটা হয়তো সে নিজেই খাইয়ে দিতো, কিন্তু তার পূর্বে নিজেকে সামলে নিয়ে পানিটা ধরিয়ে দিলো রাদের হাতে। বলল,

—-” পানিটা খাওয়া। আমি ডক্টর কল করছি। ওকে হসপিটালে নিতে হবে মনে হচ্ছে!”

—-” হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে। তুই গাড়ি বের কর। আমি ওকে নিয়ে আসছি।”

দুই ভাইয়ের শোরগোলে ততক্ষণে সব মেহমানরা এসে জোট পাকিয়েছে। মান্নাত বেগম, রাজিয়া বেগম, নিহা, নিহার শাশুড়ী সবাই শোরগোল শুনে দৌড়ে এলেন। ইলহামের অবস্থা বেগতিক দেখে আঁ/তকে উঠলো সকলের প্রান। মান্নাত বেগম বসলেন ইলহামকে ধরে। রাদকে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, হঠাৎ এতো ব্যা/থা উঠলো কেন ওর! এভাবে শ্বাস ফেলছে কেন! এখনও তো অনেক সময় বাকি ডেলিভারির। লক্ষন তো ভালো নয়।

রাদ মায়ের কথার কোনো জবাব দিতে না পারলেও মনের ভেতর একটা ভ/য় নিয়ে ইলহামকে নিয়ে বের হলো। অন্তু ড্রাইভিং সীটে বসে আছে প্রথম থেকেই। ইলহামকে নিয়ে রাদ গাড়িতে উঠলেই গাড়ি স্টার্ট দিবে সে। রাদ ইলহামকে নিয়ে একপাশ থেকে উঠলে অন্যপাশ থেকে উঠে বসে মান্নাত বেগমও। গাড়ি স্টার্ট দিলো অন্তু। চলতি পথে ব্যা/থা/র আরও বাড়াবাড়িতে জ্ঞা/ন হারালো ইলহাম। যার ফলশ্রুতি আরও বড় ধা/ক্কা লাগলো রাদের। কি হলো হঠাৎ তার ইলহামের! সবটা ভালোয় ভালোয় ঠিক হয়ে যাবে তো! নাকি, কোনো দুঃ/সংবাদ অপেক্ষা করছে তাদের পথ চেয়ে।

ওটিতে নেওয়া হয়েছে ইলহামকে। বাইরে অপেক্ষা করছে তিনটি আ/তং/কি/ত প্রাণ। অন্তু, রাদ এবং মান্নাত বেগমের। একটু পরই এসে হাজির হলো অনন্যা, প্রণয় আর রাজিয়া বেগম। সবার মুখেই আ/তং/কের ছাপ। কি হবে এই ভেবে জানপ্রাণ বেরিয়ে আসছে সবার।

হঠাৎ এর মাঝে আরেকটা দুঃ/সংবাদ এসে কড়া নাড়লো অন্তুর ফোনে। নাম্বারটা দেখে অন্তু চাইলেও কলটা কেটে দিতে পারলোনা। বাধ্য হয়ে কলটা রিসিভ করে চলে গেলো অন্যপাশে। রাদ বসে আছে একটা চেয়ারে। হাঁটুতে ভর দিয়ে কপাল ঠেকিয়ে রেখেছে হাতে। প্রণয় আর অনন্যা বসে আছে তার দু’পাশে। প্রণয় বারবার তার কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিচ্ছে। অনন্যা মন খারাপ করে তার একহাত জড়িয়ে বসে আছে। মান্নাত বেগম কান্না করছেন লাগাতার। রাজিয়া বেগম থেকেথেকে স্বান্তনা দিচ্ছে তাকে।

কথা শেষ করে অন্তু রাদকে ডেকে নিয়ে গেলো সবার আড়ালে। জরুরি কলটা অবশেষে এসেছে তার কাছে। কথাটা শুনতেই আরেকটা দুশ্চিন্তা মস্তিষ্কে গেঁথে বসলো রাদের। তাকে এক্ষনি যেতে হবে সেখানে। না গেলে না জানি আবার কবে পাবে এই সুযোগ।

—-” আমি ইলহামকে এই অবস্থায় ছেড়ে কি করে যাবো বল! ইলহামের পাশে এই মুহুর্তে থাকাটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।”

—-” আই নো দ্যাট রাদ। বাট, আর তো কোনো ওয়ে নেই। কি করবি বল?”

—-” একটা ওয়ে আছে। তুই চলে যা আমার হয়ে।”

—-” কিন্তু, উনি তো তোকে এ্যাপয়েনমেন্ট দিয়েছেন!”

—-” নো প্রবলেম। তুই গিয়ে বলবি, আমি একটা জরুরি কাজে আঁটকে পড়েছি। তাই তোকে পাঠিয়েছি। তুই আমার ভাই হোস। এটা বলার পর আই থিংক উনি আর কিছু ভাববেন না।”

—-” তুই আমাকে এতো বড় একটা দায়িত্ব দিচ্ছিস। আমি কি পারবো তোর বিশ্বাস রাখতে?”

—-” কেন পারবিনা। ভাই হোস তুই আমার। পর নাকি? আমার নিজের ভাই।”

অন্তু বেশ ইমোশনাল হয়ে পড়ে। হওয়ারই কথা। একটা সময় ওদের যতটা ক্ষ/তি সে করেছে। সেই দিক থেকে ভেবে দেখলে রাদের উচিৎ তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া। তবে তা না করে রাদ তাকে এতোটা আপন করে নিয়েছে। ভাবতেই অবাক হয়ে যায় সে।

—-” পারবিনা?”

প্রশ্ন করে রাদ। অন্তু জবাবে উত্তর না দিয়ে জড়িয়ে ধরে ভাইকে। সে পারবে। এটুকু আত্মবিশ্বাস তার নিজের প্রতি ছিলো। তবে তার জোর এখন আরও দিগুণ বেড়েছে রাদের ছোট্ট কথাটায়, “ভাই হোস তুই আমার। আমার নিজের ভাই।” কি অদ্ভুত এক টান ফিরে পেলো সে।

—-” চল যা। লেট করিসনা।”

—-” ওকে ভাই। আমাকে এদিকের খবর জানাস প্লিজ। আমি টেনশনে থাকবো।”

—-” শোন!”

অন্তু কথাটা বলে যেতে নিলে রাদ হঠাৎ পিছু ডাকে অন্তুকে। অন্তু দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন মুড়ে বলে,

—-” হ্যাঁ বল?”

রাদ দ্বিধাহীন গলায় প্রশ্ন করে,

—-” এখনোও খুব ভালোবাসিস ইলহামকে?”

রাদের প্রশ্নে অন্তুর মুখখানায় কেমন মেঘের ছায়া পড়ে। ফ্যাকাসে বিচূর্ণ চাহনিতে অন্তু জবাব দেয়,

—-” না ভাই। ভালোবাসি না।”

রাদ মুচকি হাসে। এককদম এগিয়ে এসে অন্তুর গালে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলে,

—-” যা। সাবধানে যাস। এদিকে সব খবর পেয়ে যাবি।”

অন্তু জোরপূর্বক হেসে রাদের হাতের উঠর হাত রেখে মুমূর্ষু গলায় বলে,

—-” ইলহাম তোকে ভীষণ ভালোবাসেরে। আমাকে নিয়ে অযথা নিজের ভালোবাসার প্রতি কনফিউশান বাড়াস না।”

এই বলে চলে গেলো অন্তু। রাদ ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে তেড়ে আসা বড় একটা দীর্ঘশ্বাস গিলে নিলো। স্মিত হেসে আনমনে বলল,

—-” তুই সত্যিই অনেক বদলে গেছিস ভাই।”

#চলবে#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব______৩৬.

৬তলা অফিসের সবচেয়ে বড় এবং আলিশান রুমটাতে বসে আছে অন্তু। পরনে ফরমাল পোশাক। চোখে মুখেও পূর্বের সেই আতংক ভাবটা নেই। কারন যার সঙ্গে ও কথা বলতে এসেছে, তার সামনে কোনোরূপ চিন্তান্বিত ভাব কিংবা আতংকিত চেহারা প্রদর্শন করা চলবেনা। থাকতে হবে একদম নিখুঁত ও পরিপাটি। যেন, লোকটা চাইলেই ওকে ছোট করে চলে যেতে না পারে। শুনেছে বড় ভাবওয়ালা মানুষ। অবশ্য ভাব থাকাটাও দোষের কিছু নয়। কত বড় একজন বিখ্যাত গায়ক। তার তো ভাব থাকবেই।

বাইরে থেকে দরজা খোলার শব্দ ভেসে আসতে নড়েচড়ে শার্টের কলারটা টেনেটুনে নিজেকে ঠিক করে নেয় অন্তু। বুটের খটখট শব্দ তুলে কেউ হেঁটে আসছে ভেতরে। অন্তুর হৃদপিণ্ড একটু একটু কাঁপছে। ধীরেধীরে বুটের শব্দ কানের কাছে আওয়াজ তুলতে অন্তু চটজলদি উঠে দাঁড়ায়। সম্মান প্রদর্শনের খাতিরে স্মিত হেসে গুড মর্নিং জানায়। লোকটা শুনতে পেয়েছে কিনা ঠিক বোঝা গেলোনা। হাত ইশারায় অন্তুকে থামিয়ে দিয়ে বসতে ইশারা করে সেও বসলো তার জন্য সাজিয়ে রাখা চেয়ারটাতে। অন্তু গাল ফুলিয়ে সবার অগোচরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বসে পূণরায়। লোকটার পিছুপিছু দু’জন বডিগার্ড এবং একজন পার্সোনাল এসিসট্যান্টও আসে। লোকটা চেয়ারে ঠিক ভাবে বসলে বডিগার্ড দু’জন স্থানান্তর করে। এখন তাদের কাজ রুমের বাইরে পাহারা দেওয়া। লোকটার পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট একজন মেয়ে। বয়স ২৩-২৪। বসের ন্যায় তারও বেশ দামি পোশাক চড়ানো গায়ে। অন্তু মেয়েটাকে একপলক দেখেছে ঢোকার সময়। মুখ না দেখলেও পেছন থেকে মেয়েটার স্ট্রেইট করা চুল গুলো নজরে পড়েছে তার।

—-” স্যার, মিহাদ আবরিশাম রাদ।”

মেয়েটা নীচু স্বরে অদূরে বসে থাকা ছেলেটাকে ইশারা করে বলল কথাটা। লোকটা অর্থাৎ বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী রেজা খান পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার দেখলো অন্তুকে। সে তাকাতেই অন্তু ভদ্রতা সূচক হাসলো। হাসলো রেজা খানও। তবে দাম্ভিক হাসি। অন্তুকে ডেকে বসতে বললো তার সামনের চেয়ারটায়। অন্তু উঠে এসে বসলো তার সম্মুখে। অতঃপর নিজেকে খানিক ধাতস্থ করে বলে উঠলো অন্তু,

—-” ফার্স্ট অফ অল,আই এম অ্যাপোলাইজিং, বিকজ অফ মাই ব্রাদার! আজ আপনার সাথে ওর মিটিংটা থাকলেও ও একটা পারসোনাল প্রবলেমের জন্য আসতে পারেনি।”

—-” আপনার ভাই?”

—-” আব.. আই মিন, রাদ। আমি রাদ নই। রাদের ভাই। অন্তু।”

—-” আচ্ছা আচ্ছা, এতো ইম্পরট্যান্ট একটা মিটিং সে আসতে পারলোনা! ভেরি ডিস্যাপ্পোয়েন্টিং।”

—-” প্লিজ ডোন্ট বি ডিস্যাপ্পোন্টেড! ইউ ক্যান ট্রাস্ট মি। রাদই আমাকে পাঠিয়েছে এই মিটিংটা এটেন্ড করতে।”

—-” ও। ওকে দ্যেন। মিমি, ফাইলটা দাও উনাকে।”

লোকটা তার পিএকে উদ্দেশ্য করে বলল। ‘মিমি’ নামটায় একটু হোঁচট খেলো অন্তু। রেজা খানের ডাকের উৎস ধরে অন্তু দ্বিতীয় বারের মতো তাকালো মেয়েটার দিকে। মেয়েটাও ওর পানেই তাকিয়েছিলো। হঠাৎ অন্তু তাকাতে চোখাচোখি হলো দু’জনের। মেয়েটা সৌজন্যমূলক হেসে একটা ফাইল এগিয়ে দিলো অন্তুর পানে।

—-” এখানে জমিটার সমস্ত ডিটেইলস দেওয়া আছে। আপনি চাইলে একবার চেক করে নিতে পারেন। তারপর নীচের ওখানটায় সাইন করে ডিলটা ফাইনাল করুন।”

—-” সিওর।”

অন্তু বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছে ফাইলটা। কিন্তু বারবার মনে হচ্ছে কেউ একজন একধ্যানে তাকিয়ে কেবল ওকেই দেখছে। যার দরুন ফাইল দেখতে নিয়েও বারবার মনোযোগ ঘেটে যাচ্ছে ওর। তাই আর চেয়েও পুরো ফাইলটা দেখতে পারলোনা। মাঝপথেই সাইনটা করে দিয়ে ডিলটা ফাইনাল করলো।

—-” থ্যাঙ্ক ইউ। রাদ সাহেবকে একবার দেখা করতে বলবেন সময় করে। বাই দ্য ওয়ে, উনার কোনো মেজর প্রবলেম হয়নি তো?”

—-” হ্যাঁ মেজর প্রবলেমই বটে। এক্টচুয়ালি ওর ওয়াইফ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেভেন মান্থ’স প্রেগন্যান্ট। হসপিটালে নিতে হয়েছে। তাই..”

—-” ও আই সি। এখন সে কেমন আছে?”

—-” জানিনা এখনও! হোপ সো, সে ঠিক হয়ে যাবে।”

—-” ইয়াহ ইয়াহ, অফকোর্স।”

—-” থ্যাংঙ্ক ইউ। আজ আমি আসি তবে।”

—-” সিওর। নাইস টু মিট ইউ।”

—-” সেম হেয়ার।”

এই বলে অন্তু উঠে যেতে নিয়েও কিছু একটা ভেবে আবার উঠলো না।

—-” কিছু বলবেন?”

রেজা খান প্রশ্ন করলে অন্তু অদ্ভুত হেসে কন্ঠটা খাদে নামিয়ে প্রশ্ন করল,

—-” স্যার, আপনার একটা মেয়ে ছিলোনা? কি যেন নাম!( মনে করার চেষ্টা করে) ও হ্যাঁ, ইলহাম। ইলহাম কেমন আছে?”

আকস্মিক অন্তুর থেকে এমন অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন একদমই আশা করেনি রেজা সাহেব। তার হাসিখুশি মুখখানা আকস্মিক অন্ধকারে তলিয়ে গেলো। মিমি কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকালো রেজা সাহেবের দিকে। ও যেন আকাশ থেকে পড়েছে। রেজা খানের মেয়ে আছে? কই, ও তো কোনোদিন শোনেনি!

—-” এখন তো নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়ে গেছে। তাই না স্যার!”

এবার যেন রেজা সাহেবের গলা চে/পে ধরলো কেউ। চোখ মুখ কেমন লাল হয়ে উঠলো। তার মেয়ের কথা এই ছেলেটা কিভাবে জানলো? যে ইতিহাস তিনি আরও ২৩বছর পূর্বে গলা চে/পে হ//ত্যা করেছে সেই ক/বর কে খুঁড়ল!

—-” হোয়াট ডু ইউ মিন! কি বলতে চাচ্ছো তুমি?”

ভ/য়ানক রে/গে গেলেন রেজা সাহেব। যেন চোখ দিয়ে গিলে খাবেন অন্তুকে। অন্তু অবাক হওয়ার ভান করলো। বিস্মিত কন্ঠে বলল,

—-” আপনি এতো রে/গে যাচ্ছেন কেন! কুহেলিকা ম্যামের মৃ//ত্যুর পর আপনি ইলহামকে নিয়ে আসেননি আপনার কাছে?”

কুহেলিকা খান’ ইলহামের মা। এক সময়ের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী। মিমি নামের মেয়েটা একের পর এক হোঁচট খেয়ে চলেছে। তবে কি ইলহাম রেজা খান এবং কুহেলিকা খানের একমাত্র মেয়ে। আর রেজা সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী অর্থাৎ লাবনী ম্যাম নিঃসন্তান। লোকমুখে মিমি শুনেছে রেজা সাহেবের একটা মেয়ে আছে। তবে সে যে কুহেলিকা ম্যাম এবং রেজা সাহেবের মেয়ে সে কথা মিমির ধারণাতীত ছিলো।

—-” দেখুন মিস্টার অন্তু। আমি আপনাদের সাথে কোনো পার্সোনাল ইস্যু নিয়ে ডিসকাস করার ডিল করিনি। ডিল করেছি টাকার এবং কনস্ট্রাকশনের। এগুলো সম্পূর্ণই আমার পার্সোনাল ম্যাটার। আমি খুশি হবো, আপনি আমার পারসোনাল প্রবলেম নিয়ে আর কোনো কথা না বাড়ালে।”

—-” সরি স্যার! সামান্য কৌতুহল বশত আপনাকে বিব্রতবোধে ফেলে দিলাম। আই এম রিয়েলি সরি।”

জবাবে আর কিছুই বললেন না রেজা সাহেব। শুধু ভেতরে ভেতরে ক্ষো//ভে ফেটে পড়তে লাগলেন। এতোবছর বাদে হঠাৎ অতীত নিয়ে প্রশ্ন উঠবে ভাবতেই পারেননি তিনি।

তবে, অন্তু মনেমনে পৈ/শাচিক আনন্দে হাসলো। যে উদ্দেশ্যে এসেছিলো, সে উদ্দেশ্য তো সফল হয়ে গেছে। এবার কেবল সমস্ত সত্যিটা সামনে আসার পালা।

—-” আসি।”

এই বলে উঠে বেরিয়ে গেলো অন্তু। অন্তু বেরিয়ে যেতেই টেবিলের উপর জোরে একটা বারি বসিয়ে নিজের রা//গটাকে কন্ট্রোল করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালালেন রেজা সাহেব। কিন্তু রা/গ যে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছেনা।”

_____________

খাবারের প্রতি অনিয়ম এবং অতিরিক্ত চিন্তার ফলে ইলহামের শারিরীক কন্ডিশনের বেহাল দশা হয়েছে। ডক্টর যখন কথাগুলো বললেন, সবার মুখ চোখ শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে আসলো। জীবনের এমন একটা পরিস্থিতি সবচেয়ে বড় শ//ত্রুও তো কারোর এতো বড় ক্ষ//তি করেনা যতটা ইলহাম নিজেই নিজের করেছে। রাদ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। আসলে তারই ভুল হয়েছে। যবে থেকে ইলহাম ওর মায়ের মৃ//ত্যুর সম্মন্ধে এবং রন আঙ্কেলের সম্মন্ধে জানিয়েছে তবে থেকেই ওর এই রো/গ হয়েছে। সারাদিন শুধু এসব নিয়ে ভাবতে থাকতো। রাদ অনেকবার বারন করেছিলো তাকে, কিন্তু ইলহাম বারন শুনেও নিজেকে শুধরাতে পারেনি। আর সেই রো/গেই আজ সবটা শেষ হতে বসেছিলো। হয়তো উপরওয়ালা সহায় হয়েছেন ওদের উপর। তাই সবটা শেষ হতে হতেও ঠিক হয়ে গেলো।

ইলহামকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। সবাই এক এক করে দেখা করে গেলেও রাদ এলোনা দেখা করতে। মাকে বলে বেরিয়ে পড়েছে সে কোথাও। এটা হলো ইলহামের শা/স্তি। খুব অনিয়ম করা হয়েছে না নিজের উপর? এবার আরও অনিয়ম করুক! সব ধ্বং//স করে দিক! এই বলেই চলে গেছে সে। ইলহাম সবার দেখা পেলেও কাঙ্ক্ষিত মানুষটার দেখা না পেয়ে ভ/ঙ্গ হৃদয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলো।

রাত করে কেউ একজন এলো ওর কেবিনে। ইলহাম ভেবে খুশি হলো যে এটা রাদ। কিন্তু রাদ আসেনি। এসেছে অন্তু। কেবিনে প্রবেশ করে ইলহামকে এমন চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে থাকতে দেখে অন্তু মুচকি হাসলো। এগিয়ে আসতে আসতে বলল,

—-” রাদের অপেক্ষা করছিলে বুঝি?”

ইলহাম মন খারাপ করে চোখ সরিয়ে নিলো। কাতর কন্ঠে বলল,

—-” উনি ভীষণ রা/গ করেছেন আমার উপর তাই না?”

—-” হু, রাগ তো একটু করেইছে। বাট ইউ ডোন্ট ওয়ারি। আমি আছি তো।”

অন্তুর কথায় ভরসা পেলো ইলহাম। কিন্তু ভীষণ কান্না কান্না পাচ্ছে তার। নিজেকে কেন যেন কন্ট্রোল করতে পারছেনা। হঠাৎ কেঁদে উঠলো বাচ্চাদের ন্যায়। ওর এরূপ কান্না দেখে ভড়কে গেলো অন্তু। আমতাআমতা করতে করতে চটজলদি ফোন বের করে কল দিলো রাদকে। অসহায় গলায় জানালো,

—-” এ ভাই, তোর বউ কাঁদছে। জলদি ফিরে আয়।”

অন্তুর কথায় কাজ হয়েছে। পাঁচ মিনিটের মাথায় ঝড়ের বেগে এসে হাজির হলো রাদ। কোথা থেকে এলো, কেমন করে এলো ভাবতে গিয়ে কান্না থেমে গেলো ইলহামের। রাদ ব্যস্ত হয়ে গেলো ওর কান্না দেখে। পা/গলের মতো করতে লাগলো। কি হয়েছে, কোথাও পে/ইন হচ্ছে কি-না, ক/ষ্ট হচ্ছে কি-না এমন হাজারোও প্রশ্ন তার। ইলহাম রাদের পা/গলামি দেখে কি জবাব দিবে বুঝে কুলোতে পারলোনা। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে আচমকা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রাদকে। রাদ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো ইলহামের কান্ডে। ইলহাম কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

—-” আমাকে রেখে কোথায় চলে গিয়েছিলেন আপনি! আপনাকে দেখতে না পেয়েই তো কাঁদছিলাম।”

ইলহামের স্বভাব সুলভ জবাবে রাদ যেন কথা খুঁজে পেলোনা। এদিকে অন্তু আর কাবাবমে হাড্ডি হতে না চাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করে বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। রাদ জবাব খুঁজে না পেয়ে জড়িয়ে ধরলো ইলহামকে। রা/গারা/গি পরেও করা যাবে। এই মুহুর্তে ইলহামের মেন্টাল সাপোর্টটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here