‘প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল’
৫৮.
বেহিসেবী বর্ষা অঝোর ধারায় ঝরে প্রকৃতি রুষ্ট করতে এখনো ব্যস্ত। থেমে থেমে চমকাচ্ছে মেঘেদের দল। আঁধার পৃথিবীকে ক্ষনিকের আলোর ঝলকানি দেখিয়ে দিচ্ছে। অশান্ত বাতাস তেড়ে আসতে চাইছে বাড়ির ভেতরে।
স্তব্ধতা ভেঙে, অরু সজোরে চিৎকার করে ওঠে। আর্তনাদ! কেমন ধড়ফড়িয়ে ছুটে এগোল। অগ্রাহ্য করে বসলো মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা, কাঁচের টুকরো গুলো। নরম তুলতুলে পায়ের তলা কাঁচ ঘেঁষে যেতেই, র’ক্তের ছোপ ছোপ দাগ ভেসে উঠল মেঝেতে। ভড়কে উঠলেন আনোয়ার সাহেব। বিমুঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। পরপরই দ্রুত হাতে মেয়েকে বুকে আটকে নিলেন। তন্ময় বেশ দুর্বল। দাঁড়াতে পারছে না। তাকে ধরে আছে মোস্তফা সাহেব, ওহী সাহেব। পেছনে অয়ন, আকাশ ও সাহায্য করছে। সেখানে অরু কিভাবে যাবে? তাই আটকে রেখেছেন। কিন্তু অরু ছটফটিয়ে উঠছে। এখন আর সে চিৎকার করছে না। হাউমাউ শব্দে কাঁদছে। নিজেকে ছাড়াতে চাচ্ছে। দুয়ারে দাঁড়ানো তন্ময়কে ছুঁতে চাওয়ার অসীম প্রচেষ্টায় মগ্ন সে। আনোয়ার সাহেবের বুঝ তাকে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে না। তার চোখের সামনে শুধু র’ক্ত! তন্ময়ের বিষণ্ণ মুখশ্রী। দুর্বল শরীর!
রেজাউল সাহেব তখনো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে। ভেজা তন্ময়কে দু’হাতে আগলে ধরেছেন, লম্বাচওড়া সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মোস্তফা সাহেব। ওহী সাহেবের সাহায্যে ছেলেকে ভেতরে নিতে নিয়ে, ব্যাকুল গলায় বিড়বিড়িয়ে আওড়ালেন, ‘কি হয়ে গেল এসব আব্বা! এই তন্ময়!’
রেজাউল চটপট জবাব দিল,’ এক্সিডেন্ট! কবরস্থানের ওদি..’
অ্যাক্সিডেন্ট শুনেই থমকে যান জবেদা বেগম। খোদার নাম নিয়ে রীতিমতো হেলে পড়েছেন। মুফতি বেগম এবং সুমিতা বেগম না ধরলে, তিনি পরে যেতেন ফ্লোরে।
_____
ইতোমধ্যে শাবিহাও চলে এসেছে। ভাইয়ের এই করুণ হাল, সেও মেনে নিতে পারছে না। দু’চোখ ভিজে উঠেছে। কিছুক্ষণ আগের উত্তেজনা, ভালো লাগা কোথায় যেন উবে গেল। একরাশ ভয়, আতঙ্ক বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে দিল। সোফায় একান্তে বসে ফুপিয়ে কাঁদছে। তন্ময়কে কামরায় নেওয়া হয়েছে। সবাই সেখানে। শাবিহাও গিয়েছিল। দাঁড়ানোর যায়গা নেই বিদায়, বড়দের জায়গা দিয়ে সরে এসেছে। অয়ন ও তার পিছু পিছু এসেছে। চারিপাশে নজর বুলিয়ে পাশে বসেছে। খানিক কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়েছে। শাবিহার কান্নার স্বর মিইয়ে গেল মুহুর্তে। তবে চোখ তুলে তাকাল না। শব্দহীন কান্নায় নিমজ্জিত সে।
অয়ন স্বান্তনার সুরে বলল, ‘কাঁদছ কেন? কান্না থামাও। ভাইয়ার কিছু হয়নি। সকালেই দেখবে সুস্থ!’
শাবিহা ভেজা গলায় বিড়বিড় করল, ‘কি হয়ে গেল! কেন হলো! এইতো বিকেলেও সুস্থসবল ছিল!’
‘তুমি এভাবে কাঁদলে অরুকে সামলাবে কে? মেয়েটা কেমন করছে দেখেছ? প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। এই অবস্থায় এতো হাইপার হওয়া ওর জন্য ভালো না।’
শাবিহা মাথা দোলাল। দু’হাতে চোখমুখ মুছল। উঠে দাঁড়ালো। তাদের অরু তো এখন একা নয়। অরুর ভেতরে আরেকটি অরু আছে। দুজনের খেয়াল রাখতে হবে। অয়ন হাসলো। সেও উঠে দাঁড়ালো। পুনরায় চারপাশে নজর বোলালো। কেউ নেই! মুহুর্তে শাবিহার হাত টেনে বুকে জড়িয়ে নিল। শক্ত করে, দৃঢ় বন্ধনে। শাবিহা চমকে উঠলো। ছাড়াবার জন্য ছটফট করছে, ‘আরে..কি করছ!’
অয়ন হেসে সশাবিহাকে বাহু বন্ধন হতে মুক্ত করলো। হাত বাড়িয়ে শাবিহার চোখের জল মুছিয়ে দিল, ‘আজকে একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম। তোমার চোখে পানি আমার সহ্য হয়না। বুকে যন্ত্রণা অনুভব করি।’
শাবিহা চোখ আড়াল করলো। মুখমণ্ডল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুধালো, ‘এখন কি আমি কাঁদতেও পারব না?’
অয়ন হাসলো, ‘যাও। অরুকে দেখ।’
শাবিহা আড়চোখে তাকাল। মাথা দুলিয়ে অগ্রসর হলো পূর্ব দিক। সেদিক থেকে অরুর গলা শোনা যাচ্ছে। মেয়েটা কীভাবে কাঁদছে! তার কান্নার তোড়ে বাকিরা চুপসে গেছে। কেউই আর নিজেদের আবেগ দেখাচ্ছে না। বুকে গেঁথে রেখেছে। তাদের শান্ত দেখে হয়তো অরুর কান্নাকাটি থামবে। তার হৃদয় শীতল হবে।
___
প্রকৃতি প্রাণবন্ত, ভেজা-ভেজা। আবহাওয়া ঠান্ডা। নির্জন চারিপাশ। মৃদু বাতাস বইছে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসছে। বৃষ্টি থেমেছে। আকাশ এখনো মেঘলা। প্রকৃতি আঁধারে।
পর্দা গুলো দাপিয়ে দুলছে। এলোমেলো ভঙ্গিতে ছুঁয়ে দিচ্ছে অরুর মুখশ্রী। সে জানালা আর বিছানার মধ্যে বসেছে। পর্দাগুলো তাকেই পেয়েছে জ্বালানোর জন্য। বিছানায় মাথা পেতে রেখে, বসেছে সে ফ্লোরে। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত জেগে ছিলো। চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে ছিল তন্ময়ের পানে। সহস্র চুমু খেয়েছে মুখমন্ডল জুড়ে। কতটাই না শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছিল মানুষটাকে। ভয়ে সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপেছে। তন্ময় চোখ মেলে তাকিয়েছে। অস্পষ্ট স্বরে জানিয়েছে, সে ঠিকাছে! তখনই একটু শান্ত হয়েছে মেয়েটা! তার আগ পর্যন্ত শুধু কেঁদেছে। আর্তনাদ করেছে। পাগলের ন্যায় ছটফট, ধড়ফড় করেছে।
গলাটা শুকিয়ে কাঠকাঠ হয়ে এসেছে তন্ময়ের। কয়েক প্রচেষ্টার পর আধো-আধো চোখ মেলে তাকায়। মাথা সহ শরীর বেশ ভাড় হয়ে আছে। বড্ড যন্ত্রণা অনুভব করছে সর্বাঙ্গে। চোখ জোড়া কুঁচকে, কপালে হাত চেপে ধরে। অনুভব করে ব্যান্ডেজের। দৃষ্টি পরিষ্কার করে পাশে তাকায়। তার ব্যান্ডেজ করা বাম হাত, জাপ্টে ধরে ঘুমাচ্ছে অরু। তন্ময়ের চোখের ভাঁজের মাত্রা দ্বিগুণ হয়। এতো কষ্ট করে ঘুমানোর মানে কি? ঘাড়ে ব্যথা পাচ্ছে না? তন্ময় উঠে বসতে চাইল। পারলো না। শরীর বেশ দুর্বল।
দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে জবেদা বেগম। সারারাত তিনি জেগেই কাটালেন। ক্ষনে ক্ষনে এসে দেখছেন ছেলেটা উঠেছে কিনা! কিছু লাগবে কিনা! তন্ময়কে নড়তে দেখেই এগিয়ে আসলেন। গলার স্বর নামিয়ে শুধালেন, ‘কি লাগব আব্বা? উঠে না!’
বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন৷ আঁচলে মুখ মুছলেন। তন্ময় মায়ের হাত টেনে পাশে বসালো। ভাঙা গলায় বলল,’আমি ঠিকাছি মা।’
‘কই ঠিক আছস? ভালোভাবে কথাটুকু বলতে পারতেছস না!’
তন্ময় চোখের ইশারায় অরুকে দেখাল, ‘ও এভাবে শুয়ে আছে কেন? কিছু বলোনি!’
‘তোর বাবা, চাচ্চু আমি সবাই কত করে বললাম! কথা শুনল না। এসময় কতো গুঁছিয়ে চলতে হয়। মেয়েটা কোনো কথাই শোনে না। এখন কি ও একা? কবে…’
ছেলের প্রশ্নবোধক চাহনিতে দৃষ্টি মিলতেই, জবেদা বেগম হুট করে থেমে গেলেন। মনে পড়লো ছেলে তার কিছুই জানে না। জবেদা বেগম এবার প্রগাঢ় দৃষ্টিতে ছেলের মুখশ্রী দেখে নিলেন। বিচিত্র ভঙ্গিতে ঠোঁটের কোণ ঠেসে হাসি ছুটলো তার। তন্ময়ের সন্দেহজনক স্বর, ‘কি হয়েছে মা অরুর?’
জবেদা বেগমের হাসির রেখা বড়ো হলো, ‘অরুর দায়িত্ব কার এখন? ও না-হয় ছোটো? তুই ও কি ছোটো? দেখেশুনে রাখবি না! কতটুকুই বা বুঝে!
হেলাফেলা চলবে না। সচেতন হ। খেয়াল রাখ। দায়িত্ব নে!’
তন্ময় ঘাবড়াল। গলার স্বর বেশ সচেতন, ‘হয়েছে কী?’
‘কি হবে? অরু প্রেগন্যান্ট! বাপ হতে যাচ্ছস আর জানস ও না! পোলাপান মানুষ করবি কেম্নে?’
তন্ময় পলক ঝাপটাল। পরপর থমকাল। দৃষ্টি নিথর। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রেখেছে। অসামান্য বড়ো হয়ে আছে চোখ। বেশ খানিক সময় নিল, ‘কী! মানে..’
জবেদা বেগম হেসে ছেলের মাথায় হাত রাখলেন। বোলালেন। উঠে এক গ্লাস পানি এগিয়ে রাখলেন। যাবার পূর্বে বলে গেলেন, ‘খাবার নিয়ে আসি। খাবি! তোর বাপ কিচ্ছুটি মুখে নেয়নি। এখন যদি তোর দেখাদেখি একটু খায়।’
তন্ময় তখনো থমকে বসে। মায়ের কথা বুঝতে বেশ সময় লাগলো তার। দৃঢ় দৃষ্টি ফেললো অরুর নরম ঘুমন্ত মুখশ্রীর পানে। মাদক চাহনিতে খুব করে দেখে নিল। হাত বাড়ালো। আঙুলের সাহায্যে গাল ছুঁয়ে দিল। নিস্তব্ধ কক্ষে আওড়াল, ‘সত্যি?’ চোখ বুজল। লম্বা শ্বাস নিল। দমবন্ধ হয়ে আসছে। সুখে কী? এক অদ্ভুত উত্তেজনায় সর্বাঙ্গ শিরশির করছে। ভাগ্যের উপর চরম বিরক্ত সে। এই মুহুর্তে তাকে অ্যাক্সিডেন্ট করতে হলো? এইযে অরুকে পাজাকোলে তুলতে পারছে না। আদরে দিশাহারা করতে পারছে না! অসম্ভব ভাবে চোখজোড়া লাল হয়ে এসেছে। বাবা হবার খুশিতে?
__
উইকেন্ডস ছাড়া মাহিন খুব পরিপাটি মানুষ। ঠিকঠাক সময় মতো খেয়ে নেয়। রুটিন মাফিক ঘুমোয়। ন’টায় অফিস থাকে! আটটায় বাড়ি ফিরে। উইকেন্ডের বিষয় আলাদা। সেদিন আড্ডা দেয় বন্ধুদের সঙ্গে। ঘুমোতে দেরি আর উঠতেও। সেই সময়নুমাফিক চলা ছেলেটা আজ কোথায় হারিয়ে গেল? অফিস থেকে ফিরে কথা বলা শুরু করেছে, এখনো করছে। ভোর হতে চলেছে। মারজি ঘুমঘুম গলায় কিছু একটা বলছে। মাহিন শুনছে। হাতে কফির মগ। এই নিয়ে তিনটা কফি শেষ করলো। কত ঘন্টা ধরে কথা বলছে? চার-পাঁচ ঘন্টা তো হবেই। না এবার থামতে হবে। টিনএজেরদের মতো করলে চলবে নাকি? মেয়েটাকে তো ঘুমোতে হবে! কাল আবার নাকি তার ক্লাস আছে! মারজির বকবকানি মাঝপথে থামিয়ে মাহিন বলল, ‘ক্লাস আছে না? ঘুমোতে যাও!’
‘তুমি কি ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলছ? বিরক্ত হচ্ছ?’
মাহিন নিঃশব্দে হাসলো। জবাব দিবে পূর্বেই ইনকামিং কল আসার, নোটিফিকেশন দেখা গেল। এসময় ইব্রাহিমের কল? মাহিন তাগাদা দিল, ‘শুয়ে পড়ো। গুড নাইট।’
মারজি অভিমান করতে চাইল। হলোনা। ঘুমে চোখ বুজে গিয়েছে। মুহুর্তে ঘুমের দেশে পাড়ি জমাল। কান থেকে সেলফোন ও সরানো হলো না।
‘কি হয়েছে?’ মাহিনের সচেতন গলার স্বর।
ইব্রাহিম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। কোনো বাজে সংবাদ শুনবে, বুঝে নিয়েছে মাহিন। হলো ও তাই। ইব্রাহিম জানালো, ‘তন্ময় অ্যাক্সিডেন্টে করেছে!’
‘হোয়াট? আর ইউ কিডিং?’
‘খবর পেলাম মাত্র। আকাশ বললো। অবস্থা তেমন খারাপ না। ঠিক আছে।’
‘কেম্নে কী!’
‘জানি না। যাবি?’
‘হ। কল দে শুহানি ওদের। জানা! গেলে মিলেমিশে যাই৷’
‘কল দিতেছি দুপুরের দিক।’
‘উম!’
___
ঘরের বাতি বন্ধ। পর্দা টেনে দেওয়া হয়েছে। কামরা মৃদু আঁধারে তলিয়ে। তন্ময় ভাঙা পা আর দুর্বল শরীরে উঠে দাঁড়িয়েছে। অরুকে জাপ্টে ধরে তুলেছে। পুরো শরীর ব্যথায় নিল হয়ে গেল! কাঁ’টা ক্ষত গুলো এখনো কাঁচা। টান লেগেছে অরুকে তুলতে গিয়ে। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সে দেয়াল ধরে ঘনঘন শ্বাস নিল। তারপর ধীরে বিছানায় উঠে বসলো। অরুর পাশে শুয়ে পড়লো। শরীরে কাঁথা মেলে নিল। অনিমেষ ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকলো। কেঁদেকেটে মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। লাল হয়ে আছে মুখমণ্ডল। চোখের জলের দাগ এখনো দৃশ্যমান। তন্ময় ঘনিষ্ঠ হলো। অরুকে বুকে নিল আলগোছে। মুখের কাছে মুখ এগিয়ে নিল। দু’চোখের পাতায় চুমু বসালো। গলা নামিয়ে ডাকল, ‘অরু!’
জবাব এলো না। তন্ময় হাত নিচে নামাল। অরুর পেটে ছুঁয়ে দিল। খুব করে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছে এখানটায়! কান পেতে বসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে! তার ছোট্ট অরু মা হবে। তার অনাগত সন্তানের মা। ভাবতেই শরীর লোমকূপ দাঁড়িয়ে উঠছে। তন্ময় মুখ ডোবাল ঘন রেশমি চুলে। গোঙাল, ‘ধন্যবাদ জান। আই লাভ ইউ।’
_________
চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক”প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল’
৫৯.
অরু কিছুটা ছন্নছাড়া। একটু বদমেজাজি। সামান্য বোকাসোকা ও। বুঝে কম, চেঁচায় বেশি। তাই বলে এতটাই অবুঝ হ্যাঁ? সে প্রেগন্যান্ট, অথচ নিজেই জানে না! বাকি সকলেই জানে! দুঃখ পেল। কষ্ট অনুভব করল। তবে চোখে জল এলো না। সে আনার চেষ্টা করেছে সামান্য। যখন থেকে প্রেগন্যান্সির খবর শুনেছে, পেটে হাত বুলিয়ে চলেছে সমানে। ক্ষনে ক্ষনে আয়না দেখছে। বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা আওড়াচ্ছে। অনাগত সন্তানের সঙ্গে হয়তো বোকা মেয়েটা কথা বলতে চাচ্ছে! বাড়ির সবাই চিন্তায় অরুকে নিয়ে। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছে। অরু নাকি অনেক ছোটো। এমন অল্পবয়সে বাচ্চা নেওয়া ঝুকিপূর্ণ বিষয়। তার সম্পুর্ন জীবন উপভোগ করা বাকি। পড়াশোনাই বা কতদূর গেল? নিতান্তই ছোটো মেয়েটা এখনই বাচ্চা নিলে, ভবিষ্যতে এই বিবাহ জীবন তার আর ভালো লাগবে না। ইত্যাদি!
এসব শুনে অরুর মন খারাপ হলো। ভীষণ পরিমাণে! বাড়ির সবাই কেন ভাবছে যে তার বয়স হয়নি? হয়তো অরু অবুঝ। পরিবারের ভালোবাসার আবডালে বড়ো হওয়া একটা বড়সড়বাচ্চা। কিন্তু সে আশেপাশের মানুষ দেখে। বন্ধুবান্ধবদের অবস্থা জানে। এসএসসি দিয়েই তার বান্ধবী রূপা বিয়ে করে ফেলল আলহামদুলিল্লাহ, এখন সে দু’বছরের বাচ্চার মা। তার বয়সী অনেক মেয়ে-ই সংসার করছে। তাদের বাচ্চা আছে। তাহলে অরু কেন পারবে না? পারবে সে। পেরে দেখাবে সবাইকে। এই বাচ্চার জন্য অরু সবকিছু করতে রাজি। সবকিছু!
ভালোবাসার রঙ লাল। লাল কেন? কারণ লাল রক্তের প্রতীক। আর রক্ত আমাদের ভেতরটায় অবস্থিত। রক্ত বিহীন কী মানুষ বাঁচে? উঁহু নয়। বাঁচে না। তেমনই ভালোবাসা ছাড়া মানুষ বাঁচে না। মানুষ মাত্রই ভালোবাসার কাঙাল। ভালোবাসার দাস। এতো কষ্ট, বিচ্ছেদ, হৃদযন্ত্রণার পরও ভালোবাসাই চেয়ে যায় মানুষ। ভালোবাসার মানুষ কাছে চায়, পাশে চায়। একটা দিন চোখের মনিটার উপর প্রিয় মানুষটার মুখ ভেসে না উঠলে, বক্ষে শান্তি মিলে না। পরানে আগুন জ্বলে দাউদাউ করে। যন্ত্রণা অনুভব হয়। ছটফট করে হৃদয়। আর যদি ভালোবাসার মানুষটা কথা না বলে? তাহলে কেমন অনুভূতি হয়? ভয়ংকর নয় কী? অবশ্যই। তন্ময় একদম কথা বলছে না। অরুর পানে তাকাচ্ছে না। গম্ভীরমুখে অন্যদিকে ফিরে রয়। খেতে বসে মাথা নিচুস্তর পদে রাখে। চুপচাপ থাকে। অরু বিড়ালছানার মতো তার আশেপাশে ঘুরেফিরে বেড়ায়। একটু দৃষ্টি পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে রয়। কিন্তু পাষাণ মানুষটার কোনো হেলদোল নেই। ভুলবশত ও ফিরে দেখছে না।কেমন থমথমে করে রেখেছে চেহারা। কেন? তন্ময় কী খুশি নয় এই সুখবর শুনে? সে কী বাচ্চাটা চায় না? পরমুহূর্তেই মনে পড়ল বড়ো মায়ের কথা। তিনি স্পষ্ট গলায় বলেছিলেন, বাবা হবার খুশিতে তন্ময় ইমোশনাল হয়ে পড়েছিল! কেঁদেছে ও। তাহলে? অরুর সাথে এমন কেন করছে? আকাশকুসুম ভাবনায় বিভোর সে, বড্ড অসহায় হয়ে পড়েছে।
বক্ষে বইছে সীমাহীন, আসমান জমিন ধ্বংসের সমান যন্ত্রণা। অসহ্যকর এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি শুধু তাকে তন্ময় দিতে পারবে।
_________
হাসপাতালে এপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হয়েছে সকাল দশটার। দশটার পূর্বেই অরুকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরোনো হবে। সুমিতা বেগম ন’টার মধ্যেই ব্যাগ গুঁছিয়ে নিয়েছেন। প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়েছেন সঙ্গে। যেমন, ফ্ল্যাক্সে গরম পানি। টিস্যু, নরম তুলতুলে খাবার। পানির বোতল, ইত্যাদি। জবেদা বেগম রান্নাঘরে। তিনি খুব ভোরে আকাশকে দিয়ে টাটকা সিং মাছ আনিয়েছেন। মেয়েটা হাসপাতাল যাবে। রক্ত পরিক্ষা করাবে। কতগুলো রক্ত নেওয়া হবে। শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। সেসময় সিং মাছ বড্ড উপকারী। শরীরে রক্ত হতে সাহায্য করে। সঙ্গে তিনি আনাড় আনিয়েছেন। এই ফলেও শরীরে রক্ত হতে সাহায্য করে। এমন অনেককিছুই আনিয়েছেন যা এখন অরুর শরীরের জন্য উপকারী।
অরুর সঙ্গে হাসপাতালে যেতে সবাই তৈরি। এইযে দীপ্ত সকালসকাল ড্রয়িংরুমে বসে। তৈরি হয়ে। বাড়ির সকলের আগে। এরপর এসেছে আকাশ তারপর শাবিহা। তারাও নাকি যাবে হাসপাতালে। পাঞ্জাবি পরে এসেছেন মোস্তফা সাহেব। আনোয়ার সাহেব ও পরপর এলেন। ড্রয়িংরুম ভর্তি মানুষ দেখে, একে অপরের মুখে তাকিয়ে হাসলেন। সজোরে, উচ্চস্বরে। জবেদা বেগম হেসে বললেন, ‘বাচ্চাদের গিয়ে কাজ নেই। বড়ো কয়েকজন গেলেই হবে।’
আনোয়ার সাহেব হাসলেন। এগোলেন বড়ো ভাইয়ের দিক। কাছাকাছি এসে বললেন, ‘ভাইয়া যান। আমি থাকি।’
‘না না। তুই যা আমি থাকি।’
তর্কতর্কি হলো কিছুক্ষণ। অবশেষে ফয়সালা হলো। আনোয়ার সাহেব এবং মোস্তফা সাহেব দুজনেই যাবেন। সঙ্গে সুমিতা বেগম। ব্যস! অরু নেমেছে। বড়ো বড়ো চোখে সবাইকে দেখছে। তারা বেরোবে এমন সময় তন্ময় বেরিয়ে আসলো। ধীরেসুস্থে। তাড়াতাড়ি হাঁটলে ব্যথা পায়। খুব সাবধানে হাঁটতে হয় তার। তাকে দেখে মোস্তফা সাহেব চিন্তিত হলেন। জিজ্ঞেস করতে চাইলেন, ‘তুমি কেন… ‘
আনোয়ার সাহেব ভাইয়ার চোখে চোখ রাখলেন। ইশারায় কিছু একটা বোঝালেন। হয়তো মোস্তফা সাহেব বুঝেছেন। তাইতো আর কিছুই বললেন না। আড়ালে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। শেষমুহুর্তে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে চারজন বেরিয়েছেন।
তন্ময় ড্রাইভিংয়ে বসেছে। এক্সিডেন্টের পর একটা ট্রমাটিক সিচুয়েশনে ছিল সে। আপাতত নেই। সুস্থসবল ভাবেই চালাচ্ছে। হাতে চিনচিন ব্যথা অনুভব করছে, তবে তা সম্পুর্ন অগ্রাহ্য করল মস্তিষ্ক! এই সামান্য ব্যথা তার একরোখা মস্তিষ্ক নাজেহাল টিস্যুর মতো ডাস্টবিনে ফেলে দিল যেন!
অরু বাপ-চাচার মধ্যখানে চুপসে বসে আছে। মোস্তফা সাহেব চিন্তিত নয়নে বারবার পাশে তাকাচ্ছেন। মেয়েটার কোনো সমস্যা হচ্ছে কি-না! থেমে নেই আনোয়ার সাহেব ও। তিনি বড়ো ভাইয়ের থেকে এগিয়ে কি-না! প্রশ্নই করে বসলেন,’খারাপ লাগছে আম্মা?’
অরু মাথা নাড়াল। চোখ বুজল। আবারো খুলল। সামনে তাকাল। তন্ময়ের পাশে সুমিতা বেগম বসে। তিনি ফিরে তাকালেন। পানির বোতল বের করে এগিয়ে ধরলেন, ‘একটু খেয়ে নে। ভালো লাগবে।’
বাড়ি থেকে বেরিয়ে আধঘন্টা হয়নি। এখনই কী পানির তৃষ্ণা পায়? অরু তবুও হাত বাড়িয়ে নিল। অল্পখানিক পানি খেয়ে বোতল হাতে রাখল। উদাসীন চাহনি নিক্ষেপ করল পাষাণ মানুষটার দিক। মানুষটা কী বুঝতে পারছে তার হৃদয়ের ব্যাকুলতা? ভেতরটা যে ক্ষনে ক্ষনে দুমড়েমুচড়ে উঠছে উপলব্ধি করতে পারছে? পারছে না। তাইতো এভাবে কষ্ট দিতে পারছে।
আনোয়ার সাহেব দক্ষ চোখের অধিকারী। আশেপাশের হালচাল চোখা চোখে দেখে বুঝে ফেলতে পারেন। আপনজনের মুখ পড়ে সবকিছু বুঝে ফেলার গুণ তার মধ্যে বিদ্যমান। তাইতো ছেলেমেয়ের মধ্যে সমস্যা চলছে বুঝতে সময় লাগেনি। দুজনের মধ্যে একটা রেষারেষি চলছে, বুঝে নিলেন আনোয়ার সাহেব। তন্ময় বুদ্ধিমান ছেলে। প্রচন্ড নির্ভরশীল। অগাধ বিশ্বাস এই ছেলের প্রতি তার আছে। ঠিক সামলে নিবে। ঠিক করে নিবে। ভেবেই আনমনে মৃদু হাসলেন আনোয়ার সাহেব। নিজেদের বোঝাপড়া নিজেরাই করে নিক। মাত্রই তো শুরু সংসার জীবন। এমন ছোটোখাটো কথা-কাটাকাটি, মান-অভিমান নিয়েই তো এগোতে হবে।
অপেক্ষাকৃত মনমানসিকতা নিয়ে দাঁড়িয়ে দুই গুরুজন। দৃষ্টি তাঁক করে রেখেছেন সামনে। অরুর বেশ কিছু টেস্ট নেওয়া হয়েছে। একেক টেস্টের জন্য একেক ফ্লোরে যেতে হচ্ছে। গার্ডিয়ান শাহজাহানেরা সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছেন। তন্ময় বেঞ্চে বসে দু’পা ছড়িয়ে। একনাগাড়ে সে দাঁড়াতে পারছিল না বিধায়, একপ্রকার জোরপূর্বক ছেলেকে বসিয়েছেন মোস্তফা সাহেব। পাক্কা দু’ঘন্টা লেগেছে সবগুলো টেস্ট করাতে। রিপোর্ট গুলো কাল নিয়ে যেতে হবে। তন্ময় প্রেসক্রিপশন নিয়ে এসেছে। সুদূরে অরু দুর্বল হয়ে, ঢলে পড়েছে সুমিতা বেগমের বাহুতে। একটু র’ক্ত নিয়েছে, আর একটুখানি এদিকসেদিক কী যেতে হয়েছে, তাতেই নাজেহাল অবস্থা মেয়েটার।
_______
‘মাহিন!’
‘হু! ক!’
‘দুঃসংবাদ শুনছস! এখন সুসংবাদ শুনবি না?’
‘আবার কী হইলো?’
‘আংকেল হতে যাচ্ছস শালারপো!’
মাহিন থমকাল সামান্য ঘাবড়াল। সোফা ছেড়ে দাঁড়াল। হতবাক, বিমুঢ় সে, ‘কী কস? গাঞ্জা খাইছস?’
‘তুই দিছস?’
‘ইব্রাহীম! কী বলতাছস?’
‘আমাদের বড়ো তন্ময় চাচা ওরফে আমাদের চ্যাম্প.. চ্যাম্পের চ্যাম্পিয়ন আসতে যাচ্ছে!’
‘খাইছেড়ে!’
‘খাইছে মানে! বাইড়া তাড়াতাড়ি। এক্ষুনি যাইতে হইব।’
মাহিন দেরি করল না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শরীরে শার্ট জড়িয়ে, টেবিল থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সোজা হাইওয়ে চলে এলো। এখানে সীমান্ত ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে রিয়াদ, শুহানি, ইব্রাহীম। তারা মাহিনের অপেক্ষাতেই ছিল। কথোপকথনে পুরোদমে ব্যস্ত। গাড়ি নজরে আসতেই প্রত্যেকে উঠে বসলো। পেছনে রিয়াদ, শুহানি। সামনে ইব্রাহীম। মুহুর্তে টেনে চলে গেল গাড়িটা। উদ্দেশ্য শপিংমল। কিছু কেনাকাটা করবে। সঙ্গে হরেকরকম মিষ্টি.. ফলমূল নিতে হবে না? এমন সুসংবাদ অনেককিছুর প্রাপ্য।
______
বাড়িতে ফিরে ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিয়েছে অরু। মায়ের হাতে স্যুপ খেয়েছে। মাথায় পানি দিয়েছে। ফলের রস খেয়েছে। নিজেকে সুস্থসবল করে রুম থেকে বেরিয়েছে। মাথাটা বের করে আশেপাশে নজর বুলিয়েছে। না কেউ নেই! তারপর ছোট ছোট পা ফেলে তন্ময়ের রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তন্ময় বিছানার সাথে হেলে বসে। মুভি দেখছে মনোযোগ দিয়ে। অরু গুটিগুটি পা ফেলে বিছানার সামনে দাঁড়াল। তন্ময় তাকে দেখেও দেখছে না। অবশেষে করুণ গলায় ডাকল, ‘শুনেন।’
তন্ময় মাথা তুলে তাকাল। অরুর মায়াবী মুখে দৃষ্টি তাঁক করল। এবং তাকিয়েই থাকল। নজর আর সরাল না। তীক্ষ্ণ ভূতগ্রস্ত দৃষ্টিতে অরু ভীতু হলো। নড়েচড়ে উঠল। দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। বুকের ভেতরটা ধপাস করে উঠল। এভাবে তাকালে অরুর বুঝি কিছু হয়না? অপরদিকে তন্ময় শুধু তাকিয়েই আছে। কোনোপ্রকার প্রশ্ন করছে না। আর নাইবা দৃষ্টি সরাচ্ছে। অদ্ভুত! অরু তীক্ষ্ণ দৃষ্টির মাঝেই বিছানার কোণে বসলো। জড়সড় ভঙ্গিতে। জামার কোণ ধরে মোচড়ামুচড়ি করছে। মস্তিষ্ক হাতড়ে কিছু একটা বলে, ‘মুভি দেখছেন?’
তন্ময়ের জবাব এলো না। তবে সে ল্যাপটপ ঘুরিয়ে দিয়েছে অরুর দিক। যাতে সে নিজে দেখে নিতে পারে। অরু কষ্ট পেলো। কিছুক্ষণ আগের মিশ্রিত লজ্জিত অনূভুতি সুদূরে পালাল। মনের গহীনে হানা দিল একরাশ বিষন্নতা। গুমোট বাঁধ ভাঙা কান্না ঠেলে আসতে চাচ্ছে। সে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রাখল। কান্না না করার আপ্রান চেষ্টা করল। তার দ্বারা হলো না। ক্ষনিকের মাঝে চোখের কোণ ঘেঁষে গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। ফুঁপিয়ে উঠল। গলার স্বর নামিয়ে আওড়াল, ‘কথা বলেন না কেন! কী করছি আমি?’
তন্ময় নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকলো। তারপর হুট করে উঠে দাঁড়াল। ভাঙা পা ফেলে ধীর গতিতে গিয়ে দরজা লক করল। ফিরে এসে দাঁড়াল অরুর সম্মুখীন হয়ে। একদম সামনাসামনি। অরুর কান্না গলায় আটকে গেল। চোখের জল থমকে গেল। মুখ তুলে সে তাকাল। তন্ময় ঝুকল। একদম অরুর মুখ বরাবর। তার ঘন, তপ্ত নিশ্বাস অরুর মুখশ্রী ছুঁয়ে গেল। অনিমেষ তাকিয়ে থাকলো ক্ষনিক। সময় নিয়ে শুধালো, ‘তুই পিল গুলি নিয়েছিলিক?’
________
চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক’