প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব –৫২+৫৩

‘প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল’

৫২.
অয়ন লম্বা শ্বাস ফেলছে। মুখশ্রী বেশ করুণ। রুদ্ধশ্বাস নিয়ে একটু নরম গলায় বলল, ‘তোমার কী মায়া নেই? আমি কি এভাবে গাড়ি চালিয়ে চালিয়ে ঘুরেফিরে বেড়াবো? জানো, কতটা ঘুম পেয়েছে আমার? এভাবে ঘুমানো যায় না। শরীর ব্যথা করছে!’

শাবিহা চোরাচাহনি নিক্ষেপ করলো। প্রচন্ড মায়া হলো।তবে তার গলাটাও শুকিয়ে আছে। অনুভূতি ঝেঁকে বসেছে। বুকটা ধড়ফড় করছে৷ অয়নকে সে কীভাবে বলবে, ভয়টা সে নিজেকে নিয়ে পাচ্ছে! নিজের উপর তার ভরসা নেই। খুব ভেবেচিন্তে ছোট গলায় বলল, ‘আচ্ছা ঠিকাছে।’

অয়ন যেমন উগ্র সমুদ্রে জাহাজ পেয়ে বসেছে। উড়োজাহাজের গতিতে ছুটলো। বাছাই করা হোটেল রিসার্ভ করে রেখেছিল। সোজাসাপটা গিয়ে পৌছালো। শাবিহা বিরক্ত হলো বটে! ছেলেটা প্রচন্ড খারাপ। খারাপের ঘরে খারাপ। এতক্ষণ যাবত, মুখটাকে প্যাঁচার ন্যায় করে রেখেছিল।

খুব গোছালো দীর্ঘ কামরা। বড়ো বিছানা। শাবিহা ইনিয়েবিনিয়ে বলল, ‘আরেকটা রুম নেওয়া যাবেনা?’

অয়ন শুনেও যেমন শুনল না। টি-শার্ট খুলে বিছানায় ছুড়ে মারল। প্রশস্ত দীর্ঘ পিঠ শাবিহার চোখের সামনে। বুকটা ধক করে উঠলো। দৃষ্টি নড়েচড়ে গেল। শ্বাসপ্রশ্বাস অশান্ত। এদিকসেদিক নজর ঘোরাতে চাইল। পারলো না। বেহায়া চোখজোড়া ফুলো বাহু দেখতে ব্যস্ত। ওয়ার্ক-আউট করা শরীর। দেখতেই আকর্ষণীয়। নজর ফেরানো দায়। অয়ন বেহায়ার ন্যায় ঘুরে দাঁড়ালো। শাবিহা গোপনে হাসফাস করে বারান্দার ছুতোয় চলে গেল। অয়ন আনমনে হাসলো। ওয়াশরুম গেল। শাবিহাকে সে মোটেও বিরক্ত করবে না। কোনো স্পর্শ করবে না। সে শাবিহাকে বাধ্য করবে, যেচে এসে তার স্পর্শ নিতে। তার স্পর্শের আকাঙ্খা গড়তে!
—–
‘পিল নিয়েছিস?’
‘হু!’
‘কই দেখি বড়ো হা কর।’
‘কীসের পিল ছিলো বলেন আগে!’

তন্ময় মহা বিরক্ত হলো। দু আঙুল দিয়ে অরুর ঠোঁট চেপে ধরলো। চোখ রাঙিয়ে ইশারায় বোঝালো, মুখ খুলতে। অরু তবুও খুলছে না। নাছোড়বান্দা! তন্ময় টেবিলের দিক এগোল। আরেকটি নিবে ঔষধ এমন হাবভাব! সেটা দেখে অরু ঘাবড়ে গেল। ছটফট করে মুখ খুলে তন্ময়ের সামনে দাঁড়ালো, ‘এইযে দেখেন! আমি খেয়েছি। সত্যি। দেখেন…’

তন্ময় সেই ছোট্ট মুখের দিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। গোলাপি ঠোঁট জোড়া দুপাশে ছড়িয়ে। ফুলোফুলো গাল জোড়া, খুব আকর্ষণ কাড়ছে। তন্ময়কে ডাকছে যেমন। সে মুখ বাড়ালো। শক্ত করে কামড় বসালো তুলতুলে নরম গালে। হঠাৎ আক্রমণে অরু তাজ্জব, কিংকর্তব্যবিমুঢ় এবং ব্যথিত! এমনটা তার তন্ময় ভাই করেছে বিশ্বাস করতে পারলো না। বড়ো বড়ো গোল চোখে দেখতে থাকলো। তন্ময় হাসলো নির্বিকার ভঙ্গিতে। হেসে গাল টেনে ধরলো, ‘ট্রাস্ট করবো?’
‘হু। আমিতো আমাদের ভালো চাই।’
‘আমাদের?’

অরু খানিক লজ্জাও পেলো! একটু কষ্ট ও পেলো। কিন্তু সে তো ভালোই চায়। তাই না? ভালোর জন্য একটু মিথ্যে বললে কিছু হয়না।
______
মাহিন অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে সোফায় বসে। মুখশ্রী বড্ড নাজুক। বেচারা প্রচন্ড ক্ষেপে আছে, প্রকৃতির উপর। এসব রোমান্টিক ওয়েদার কী তার জন্য নাকি! যদি তার জন্য না হয়, তাহলে দরকার নেই এইরকম ওয়েদারের। সে ঘুরতে এসেছে, ঘুরবে। রোমান্টিক বৃষ্টি দেখে, যাকে তাকে নিয়ে ভাবতে বসবে না,’বাল! বৃষ্টিও তন্ময়ের সাইডে মনে হয়। হানিমুন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার সব, ওয়েস দিয়ে দিচ্ছে শালারে! আর আমরা যে ট্যুর দিব ভেবে আসলাম, সেটার কী হবে? বেরোতেই পারছি না। সকাল থেকে বৃষ্টি! দেখতে দেখতে বিকেল! সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবে ভাই! ঘুরাফেরা কী আদৌও হবে?’

তন্ময় ভ্রুক্ষেপহীন। চুপচাপ বন্ধুদের মধ্যে বসে। মাহিনের থমথমে চেহারার চটচটে মেজাজের বকবক নির্বিকার ভঙ্গিতে শুনছে। ইব্রাহিম শব্দ করে হাসলো। সেলফোন পকেটে ঢোকাল। সাজেশন দিল, ‘রেইনকোট পরে নেই চল। তারপর বাইক নিয়ে বেরোই! ব্যাপারটা জোস হবে।’
‘হ্যাঁ! তারপর ব্যাচেলর আমি কোনো চিপায় পড়ে মরেটরে যাই। রাস্তাঘাট উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমাকেও ভাসিয়ে দিবে শালা!’
‘তুই কোনো ব্যাটা না!’
‘হ আমি তোর ব্যাটি। দে বাবা বিয়ে দে! পকপক করে মাথা খা.. কাজের কাজ ত…’

মাথা গরম মাহিনকে থামাতে শুহানি নরম সুরে বলল,’আচ্ছা হোম গেমস খেলি? আরেকটা নাইট ইভেন্ট? হাও এবাউট ট্রুথ অ্যান্ড ডেয়ার? বাগানে ত ব্যবস্থা করাই। আমরা শুধু খাবার টাবার স্যাট করবো। গানটান বাজাব, খাব, এঞ্জয় করবো। কেমন হবে?’

মাহিন তার বিরক্ত মুখ খুলবে ভাব, পূর্বে শুহানি ওয়ার্নিং দিয়ে দিল, ‘খবরদার আমাকে তেঁতো কথা শোনাতে আসবি না। মনে রাখবি আমি মেয়ে।’
‘কলিজা কেটে দিয়ে দেই? তুই ভুনাখিচুড়ি করে, সবাইকে বিলিয়ে দে! বালসাল!’

মাথা গরম মাহিনের তেঁতো কথা কমবেশি গ্রুপের সবাই গিলেছে। গিলে কেউই আর আগ বাড়িয়ে সাজেশন দিতে গেল না। তন্ময় দু’পাশে মাথা নাড়াল। তপ্ত শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। কেয়ার টেকার চাচাকে বলল, ‘দুটো ছাঁতা হবে? থাকলে দিন চাচা!’

কেয়ার টেকার চাচা ‘জি’ বলে ছুটে গেল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে নিয়ে আসল। এগিয়ে দিল। তন্ময় একটা ছাঁতা নিয়ে আরেকটা মাহিনের দিক ছুড়ে মারল, ‘নে। আয় বাইরে।’

ছ্যাত করে উঠে দাঁড়ালো মাহিন। ছাঁতা হাতে ধেইধেই করে তন্ময়ের পিছু গেল। বিরক্তিতে রীতিমতো তার চাপা কাঁপছে। কাকে ঝাড়া যায়? তন্ময়কে তো একদম নয়। এই ছেলে দেখতে শান্ত। কিন্তু মুখ চললে অশান্ত। খবর করে দিবে তার।
একপ্রকার বাধ্য ছেলের ন্যায় বেরোলো। তন্ময় ছাতা মাথায় যাচ্ছে বাগানের দিক। মাহিন পিছু চলল। উদাসীন পায়ের গতি। দুজন বাগানের নিরিবিলি জায়গায় আসতেই থামলো। দৃষ্টি দুজনের এদিকসেদিক। নিরবতা ভাঙলো মাহিন, ‘আমারে দেখ! কতো মেয়ে পেছনে ঘুরেছে, ঘুরছে কাউন্ট করে শেষ করতে পারবি দোস্ত? পারবি না। অথচ, আধবয়সী ছোট ইঁদুর একটা মেয়ে, আমাকে বুড়ো আঙুল দেখায়। আমি.. আমি মাহিনের কল রিসিভ করে না। কত্তবড় সাহস! এসব একটুখানি মেয়ে আমার দাম বুঝবে কীভাবে! কদর করবে কীভাবে! জানেই না আমি কে! শালার কতো মেয়ে পিছু ঘোরালাম, ডেট করলাম, ছুড়ে মারলাম হিসেব নেই। আর এখন এই বয়সে এসে, কীসব দেখতে হচ্ছে!’

গলা পরিষ্কার করে আঁড়চোখে তন্ময়ের দিক তাকাল, ‘ওই মেয়েটা! মানে মারজি.. ওর ছবি আছে?’

তন্ময় মাথা ঘোরালো। নিবিড়ভাবে মাহিনকে পর্যবেক্ষণ করছে। মাহিন নড়েচড়ে ওঠে, ‘এভাবে তাকাস কেন!’
‘তোকে সুবিধার লাগছে না।’
‘লাগবে কীভাবে! থাকলে দেখা…’

তন্ময় পকেটে হাত দিল। সেলফোন বের করবো। হুট করে মাথা উঁচু করলো। অযথাই চোখ গেল উপরে। দোতলার পশ্চিম দিকের বারান্দায় তার বোকাসোকা অরু দাঁড়িয়ে। বৃষ্টির মধ্যে। এভাবে থাকলে ধীরেধীরে ভিজে যাবে ত! ঠান্ডা লাগবে। তারপর সারাদিন নাক ধরে বসে থাকবে! তন্ময় পা বাড়ালো ঘরের দিক। যাবার আগে বলে গেল, ‘পাঠিয়ে দিচ্ছি হোয়াটসঅ্যাপে!’

মেঘ ডাকছে গুড়ুম গুড়ুম শব্দে। প্রকৃতি বড্ড ঠান্ডা, শান্ত। বাহিরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তাঘাট স্যাতলা! গাছগাছালী নরম এবং ভেজা। আবহাওয়া জানান দিচ্ছে, এই ঝুম বৃষ্টি নামবে বলে! হুট করে বৃষ্টি নামলে অরু ভিজে যেতে পারে। সে তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আসমানের নিচে। সটান মেরে। নড়চড় নেই। একমনে, চিন্তিত মুখে আকাশকুসুম ভাবনায় মশগুল। এতসব ভাবতে গিয়ে ভুলে বসেছে জগৎ। তার তন্ময় ভাইয়া ভীষণ দায়িত্বশীল এবং ধৈর্যবান ব্যক্তি। উপর দিয়ে একটু গম্ভীর আর থমথমে চেহারার অধিকারী। তবে ভেতরে নরম তুলতুলে। খুব কাছ থেকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই, এই লোক বাচ্চাকাচ্চা কতটা পছন্দ করে।
ছোটবেলা থেকে তন্ময়কে দেখে এসেছে। খুবকরে চেনে তন্ময়কে। এইযে, দীপ্তকে তন্ময় পেলেছে বললে মোটেও ভুল হবেনা। ছোট থেকেই দীপ্ত তন্ময় বলতেই অজ্ঞান! রাতবিরেত মায়ের বুকের দুধ ফেলে, তন্ময়ের সঙ্গে ঘুমিয়েছে। দিন নেই সকাল নেই, তন্ময়কে তার মর্জি মোতাবেক ঘুরতে বেরোতে হয়েছে। এমনকি কোলে করে অফিস গিয়েছে। পাশে রেখে মিটিং সেরেছে। ছোট বোন শাবিহাকেও কম আদরে পালেনি সে! যা চেয়েছে দিয়েছে, দিচ্ছে! না নেই। এসব বিচিত্র চিত্র গুলো সকাল থেকে হানা দিচ্ছে অরুর মস্তিষ্কে। তার তন্ময় ভাইয়া একজন সুপুরুষ। ভালো ছেলে, ভালো ভাই তেমনি একজন ভালো হাসবেন্ড। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই একজন বেস্ট বাবাও হবে? অরু খুব করে চায় তন্ময় বাবা হোক। আর সে মা। তাদের দুজনের অংশ আসুক। হ্যাঁ, তাদের বিয়ের বয়স কম। সে খুব ছোটো। তার সম্পুর্ন ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। তাতে কী! তন্ময়ের তো বাবা হবার বয়স হয়েছে। তাতেই হবে।
সকাল থেকে গিল্টি ফিল করা অরু আকাশকুসুম ভেবে, মনকে শান্ত করলো। অতি ভেবেচিন্তে সে আর পিলের বিষয়টি তন্ময়কে বলবে না ভাবলো। তাকে কে’টেকুটে নদীতে ভাসিয়ে দিলেও বলবে না! যখন তন্ময় জানবে তখন নিশ্চয়ই একটা চড় মারবে তাকে! মারুক! অরু সহ্য করে নিবে। সবকিছু মুখ বুঝে মেনে নিবে।

‘এই ছোট্ট মাথায় কি খিচুড়ি পাকাচ্ছিস!’

অরু চমকে উঠলো। ভীষণ ভড়কে গিয়েছে। রীতিমতো কেঁপে উঠেছে! কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত পোহায়। অরুর বেলায় বুঝি তাই! তড়িৎ গতিতে পেছনে তাকাল। তন্ময় দাঁড়িয়ে। একদম কাছে…তার পিঠ ঘেঁষে। চেহারায় চিন্তার ভাঁজ। সে খুব গুঁছিয়ে অরুকে দেখে নিচ্ছে। এই মেয়েটাকে সে রন্ধ্রে রন্ধ্রে চিনে। মুখমন্ডল, আচার-আচরণ, হাবভাব দেখেই বুঝতে পারে, কিছু একটা তো চলছে! অরু বত্রিশ দাঁত দেখিয়ে বোকার মতো হাসলো। অন্ধকারী বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির সামনে, এই সাধারণ পোশাকে লম্বা চুল ছেড়ে রাখা বোকা অরুকে, এক রাজ্যের মায়াবতী লাগছে। আদুরে লাগছে। তন্ময়ের ছোট্ট সন্দেহ বহু দূরে পালালো। মস্তিষ্ক শীতল পড়ে গেল। থেকে গেল বুকের বা’পাশের চিনচিন ব্যথা। দু’পা এগোল। অরু তখনো নিজেকে বাঁচাতে বেশ তোরজোড় করছে, ‘কিছু ভাবছি না। আমিতো মেঘলা আকাশ দেখছিলাম। বলুন আমি কী মিথ্যে বলি! আমার মতো সত্যবাদী কি কেউ….’

পিঠে এবং হাঁটুর নিচে হাত চেপে অরুকে পাজাকোলে তুলে নিল তন্ময়। ঘটনাটি বেশ দ্রুত ঘটেছে। ভীতু অরু কুকড়ে গিয়েছে। চোখমুখ খিঁচিয়ে মৃদু আর্তনাদ করেছে। আষ্ঠেপৃষ্ঠে জাপ্টে ধরেছে তন্ময়ের গলা। আসমান তখনও কাঁদতে ব্যস্ত। জল ভীড় জমিয়েছে তন্ময়ের ঘাড়ে। টি-শার্ট জুড়ে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির ছাপ। অরুর উদাসীন চেহারার রঙ বদলাতে শুরু করেছে। লাল বর্ণের আভা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বাঙ্গে। মাথা নত, দৃষ্টি লাজুক। এদিকসেদিক তাকাচ্ছে। চোখ তুলে তন্ময়ের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাতে পারছে না৷ মস্তিষ্কে ঘুরেফিরে চলে এলো রাতের দৃশ্য। আরেকদফ লজ্জার সম্মুখীন। ছোট করে ‘নামিয়ে দিন’ বলতেও দ্বিধাবোধ করছে। তন্ময় ভেতরে হাঁটা ধরেছে।
ঘর এখন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এইতো সকালে কেয়ার টেকার চাচা কাজের লোক দ্বারা পরিষ্কার করিয়েছেন।

বিছানায় বসে অরু হাসফাস করছে। ঘরবন্দী ভালো লাগছেনা। বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে। আঁড়চোখে তন্ময়কে দেখে নিল। এলোমেলো চুপসে যাওয়া গলায় আবদার ধরলো, ‘বাইরে যাবো না?’

তন্ময় ঘুরে তাকাল, ‘বৃষ্টি হচ্ছে!’
‘সুন্দর আবহাওয়া তো।’

তন্ময় কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,
‘রেডি হয়ে নে।’

অরু হাসলো। ল্যাগেজ থেকে জামাকাপড় নিয়ে ছুটে গেল ওয়াশরুমের দিক। সে আর তার তন্ময় ভাই বেরোবে। লং-টার্ম ড্রাইভিংয়ে। হে হে….তারা ত হানিমুনে আছে।
_______
বৃষ্টি যেমন শপথ নিয়ে নেমেছিল। তিনদিন পইপই করে ঝরতে থাকলো। মেঘলা আকাশ রয়ে গেল সর্বক্ষণ। আজ তাদের যাওয়ার পালা। ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। এইতো আর মাত্র দু’ঘন্টা। প্রায় চলে এসেছে। অরু গভীর রাতের উষ্ণতা মাখিয়ে নদীর পানির স্রোতের পানে চেয়ে। খুব উপভোগ করেছে এই তিনদিন। এমন কিছু ঘটেছে যা আর কখনো ঘটেনি। তার আর তন্ময়ের একান্ত ব্যক্তিগত সময় গুলো, এতটাই প্রাইসল্যাস ছিলো যে অরু ভাবতে বসলেই, এক রুপকার রাজ্যে হারিয়ে যায়। অনুভূতির সাগরে ভেসে বেড়ায়। খুব অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। বাড়িতে গেলে তো আর এমন হবেনা। একসাথে থাকা হবে না। একসাথে ঘুমোনো হবে না। এইযে এই তিনদিন অরু তন্ময়কে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমিয়েছে। তন্ময়ের বুকে মাথা রেখেছে ঘন্টার পর ঘন্টা। তন্মুয়ের শরীরের সুগন্ধি শুকতে শুকতে শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলেছে। এগুলোতো আর করতে পারবেনা। অরুর ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে! বুকে যন্ত্রণা অনুভব করছে!
‘কী হয়েছে?’

তন্ময়ের গম্ভীর গলা। সে মাত্রই এলো। এতক্ষণ বন্ধুদের সঙ্গে বাহিরে ছিলো। প্রচন্ড গরম। শরীরের ঘর্মাক্ত শার্ট খুলে ফেলল মুহুর্তে। ল্যাগেজ হতে টিশার্ট নিতে নিয়ে অরুর মুখশ্রী দেখতে পেল। মেয়েটা কেঁদেছে নাকি? তন্ময় চিন্তিত ভাবে এগিয়ে গেল। থুতনি চেপে মুখ তুলে ধরলো চোখের সামনে। তুলতুলে নরম মুখ। লালচে নাক। ভেজা চোখ। বেশ আবেদনময়ী বৈচিত্র্য, ‘প্রশ্ন করলাম তো!’
‘কিছু না।’

তন্ময় যেমন সব বুঝতে পারে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে অরুকে বুকে মিশিয়ে নিল। তার উদোম প্রশস্ত বুকে গিয়ে ঠেকেছে অরুর ভেজা গাল। গরম উষ্ণ আভাস। শরীর শিউরে উঠলো অরুর। তীব্র ব্যাগে ছুটছে রক্ত চলাচল। ঘনঘন তপ্ত শ্বাস ফেলছে। হৃদয় খানাও বাজতে ব্যস্ত। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভালো লাগা ছেয়ে বসেছে। নিবিড়ভাবে চোখজোড়া বন্ধ করে রাখল। মনোযোগী হলো তন্ময়ের বুকের গতিপথ মাপায়। জীবন থমকে যাক এখানেই, এভাবেই, এসময়!

লঞ্চ থেমেছে। শাব্বির শেখ সাহেব দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে। পেছনে দু’হাত গম্ভীরমুখে পেঁচিয়ে রেখেছেন। তন্ময় অরুকে নিয়ে ল্যাগেজ হাতে এগিয়ে গেল। সালাম জানাল। কুশল বিনিময় করে নিল। ঘড়ির কাঁটা তিনটা বিশে। তন্ময় অয়নকে কল করলো। ছেলেটার সঙ্গে তার রাত দশটায় একবার কথা হয়েছে। বলেছে সদরঘাট সময় মতো চলে আসবে। এসেছে কিনা! মাহিনকে বিদায় দিয়ে, সামনে এগোল। বেরোতেই একগাদা সিএনজির মধ্যে সাদা গাড়ি দাঁড়ানো দেখতে পেল। শাবিহা ছুটে আসছে। হাস্যজ্বল, ভরাট মুখশ্রী। তিনদিনে মেয়েটার সবকিছু কেমন উজ্জ্বল হয়ে গিয়েছে। প্রাণ ফিরে পেয়েছে যেমন! অরু সেই যে হাত ধরেছে শাবিহার, ছাড়ার নাম নেই। গাড়িতে উঠেও সে শাবিহার সাথে লেপ্টে বসে থাকলো। অয়ন দিব্বি তাদের ঘোরাফেরার বর্ননা করছে। অরু মনোযোগ সহ শুনছে। হুটহাট প্রশ্ন করছে। কাহিনি শোনার আগ্রহ প্রকাশ করছে। সে প্রেম বিষয়ক টপিকে ভীষণ চঞ্চল!
_____
মোস্তফা সাহেব আর আনোয়ার সাহেব সোফায় বসে। দুজন এই রাতবিরেত চা খাচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ঢুলতে ঢুলতে মুফতি বেগম এলেন। হাতে ট্রে! সেখানে আরও দু’কাপ চা। সেই বারোটা থেকে চা বানিয়ে চলেছেন। না ঘুমিয়ে দু ভাই, চায়ের পর চা পান করছেন, ঘুম তাড়াবার জন্য! কেন ভাই! বাড়ির ছেলেমেয়ে ফিরবে, ফিরে তো ঘুমোবে। সকালে দেখা করা যাবে না? আশ্চর্য! বিরক্ত মুফতি বেগম একা নন। জবেদা বেগম ও চরম বিরক্ত। তিনি একটু আগে গটগট পায়ে ঘুমোতে গিয়েছেন৷ পরপর আবার ফিরে এলেন। আসলে তিনি নিজেও ছেলেমেয়ের চিন্তায়। তিনটা দিন ধরে ঘরবাড়ি ফাঁকা হয়ে আছে। নিস্তব্ধ, নির্জন। এতো খারাপ লেগেছে বলে বোঝানো যাবেনা। আর কিছুক্ষ মাত্র। সব আগের মতো হবে। ঘরবাড়ি উজ্জ্বল হয়ে পড়বে। এইতো অরু এসেই নাক টেনে বলবে, ‘বাবা! চাচ্চু! তোমাদের কী আমার উপর মায়া নেই? এইযে আমি তিন ধরে বাহিরে। কই আমার তো খবর নিলে না!’ বলতে বলতে হয়তো কেঁদেও দিতে পারে….

_________
চলবে~
‘নাবিলা ইষ্ক’‘প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল’

৫৩.
শাবিহা বেশ চুপচাপ। একটি টু-শব্দ করছে না। দৃঢ় দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে। একমনে, নিশ্চুপ হয়ে। পাশে অরু ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথা খানা এখনো হেলেদুলে, চলেছে তার। বেকায়দায় পড়লে মাথায় আঘাত পেয়ে বসবে নিশ্চিত। তন্ময় উপরের আয়না দ্বারা দৃশ্যটি বেশ কিছুক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছে। রাস্তায় মনোযোগ দিতে পারছে না। একপ্রকার অস্বস্তি অনুভব করছে। এবার সে গলা উঁচিয়ে শাবিহাকে ডাকল। শাবিহা নিরুত্তেজ! ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে অন্য বিষয়ে হয়তো। বাধ্য হয়ে অয়ন হাত বাড়িয়ে ছুয়ে দিল, ‘এইযে।’

হুড়মুড়িয়ে তাকাল শাবিহা। দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ হতেই, গাঢ় করে চোখ রাঙাল। মুখশ্রী খিঁচিয়ে ফেলেছে। সমানে দৃষ্টি দ্বারা আগুন ছুড়ে চলেছে যেন। অয়ন বুঝেও বুঝলোনা! হেসেখেলে শুধালো, ‘ওমা, এমন করে তাকাচ্ছ কেন! ভাইয়া ডাকছে শুনছ না! অরু ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথাটা কোলে নাও। ঘাড়ে ব্যথা পাবে।’

শাবিহা পাশে তাকাল। অরুর মাথাটা তখনো দুলছে। এবার পড়ে যাবে প্রায়! সঙ্গে সঙ্গে অরুর মাথাটা ধরে ধীরেসুস্থে কোলে রাখল শাবিহা। সামনের চুলগুলো গুঁছিয়ে দিতে নিয়ে পুনরায় আড়চোখে তাকাল অয়নের দিক। পুনরায় দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলে গেল। ডান চোখ আলগোছে বুজে অয়ন দুষ্টু হাসলো। কত্তবড় সাহস আবার চোখ মারে! শাবিহা দ্রুত নজর ফেরালো। জানালার বাইরে দৃষ্টি রাখল। শক্ত করে নয়ন জোড়া বুজে নিল। বেগতিক গতিতে ছুটছে ভেতরের গরম তরল রক্ত। বেসামাল হয়ে পড়েছে হৃদয়। ছটফট করছে। ধুকপুক করছে। বন্ধ দু চোখের পাতায় ভেসে উঠল, গতকাল রাতের দৃশ্য। শিউরে উঠলো মুহুর্তে। শুকনো ঢোক গিলল। এখনো উপলব্ধি করতে পারছে, তখনকার শক্ত মজবুত হাত জোড়ার স্পর্শ। গরম নরম ঠোঁটের ছোঁয়া। ক্রমাগত শ্বাসপ্রশ্বাস অশান্ত হয়ে উঠছে। মাথাটা পেছনে এলিয়ে দিল শাবিহা। এই কী করে বসলো….

ভোর চারটা। গাড়ি থেমেছে শাহজাহান বাড়ির সামনে। তন্ময় আগে বেরোলো। অয়ন ও বেরিয়েছে। বেরিয়ে সে পেছনের বিপরীত পাশের দরজায় পিঠ হেলিয়ে
দাঁড়িয়েছে। মুলত শাবিহাকে বেরোতে দিবে না। যেমন এইযে শাবিহা দরজা খুলতে চাচ্ছে, পারছে না।
তন্ময় ইতোমধ্যে দরজা খুলে অরুকে কোলে তুলে নিয়েছে। ঘুম থেকে ডেকে তোলার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন বোধ করেনি। শান্ত সুরে যাবার পূর্বে শাবিহার উদ্দেশ্যে বলে গেল, ‘তাড়াতাড়ি আয়।’

শাবিহা কীভাবে আসবে? তাকে তো বেরোতেই দিচ্ছে না। বিরক্ত হয়ে ওপর পাশ দিয়ে বেরোবে এমতাবস্থায়, অয়ন ভেতরে এসে ঢুকে বসেছে। দরজা লক করে দিয়েছে। শাবিহা রাগান্বিত হবার প্রচেষ্টায়। কড়াকড়ি চোখে তাকাল, ‘কী সমস্যা?’

অয়ন নির্বিকার ভঙ্গিতে নিবিড়ভাবে শাবিহাকে দেখছে। মেয়েরা লাজুক হলে তাদের সৌন্দর্য হাজারগুন বেড়ে যায় নাকি? বাল্বের সামান্য আলোয় শাবিহার মুখ খানা বড্ড লাল। নাকের ডগায় কেউ হয়তো, লাল রঙ ছুঁয়ে দিয়েছে। ভেজা ঠোঁট জোড়ায় চোখ যেতেই বুকের আকুতি বেড়ে গেল। এই ঠোঁটের স্বাদ কতটাই না গভীর ভাবে নিয়েছে সে রাতে। শাবিহার দুপাশে হাত ছড়িয়ে রাখল। বন্দী করে রেখেছে বুকের পিঞ্জিরায়। ঘামতে শুরু করেছে শাবিহা। মস্তিষ্কে হানা দিতে শুরু করেছে , সেই অঘটনের দৃশ্য গুল। মুখা বাড়ালো অয়ন। শাবিহার ঠোঁটের সামনে ঠোঁট এনে রেখেছে। ছুঁইছুঁই। আরেকটু বাড়ালেই স্পর্শ। ধীর স্বরে আওড়াল, ‘রেগে আছ কেন! তুমি স্বেচ্ছায় এসেছিলে আমার কাছে।আমিতো যাইনি। তাহলে… হু?’

শাবিহা দরজা খুলতে চাইল। এই বাঁধন হতে মুক্ত হওয়ার আপ্রান চেষ্টা তার। অয়ন দু’হাতের বাঁধন দৃঢ় করল। দূরত্ব সম্পুর্ন ঘুচিয়ে দিল। শাবিহার নরম ঘাড়ে মুখটা নিয়ে রেখেছে। ঘনঘন শ্বাস ফেলছে, ‘একটু চুমু খেয়েছি। আর ছুঁয়েছি মাত্র। এতেই এমন অবস্থা তোমার! এ-র বেশি করলে কী করবে? অজ্ঞান হয়ে পড়বে? আমি কিন্তু তখনো ছাড়বো না। বিয়েটা শুধু হতে দাও। আমাকে যতটা জ্বালিয়েছ, এরথেকে ত্রীপল জ্বালাব তোমায়।’

পরপর শক্ত করে কামড় বসালো শাবিহার তুলতুলে নরম ঘাড়ে। শাবিহার সীৎকার অগ্রাহ্য করে, কামড়ের স্থানে শব্দ করে চুমুও খেল। ব্যস্ত হাতে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। শাবিহা তখন ব্যথিত স্থান চেপে রেখেছে।আতঙ্কিত পাখির মতো ছটফট করছে। ছেলেটা এতো ফালতু। উফ!
______
বাড়ি আবছা অন্ধকার। বাতি সবগুলো ওফ, ড্রয়িংরুমের’টা ব্যতীত। তন্ময় অরুকে নিয়ে উপরে চলে এলো। নিজের ঘর ডিঙিয়ে অরুর ঘরে প্রবেশ করলো। আলতো হাতে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে। পাশে বসে হাত বাড়িয়ে জুতো জোড়া খুলে রেখেছে। কাঁথা টেনে শরীরে মেলে দিল। অরু আড়মোড়া ঘুরেফিরে তন্ময়ের দিক কাঁত হয়েছে। আবছা চোখ মেলে তাকায়। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন স্বরে ডাকে, ‘তন্ময় ভাইয়া!’
‘হু।’
‘ঘুমাবেন না? আসুন!’

খালি জায়গাটুকু অরু হাতড়ে দেখিয়ে দিল। তন্ময় অশান্ত মনকে শান্ত করছে যেমন! মিইয়ে যাওয়া অস্পষ্ট কন্ঠে বলল, ‘পড়ে ঘুমোচ্ছি। তুই ঘুমো।’

অরুর কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়লো। তন্ময়ের উত্তর তার মোটেও পছন্দ হলোনা যেন! হাত বাড়িয়ে তন্ময়ের শক্ত হাত আঁকড়ে ধরলো। বিরক্ত ভঙ্গিতে চাপাস্বরে কিছু একটা আওড়াল। ঘুমের ঘোরে হয়তো। তন্ময় মুখ বাড়িয়ে কপালের মধ্যস্থান ছুঁয়ে দিল। হাতটা ছাড়াতে চাইল। অরু শক্ত করে ধরে। তন্ময়কে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকতে হলো। অরুর বাঁধন ঢিল হতেই, ধীরেসুস্থে উঠে কামরা হতে বেরিয়ে গেল। যাবার পূর্বে দরজা ভালোভাবে চাপিয়ে গেল। বসার ঘরে আসতেই মোস্তফা সাহেবের সঙ্গে দেখা। মোস্তফা সাহেব সোফায় বসে আছেন। তন্ময় ডাকল, ‘বাবা!’
‘হু।’
‘তুমি এখনো জেগে যে?’
‘ঘুম আসছিলো না। ওখানে কোনো সমস্যা হয় নাই তো?’
‘না। সব ঠিক ছিলো।’
‘অরুর ভার্সিটির এপ্লিকেশন চলছে শুনলাম। গতকাল সময় করে কয়েকটায় এপ্লাই করে দিও!’
‘আচ্ছা।’
‘শুয়ে পড়ো গিয়ে।’

তন্ময় যেতে পা বাড়ালো। মোস্তফা সাহেব পিছু ডেকে বললেন, ‘শাবিহার মানসিক উন্নতি হয়েছে কী?’

তন্ময় হেসে বলল, ‘অনেক! চিন্তা করো না।’
_______
ঢাকা ফিরেই তন্ময় কাজ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে উঠলো। তিন চার দিনের কাজ পেন্ডিং-য়ে। কিছু বায়ার’দে কথা দিয়ে গিয়েছিল! পুরান ঢাকার ফ্যাক্টরি নিয়ে বেশকিছু মিটিং আছে তার। চোখমুখ থুবড়ে কাজ করতে হচ্ছে! তাকে বাড়িতে পাওয়া মানে, চাঁদ হাতে পাওয়া। প্রত্যেকদিন ঘুম থেকে উঠতে অরুর দেরি হয়ে যায়। হৈচৈ করে উঠে নিচে এসে শুনবে, ‘তন্ময় বেরিয়ে গিয়েছে।’ তখন আর গলা দিয়ে খাবার যেতে চায় না তার! দুচোখ ভিজে উঠে। আফসোসে বুক ভাড় হয়ে থাকে! রাতে ফিরতে ফিরতেও লোকটা এগারোটা- বারোটা বাজিয়ে ফেলে। তাও ডিনার সেরে আসে। অরু সেই-মূহুর্তে অথৈজলে ঘুমোতে ব্যস্ত। এতো চেষ্টা করে, তবুও ঘুমকাতুরে সে ঘুম থেকে রক্ষ পায় না। আজকের দিন নিয়ে দু-সপ্তাহ! দু সপ্তাহ ধরে অরু তন্ময়কে দেখে না! বুকে একরাশ অভিমান। সেই অভিমান ডিঙিয়ে কলও দিচ্ছে না আগ বাড়িয়ে।

বৃহস্পতিবার। সকাল থেকে অরু ঘর আটকে বসে। দু’একবার আয়নায় মুখ দেখে কেঁদেছে। কেঁদেকেটে মুখ ধুয়ে খেতে গিয়েছে। খেয়ে দেয়ে রুমে এসে শুয়ে পড়েছে। সেলফোন ঘাটিয়ে তন্ময় আর তার ছবি গুলো দেখতে বসলো। তাদের অনেক ছবি! গ্যালারি জুড়ে শুধু ছবি আর ছবি। সাদা শাড়ি পরিহিত সে আর পাশে বসে তন্ময়। কী সুন্দর ছবি! ছবি গুলো দেখতে নিয়ে অরু আবারো একটু কেঁদে নিল। টিস্যু নাকে চেপে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার তন্ময় ভাই কি তাকে ভুলে গেল?

দীপ্ত এসেছে। হাতে প্যাড৷ মুভি দেখছে। ইন্টারেস্টিং পার্ট চলছে হয়তো। একমুহূর্তের জন্যেও চোখ ফেরাচ্ছে না। লাফিয়ে উঠে বসলো অরুর বিছানায়।
চিৎপটাং শুয়ে মুভি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অরু এগিয়ে এসে পাশে বসলো। যথেষ্ট নরম গলায় শুধালো, ‘তন্ময় ভাইয়ার সাথে দেখা হয়েছে তোর?’
‘হু। সকালে হলো ত। আমাকে মিল্কশেক কিনে দিয়ে গেল।’
‘ক’টা বাজে তখন?’
‘ছ’টা ত্রিশ।’

অরু বিষন্ন অনুভব করলো। সে উঠেছে আটটা ত্রিশে। এরজন্যই ত তন্ময়কে পায়না। আজ আকাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। রোদ উঠেছে হালকাপাতলা! হিম বাতাস বইছে। অরু বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে, মারজি আর এহসান আসছে। দু’ভাইবোনের মাথায় সাদা ছাতা। গরমে ত্যক্ত মারজি নিচ থেকে চেঁচাল, ‘অরু নাম তাড়াতাড়ি!’
‘কেন!’
‘নতুন ভার্সিটি দেখে আসি। ক্যাম্পাস ঘুরবো!’
‘আয় ভেতরে।’
‘না। রেডি হয়ে নাম। আমরা গাড়িতে বসি!’
‘আচ্ছা।’

অরু সময় নিয়ে সেজেগুজে নিল। তন্ময়ের বিরহে কয়েকদিন যাবত সাজগোছ ও করছে না। বেরোনো ও হচ্ছে না! সুযোগের বেশ ভালোভাবে সৎ ব্যবহার করলো। চমৎকার রূপে আবদ্ধ হয়ে বেরোলো। ধেইধেই করে গাড়িতে উঠে বসলো। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করেছে। অরু জানালার পাশে বসেছে। তার পাশে মারজি। ড্রাইভারের সঙ্গে এহসান। মারজি কনুই দ্বারা খোঁচাল অরুকে, ‘কী ব্যাপার বলত?’

অরুর মুখশ্রী মুহুর্তে করুণ বনে গেল। কয়েকবার চোখের পলক ফেললো, ‘কিছু না।’
‘তন্ময় ভাইকে জ্বালাচ্ছস নিশ্চিত!’

অরু রেগে গেল, ‘তুই এমন কেন মারজি! আমি জ্বালাই? আমাকে জ্বালাচ্ছে যে! জানিস সেই যে ফিরেছি, আর দেখাসাক্ষাৎ নেই।’
‘তুই দেখিস না তবে ভাইয়া তোকে ঠিকই দেখে। এক কাজ কর কল দে। ভাইয়া হয়তো ব্যস্ত৷ কাজ ফেলে ঘুরেফিরে এসেছে। কাজগুলো কভার-আপ করতেও ত সময় লাগে!’
‘তাই বলে এতো!’

অরু অসন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা ঘুরিয়ে চুপ রইল। হাতে সেলফোন। তন্ময়ের নাম্বার সে অনেকবার ডায়াল করতে চেয়েছে। কিন্তু করেনি। মারজি বোঝানোর সুরে বলল, ‘তোর মধু লোভী তন্ময় ভাই, মধু ছাড়া বাঁচবে না! তোর মধুর ফায়দা নে।’
‘মধুর ফায়দা?’

মারজি ফিসফিস করে উল্টাপাল্টা কিছু বুঝ মাথায় ঢেলে দিল। অরু হ্যাবলার মতো শুনে বলল, ‘ছিঃ। এসব কখনো করবো না। যা ভাগ!’

অরুর কামরার দরজা আবছা ভেড়ানো থাকে। লক করেনা সে সচরাচর। আজ অরু দরজা লক করে ঘুমিয়েছে। মারজির কথা খানা তার মনে বিঁধেছে। নিশ্চয়ই তন্ময় রাতে রুমে আসে। নাহলে এসির ট্রেম্প্রেচার বাড়ায় কে? অরু ত ভীষণ কমিয়ে ঘুমোয়। শরীরে কাঁথা বা কে মেলে দেয়? নিজে এসে দেখে যায় অথচ অরুকে দেখতে দেয়না, তা তো হবেনা। তাই অরু আজ থেকে দরজা লক করে ঘুমাবে।

পরপর পাঁচদিন অরু দরজা লক করে ঘুমালো। দু’দিনই মধ্যরাতে দরজায় করাঘাত পড়েছে। নিস্তব্ধতা কাটিয়ে শোনা যাত ঠকঠক শব্দের। রাগে দুঃখে অরুর কাঁদতে ইচ্ছে করছে। নিজে প্রত্যেকদিন আসে। অথচ অরুকে ডাকে না! আজ শব্দগুলো শুনেও না শোনার ভান করে পড়ে থাকলো।
_________
ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পঁয়তাল্লিশে। অরুর দুচোখের পাতায় সারা বিশ্বের ঘুম এসে জড়ো হয়েছে। একটু পরপর ওয়াশরুম গিয়ে চোখমুখে পানি দিচ্ছে। ঘড়িতে সময় দেখে উঠে দাঁড়ালো। দরজা খুলে মাথা বের করলো। সবগুলো বাতি নেভানো। অন্ধকার। কেউ নেই চারিপাশে। অরু পা টিপে টিপে তন্ময়ের কামরায় ঢুকলো। দরজা আবছা লাগিয়ে দিল। অন্ধকারে হাতড়ে বড়ো বিছানার, আরাম করে শুয়ে পড়লো। মুহুর্তেই নাকমুখে আছড়ে পড়ল তন্ময়ের ঘ্রাণ। কোলবালিশ বুকে শক্ত করে জড়িয়ে নিল। বালিশে নাক গুঁজে রাখল। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। আহা!

দরজা খোলার শব্দ। অরুর ঘুম খানিক কেটে গেল৷
তন্ময় ফিরেছে। ডান হাতে কোর্ট আর বাম হাতে অফিস ব্যাগ। ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাতের ব্যাগ আর কোর্ট সোফায় রেখে, ওয়াশরুম ঢুকে গেল। বাতি জ্বালানোর প্রয়োজন বোধ করলো না। তাতে বরং অরুর জন্য ভালোই হলো। সে দিব্বি পুনরায় চোখ বুজে ঘুমানোর প্রচেষ্টায়। এবং ঘুমিয়েও গেল। তন্ময় কোমরে তোয়ালে পেঁচিয়ে বেরিয়েছে। অন্ধকার কামরায় বাতি জ্বালাল। চুল ঝেড়ে ড্রেসিং টেবিলে দাঁড়াতেই চমকে গেল। বিছানায় তার মাতই গিয়েছে। অরু ঘুমিয়ে কোলবালিশ জড়িয়ে। স্কার্ট পরে শুয়েছে। ফলস্বরূপ ফর্সা স্লিম পা জোড়া চোখের সামনে দৃশ্যমান! পরনের গেঞ্জির হাবভাব ও ভালো নয়। তন্ময় অশান্ত মন নিয়ে এগিয়ে গেল। গলার স্বর সাংঘাতিক ছোট করে ডাকল, ‘অরু?’

কাঁচা ঘুম অরুর আবার কাটলো। আবছা চোখে তন্ময়কে পরখ করে নিল। নিবিড়ভাবে, একমনে। উদোম প্রশস্ত বুকে নজর আটকে গেল। ফোটা ফোটা জল এখনো দৃশ্যমান৷ পেশিবহুল হাত জোড়া ফুলে আছে। দেখতে আকর্ষণীয়! ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। ঘুম সম্পূর্ণ কাটতেই লাফিয়ে উঠে বসলো অরু। অভিমানী চোখে তাকিয়ে আছে। ধীরেসুস্থে আঁখিদুটি ভিজে উঠছে। একসময় চোখের কোণ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। তন্ময় হাত বাড়ালো। অরু দূরে সরে বসলো, ‘ছুঁবেন না। আপনি আমাকে মোটেও পছন্দ করেন না। একটুও ভালোবাসেন না। ওগুলো সব মিথ্যে ছিলো।’

তন্ময়কে খানিক ব্যাকুল দেখাল। হন্তদন্ত ভঙ্গিতে অরুর হাতটি চেপে ধরলো। টেনে আনল নিজের দিক। জাপ্টে ধরলো ছটফট করতে থাকা অরুকে। একপ্রকার কোলে উঠিয়ে নিয়েছে। কোমল স্বরে আওড়াল, ‘আম সরি। রাগ করে না সোনা। একটু ব্যস্ত ছিলাম।’

অরুর কান্নার গতি বেড়েছে। দুচোখ বেয়ে ঝড়ছে অজস্র ক্ষুদ্র জল। ফুপিয়ে বলল, ‘ভালোবাসার মানুষের জন্য কোনো ব্যস্ততা থাকেনা। ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে তাই আপনি…’
‘চুপ! একদম চুপ।’

অরুর নাক ফুসছে। ধমক খেয়ে সে থমকে আছে। তন্ময় তার অগোছালো লম্বা চুলগুলো হাতে পেঁচিয়ে নিল, খুব যত্নসহকারে। কপালে চুমু খেল, ‘সময় দে। বাড়িতে বিয়েটা মেনে নিলে, তোকে কোনো অভিযোগ করার সুযোগ দিব না। হু? কান্না করে না জান। থাম… ‘
‘আমি কান্না করলেই বা কী! আপনার কোনো যায় আসে?’
‘হু আসে। অনেক আসে।!
‘মিথ্যে। না আসেনা। একদম আসে না।’

তন্ময় হাসলো। অরুর লাল নাক টেনে দিল। কোল থেকে নামাতে চাইল। তাগাদা দিল, ‘কাল তাড়াতাড়ি আসব। এখন যা রুমে। রাত হয়েছে।’

অরু তন্ময়ের গলা দু’হাতে পেঁচিয়ে ধরলো শক্ত করে সঙ্গে সঙ্গে শিউরে উঠলো। তন্ময়ের উদোম শরীরের সাথে লেপ্টে গিয়েছে। থরথর করে কেঁপে উঠেছে দেহ খানা। চোখমুখ খিঁচে তবুও জড়িয়ে রাখল। তন্ময় শান্ত নেই। বড্ড অশান্ত। যেই ভয়ের জন্য দূরে দূরে থাকছে, সেটাই যেচে সামনে এসে বসে। চোয়াল শক্ত করে রেখেছে। কন্ঠ নামিয়ে ডাকল, ‘অরু!’
‘এখানেই থাকব। আপনার সাথে। কোত্থাও যাব না।’
‘না। রুমে যাবি!’

তন্ময়কে ছেড়ে অরু বিছানায় শুয়ে পড়লো, ‘এখানেই ঘুমাব।’
‘জেদ করে না।’

অরুকে কোলে তুলতে নিতেই ঘটলো অঘটন। তন্ময়ের কোমরের তোয়ালে ঢিল হয়ে গেল। খুলে পড়ে যাবে যাবে ভাব৷ অরু চিৎকার করে দুচোখের উপর দুহাত চেপে ধরল। লজ্জায় সে হতভম্ব। দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে নিয়েছে। তন্ময় নিঃশব্দে হাসলো। সে তোয়ালে ঠিক করতে নিতেই, অরু লাফিয়ে উঠলো। দরজার সিটকানি আটকে দিল। যত যাই হোক, আজ সে এখানেই ঘুমাবে। তন্ময়ের কথা একদম শুনবে না।

_________
চলবে~
‘নাবিলা ইষ্ক’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here