প্রেম সায়রের ছন্দপাত পর্ব ১৪

#প্রেম_সায়রের_ছন্দপাত

#সাদিয়া_নওরিন

পর্ব—–১৪

গাড়ি আরিচাঘাটে ফেরিতে উঠতেই চোখ মুখ কুঁচকে পাশে বসা মানুষটির দিকে তাঁকালো আরশী।রাগের মাথায় আচারের ওপর আচার গিলছিল সে এতোসময় ধরে। কিন্তু বিপত্তি টা তখন বাধলো, যখন পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে বমি আসার যোগাড় হয়েছে তার। হাঁতের মুঠোটা খুলে বাকি আচারের প্যাকেটগুলো গুনলো আরশী। গুনে গুনে চৌদ্দটি আচার সাবাড় করেছে সে ইতোমধ্যে! নিজেকে নিজেরই মারতে ইচ্ছে হচ্ছে আপাতত আরশীর৷ এতো বড় হওয়ার পর এতোটা বেখেয়ালী হবে সে, এ যেন ভাবনা অতিত ছিল তার কাছে।
সে মনে মনে কিছু ভেবে করুন দৃষ্টিতে তাকালো ইরহামের দিকে। তারপর অনুনয়ের স্বরে বলল,
—– জানালার পাশে কি আমি বসতে পারি কিছুসময়?
——এসি বাসে তো জানালা খোলা নিষেধ। শুধু প্রকৃতিই দেখা যায় পর্দা সরিয়ে।আর তুমি তো জানো আমি কতোটা প্রকৃতিবিলাসী।তার চেয়ে বরং একটা কাজ করো,রাতটাও যেহেতু গভীর হয়েছে ঘুমিয়ে পড়। দেখবে এক ঘুমে গন্তব্যে পৌঁছিয়ে গিয়েছো তুমি।
আরশীর ভারী রাগ হলো। সে দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে ” শালা,শালা ” গালি দিল। তারপর রাগটা আটঁকে শান্ত স্বরে বলে উঠলো,
—– আমার বমি ভাব হচ্ছে তাই বললাম।
—- ওহ হো ! হঠাৎ!তা বিবিজি আমাদের অনাগত বেবি আসছে নাকি? হুম?যদিও আমি কিছুই করলাম না।
রশিকতার সুরে মুচকি হেঁসে বলতে লাগলো ইরহাম।

আরশী বিষ্ময়ে হা হয়ে গেল ইরহামের এমন নির্লিপ্ত ব্যবহারে। মানুষটার এমন গায়ে পড়া কথাগুলো গায়ে ঘিন ধরিয়ে দিচ্ছে যেন তার।সে তাড়াতাড়ি তার সামনের সিটের বেকপকেটে পলিথিনের খোঁজ করা শুরু করলো।খুব বিষ্ময়করভাবে পেয়েও গেল সে একটি পলিথিন সেখানে! সে তাড়াতাড়ি মুখের সামনে পলিথিনটা খুলে ধরলো। ইরহাম সেদিকে তাকিয়ে অবাক কন্ঠে কিছু বলার আগেই হড়হড়িয়ে বমি করে দিল আরশী তাতে!
আরশীর বমির বেগ পরপর বাড়ছে। বুকের ভেতরটাও প্রচন্ডভাবে জ্বলছে তার। পছন্ড কষ্টে চোখ বুঝে বমি করতে লাগলো সে!অন্যদিকে ইরহাম, সে নাক সিঁটকে যথাসম্ভব আরশীর থেকে দূরে পালাতে ব্যাস্ত আপাতত! বমি শুরু হওয়ার সাথে সাথেই জানালার সাথে এঁটে দাঁড়িয়ে গেল সে, যেন এখুনি জানালার ভেতরেই প্রবেশ করে বসে থাকার ইচ্ছুক সে!
ধরফরিয়ে উঠে বসলো ইরশাদ। ফেরিতে উঠে আশার পর থেকেই গাড়িতে ধাক্কার ভাবটি একদমই নেই যেন।আর পুরো গাড়িও একদম নিস্তব্ধ হয়ে আছে।সব যাত্রীরা আরামের সহিত ঘুমুচ্ছে এখন।কিন্তু কারো কষ্টের আর্তনাত একদম ছুঁচের মতো বিঁধছে ইরশাদের হৃদয়ে! কন্ঠের ব্যাক্তিটিকে চিনতে মোটেও অসুবিধা হলো ইরশাদের। আর চেনার সাথে সাথে সে তাড়াতাড়ি সিট ছেড়ে উঠে এলো আরশীর কাছে।

ইরহামের চেহারার দিকে তাকাতেই রাগে ফেটে পড়লো ইরশাদ। কিন্তু মুখের ওপর কিছুই বলল না সে তাকে।আপাতত আরশীকে বেটার ফিল করানোটাই যেন তার প্রধান কাজ। সে নাক ফুলিয়ে ইরহামের দিকে তাকিয়ে, আলতোভাবে আরশীর পিঠ মালিশ করতে লেগে গেল।
হঠাৎ কারো কোমল স্পর্শে বিষ্মিত হলো আরশী। সে আলতো মাথা ঘুরিয়ে নিজের পেছনে থাকা মানুষটির দিকে তাকালো।
হুট করেই আরশীর ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসির উদয় হলো যা ইরহামের অলক্ষ্যেই থেকে গেল!আর তারপর সে নিজের শরীরের সবটুকু ভার ছেড়ে দিল পেছনে থাকা ব্যাক্তিটির উপর!

একহাঁতে আরশীকে শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল ইরশাদ।আর তারপর অন্যহাতে আরশীর পিঠে মালিশ করতে করতে পানির বোতলটি এগিয়ে দিতে বলল ইরহামকে। ইরহাম তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলে পানির বোতলটি সামনে এগিয়ে দিয়ে, দুকদম পিছিয়ে গেল।তারপর একনিশ্বাসে বলল,
—– আসলে আমি একদমই বমি সহ্য করতে পারি না।
—- বমি সহ্য করার জিনিস না। কেউ শখ করেই এইটা করে না ভাইয়া। যে দেখছে তার থেকে যে করছে তার বেশী কষ্ট হয় এটি করতে। আর তাছাড়া, আপনি হয়তো এই বিষয়ে অজ্ঞ ।
নাক ফুলিয়ে উত্তর দিল ইরশাদ। প্রচন্ড রাগ লাগছে এখন তার। কিছুসময় পর, হুট করেই অদ্ভুত এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ইরশাদ! আরশীকে এখানে একা ফেলে যাওয়াটা একদমই মন থেকে সায় দিচ্ছে না তার। আর তাই সে সরাসরি ভাবেই ইরহামকে বলল,
—– আপনার হয়তো খুব বেশী অসুবিধে হচ্ছে এখানে।আপনি চায়লে আমার সিটে গিয়ে বসতে পারেন। আমি এখানে ঠিক আছি।আমার কোন প্রবলেম হবে না।

ইরহাম হয়তো এই কথার জন্যই অপেক্ষা করে বসেছিল এতোক্ষণ! আর সেইকারনেই ইরশাদের বলা কথার পরপরই উঠে দাড়িয়ে ব্যাগটি হাতে নিয়ে কেটে পড়লো সে সেখান থেকে। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে একপলকে ইরহামের যাওয়ার পানে তাকিয়ে জানালাটি খুলে দিল ইরশাদ।তারপর আরশীর হাতের প্যাকেটটি সাবলীলভাবেই নিয়ে পলিথিনটি শক্ত গিট দিয়ে ছুঁড়ে মারলো বাইরে। ঠিক একটু পরই পানির ছলাৎ শব্দ শুনা গেল বাইরে। আর তারপর নিজের হাতটি ভালোভাবে ধৌত করে আরশীকে কুলি করে নিতে বলল ইরশাদ।
মুহূর্তেই দু-চোখ জলে ভরে উঠলো আরশীর! অশ্রু ফোয়ারা ঝরঝরিয়ে ঝরে পড়তে লাগলো তার আঁখি ছুঁইয়ে। পরম গভীর দৃষ্টিতে ইরশাদকে নিরক্ষণ করতে লাগলো সে কিছুসময়! এর একটু পর জানালার কাছে দাঁড়িয়ে কুলি করে কিছুটা পানি পান করলো সে।তারপর আস্তে করে বসে পড়লো জানালার পাশে থাকা সিটটিতে।

কিছুসময় নিরবতা চলল উভয়ের মাঝে। আরশী হালকা সুস্থতা অনুভব করতেই সে জানালার কপাটটি বন্ধ করতে উদ্যত হলো। আর সাথে সাথেই ইরশাদ হুট করে চেপে ধরলো আরশীর হাতটি! চমকে ইরশাদের মুখ পানে তাকালো আরশী।
নদীর মিষ্টি বাতাস ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে দুটি মনকে। আঁখির শুভদৃষ্টি ক্ষণে কেঁপে উঠছে দুটি সত্তা! শীতলতার আভাস ছড়িয়ে পড়েছে আরশীর চোখেমুখে। ওষ্ঠদ্বয়ের কম্পনে কুঁকড়ে যাচ্ছে তার শরীর! ইরশাদ পুলকিত ভাবে তাকিয়ে আছে তার মুখ পানে! গভীর চোখের সাথে মিলিয়ে ছোট নাকটি আরশীর সৌন্দর্যের যেন এক বিশেষ অংশ। চিকন গোলাপি ঠোঁটটি ঈষৎ গোলাপি রঙ ধারণ করছে বমির পর।কিন্তু ইরশাদ আপাতত আরশীর সেই মিষ্টি হাসিটাই তালাশ করে চলেছে তার ঠোঁটজোড়ায়!আরশীর কম্পিত ঠোঁটের পাশে দেবে যাওয়া টোল নামক বিশেষ বস্তুটি যে ইরশাদের প্রাণ হরনে যথেষ্ট।
আরশীর গায়ের রঙটা ইরশাদের মতো ফর্সা নয়৷ কেমন সোনালী হলদে একটা ভাব আছে তার গায়ের রঙে। তবে তার এই বিশেষত্বটাও মুগ্ধ করে তুলে ইরশাদকে! মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে যেন নেশা নেমে আসে ইরশাদের চোখে! সে নেশাতুর স্বরে ফিসফিসিয়ে বলে,
—– কিছুসময় খোলা থাকুক। বদ্ধ ভাবটা চলে গেলে হয়তো আরাম লাগবে তোমার

ইরশাদের ফিসফিসানো মিশ্রিত ধ্বনি ঝংকার তুলল আরশীর হৃদয়ে! স্পর্শকাতর অনুভূতিতে কম্পিত হলো সে। হৃদয়ের ধুকপুকানির সাথে পাল্লা দেওয়া ওষ্ঠের কম্পন যেন মুহূর্তে বেড়ে গেল তার! ইরশাদ আলতোভাবে চোখ তুলে তাকাতেই আরশীর কম্পিত দেহ চোখে পড়লো তার। চোখ খিঁচে ওড়নাটি আঁকড়ে ধরে আছে সে।
ইরশাদ যেন আজ নতুন নেশায় মজছে।আর সেই নেশার নাম হয়তো আরশীনেশা! হঠাৎ ইরহামের দিকে চোখ পড়লো তার। পেছনে তার সিটে বসে থাকা মেয়েটির সাথে গল্প করছে ইরহাম।মুখে ঝুলছে তার অমায়িক হাসি!

মুহূর্তেই মেজাজটি আবার বিগড়ে গেল ইরশাদের। সে নাক ফুলিয়ে বলল,
—- বাহ্, ভালো স্বামী জুটিয়েছো তো। বিসিএস ক্যাডার, সুন্দর! ভালো, দিনকাল খুব ফুর্তিতেই যাচ্ছে আজকাল হয়তো তাই না?
আরশীর হঠাৎ মনে হলো তাকে কেউ মনোরম সৌন্দর্য থেকে ধাঁকিয়ে নর্দমায় ফেলে দিয়েছে।আর কিছুসময় আগে দেখা সুন্দর স্বপ্নটিও যেন চুরচুর করে ভাঙ্গছে তার সামনে এখন। আঁখিযুগল আবার ভরে উঠার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে আরশীর। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল সে৷ বাস ফেরী পার হয়েছে কিছু সময় আগে।আর এখন রাতের বাতাসের বেগটাও অতিরিক্ত বেরেছে বাইরে। বাতাসের শো শো ধ্বনি বারবার তাকে জানান দিচ্ছে ঝড়ের আভাস।কিন্তু আরশীর হৃদয়ে চলছে এখন তুফান! সে তাড়াতাড়ি জানালা টি বন্ধ করে চোখ বুঝলো। মনের এই যন্ত্রনা আর সহ্য হচ্ছে না তার। তার ওপর আবার এখন মুখটাও বড্ড তেতো ঠেকছে তার কাছে। মাথাটাও হালকা ধরে আছে।
আপাতত ঘুৃমনোটায় শ্রেয় মনে হলো আরশীর কাছে।আর সে কিছুসময় পর ঘুমের দেশে তলিয়ে ও গেল।

চোখদুটো আলতো বুঝে নিজের অতিতটা ভাবতে লাগলো ইরশাদ।আরশীর সেই দিন আবার তার সাথে দেখা করতে আসা, তাদের একসাথে কাটানো পুরো দিনের সেই সুন্দর স্মৃতি আজো ইরশাদের চোখের সামনে ভাসছে যেন! সে আনমনেই বলে উঠে,
—– তুমি আজো একটুও বদলাও নি। তোমার সেই লাজুক চপলতা আজো মুগ্ধ করে আমায়৷ আচ্ছা তোমার এই কম্পন, এ কি শুধুই আমার জন্য। আমার অস্তিত্ব অনুভব করেই কি তোমার শিরা-উপশিরায় এতোটা কম্পনের উৎপত্তি হয়? নাকি অন্য কেউ.

বাকি কথাটুকু আর ভাবতে পারলো না ইরশাদ।বড্ড অস্হির লাগছে তার এখন।জিবনটাই অসহ্য লাগতে শুরু করলো হুট করে তার৷ অসহ্য যন্ত্রণায় হাহাকার করে উঠলো যেন হৃদয়টিও!

হঠাৎ বুকের ওপর ভারী কিছু অনুভব হলো ইরশাদের। কারোগরম নিশ্বাসগুলো যেন গুনে গুনে পড়ছে তার কাঁধ আর বুকজুড়ে!তাড়াতাড়ি চোখ খুলে বুকের ওপর তাকালো সে। মুহূর্তেই অবাক হলো সে! গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা আরশীকে দেখে যেন মুহূর্তেই মনটা ভালো হয়ে গেল তার!
আনমনে চিন্তা করলো সে,
“এতো জার্নিতে তো সে ঘুমুই নি, কেমন আমি পাশে বসতেই ঘুমিয়ে কাঁদা! শুনেছি স্বামী পাশে থাকলে স্ত্রীরা যেকোন জায়গাতেই নিশ্চিতে ঘুমুতে পারে। কথাটি কি আসলেই সত্যি!”
আচমকা ইরশাদকে আরো অবাক করে ইরশাদের বাহুটি শক্তভাবে আঁকড়ে ধরলো আরশী!
ইরশাদের বুকের রক্তগুলো যেন ছলকে উঠলো সাথে সাথে ! রক্তনালি মাঝে রক্তের বেগ যেন হুট করেই বেড়ে গেল তার!হাতদুটিও অসম্ভব ভাবে কাঁপছে এখন ইরশাদের! প্রথম বার নিজের স্ত্রীর স্বইচ্ছায় স্পর্শ কতোটা স্বর্গীয় তাই যেন অনুভব হচ্ছে এখন তার।

ইরশাদ আরেকটু নড়েচড়ে বসলো। আরশীকে টেনে নিজের দিকে তুলতে গিয়ে খনিকটা ইতস্তত হলো তার। হাজার হোক কোন মেয়েকে হুট করে স্পর্শ করা অযৌক্তিক। আর যদি সে ঘুমন্ত বা অজ্ঞান হয়, তাহলে তার থেকে আরো বেশী দূরে থাকা দরকার পুরুষের।কারন ঘুমন্ত কন্যার রূপ যুগে যুগে মোহিত করে আসছে পুরুষজাতিকে।আর এই সময় খনিকের জন্য কাছে আসাটা মাঝে মাঝে প্রবল ঘাতক হয়।

তাড়াতাড়ি নিজের দৃষ্টি সংযত করে পাশের সিটের দিকে তাকালো সে। তারপর কিছুভেবে কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতে লেগে গেল। গাড়ি চলছে আপন গতিতে আর ইরশাদও ঘুমিয়ে কাঁদা। তবে গাড়ির হালকা ঝাকুনি যেন একদম কাছে নিয়ে এসেছে তাদের দুজনকে ! ঠিক কোন সময় ইরশাদ আরশীকে আঁকড়ে নিজের বুকের মাঝে ধারণ করছে, আর আরশীও কখন ইরশাদের বুকে হেলে পড়েছে তা কেউ জানে না! দুটি দেহ যা কোন সময় একটি দূর্ঘটনায় ” কবুল” নামক শব্দে বাধা পড়েছিল তা যেন আজ উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে আবার তাদের হৃদয়ে! এটা কি সেই কবুলের শক্তি? নাকি হৃদয়ের কোনে জমে থাকা সেই সায়র রূপী প্রেম যার ছন্দপাত আজো শুনতে পারছে দুটি হৃদয়

চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here