প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব –৫৪+৫৫

‘প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল’

৫৪.
‘অরু! মাইর দিব কিন্তু!’

স্ব-শব্দে, গম্ভীর স্বরে তন্ময় ধমকে উঠে নিস্তব্ধ কক্ষে। অরু ঘাবড়ে যায়। থমকে যায় পা’জোড়া। থমথমে চেহারায় ফিরে তাকায়। করুণ দৃষ্টি। নাজুক অবস্থা! নাক ফুলিয়ে বিছানায় উঠে বসে। টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। মুখশ্রী মলিন হয়ে আছে। তন্ময়ের ধমক এসময় হজম হলো না তার। এটা সময় ধমকে উঠার? আর অরু কী এমন করেছে যে ধমক দিতে হবে। অরু অভিমানে পাশে ফিরে গেল। তন্ময় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। কপালে আঙুল ঘষে, এগিয়ে গেল। আঁটসাঁট ভঙ্গিতে এক গ্লাস পানি গটগট করে খেল। গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে কেন বারবার। মাথাটাও ধরে আসছে। বুকে অশান্তি। মেয়েটা তাকে কিছুতেই শান্তি দেয়না। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করতে ব্যস্ত থাকে! তন্ময় দুপাশে অশান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায়। কাবার্ডের দিক এগোয়। সহিসালামতে রাখা ফাইল খানা হাতে নেয়। টেবিলের সামনে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে৷ হাতের ফাঁকে আঙুল চালিয়ে, একটু মনোযোগ হবার প্রচেষ্টায়। তবে তা অসম্ভব। তার অবাধ্যগত ঘূর্নিঝড় তো পাশেই। এই ঘূর্ণিঝড় চারিপাশে থাকলে কাজ করা অসম্ভব। অরু ইতোমধ্যে গুটিগুটি পায়ে, তন্ময়ের পাশে বসে দাঁড়িয়েছে। মাথা ঝুকিয়ে ফাইল দেখছে। তন্ময় ফাইল বন্ধ করে ফেললো। মাথা উঁচু করে তাকাল। অরু মিনমিনে গলায় বলল, ‘কী? ঘুম ধরছে না তো! না ধরলে আমি কী করবো!’
‘আমাকে খেয়ে ফেল।’

তন্ময় উঠে দাঁড়ালো। অরুকে ঠেলে বিছানায় ফেলে দিল, ‘চুপচাপ ঘুমা!’
‘আপনিও আসেন।’

তন্ময় বাধ্য ছেলের মতো বিছানার অপরপ্রান্তে উঠে বসলো। আধশোয়া হয়ে শুল। অরু জড়সড়ভাবে তন্ময়কে জড়িয়ে ধরেছে। সঙ্গে মৃদু কেঁপেও উঠেছে। তবুও ছাড়েনি। ধরেই রাখল। বুকে মাথা পেতে দিল। দুচোখের পাতা বন্ধ করলো। ঘুমানোর চেষ্টা করছে, হচ্ছে না। দ্রিমদ্রিম শব্দে বুক ধড়ফড় করছে। তন্ময় পাশে থাকলে এই এক সমস্যা। বুকের গতিপথ সাধারণ থাকতেই চায় না৷ অরু বিচলিত ভঙ্গিতে চোখ তুলে তাকায়। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলে যায়। অরু আহত গলায় বলে, ‘ঘুম ধরছে না৷ গান শোনাবেন?’

তন্ময়ের গম্ভীর স্বর আরও গম্ভীর শোনালো, ‘এটা গান গাওয়ার সময়!’
‘এমন করেন কেন! একটু শোনালে কী হয়?’

তন্ময়ের জবাব এলো না। গভীর চোখে তাকিয়ে রইলো। অরু মাথা নুইয়ে অন্যপাশে ঘুরে গেল। চোখমুখ অন্ধকার। জামার ফালি সরে, ধবধবে ফর্সা পেটের কিছু অংশ দৃশ্যমান। তন্ময় নিজের দুচোখ ইচ্ছে মতো ডলে নিল। এই নির্বোধ মেয়েটাকে ইচ্ছেমতো ঝাড়তে ইচ্ছে করছে তন্ময়ের। অবুঝের বাচ্চা! হাত বাড়িয়ে অরুকে বুকে টেনে নিল। চুলে আঙুল বোলালো। খুব ধীর স্বরে একটি গানের লাইন আওড়াল। নিভু নিভু গলার স্বর। স্তব্ধ, বিমুঢ়, নিস্তব্ধ আঁধার কক্ষে, গভীর শোনাল। অরুর সর্বাঙ্গে শিহরণ বয়ে গেল। বুকের ভেতর ঢেউ খিলখিল করে উঠলো। উথাল-পাতাল অবস্থা,

‘ঘুমাও তুমি ঘুমাও গো জান, ঘুমাও আমার কোলে
ভালবাসার নাও ভাসাবো, ভালবাসি বলে
তোমার চুলে হাত বুলাবো, পূর্ণ চাঁদের তলে
কৃষ্ণচূড়া মুখে তোমার, জোসনা পড়ুক কোলে

এত ভালবাসা গো জান,
রাখিও আঁচলে
দোলাও তুমি, দুলি আমি,
জগত বাড়ি দোলে ‘

অরুর কী যে হলো! সে এক অদ্ভুত কান্ড ঘটাল। তন্ময়ের কোলে চড়ে বসলো। চোখমুখ বন্ধ করে তন্ময়ের গালে চুমু বসালো। এতো আদুরে, তার তন্ময় ভাই যে অরুর খেয়েই ফেলতে ইচ্ছে করে। বুকের গতিপথ ও তো ঠিকঠাক চলছে না। চুমু খেয়ে সেই অজ্ঞান হয়ে যাবে, এমন ভাব। অপরদিকে তন্ময়ের এতক্ষণের ধৈর্য্য ভেঙেচুরে ফ্লোরে পড়ে গিয়েছে।
__________
ভার্সিটির জীবন শুরু অরুর। এখন সে ভীষণ ব্যস্ত। মারজি আর তার সাবজেক্ট এক। একই ডিপার্টমেন্ট। ক্লাসগুলো একসাথে করছে। চতুর্থ দিনের মধ্যেই, ভিন্ন ডিপার্টমেন্ট হতে চারজন বন্ধু বানিয়ে ফেলেছে। শুভ, জয়, রাহিতা,শান্তি। তাদের ছ’জনের ভালো বন্ডিং হয়ে উঠেছে ইতোমধ্যে। এখন ক্যাম্পাসে আড্ডা দেওয়া তাদের রোজকার বিষয়। একসাথে কফিশপে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটানো হয়। আজ ছজন ক্যান্টিনে বসে। গোলাকার ভঙ্গিতে একেকজন একেক চেয়ারে আয়েস করে বসে। অরু কফিতে চুমুক বসাচ্ছে। মারজি তর্ক করছে জয়ের সঙ্গে। জয়ের গার্লফ্রেন্ড সুবিধার নয়। ধান্দাবাজ মেয়ে একটা। মারজি মেয়েটাকে দেখতেই পারে না। এটার সাথে কেন প্রেম করছে, মাথায় আসে না তার। শুভ হাত উঁচিয়ে বলে, ‘শান্ত হ আমার মা। প্লিজ লাগে।’

মারজি বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা ঘুরিয়ে রাখল। অরু নিজমনে চুপচাপ বসে৷ সাড়াশব্দ নেই কোনো। তাকে অন্যমনস্ক দেখে জয় শুধালো, ‘কিরে? হইছে কী তোর?’
‘হু? কই না কিছু না!’

রাহিতা শব্দ করে হাসলো, ‘হাসবেন্ড নিয়ে চিন্তিত আমাদের অরু! তাই না? ঝগড়া করে এসেছিস নিশ্চয়ই? মারধর করেছে নাকি?থাক দোস্ত! বিবাহিত জীবনে এই টুকটাক ঝগড়া লেগেই থাকে!’

মারজি হেসে উঠলো, ‘মারধর? ভাইয়াকে দিয়ে?অসম্ভব! ঝগড়া তাও ওদের মধ্যে? কখনোই না। তন্ময় ভাই একটা জ্বলজ্যান্ত আইটেম। ধৈর্যের সাগর। মহা পুরুষ। তোরা তো তাকে দেখিস নাই। জানোস ও না কেমন! তাই বলতে পারছিস। এটাকে কোলেপিঠে মানুষ করেছে ভাইয়া। সবকিছু মুখ বুঝে সহ্য করে নেয়।’

শান্তি হতাশ গলায় বলল, ‘ভাইয়াকে খুব দেখার ইচ্ছা রে!’
‘আমারও। তাও আবার অরুর কাজিন। একই বাসায় থাকা হয়। আমার ভাই ভাবতেই শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। কী রোমান্টিক! এই অরু, একদিন ইনভাইট কর না তোদের বাসায়। দেখে আসি!’

অরু অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে জবাব দিল, ‘হু।’

সকাল থেকেই অরুর শরীর ভালো না। ঠিক সকাল থেকে নয়। কিছুদিন ধরেই এক অদ্ভুত খারাপ লাগা কাজ করছে। কেমন শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে। খেতে ইচ্ছে হয় না। আবার হুট করেই অনেক কিছু খেতে ইচ্ছে হয়। মাথা ঘুরিয়ে উঠে। নাহলে বোমি চলে আসে। এইতো রাতে মাছের ঘ্রাণ শুনে, একগাদা বোমি করে বসেছে। সকালে আসার সময় মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছে। কয়েকটি সিঁড়ি বাইতেই শ্বাসপ্রশ্বাস অশান্ত হয়ে উঠে৷ শরীর অল্পতেই ক্লান্ত। আজ আবার দুপুর হতে না হতেই, দুচোখ ঘুমে কাতর হয়ে গিয়েছে। বিছানা পেলেই ঘুমিয়ে পড়বে। অরু টেবিলে দুহাত বিছিয়ে মাথা রাখল। একটু রেস্ট নিবে ভেবেছে। কখন ঘুমিয়ে পড়লো অজানা। মারজি ছুঁয়ে দিল, ‘এই অরু!’

অরু চোখজোড়া পিটপিট করে মেলে চাইল। সবকিছু চোখের সামনে ক্লিয়ার হতেই উঠে বসলো, ‘আমি আজ আগে বেরিয়ে যাই। শরীর ভালো লাগছে না।’

শুভ উঠে দাঁড়ালো অরুর সঙ্গে, ‘চল গাড়ি পর্যন্ত দিয়ে আসি। তোরা বোস। আসছি আমি।’

অরু সকলকে বিদায় জানিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। খুব ধীরেসুস্থে হাঁটছে। হাঁপিয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ লক্ষ্য করে শুভ শুধালো, ‘দোস্ত, কোনো সমস্যা? তোর জামাই কী তোকে..মানে তোর পরিবার… ‘

অরু ক্রমাগত মাথা নাড়াল। শুভর সন্দেহজনক গলার আভাস পেয়েই, চমকে উঠেছে সে। হাঁটা থামিয়ে দিল। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে শুভর চোখে দৃষ্টি রাখল। দৃঢ় গলায় বলল, ‘শুভ! আমার তন্ময় ভাই বেস্ট। সবদিক দিয়েই বেস্ট। তার মতো জীবনসঙ্গী আমি খুব ভাগ্য করে পেয়েছি। আমি কখনোই আমার পরিবার হতে, খারাপ আচরণ পাইনি। আমি হাতেহাতে পুতুলের মতো বড়ো হয়েছি। কিছুদিন ধরে আমার শারিরীক দুর্বলতা বেড়েছে এই যা!’
‘যাক। শান্ত করলি। খুব টেনশন হচ্ছিলো।’
‘করিস না। সামনেই গাড়ি। তুই যা!’
‘উঠ গাড়িতে, চলে যাব।’

অরু হাসলো। এগোল গাড়ির দিক। ড্রাইভার চাচা অপেক্ষা করছে। অরু দূর হতে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাল। ঝটপট উঠে বসলো গাড়িতে। হাতপা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখল। অস্থির গলা উঁচিয়ে বলল, ‘এসির টেম্প্রেচার আরেকটু কমিয়ে দিন চাচা। প্রচন্ড গরম!’
‘বেশি খারাপ লাগছে?’
‘একটু।’
‘পানি নাও।’

ড্রাইভার চাচা পানির বোতল এগিয়ে দিলেন। অরু খেল অল্প করে। খেয়ে পুনরায় সিটে মাথা এলিয়ে দিল। অরু অস্থির হয়ে উঠছে। নড়েচড়ে উঠছে বারংবার। ড্রাইভার চাচা চিন্তিত মুখে ফিরে তাকাচ্ছে। মেয়েটার কী হলো!
________
মারজি আড্ডাস্থল থেকে উঠেছে দুটোর দিক। মাত্রই বেরিয়েছে ভার্সিটি থেকে। আজ গাড়ি আসেনি। গাড়ি করে তার মা নানুর বাড়ি গিয়েছে। রিকশা করে যেতে হবে। সে হাঁটা ধরবে সেমুহুর্তে সেলফোন বেজে উঠলো। ব্যাগ থেকে বের করে স্ক্রিনে নজর বোলালো। সেই চিরচেনা নাম্বার। মারজির মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। মাস খানেক ধরে কল আসেনি। মারজি ভেবেছে লোকটা হয়তো ভুলে গিয়েছে। সেও ভুলে যাবার চেষ্টা করেছে। তবে হুট করেই মনে পড়ে যেতো। এতদিন পড় হঠাৎ কেন কল করেছে? মারজি সংকোচবোধ করছে। ধরবে কী না! সময় নিয়ে ধরলো, ‘হ্যালো?’

মাহিনের গলার স্বর ফোনের ওপর পাশ হতে গম্ভীরই শোনাল, ‘হোয়াইট টপ, হোয়াইট স্নিকার্স, কাঁধে ব্যাগ, মেয়েটা তুমি তো?’

মারজি চমকে উঠলো দৃশ্যমান রূপে। বড়ো চোখে তাকাল চারিপাশে। চোখ গেল সামনে। রাস্তার ওপর প্রান্তে। একটি কালো গাড়ির সামনে, ফর্মাল ড্রেসে একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। লম্বাচওড়া সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। গাল জুড়ে চাপদাড়ি। চোখে কালো সানগ্লাস। কানে সেলফোন চেপে রেখেছে। নজর মারজির দিকই। মারজির হৃদপিণ্ড লাফিয়ে চলেছে সমানে। বিচলিত নয়নে আশপাশ তাকাচ্ছে। কী করবে? ইতোমধ্যে মাহিন রাস্তা পেরিয়ে আসছে। মিনিটের মধ্যে চলে এলো মারজির সামনে। লম্বাটে মাহিনের পানে তাকাতে মারজি মাথা উঁচু করলো। পরপর নজর ফিরিয়ে নিল। কী করবে বুঝতে পারছে না! ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে সে। মাহিন হাসলো। দীর্ঘ হাসি তার, ‘আমি মাহিন।’

মারজির মুখ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চলল, ‘তো আমি কী করবো!’

বলে আহম্মক বনে গেল। মুখটা এতো আগে আগে কেন চলে! অবশ্য ভুল কিছু বলেনি। তার আরও কিছু কতজা শোনাতে ইচ্ছে করছে। একমাস কোথায় ছিল? মনের এক কোণে পুষে রাখা অভিমান রয়েছে মারজির। মাহিন শব্দ করে হাসলো, ‘আই লাইক ইট। আই মিন দ্যা ওয়ে ইউ আর।’

মারজির চোখের পল্লব সামান্য কেঁপে উঠল। থতমত খেয়ে অন্যপাশে নজর রাখল। মাহিন শুধালো, ‘লাঞ্চ হয়েছে? আমার সাথে লাঞ্চ করবে মারজি?’

মারজির খিদে পেয়েছে। মুলত লাঞ্চ করার জন্য তাড়াতাড়ি বেরিয়েছে। বাসায় গিয়ে খেতে বসবে বলে! আঁড়চোখে আরেকবার সামনের সুদর্শন লোকটাকে দেখে নিল। মিনমিনে সুরে বলল, ‘করা যায়!’
__________
অয়ন ইদানীং ব্যস্ত থাকে। খুবই ব্যস্ত। সচরাচর তাকে পাওয়া যায় না। শাবিহা ঘুম বাদে জেগে থাকে। অয়ন বেশ রাত করে কল করে। বারোটায় ঘড়ির কাঁটা তখন। শাবিহা সবেই শুয়েছিল। কল পেয়ে উঠে বসলো। অয়ন ভিডিও কল করছে। বুকে ওড়না পেঁচিয়ে রিসিভ করলো। অয়ন উদোম প্রশস্ত বুক চোখের সামনে চলে এলো। গোসল সেড়ে এসেছে হয়তো! ফোঁটা ফোঁটা পানি সর্বাঙ্গে। শাবিহা নজর ফেরালো। অয়ন চুল মুছতে নিয়ে কথা বলছে, ‘জেগে ছিলে আমার জন্য?’
‘এতো দেরি করে আসছ যে?’
‘নতুন প্রজেক্ট করলাম। আজই শেষ। ভালো ফলাফল পাব মনে হচ্ছে!’
‘খেয়েছ?’
‘না। দেখেছ তোমাকে কেন লাগবে তাড়াতাড়ি? এইযে এখন তুমি থাকলে খাইয়ে দিতে, তোমার নরম তুলতুলে হাত দিয়ে। এতো কষ্টে থাকতে হতো?’
‘ফাজলামো রাখবে?’
‘আচ্ছা রাখলাম। কাল বেরোবে। বিকেল দিক। আমি নিতে আসব তৈরি থেকো!’
‘না পারবো না।’
‘পারবে। না পারলে তোমার বাড়িতে চলে আসব। তারপর তোমার ঘর। বুঝছ? আরে সামনে আসো। ক্যামেরার পেছনে কী করো! তোমাকে না দেখলে ভালো লাগে না তো! অস্থির লাগে। কতদিন দেখা হয়না বলো ত? অসম্ভব মিস করছি। একটু ছাদে আসবা?’
‘পাগল তুমি? কী টায়ার্ড দেখাচ্ছে! এক্ষুনি ঘুমাবে।’
‘কিছু মিনিট শুধু। প্লিজ, প্লিজ। শাবিহা….’

শাবিহা বিরক্ত হলো। এতরাত করে ছাঁদে! বাবা দেখলে খবর হয়ে যাবে! তবুও সে ওড়না পেঁচিয়ে বেরোলো। অয়নের মুখশ্রী দেখার লোভ সামলাতে পারলো না।
‘প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল’

৫৫.
দুপুর গড়াতেই পরিষ্কার আকাশে মেঘ জমেছে। কালো মেঘেদের দল ভেসেছে। তাদের নিয়ে নানান জাতীয় ঐক্য বানানো যেতেই পারে। হুটহাট মেঘ ডাকছে তীব্র শব্দে। ভাপসা গরম খানা এখনো উপলব্ধি করার মতো। রোদের তাপমাত্রায় জমিন এখনো ভ্যাপসা গরম। মৃদু বাতাস বইছে। মারজি বাইরে নজর রাখতে চাচ্ছে। তবে প্রকৃতি আর তার মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, জানালার কাঁচ৷ আগ বাড়িয়ে কথা বলবে কী লোকটার সাথে? নামাতে বলবে কী কাঁচটা? কাঠকাঠ অবস্থায় বসা মারজিকে পরখ করে নিয়েছে মাহিন। হুইলের হাতচারণ কমে এলো। ঘুরে তাকাল। আন্দাজ ধরে প্রশ্ন করল, ‘কোনো সমস্যা? ফিল ফ্রি টু টেল মি!’

মারজি ছোট্ট করে বলল, ‘কাঁচ নামানো যায়?’
‘এ.সি ওন করা তো।’
‘বন্ধ করে দিন।’
‘আর ইউ শিয়র?’

মারজি মাথা দোলাল। মাহিন এ.সি বন্ধ করে কাঁচ নামিয়ে দিল। মারজি প্রাণ খুলে শ্বাস নিল। সময় নিয়ে ফিরে তাকাল। মনে পড়লো তার কাছে টাকা নেই। মাত্র একশো আছে। রিক্সা ভাড়া। সম্পুর্ন দুহাজার টাকা ভেঙেছে আজ৷ রেস্তোরাঁয় গিয়েছিল। সাথে টুকটাক কেনাকাটা করলো। এখন? থতমত গলায় আওড়াল, ‘আমার কাছে কিন্তু টাকা নেই। লাঞ্চ কী আপনি করাবেন? আমি কিন্তু হাফ পার্সেন্ট ও দিতে পারবো না।’

মাহিন মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। দৃঢ় দৃষ্টিতে মারহিকে দেখছে। তার এই গাঢ় চাহনি মারজির হজম হলো না৷ অপ্রস্তুত বোধ করলো। এভাবে তাকানোর কী আছে? অন্যকেউ হলে চওড়া গলায় ধমকে পুরো গুষ্টি ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে ফেলত সে। কিন্তু সামনের এই সুদর্শন পুরুষকে যে তার পছন্দ হয়েছে। লম্বাচওড়া, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। একদম তার মনের মতো। বয়স’টাও মানানসই। তার তো সর্বদাই একটু বয়সী পুরুষের সখ ছিলো। ম্যাচিউরড অ্যান্ড কাম কালেক্টেড টাইপ। ইশ, এক দেখায় এতটা পছন্দ করে বসেছে যে, এখন মারজির একটু ভয় লাগছে। তাকে আবার রিজেক্ট করে দিবে নাকি? দিতেও পারে! তার চরিত্র তো ফুলের মতো পবিত্র। এই পবিত্র চরিত্র দেখে না আবার পালিয়ে যায় লোকটা! এইযে এতো করে একটু ঠিকঠাক সুচরিত্রবান হতে চাচ্ছে, পারছে কই? কথায় আছে স্বভাব যায় না ইহকালে। মারজি মুখশ্রী অন্ধকার করে রেখেছে আনমনে। ভাবনায় গভীর ভাবে বিভোর। মাহিন আনমনে হাসলো। দীর্ঘ হাসি। মারজিকে খুব করে দেখে নিয়ে বলল,’আজ নাহয় আমি দিলাম।’

মাথা দোলাল মারজি। পুনরায় বাইরে নজর রাখল। মারজির দৃষ্টির আড়াল হতেই মাহিন নিঃশব্দে হাসলো। ঝকঝকে সুন্দর দাঁত গুলো দৃশ্যমান। চোখের কোণ ডুবে গিয়েছে, ভাজে ভাজে৷ বিড়বিড়িয়ে আওড়াল, ‘ইন্ট্রেস্টিং’।
________
অয়ন বাড়ি ফিরছে না বেশ কিছুদিন ধরে। নিজের টাকায় ফ্ল্যাট কিনেছে। ঠিক তাদের অফিসের সামনে। আপাতত সেখানেই থাকে। লতা বেগম ছেলের জন্য কেঁদেকেটে অস্থির। খাওয়া দাওয়া একপ্রকার ছেড়ে দিয়েছেন। ঠিকমতো ঘুমোচ্ছেন না। সৈকত সাহেব হাজারো চেষ্টা করেও স্ত্রীকে সামলাতে পারছেন না। দুর্বল শরীর নিয়ে বিকেল দিকে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন লতা বেগম। বাড়িতে ডাক্তার ডাকা হলো। সেইমুহুর্তে সৈকত সাহেব ছেলেকে খবর দিলেন। অয়ন ফিরতে সময় নেয়নি। হন্তদন্ত ভঙ্গিতে ছুটে এসেছে। ঘেমে-নেয়ে একাকার সে মায়ের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ডাক্তার তখনো বসে পরিক্ষা করছেন লতা বেগমকে। কিছু ঔষধ পত্রের নাম লিখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাকে এগিয়ে দেবার জন্য সাথে গেলেন সৈকত সাহেব। অয়ন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। একমনে চেয়ে থাকলো মায়ের পানে। জন্মদাত্রী মায়ের এই অবস্থা মানতে পারলো না। দরজায় মাথা ঠেকিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে রাখল। কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলে তাকাল। সামনে তার বাবা দাঁড়িয়ে। মাথাটা বাবার কাঁধে এলিয়ে দিল। সৈকত সাহেব ছেলেকে আস্থা দিলেন, ‘ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না।’

অস্বাভাবিক করুণ গলা শোনালো অয়নের, ‘আমি খুব ভালোবাসি শাবিহাকে বাবা। আই কান্ট লিভ উইদাউট হার!’
‘আমি জানি তো।’
‘মা কেন বুঝতে চাচ্ছে না!’
‘বুঝবে। তুই ভেঙে পরিস না!’

লতা বেগমের চোখজোড়া নড়েচড়ে ওঠে। বন্ধ চোখের কোণ ঘেঁষে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কোনোমতে ঘুরে শুলেন। অস্পষ্ট ভাবে চোখ মেলে তাকালেন। দৃষ্টি নিবদ্ধ দেয়ালে। ভাবনায় মশগুল তিনি। ছেলের কথাগুলো কানে বেজে উঠছে। মস্তিষ্কে পৌঁছে দিচ্ছে।

অয়ন নিজ হাতে খাবার নিয়ে এসেছে। মায়ের পাশে বসেছে। প্লেট হাতে সে কিছুক্ষণ বসে রইলো। তারপর খুব ধীর স্বরে ডাকে, ‘মা!’

লতা বেগমের জবাব নেই। তবে চোখ মেলে তাকালেন তিনি। অয়ন হাত বাড়ায়, ‘উঠো। আমি খাইয়ে দেই।’

লতা বেগম উঠে বসলেন দুর্বল শরীর নিয়ে। চুপচাপ তাকিয়ে থাকলেন ছেলের পানে। অয়ন মুঠো ভাত এগিয়ে ধরতেই মুখ খুললেন। খেয়ে নিলেন চুপচাপ। সৈকত সাহেব হাসিমুখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকলেন। তিনি এখনো অফিস কোর্টে। হয়তো অফিস যাবেন। লতা বেগম তাকে উদ্দেশ্য করে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, ‘তৈরি হয়ে নাও। আমরা বেরোবো।’

সৈকত সাহেব ভুরু জোড়া কুঁচকে শুধালেন, ‘কই বেরোবা?’
‘শাহজাহান বাড়ি। শাবিহার হাত চাইতে। আমার ছেলের জন্য।’

অয়নের হাত থমকে গেল। ফট করে নজর তুললো। মায়ের নরম দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিললো। লতা বেগম মলিন মুখে হাসলেন, ‘আর দেরি নয়। আমরা আজই যাবো।’

অয়ন চমকে। পলকহীনভাবে তাকিয়ে। যেমন কথাগুলো এখনো সে হজম করতে পারিনি। সৈকত সাহেব শব্দ করে হাসলেন। কক্ষ জুড়ে তার হাসির বিচরণ বয়ে চলেছে। অয়ন চোখ বুঝল। স্তব্ধ খেয়ে বসে সে। হুট করে লতা বেগমকে জড়িয়ে নিল শক্ত করে। ‘ধন্যবাদ মা।’
_________
তন্ময় ঢাকার বাইরে যাবে। কাজের সূত্রে। দুদিনের জন্য। রাতে বেরোবে। নয়টার আগ দিয়ে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে পাঁচটায়। অফিস থেকে মাত্রই ফিরেছে। টুকটাক কাজ গুলো বাড়িতে করে নিবে। বসার কক্ষে এসেই, সোফায় শরীর ছেড়ে বস পড়লো। চারিপাশে তীক্ষ্ণ নজর বুলিয়ে নিল। সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে নামতে থাকা দীপ্ত বিষয়টি খেয়াল করেছে। ফুটবল হাতে সে বাইরে যাচ্ছে। বন্ধুদের সঙ্গে খেলবে। যাবার পূর্বে তন্ময়কে তথ্যসূত্র দিয়ে গেল,’অরু আপু ঘরে। শুয়ে আছে। শরীর ভালো না। লাঞ্চও করেনি।’

তন্ময়ের শান্ত চেহারা থমথমে হয়ে উঠলো মুহুর্তে। কপালের মধ্যস্থানে ভাজ পড়ল। উঠে দাঁড়ালো। জবেদা বেগম রান্নাঘরে ছিলেন। গ্লাস করে পানি নিয়ে এসেছেন ছেলের জন্য। তাকে পেতেই তন্ময় শুধালো, ‘অরু সারাদিন নাকি খায়নি! অসুস্থ?’
‘কত করে ডেকে আসলাম! মেয়েটা কথা বলছে কই? বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ কী হলো! তোর চাচ্চু ডাক্তার ইমরানকে আনবে আজ। মেয়েটাকে দেখাতে হবে!’
‘খাবার দাও। আমি যাচ্ছি।’
‘বাড়া আছে। দিচ্ছি দাঁড়া!’

অরু হাসফাস করছে। এতো অস্থির কেন লাগছে। বিছানায় রীতিমতো গড়াগড়ি খাচ্ছে। শান্তি পাচ্ছে না ঘুমিয়ে। তবুও মরার মতো চোখ বুজে। খিদে ও লেগেছে। তবে খেতে ইচ্ছে করছে না। দরজা খোলার কিঞ্চিৎ শব্দ শুনতে পেল অস্পষ্ট ভাবে। চোখ খুলে তাকাবে যে সেই শক্তিটুকুও পাচ্ছে না। আঁধারে তলিয়ে যাওয়া কক্ষে বাতি জ্বলে উঠলো। চোখে আলো লাগতেই অরু মৃদুস্বরে ‘উফ’ আওড়াল। চোখ মেলে তাকাল। তন্ময় দাঁড়িয়ে। হাতে প্লেট। গলায় এখনো টাই ঝুলানো। উষ্কখুষ্ক চুল। অরু চোখজোড়া পিটপিট করলো। তড়িতগতি উঠে বসলো। দেয়াল ঘড়িতে চোখ বোলালো। মাত্র পাঁচটা বিশ। এতো তাড়াতাড়ি তন্ময় চলে এলো? নিশ্চয়ই কারণ আছে! অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফেরার লোক তো তন্ময় নয়। তাই ঘটা করে প্রশ্ন করল ‘এতো তাড়াতাড়ি এলেন যে? আপনি কী বিজনেস ট্যুরে যাবেন?’

অরুর সন্দেহ সঠিক। তন্ময় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। বিজনেস ট্যুর নিয়ে অরুকে কিছু বলবে না ভেবেছিল! মেয়েটা শুনলেই মন খারাপ করবে! সঙ্গে যেতে চাইবে। বাহানা করতে বসবে! এতগুলো কারণ ধরে লোকাতে চেয়েছে। পারলো কই? তন্ময়ের জবাব না পেয়ে অরু পুনরায় জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাবেন? কতদিনের জন্য?’
‘বলছি। খেয়ে নে…’
‘শুনি আগে। বলেন!’
‘অরু!’

তন্ময়ের ধমকে দমে গেল অর। মিনমিনে গলায় বলল, ‘খাইয়ে দেন।’

তন্ময় ওয়াশরুমের দিক এগোল। অরু চোখমুখ অন্ধকার করে রেখেছে। এভাবেই সকাল থেকে খারাপ লাগছিল। এখন তার খারাপ লাগা আকাশ ছুঁয়েছে। তন্ময় কাছাকাছি থাকবে না ব্যাপারটা সে মানতেই পারে না। কষ্ট হয়। দম আটকে আসে৷ তন্ময় ততক্ষণে হাত ধুয়ে এসেছে। প্লেট হাতে অরুর পাশে বসেছে। লম্বা আঙুল গুলো ভাত নাড়ছে। মেখে পাঁচ আঙুলের মুঠোয় নিয়ে, অরুর মুখের সামনে ধরলো। অরু ঝটপট খেয়ে নিল। মুহুর্তেই পেট নড়েচড়ে ওঠে। বমি বমি ভাব! নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে শুধালো, ‘আপনি খেয়েছেন?’
‘না।’
‘আমি খাইয়ে দেই?’

তন্ময় মাথা তুলে তাকাল। অরুর ফোলা ফোলা ঘুমন্ত মুখশ্রী’তে নজর বোলালো। তবে মুখে কিছু বললো না৷ না হ্যাঁ কিছুই করলো না। কয়েক নালা খেয়ে অরু থমকে গেল। এবার প্রখর ভাবে পেট গুলিয়ে আসছে। আর খেতে ইচ্ছে করছে না। তন্ময় জোর করে আরও দু মুঠো খাওয়াতেই, বিপত্তি ঘটলো। তন্ময় অবস্থা বুঝে প্লেট সরিয়ে রাখল, ‘খারাপ লাগছে? আর খেতে হবে…’

তন্ময়ের কথা শেষ হতে পারেনি। অরু মুখ চেপে ছুটে গেল ওয়াশরুম। গদগদ করে একগাদা বমি করে বসলো। পেটে যা ছিলো সবই ফেলেছে। তন্ময় ইতোমধ্যে ছুটে এসেছে। অত্যন্ত চিন্তিত সে দিশেহারা। অরুর মাথা আগলে ধরেছে। চুল গুছিয়ে মাথায় পানি ঢেলে দিল। মুখ পরিষ্কার করে বিছানায় এনে বসালো। কপালে হাত ছোঁয়ালো, ‘কী হয়েছে? জ্বর তো নেই। তাহলে?’
‘ভীষণ খারাপ লাগছে।’

অরুর মাথাটা তন্ময়ের কোলে হেলে পড়ল। চোখ বুজে সে সেভাবেই রইলো। হাত বাড়িয়ে তন্ময়ের কোমর জড়িয়ে নিল। সেই চিরচেনা পারফিউমের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। অরু কয়েক দফায় শুঁকে নিল। নেশা ধরে যায় এই ঘ্রাণে। এই ঘ্রান তো একান্তই তার তন্ময় ভাইয়ার৷ অরু তার ছোট নাক ঘষে দিল তন্ময়ের কোমরে। বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘আপনার থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে। আমার খুব ভালো লাগে।’
‘শুয়ে পড়। দেখি…’

অরুকে বিছানায় শুইয়ে তার পাশে বসলো। চুলে আঙুল চালালো। অরু গভীর ভাবে তন্ময়ের বাম হাত দু’হাতের মুঠোয় নিয়েছে। সেভাবেই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেল। তন্ময় তবুও ঠাঁই বসে। চুপটি করে অনেকক্ষণ, একমনে চেয়ে থাকলো। অধর জোড়া এগিয়ে নিয়ে অরুর কপালের মধ্যস্থান ছুঁয়ে দিল। ধীর স্বরে আওড়াল, ‘এইযে মুগ্ধ নয়নে তোকে দেখতেই থাকি, তবুও তো দেখার সাধ মিটে না।’
_________
এখন রাত নয়টা। তন্ময় বেরিয়েছে সাতটায়। খুব ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং। নাহলে সে যেতো না। অরুকে এভাবে রেখে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। দ্রুত গিয়ে দ্রুত ফিরবে বলেই বেরোনো। জ্যামে আটকে সে পুনরায় কল করলো বাবাকে। মোস্তফা সাহেব ধরলেন গম্ভীরমুখে, ‘হ্যাঁ।’
‘হ্যালো বাবা?’
‘হু।’
‘আশরাফুল আঙ্কেল এসেছেন?’
‘না। আসবে এখনই।’
‘অরু ঘুম থেকে উঠেছে? বেশি খারাপ… ‘

মোস্তফা সাহেব ভোঁতা মুখে বললেন, ‘বাবা তুমি নিশ্চয়ই একা চিন্তিত নউ! আমরাও একইভাবে চিন্তিত। কাজ করতে গেছ, যাও। আমরা আছি অরুকে দেখার জন্য।’
‘সিরিয়াস কিছু হলে বলো।’
‘হু।’

জবেদা বেগম রান্না করছেন। অরুর পছন্দের তরকারি। চিংড়ির কোপ্তা। মেয়েটার মুখে সাধ নেই। তাই স্পেশাল কিছু রান্না করছেন। সুমিতা বেগম একটু পরপর উপরে যাচ্ছেন। মেয়েকে দেখে আসছেন। পায়েস, রসমালাই কতকিছুই নিয়ে গেলেন। কিচ্ছুটি মুখে তুলছে না। বমি করে বসছে। দীপ্ত ফিরেই অসুস্থ অরুর পাশে বসে। একেএকে বাড়ির সবাই অরুর কক্ষে চলে এলো। ডাক্তার আশরাফুলও ইতোমধ্যে চলে এসেছেন। আপাতত অরুর পাশে চেয়ার পেতে বসে হাতের নলি চেক করছেন। অরুর বন্ধ চোখ খুলে দেখে নিলেন। সময় নিয়ে বেশ কয়েকবার একইভাবে চেক করছেন। ভুরু জোড়া কুঁচকে এসেছে। লাগাতার আরও কয়েকবার একই পদ্ধতিতে কিছু চেক-আপ করে নিলেন। মোস্তফা সাহেব চিন্তায় পড়লেন। এগিয়ে এসে শুধালেন, ‘কী হয়েছে আশরাফুল? সিরিয়াস কিছু নাকি?’

আশরাফুল সাহেব হাত উঁচিয়ে থামতে বললেন। সময় নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পরিক্ষা নিরিক্ষা করে, ফিরে তাকালেন। চোখমুখ উজ্জ্বল। মুচকি হাসি ঠোঁট জুড়ে লেপ্টে। মোস্তফা সাহেব ভড়কে গেলেন, ‘কী হয়েছে?’
”আমার কাছে আয়।’

মোস্তফা সাহেব সামনাসামনি আসতেই, শব্দ করে হেসে আশরাফুল সাহেব মোস্তফা সাহেবের কাঁধে হাত রাখলেন। পাশাপাশি হেঁটে কক্ষ থেকে বেরোচ্ছেন। পেছন পেছন বাকিরাও আসছে। ঘুমন্ত অরুকে সকলে রেখে আসলো। অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় আশরাফুল সাহেব বললেন, ‘বন্ধু বাড়িতে মিষ্টি আছে তো?’
‘মানে! মিষ্টি….’
‘না থাকলে আনা। মিষ্টি মুখ ছাড়া কিন্তু আমি যাচ্ছি না।’
‘অ্যাহ?’
‘বন্ধু! দাদা হতে যাচ্ছিস খুব শীগ্রই।’

নিস্তব্ধতা, নিরবতা বয়ে গেল। থমকে গেল চারিপাশ। রুখে গেল শ্বাসপ্রশ্বাস। চমকের চিহ্ন সকলের মুখশ্রীতে লেপ্টে। আনোয়ার সাহেব দু’কদম পেছনে চলে গেলেন। অবাকের চুড়ান্তে তিনি। কাঁধ রীতিমতো কেঁপে উঠেছে৷ সুমিতা বেগম কাপড় দিয়ে মুখ চেপে ধরেছেন। চোখজোড়া বড়বড়। শাবিহা চিৎকার করে বসেছে। মোস্তফা সাহেব তখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে। তার পা জোড়া থমকে যেমন। কিছুক্ষণের জন্য শ্বাস নিতেও ভুলে গেলেন।

চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here