প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব –৫০+৫১

‘প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল’

{ বিশেষ দ্রষ্টব্য – তিনহাজারের উপরে শব্দ ব্যবহার হয়েছে। ফেইসবুক লাইটে পড়তে না পারলে, মেইন ফেইসবুক অথব ব্রাউজার ব্যবহার করবেন।}

৫০.
নিস্তব্ধতা! আবদ্ধতায় ঘেরা চারপাশে। কক্ষ জুড়ে শুধু অরুর ঘন শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ। তন্ময় হতে লজ্জিত মুখশ্রী আড়াল করতে বেশ সময় নিয়ে বেরিয়েছে ওয়াশরুম থেকে অরু। বিচলিত চোখে চারিপাশে নজর বুলিয়েছে। যাকে দেখার প্রত্যাশা নিয়ে বেরিয়েছে সে নেই! তন্ময় নেই! আনাচে কানাচে কোথাও নেই। অরু স্বস্তির শ্বাস ফেলবে নাকি দীর্ঘনিশ্বাস? তন্ময়কে ভীষণ ক্লান্ত দেখিয়েছে। এতটা জার্নি করে এসেছে। এখন একটু রেস্ট নিবে না? ইতস্তত মনে বিছানার সামনে এসে দাঁড়াল অরু। তখন লজ্জায় পঞ্চমুখ হয়ে, বিছানা’খানা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেনি। এখন যখন দেখছে, বুঝতে পারছে তখন তন্ময়ের ধ্যান মেরে তাকিয়ে থাকার কারণ! তুলতুলে লাল বিছানায় হরেকরকম ফুল। ফুলের পাপড়ি’র সাহায্যে বিছানার মধ্যস্থানে ‘লাভ’ বানানো হয়েছে। লাভের ভেতরে তাদের দুজনের নাম লেখা। ‘তন্ময় এন্ড অরু’। প্রশান্তিতে অরুর ভেতরটা জুড়িয়ে গেল। এতো সুন্দর বিছানায় কীভাবে শুবে? তার তো বসতেও দ্বিধাবোধ হচ্ছে। নষ্ট হয়ে যাবেনা? কতটাই না পরিশ্রম করেছে। কিছুক্ষণ ভেবে অরু ব্যাগ থেকে সেলফোন বের করলো। ক্যামেরা ওন করে বিছানার একটি ছবি তুলল। আরেকটু জুম করে, তাদের নামের অংশটুকুর ছবি তুলে নিল। তোলা ছবি খানা দেখতেই ঠোঁটের হাসি দীর্ঘ হলো। আধঘন্টা তো হয়েছে প্রায়। তন্ময় এখনো ফিরছে না। সে কী ফিরবে না? এই কক্ষে ঘুমোবে না? অরু চিন্তায় মশগুল থাকতে পারছে না। চোখ স্বেচ্ছায় বুঁজে আসছে। প্রচন্ড ঘুম ধরছে। এমন সময় হাতের সেলফোন বেজে উঠলো। মারজির কল। অরু কল রিসিভ করলো। মারজি কল না দিলে, ঘুম থেকে উঠে সে’ই কল ব্যাক করত। মারজির গলা থমথমে শোনালো, ‘অসভ্য পুরুষ মানুষ দিয়ে আমাকে কথা শোনানো হচ্ছে! সব বুঝি। কে ছিল ওই হতবুদ্ধি লোকটা! আমাকে বলে কি-না ফার্মের মুরগী! ওহ্, তোর সাথে বুঝাপড়া আগে করে নেই অরুর বাচ্চা। আমার নাম কী লিখে সেভ করছস? ভালোয় ভালোয় বলে দে।’

অরু খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। প্রাণোচ্ছল দীর্ঘ শব্দের হাসি৷ সুগন্ধি ভর্তি কক্ষ জুড়ে হাসির বিচরণ বয়ে বলল, ‘মারজি তুই আমার নাম কী দিয়ে সেভ করছিস হ্যাঁ? ভেবেছিস আমি জানি না? আমি সব জানি। ‘মধু ওয়ালা তন্ময় ভাইয়ের মধু লোভী মৌমাছি’ দিয়ে সেভ করছিস। আমি দেখেছি। আবার আমার তন্ময় ভাইয়ের নাম্বার সেভ করছিস কীভাবে? ‘মধু লোভী মৌমাছির মধু ওয়ালা তন্ময় ভাই!’ সে মোটেও মধু লোভী মৌমাছির মধু ওয়ালা তন্ময় ভাই না। সে অরুর তন্ময় ভাই। আমাদের নাম ভালোভাবে লিখ, আমিও তোর’টা ভালোভাবে লিখব।’

তন্ময়ের থমথমে চেহারার পরিবর্তন দেখাল। মাত্রই দরজার সামনে এসে দাঁড়ানো সে বেকুব বনে গেল। মুখশ্রীর রঙ বদলাতে দেখা যাচ্ছে। থমকে গিয়েছে পা’জোড়াও। দৃষ্টি অরুর পিঠের উপর নিবদ্ধ। মুলত তারা অরুর প্রাণোচ্ছল দীর্ঘ হাসির শব্দ শুনতে শুনতে এসেছে। তন্ময়ের পেছনে দাঁড়ানো মাহিন মুখ টিপে হাসছে। ব্যাঙ্গ করে ফিসফিস করে তন্ময়ের কানের সামনে বলল, ‘মধু ওয়ালা তন্ময় ভাইয়া! লোভী মৌমাছির মধু ফিরিয়ে দিন। সেগুলো নিয়ে আর কতো ঘুরবেন বলুন!’

তন্ময়ের গাম্ভীর্যের মুখশ্রী দেখে, মাহিনের শব্দ করে হাসতে ইচ্ছে করছে। তবে সে একটি টু শব্দ পর্যন্ত করলো না। আগ্রহী চোখে কান পেতে রাখল। সে কথপোকথন আরও শুনতে চায়। মাহিনকে অসহায়ত্ব করে অরু হুট করে ঘুরে তাকাল। বড়বড় চোখ করে ফেললো। কল আলগোছে কেটে দিল। হতভম্ব অরুর পানে তাকিয়ে, মাহিন এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। ঘর কাঁপানো হাসি। হাসতে হাসতে ফ্লোরে বসে পড়লো। গম্ভীর তন্ময়ের মুখশ্রীর সাথে মধু ওয়ালা তন্ময়কে মেলাতে গিয়ে, আরেকদফা
হাসলো। হাসতে হাসতে সে দিশেহারা একপ্রকার! চোখের কোণের জল মুছে উঠে দাঁড়ালো। নিজেকে যথাসম্ভব ঠিক করে বলল, ‘টাকা দে মধু ওয়ালা। তাড়াতাড়ি। যাই। অনেক কিছু কিনতে হবে।’

তন্ময় থমথমে চেহারায় ল্যাগেজ খুলল। মানিব্যাগ বের করে পাঁচটা হাজার টাকার নোট এগিয়ে দিল মাহিনকে রফাদফা করতে। এভাবে তাদের কারো কাছে ক্যাশ নেই। তন্ময়ও ক্যাশ রাখেনা সচরাচর। আজ অরুর জন্য রাখা মুলত। রাস্তাঘাটে এটাসেটা দেখে চেয়ে বসলে! এই ভেবে আগেই বের করে রেখেছে কিছু খুচরো। মাহিন টাকা পেয়ে আরেক চট হেসে তবেই বিদায় হয়েছে। এদিকে অরু আতঙ্কের শেষ প্রান্তে। তন্ময় কখন এসেছে জানে না। কতটুকু শুনেছে বুঝতে পারছে না। লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়ে বড্ড নাজেহাল অবস্থা তার। গম্ভীর থমথমে চেহারার তন্ময় অরুকে দেখছে। অরুকে অবাকের চুড়ান্তে পৌঁছে দিয়ে সে হুট করেই হেসে ফেললো। ডান হাতে কপাল চোখ ঢেকে হাসছে। অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে হাসা যাকে বলে। আবার ফকফকে সাদা দাঁতের প্রানবন্ত হাসিও বলা যায়।
অরু ভ্রম করছে নাতো? এতো সুন্দর হাসির মালিক তার তন্ময় ভাই? অরু অনিমেষ ভঙ্গিতে দেখছে। ভুলবশত পলক ফেলছে না। তন্ময় দীর্ঘ হাসি ছোট করল। ঠোঁটে মুচকি হাসি লেপ্টে। সে অরুর দিক অগ্রসর হচ্ছে। ধীর স্বরে শুধালো, ‘মারজি ছিলো?’

অরু পিটপিট চোখে তাকিয়ে। ঠোঁট ভিজিয়ে ছোট্ট গলায় জবাব দিল, ‘হু।’
‘কি বলছিল!’
‘কই.. কিছুনা।’

তন্ময় কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। গলার স্বরে ফাজলামোর ইঙ্গিত, ‘আমাকে মধু ওয়ালা বলেছে! কেন? মধু তো চুরি করিনি এখনো। তাহলে?’

অরু বাক্যের মানে বুঝল না। নিজের মতো বলে দিল, ‘অ্যাহ? মারজি মজা করছিল। আমিও একটু..’
‘তুইও একটু মজা করছিলি?’
‘হু।’
‘মজা করা শেষ?’
‘না..হ্যাঁ।’
‘খিদে পেয়েছে?’

অরুর পেট মুচড়ে উঠলো। তার টুকরো খিদে পেয়েছে। পেটে কিছু দিয়ে ঘুমালে ঘুম আরামময় হতো। তাই ভেবেচিন্তে মাথা দুলিয়ে বলল, ‘একটু।’
‘নিয়ে আসি। বোস।’

অরুর সঙ্গে যেতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু লজ্জায় সঙ্গে যাবার আবদার ধরলো না। একটু আগে মাহিন কীসব শুনে গেল। তারউপর এমন বাসরঘর সাজাওনোর উদ্ভট বিষয়টি। সব মিলিয়ে সে বেশ লজ্জিত। খাবার আসতে সময় নেয়নি। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এসেছে। তবে তন্ময় আনেনি। খাবার এনেছে করীম চাচা। প্লেট সাজানো খাবার টি-টেবিলে রাখল। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বৃদ্ধ বলল, ‘মামনী তোমাকে খেয়ে শুয়ে পড়তে বলেছে তন্ময় বাবা। আজকের জন্য কোথাও বেরোনো হবে না। বারবিকিউ পার্টি হবে বাগানে রাতের দিক।’
‘ওহ্! আচ্ছা। সে খেয়েছে?’
‘তা তো বলতে পারছি না মামনী। আমি গিয়ে খেতে বলবো কেমন?’
‘ধন্যবাদ।’
___________
গাড়ির জানালায় ছোট ছোট টোকার খটখটে শব্দ। শাবিহা ঘাবড়ে গেল। অয়নের ছোট চুলে ঘন্টার পর ঘন্টা যাবত চলতে থাকা হাতটি থমকে গেল। চোখজোড়া বড়ো আকার ধারণ করলো। পাশে তাকাল। একজন মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা। মুখ নাড়িয়ে কিছু বলছে। শুনতে পেলো না শাবিহা। বাহির থেকে নিশ্চয়ই কিছু দেখতে পাওয়া যায় না। এখন সে কী করবে? বোধগম্য হচ্ছে না শাবিহার। অয়ন তখনো নিশ্চিন্তে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শাবিহা দিশেহারা হয়ে একপ্রকার ডাকতে বাধ্য হলো, ‘অয়ন!’

অয়নের চোখজোড়া নড়েচড়ে উঠছে। গুঙিয়ে পাশ ফিরে মুখটা শাবিহার পেটের ভেতর গুঁজে দিল। আচমকা আক্রমণে হতভম্ব, বাকরুদ্ধ শাবিহা। দৃশ্যমান রূপে কেঁপে উঠল। শক্তপোক্ত হয়ে এলো শরীর। ঢোক গিলে ডাকার তাগিদা বাড়াল, ‘এই অয়ন! অয়ন!’

ক্রমশ অয়নের মুখ খানা পেটের গহ্বরে হারিয়ে যেতে ধরেছে। শিরা-উপশিরায় রক্ত চলাচলের তীব্র বেগ। হাত বাড়িয়ে অয়নের মুখে ধরে রাখল। অন্যদিকে কাঁচের খটখট শব্দ এবার জোরে শোনা যাচ্ছে। অয়ন চোখজোড়া খুলল। নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। উঠে বসলো। ঘুম পর্যাপ্ত হয়নি। চোখমুখ ফুলে। চোখজোড়া লালচে। কপাল হতে চুলগুলো তুলে বলল, ‘বসো। বেরিয় না। কথা বলে আসি।’

শাবিহা চিন্তিত মুখে মাথা দোলাল। অয়ন বেরিয়েছে। গাম্ভীর্যের চুড়ান্তে তার হাবভাব। কাঁচা ঘুম ভাঙলে মাথাটাই গরম থাকে। বেরোতেই সামনাসামনি হলো মধ্যবয়সী মহিলার। এখন তার পাশে স্বল্প বয়সের কুমারী মেয়ে। ফটফট চোখে তাকিয়ে। অয়নকে সমানতালে দেখে চলেছে। অন্যদিকে ভদ্রমহিলা অয়নকে ভালোভাবে দেখে নিল। ঘুমাচ্ছিলো মনে হয়। দেখতেও সভ্য-টব্য। মহিলার মুখশ্রী নরম হলো। চওড়া গলায় শুধালেন, ‘কে তুমি বাবা? এখানে কী করতাছ?’

অয়ন ভদ্রতাসূচক হাসার চেষ্টা করতে পারলো না। প্রচন্ড মেজাজ গরম তার। ঘুমে মাথাটা জ্বলছে। গম্ভীরমুখে জবাব দিল, ‘ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। এখনই বেরোবো।’
‘সাথে কেডা?’

মাথাটা বাড়িয়ে গাড়িতে নজর দিল ভদ্রমহিলা। চোরাচাহনিতে দেখছে বারংবার। অয়ন বিরক্ত হলো, ‘ওয়াইফ।’
‘অ্যাহ?’

পাশের যুবতী মেয়েটি বুঝিয়ে বলল, ‘মা স্ত্রী বলেছে। সাথে স্ত্রী আছে।’

ভদ্রমহিলার মুখশ্রী এবার খুব নরম হয়ে গেল। ম্লান হাসলেন, ‘আমি হেলেনা। বাড়ির সামনে গাড়ি দেইখা একটু চিন্তায় পড়লাম। বাবা মাতাল কতগুলা নিরিবিলি জায়গা পাইয়া চলে আসে। উদ্ভট সব কান্ডকারখানা করে যায়। সেইবার তো গেং রেপ ক্যাস হইয়া গেল। তাই বাবা এতো সতর্কতা। থাকো কই? শহরের থেকে আইলা মনে হচ্ছে!’
‘জি। হানিমুনে যাচ্ছি।’

খুব স্বাভাবিক ভাবে একের পর এক মিথ্যে নির্দ্বিধায় বলে যাচ্ছে অয়ন। না নড়ছে ঠোঁট আর না নড়ছে চোখ। খুব সাবলীল ভঙ্গিমা। হেলেনা বেগম উদ্বিগ্ন হলেন, ‘এতো সুন্দর পোলা। বউ তাইলে কতটাই না সুন্দর হইবো। বেরোতে বলো না বাবা। একটু দেখি।’

এতো কৌতূহল কেন! ভদ্রসভ্য অয়ন ভদ্রমহিলার মুখের উপর দ্বিমত করতে পারছে না। আর না পারছে গাড়িতে ঢুকে টান মেরে চলে যেতে। মনে অতিষ্ঠ হয়ে দরজা খুলল। মাথাটা ঢুকিয়ে বলল, ‘বেরোবে?’

শাবিহা মাথা দোলাল। সে দরজা খুলে বেরোলো অপরপাশ হতে। কামিজ পরিহিত ফর্সা, স্লিম ফিগারের সুন্দরী মেয়ে। দেখতেই সুশীল, ভদ্র উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে মনে হচ্ছে। শাবিহা সালাম জানাল। সামান্য হাসার চেষ্টা। হেলেনা এমন সাংস্কৃতিক ভদ্র মেয়েমানুষ দেখে গলে রসমালাই বনে গেলেন। চাতক পাখির মতো ছুটে গেলেন, ‘মাশাআল্লাহ! কী সুন্দর মাইয়া। দুজনকে পইপই মিলিয়ে বানিয়েছেন আল্লাহতালা।’

প্রশংসা শুনে অয়নের গম্ভীরমুখের পরিবর্তন ঘটলো। গাম্ভীর্য অনেকাংশে কমে এলো। ঘুম কিছুটা ছুটে গেল। নরম চোখে নিজের শাবিহার দিক তাকাল। হু! প্রশংসা করবেনা আবার! তার শাবিহা পরীদের থেকেও সুন্দর। হেলেনা শাবিহার দুহাত ধরে প্রশ্ন করলেন, ‘নতুন বিয়া না? চোখমুখে সব পরিষ্কার লেখা তুমি নতুন বউ। এমন লজ্জায় লালনীল আমিও হইছি বুঝলা। তোমার আংকেলের দিক চোখ তুলে তাকাতেই পারতাম না। কি যে লজ্জা লাগতো। আর এখন দেখ! মাজায় কাপড় বেঁধে ঝগড়া করি।’

শাবিহা সন্দেহ দৃষ্টিতে তাকাল অয়নের পানে। নতুন বউ কবে হয়ে গেল সে! ঠোঁট কাঁপছে ভদ্রমহিলাকে ভুল সাবিত করার জন্য। পড়ে ভাবলো এভাবে গাড়িতে দুজন একসাথে ছিলো। স্বামীস্ত্রী না বললে ভালো দেখাবে না। বরং এই মানুষগুলোও কুৎসিত কিছু ভেবে বসবে। তাই আর মুখ খুলল না। সয়ে গেল। হেলেনা হেসে বলতেই থাকলেন, ‘হানিমুনে কই যাইতেছ? আমাদের আশেপাশে ঘোরার সুন্দর জায়গা আছে। শহর থেইকা অনেকেই ঘুইরা যায়।’

শাবিহা থমথমে চোখে তাকাল। গলাটা শুকিয়ে কাঠকাঠ। হানিমুন? আর কীসব বলেছে এই পুচকে ছেলেটা?
___________
সূর্য ডুবেছে। আঁধার নেমেছে। বাতাস ছেড়েছে। প্রকৃতি ঠান্ডা এবং উচ্ছ্বাসিত। আকাশে চাঁদ নেই। মেঘেদের দলে ঘেরা সম্পুর্ন আকাশ। বাগানে বিশাল বড়ো তাবু টানানো হয়েছে। সঙ্গে তাবু সাইজের আমব্রেলা। বেশকিছু চেয়ার পাতা সেখানে। মধ্যে গোল টেবিল। বাতি লাগানো চারিপাশে। ইটের সাহায্যে আগুন ধরানো হয়েছে। আগুনের উপরে বারবিকিউ রড রাখা। গ্রিল হবে মুরগী। গোস্তো ভাজা হবে। শিকাবট হবে। আরও কিছু গোস্তোর ভাজা আইটেম। সঙ্গে ভেতরে বাবর্চির হাতের স্পেশাল আইটেমস তো আছেই। মাহিন ব্যস্ত পায়ের এসে তন্ময়ের পাশে বসলো, ‘কই অরু? ঘুমিয়ে এখনো? তুই ঘুমোতে গেলি না যে! এতো সুন্দর বাসরঘর পেতে দিলাম। ভেবেছিলাম প্রেয়সী নিয়ে দিব্বি ঘুমোবি।’

ইব্রাহিম হতাশ সুরে তাল মেলাল, ‘ওর ভেতরে গন্ডগোল আছে বুঝলি। চলে না নাহলে নষ্ট। বউ রেখে শালায় যে কেম্নে ঘুরেফিরে আমার বুঝে আসেনা।’

তন্ময় দাউদাউ করে জ্বলজ্বল করতে আগুনের পানে তাকিয়ে। দৃষ্টি নিথর। মাহিন হেসে বলল, ‘কাজ করে দেখেই এখানে বসে। দেখছিস না ঘরে যেতে চাচ্ছে না। বাসরঘর দেখে ওর মধ্যে কিছু-মিছু হচ্ছে দোস্ত!’

তন্ময়ের থমথমে গলা, ‘মোটেও ঠিক করিস নি।’

মাহিন চওড়া গলায় হাসলো, ‘অনেক কিছু এখনো বাকি। আগে আগে দেখ হোতা হে ক্যায়া!’

তন্ময় চোখ রাঙাল। কাজে দিল না। মনের ভেতরটা সংকোচে মুচড়ে উঠলো। কীসব উল্টাপাল্টা সিচুয়েশনে দাঁড়া করাবে, ভাবতেই মাথাটা ধক করে জ্বলছে! নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা নেহাতি অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তিলেতিলে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। মরন যন্ত্রণা বুঝি একেই বলে!

শুহানি এসেছে। শাড়ি পরেছে। শুধু সে নয়! সব মেয়েরাই শাড়ি পরেছে। সেজেগুজে হাজির। বাগানে পার্টি হবে বলে কথা। মিউজিক সিস্টেমও বাজানো হচ্ছে! মাহিন উঠে দাঁড়ালো। শুহানিকে ইশারা করে একটু দূরে আনলো। ধীর স্বরে বলল, ‘দোস্ত অরু মনে হয় ঘুমোচ্ছে। ওরে উঠিয়ে তৈরি করে আন। এমন ভাবে তৈরি করাবি যেনো তন্ময় চেয়ার থেকে পড়ে যায়! বুঝলি? শালা আজ ওর বাসর তো হওয়াই ছাড়মু!’

শুহানি মুখ টিপে হাসলো। উপর নিচ করে মাথা দোলাল ক্রমাগত, ‘আমার সাদা শাড়ি আছে। তন্ময়ের সাদা রঙ পছন্দ না? ওইটা নিয়ে যাই। তারপর দেখ ওর কী অবস্থা হয়!’
‘যা ফুট!’

উদ্বিগ্ন মনে ছুটে গেল শুহানি। তার সাথে বান্ধবী মেহরুনও ছুটলো। যেতে নিয়ে শুনে নিল পুরো কাহিনি। উত্তেজনায় টানটান অবস্থা তারও। সে পুরোদমে লেগে পড়লো শুহানির সাথে অকাজে।

শব্দ শুনে অরু ছটফটিয়ে উঠে বসেছে। সে সোফায় ঘুমিয়েছিল। এতো সুন্দর বিছানা সে নষ্ট করতে পারলো না। হুড়মুড়িয়ে ঢুকেছে দু’তিনজন শাড়ি পরিহিত মেয়ে। সেজেগুজে চমৎকার রূপে আবদ্ধ। সেখানকার একজনকে চিনেছে। শুহানিকে! বাকি দুজন অচেনা। তারা ঢুকে নিজেদের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। হাতের শাড়ি, কসমেটিকস একত্রে ড্রেসিং টেবিলে রাখছে। শুহানি এগিয়ে আসল৷ অরুকে উঠিয়ে ওয়াশরুম পাঠাল জোরপূর্বক। অরু সময় নিয়ে ফ্রেশ হতে চাইল। এসব কি হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করল! সুযোগ দেওয়া হলো না তাকে। শুহানি করাঘাত করছে শব্দ করে। বাধ্য হয়ে বেরোলো অরু। শুহানি মজার সুরে বলল, ‘ভয় নেই প্রিটি গার্ল। উই আর ইওর এলডার সিস্টার্স! তোমাকে তৈরি করব। নিচে তো পার্টি হবে। সেখানে তো একটু সেজেগুজে যেতে হয় তাই না?’

অরু পুতুলের ন্যায় মাথা দোলাল। শুহানি নরম চোখে তাকিয়ে। আদুরে স্বভাবে অরুর গাল টেনে দিল, ‘লক্ষি মেয়ে। চুপচাপ বসো দেখি।’

অরুকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পুতুলের ন্যায় সাজানো হচ্ছে। শাড়ি পরাবে মেহরুন। সে খুব ভালো শাড়ি পরাতে জানে।সমস্যা বেঁধেছে ব্লাউজ নিয়ে।শুহানিরটা অরুর হবেনা। ঢোলা হবে বেশ। হুট করে মনে পড়লো তার আকাশী রঙের ক্রপ টপ আছে। এগুলো দিয়ে শাড়ি পরলে আরও সুন্দর দেখায়। সে ছুটে সেটা নিয়ে আসলো। গেঞ্জির কাপড়। বেশ ছোট। অরুর পারফেক্ট হবে। ফিটিংসে কোনো কমতি থাকবে না।

ঘড়ির কাঁটা সাতটা একুশে। একঘন্টা নিয়ে তাকে সাজানো হয়েছে। শাড়ি পরতেই সময় গেল বেশি। আপাতত শাড়ি পরিহিত অরু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। চমৎকার চোখ ধাধানো নিজেকে দেখে ঝটকা খেল। খুটিয়ে খুটিয়ে সময় নিয়ে দেখল। পিঠে সোজা পড়ে থাকা চুলগুলো দুলিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখছে। শুহানি পেছনে দাঁড়িয়ে, ‘মাশআল্লাহ! খুব সুন্দর লাগছে। তোমার কেমন লাগছে অরু?’

অরু ফিরে তাকাল। লাজুক হাসি চোখমুখে,’খুব সুন্দর।’
‘সাজগোজে আমি এক্সপার্ট বুঝলে। রিহান আমাকে এরজন্য প্রচন্ড কথা শোনায়। এতো সাজুগুজু করে অন্যকারো সাথে পালানোর মতলব এঁকেছি নাকি! ছেলেটা হিংসুটে!’

অরু আগ্রহী স্বরে শুধালো, ‘বিয়ের কত বছর আপনাদের আপু?’
‘উম, প্রেমের সাত বছর। বিয়ের তিন বছর। আমাদের পরিচয় স্কুল জীবন থেকে। পাশাপাশি বাড়ি ছিলো।’
‘স্কুল জীবন থেকে প্রেম?’
‘উহু না। ইন্টার থেকে। এর আগে দুজন সাপ বেঁজীর মতো লেগে থাকতাম।’
‘তাহলে প্রেম কীভাবে হয় আপু? প্রপোজ কে করে?’
‘চলো যেতে যেতে বলি।’
‘আচ্ছা।’

অরু কুঁচি ধরে হাঁটছে। ব্যাকুল নয়নে তাকিয়ে শুহানির পানে। প্রেমের গল্প শুনবে। শুহানি সময় নিয়ে বলতে লাগলো, ‘ক্লাস সিক্স পর্যন্ত মারামারি করে কাটিয়েছি। সেভেন থেকে বন্ধু হলাম। ক্লোজ ফ্রেন্ডস। আমি ভাই ওকে সর্বদাই বন্ধু ভেবে এসেছি। কখনো কিছু ফিল করিনি। ও নিজেই পরিবর্তন হয়ে গেল ক্লাস টেন থেকে বুঝলে? আমি জানতাম না। ইন্টারে দুজন একই কলেজ। ব্যাচের একটা ছেলে আমাকে প্রপোজ করে। হ্যান্ডসাম ছেলে। আমিও ভাবলাম ট্রায় করে দেখি। ওমা, আমি প্রেম করবো শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। রেগেমেগে অস্থির। পারেনা আমাকে মেরে তক্তা বানাতে। আমিও রাগলাম। ও কিন্তু নিজে মেয়েদের সঙ্গে দুনিয়ায় ঘেঁষাঘেঁষি করেছে। আমার স্ব-চোক্ষে দেখা। ও কতো তুলসীপাতা আমিতো জানি। তাই ইগ্নোর করতে লাগলাম। মাস খানেক করেছিও বুঝলে। কিন্তু খারাপ লাগছিল। মনের বন্ধু। সে এমন ভেঙে পড়লো চোখের সামনে মানতে পারিনি। বন্ধুত্ব বজায় রাখতে যাই। সাহেব প্রপোজ করেন। কোনো মেয়ের সাথে কখনো জড়াবে না, গ্যারান্টি দিল। আমিও কিছুদিন পিছু ঘোরালাম। তখন কিন্তু ওর প্রতি প্রেম আমি উপলব্ধি করে ফেলেছিলাম। তবু্ও স্বীকার করিনি। আমাকে প্রেমিক হিসেবে পেতে ওকে বেশ কাঠখড় পোহাতে হয়েছে।’

হুট করে শুহানি শব্দ করে হাসতে লাগলো। অরু হঠাৎ হাসির কারণ বুঝে পেল না। বোকার মতো চারপাশে তাকাল। তারা বাগানে এসে পড়েছে ইতোমধ্যে। গান বাজছে। আশেপাশে অনেকেউ হাঁটাচলা করছে। হাসাহাসি করছে। গান গাইছে। দুলছে। অরু সকলের মধ্যে তন্ময়কে খুঁজে পেল। আমব্রেলার নিচে দাঁড়িয়ে। একটা চেয়ার তার পায়ের নিচে পড়ে। হাতের সেলফোনটাও জমিনে।
স্তব্ধ শরীর আর মুগ্ধ নয়ন অনিমেষ ভঙ্গিতে অরুকে দেখছে। অরু কিছুটা বুঝতে পেরে লজ্জা পেলো বটে। শুহানির সঙ্গে বাকিদের তুমুল হাসির শব্দ ভেসে এলো। মাহিন কড় তালি দিচ্ছে, ‘সাব্বাশ দোস্ত! তোর থেকে এটাই আশা করেছি। ছক্কা মেরে দিছোস! তন্ময় পড়েনি। তবে চেয়ার আর সেলফোন তো পড়েছে। এটাই এনাফ!’

ইব্রাহিম শিষ বাজালো জোরসে। রিহান ইব্রাহিমের উদ্দেশ্যে বলল, ‘অরু মারাত্মক সুন্দর তাই না? মেয়েটা এতো মায়াবী। তন্ময়ের সেল্ফকন্ট্রোলের দাঁত দিতে হবে।’
‘শাড়ি আর সাদা রঙ মিলে এক অনাকাঙ্ক্ষিত মায়াবতী। আজ তন্ময় কই যাবে!’

হেসে ফেললো রিহান। থতমত খাওয়া তন্ময়কে আরেকবার দেখে নিল। ইশ, দুজনকে একসাথে এতটা মানায় যে রিহানের বুক জ্বলছে।
______________
অরু তন্ময়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শাড়ির কুঁচি ধরছে একটু পরপর। চুলগুলো সামলে নিচ্ছে। বাতাস ছেড়েছে। আবহাওয়া ঠান্ডা। বৃষ্টি নামবে মনে হয়। তার পাশে তন্ময় কাঠকাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে। অরু লাজুক চোখে তাকাল। তবে তন্ময় ভুলেও পাশে ফিরছে না। তাকাচ্ছে না৷ অরু খানিক মন খারাপ করলো। এতো সুন্দর তৈরি হয়ে আসলো। অথচ তন্ময় তাকাচ্ছেও না ভালোভাবে! কেন!

‘ছাম ছাম’ গানে নাচার প্ল্যান করা হলো। শুহানি, মেহরুন আর ঝর্না নাচবে। সকলে গোল হয়ে বসেছে চেয়ার পেতে। মিউজিকের লাউড বাড়ানো হয়েছে। অরু তন্ময়ের পাশে বসে। হাতে হাত রেখে আগ্রহী চোখে তাকিয়ে। নাচ শুরু হতেই করতালি। অরু হাসছে। নাচগান সে বড্ড উপভোগ করে কিনা।
হাততালি, শিষ বাজানো, চেঁচামেচি সবকিছু একত্রে কানে ভাসছে। উত্তেজিত মানুষদের সঙ্গে অরুও একটু উত্তেজিত। ছোট্ট গলায় সেও গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলাচ্ছে। হাততালি দিচ্ছে। পাশে কাঠকাঠ হয়ে বসে থাকা তন্ময়কে ভুলে গেল প্রায়। হঠাৎ অরু হাততালি দেওয়া বন্ধ করে দিল। মুখের হাসি উধাও হয়ে গেল। শ্বাস আটকে এলো। ধীরে উপলব্ধি করছে ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া। যা শাড়ি ভেদ করে পেট ছুঁয়েছে। চমকে আঁড়চোখে পাশে তাকাল। তন্ময় তাকিয়ে। অরুর বুকের ভেতর তুফান শুরু হলো। তোলপাড়, বেসামাল পরিস্থিতি। থরথর করে কেঁপে উঠা হাত তন্ময় আলগোছে লুকিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করেছে নিজের হাতে। শক্ত করে ধরে আছে। মুখটা কাছাকাছি নিয়েছে। ঠিক অরুর কান বরাবর। কানে ঠোঁট ছুইছুই অবস্থা। অরু ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকাল। কেউ এদিকে তাকিয়ে নেই। সবাই নাচগানে ব্যস্ত। কানে ঘনঘন শ্বাসপ্রশ্বাস উপলব্ধি করা যাচ্ছে। তন্ময়ের অসম্ভব গভীর স্বর শোন গেল, ‘খুব খুশি না? আমাকে আগুনে জ্বলতে দিয়ে তুই দিব্বি আছিস!’

পেটে চাপ পেয়ে ভয়ার্ত হতভম্ব অরু মুচড়ে উঠলো। খামচে ধরেছে কী? অরু ব্যথিত সুরে বলল, ‘কি করেছি?’
‘নির্বোধ!’

থরথর করে কেঁপে উঠল অরু। তন্ময় হাওয়ার বেগে ধরেছে তেমনি হাওয়ার বেগে ছেড়ে দিয়েছে। কারণ শুহানিদের নাচ শেষ। সকলেই আগের মতো বসেছে নিজেদের চেয়ারে। এতক্ষণের হাস্যজ্বল অরু মুহুর্তে অনুভূতির সাগরে ভেসে চুপসে গেল। থমকে গেল। অতি চেষ্টা করেও হাসতে ব্যর্থ হলো।

কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি নামছে। ফোটা ফোটা। অরুর হাতের তালুতে একফোঁটা বৃষ্টি এসে পড়লো। মুগ্ধ নয়নে অরু সেখানে তাকিয়ে। বৃষ্টি আসার খুশিতে সে পুনরায় তন্ময়কে ভুলে গেল। ভুলে গেল তার করা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। শুহানি শব্দ করে চেঁচাল,
‘উফ! বৃষ্টি’টা আরেকটু আগে আসত। তাহলে ‘ছাম ছাম’ গানে বৃষ্টিতে ভিজে নাচা যেতো। তাই না?’
‘আরেকবার হয়ে যাক তাহলে?’
‘অবশ্যই!’

হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেল পুনরায়। ঝুম বৃষ্টি নামতে দেখে সকলে আঁটসাঁট হয়ে আমব্রেলা এবং তাবুতে ঢুকে গেল। মুলত এগুলো আজকের ওয়েদার জেনেই গাড়া হয়েছে। বৃষ্টি উপভোগ করে আড্ডা দেওয়া হবে। রাত দশটা পঁয়তাল্লিশ। সময় কীভাবে পেরিয়ে গেল বলা দায়। মুশলধারা বৃষ্টি হচ্ছে। শুহানি’রা পুনরায় নেমেছে বৃষ্টির মধ্যে। নাচের একফাঁকে একেক করে অনেকে, যোগদান করলো। আমব্রেলার মধ্যে রয়ে গেল তিন চারজন মানুষ। তাদের মধ্যে তন্ময় অরু উপস্থিত। একসময় শুহানি ছুটে এলো অরুকে সঙ্গে নিবে বলে। তন্ময় দ্বিমত করলো। অরুর পাতলা শাড়ি। এভাবে বৃষ্টিতে ভেজার প্রশ্নই আসে না। তার উপর এই মেয়ের অল্পতেই ঠান্ডা জ্বর বেধে যায়।

খাওয়াদাওয়ার পর্ব চুকিয়ে মেয়েদের ভেতরে যাবার নির্দেশ দেওয়া হলো। এবার পুরুষদের পার্টি। তাদের পার্টি বলতে মদ্যপান সহ হাবিজাবি। অরু শুহানির সাথে ভেতরে এসেছে। তার রুমেই বসে। আর সকলের সঙ্গে গল্প মশগুল করতে ব্যস্ত হতে চাইল।কিন্তু পারলো না। তন্ময়ের অসভ্য দৃষ্টি বেপরোয়া ছোঁয়া এখনো মস্তিষ্কে গেঁথে আছে। পিঁড়া দিচ্ছে। বুকের ধুকপুক বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই কী যন্ত্রণা!

ঘড়ির কাঁটা বারোটায় ছুইছুই। অরু কক্ষের দিক যাচ্ছে মাত্রই। ওই ফুলের বাগান নামক কক্ষে যেতেই বুকের উঠানামার গতি বেড়ে যায়। সুগন্ধে মাতোয়ারা হতে বাধ্য হতে হয়। তন্ময় নেই ভেবে সে ব্যস্ত পায়ে ঢুকে পড়লো। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঢুকে সুইচড খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হুট করে পেছন থেকে দরজা লাগানোর শব্দ শোনা গেল। নিস্তব্ধ কক্ষে অতটুকু শব্দ বজ্রপাতের মতো। ভয়ে লাফিয়ে উঠলো অরু। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেল না। প্রশ্ন করবে পূর্বেই বাতি জ্বলে উঠলো। সামনে তন্ময় দাঁড়িয়ে। উষ্কখুষ্ক চুলগুলো কপাল থেকে উঠিয়ে দিল। গভীর নেশাতুর চোখে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টি কম্পন সৃষ্টি করছে যেন৷ অরুর সর্বাঙ্গ শক্ত হয়ে গেল। হাসফাস লাগছে। দমবন্ধ হয়ে আসছে। চোখ তুলে তাকানোর চেষ্টা করল। তন্ময় একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে। মিনিট খানেক চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে থাকলো। যেমন কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।

অরু কী কিছু বলবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য? সেমূহুর্তে তন্ময় চোখ মেলে তাকাল। ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এলো ভাবুক অরুর দিক। বড়বড় পায়ের ধাপ। সেকেন্ডেই সামনে চলে এসেছে। অরুও আনমনে পিছিয়ে বিছানার কাঠের সঙ্গে লেগে গিয়েছে। কোমরে শক্ত ঠান্ডা হাতের স্পর্শ। মুর্তির ন্যায় দাঁড়ানো অরু আতঙ্কিত হয়ে শক্ত করে চোখ বুঁজে ফেলেছে। তন্ময় ততক্ষণে তার ঠোঁট নিজ ঠোঁট দ্বারা আঁকড়ে নিয়েছে। উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। নিজের সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরেছে। তার উত্তেজিত শ্বাসপ্রশ্বাস অশান্ত আজ। বিচলিত হাতের স্পর্শ অরুর সম্পুর্ন শরীরে বিচরণ চালাচ্ছে। থরথর কাঁপতে থাকা অরুকে আজ কোনো সুযোগ দেওয়া হলো না। শ্বাস নেবার সময় দেওয়া হলো না।

ঠোঁট ছেড়ে ঠোঁট অরুর ঘাড়ে নামিয়েছে তন্ময়। তার গলার স্বর আটকে আসছে, ‘একটু মদ খেয়েছি। মাতাল নই। অরু আমার… শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দাউদাউ করে জ্বলছে সবকিছু। ভস্ম করে দিচ্ছে।তুই…তুই কী রাজি? যদি না হয়, তাহলে তুই..না। অরু…. ‘

এতো ব্যাকুল কন্ঠ, অসম্ভব লালচে চেহারা, এই বিচলিত তন্ময়কে দেখে থমকে গেছে অরু। অসম্ভব লজ্জা, দ্বিধা কাটিয়ে চোখ মেলে তাকাল। বুক ভরে শ্বাস নিল। কম্পিত হাত বাড়িয়ে তন্ময়ের পিঠে রাখল। তন্ময় যেমন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। মুহুর্তে অরুকে পাজাকোলে তুলে নিল। ঠোঁটে পুনরায় ডুবে গেল। সাজানো নরম তুলতুলে বিছানায় পিঠ ঠেকল অরুর। সর্বাঙ্গ জুড়ে লাজ। কোথায় হাত রাখবে আর কোথায় দৃষ্টি বুঝে পাচ্ছে না। এদিকে হালকা নেশায় তন্ময় বুদ হয়নি। তবে সেল্ফকন্ট্রোল হারিয়ে বসেছে।

বৃষ্টি থেমেছে। মেঘ সরেছে। আকাশ পরিষ্কার। চাঁদ ভেসেছ। কক্ষের বাতি নেভানো। জানালা দ্বারা দমকা ঠান্ডা বাতাস। উড়িয়ে তুলছে পাতলা সাদা পর্দা। চাঁদের আলো উঁকি মারছে। অরু ছটফট করছে অস্পষ্ট স্বরে। চোখ ভিজে আছে। তার ছোট্ট দেহ তন্ময়ের পেশীবহুল দেহের নিচে চাপা পড়ে আছে। তন্ময় তার মুখের দিকে তাকিয়ে। সর্ব মুখশ্রী জুড়ে চুমু বসাচ্ছে। কাতর গলায় বলে উঠলো আঁধার কক্ষে, ‘অনেক ধৈর্যের ফল তুই আমার। খুব আদরের। অনেক ভালোবাসার। খুব ভালোবাসি তোকে…. আমার জান।’
‘প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল’

৫১.
মাহিনের হাতে সেলফোন। স্ক্রিনে একটি নাম্বার। কল দিতে নিয়েও সংকোচবোধ করছে। হাসফাস করছে। প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ সে। বড়সড় কোম্পানি চালায়। শত মানুষ তার ইশারায় চলে। আর সে কিনা এক পুচকে মেয়ের ঝাঁজালো কন্ঠের স্বরে ব্যাকুল হয়ে গেল। এসব আদৌ মানা যায়? অল্পবয়সী ছেলেদের মতো হৃদয় ব্যাকুল হবার দিন কী তার আছে? তাও আবার একটুখানি মেয়ে! উর্ধ্বে গেলে চার-পাঁচ বছরের গ্যাপ মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু এতটা! মাহিন দ্বিধায় জর্জরিত। মন ভেবে বসলো শুধু একটু কথাই তো। ক্ষতি কী! পুচকে মেয়েটাকে একটু বাজাবে। বেশ খানিক্ষন বিবেচনা করে এই রাতবিরেত কল লাগালো মাহিন। ওপাশে রিং হয়ে যাচ্ছে। রিসিভ হচ্ছে না। শেষমুহুর্তে রিসিভ হলো। শান্ত কন্ঠের স্বরে পকপক করে উঠলো, ‘ওয়ান টু থ্রি ফোর, দ্রুত কথা বলে ফুটে পড়।’

মাহিনের ঠোঁট জুড়ে হাসির বিচরণ। হাসি দমিয়ে শুধালো, ‘আত্নীয় স্বজন কিংবা মুরব্বি কেউ হতে পারতো। তখনো এভাবে কথা বলতে?’
‘দেখেন ভাই! এটা আমার পার্সোনাল নাম্বার। বেস্ট ফ্রেন্ডস ছাড়া কেউ জানে না। তাই মুরব্বিদের কল আসার চান্স নেই। এখন ভালোয় ভালোয় নিজের পরিচয় দিয়ে দেন। কোন ভার্সিটি, কোন ইয়ার, নাম কী, ফোন নাম্বার কে দিল…’
‘আমি মাহিন।’

মারজি থমকে গেল। মনে পড়লো তখনকার ভদ্রলোকের কথা। চাহনি কঠিন হলো। মুখশ্রী শক্ত হলো। কন্ঠের স্বর ঝাঁজালো, ‘কী সমস্যা মিস্টার! ডিস্টার্ব করার ধান্দায় আছেন নাকি! আমার চাচা পুলিশে। কমপ্লেইম করে দিলে সোজা হাজতে বুঝলেন। ভালোয় ভালোয় শুধরে… ‘
‘পড়াশোন কেমন চলছে!’
‘আপনাকে বলবো কেন!’
‘খাওয়া দাওয়া হয়েছে!’
‘এই মিয়া!’

মাহিন নিঃশব্দে হাসলো, ‘হু!’
‘কি ব্যাপার বলেন তো!’
‘ব্যাপারটা একটু ডিফিকাল্ট এক্সপ্লেইন করা। উম, এতো ঝাঁজালো কন্ঠ সচরাচর শোনা হয়না আমার। হঠাৎ শুনেছি তো। নিতে পারিনি। বুকে গেঁথে গেছে। তাই ভাবলাম আরেকবার শুনে নেই।’

কিছুক্ষণ ওপর পাশ হতে নিরবতা। পরপর টুট শব্দে কল কেটে গেল। মাহিন নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকলো। মেয়েটা বড্ড নাজুক, একটু লাজুক ও বটে। শুধু মুখেই সব চঞ্চলতা। এই চঞ্চল মেয়েটাকে মাহিনের দেখার স্বাদ জেগেছে। খুব করে দেখতে ইচ্ছে করছে। কেমন হবে দেখতে? কন্ঠের স্বরের মতো ঝাঁজালো নাকি নরম তুলতুলে? যুবক বয়সে চুটিয়ে প্রেম করেছে কতশত। কই এমন অনুভব তো কখনো করেনি!
_________
তন্ময়ের ধৈর্যের সকল বাঁধ আজ যেমন ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তার ব্যাকুলতা অরুর নরম তুলতুলে শরীরে তুফান উঠিয়ে ছেড়েছে, বিধস্ত করে ছেড়েছে। এখন মধ্যরাত। নিস্তব্ধ, নির্জন কক্ষ। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে তিনটে বিশে। মেঘেদের রাজত্ব শুরু হয়েছে আকাশের বুকে। চাঁদ হারিয়ে গিয়েছে। পুনরায় দেখা মিলেছে কালো মেঘের। চাঁদের আলো বিহীন কক্ষটি আঁধারে তলিয়ে গেল। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পরছে বাহিরে। ভেজা ভেজা শব্দ তুলছে প্রকৃতি। খোলা জানালা দ্বারা দুমড়ে প্রবেশ করছে দমকা হাওয়া, সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা। দু’ধারে মেলে দেওয়া সাদা পর্দা গুলো শান্ত নেই। অশান্ত বেগে দুলছে। কক্ষে ফুলের সুবাস। সুবাস লেপ্টে চারিপাশে। গোলাপ, জবা এমন হরেকরকম ফুলের সুগন্ধী মিলেমিশে অনাকাঙ্ক্ষিত সুবাসের উৎপত্তি ঘটেছে।অরু অর্ধজ্ঞান। আবছায়া হয়ে সবকিছু উপলব্ধি করতে পারছে। তার নিশপিশ চোখের পাতা মৃদু কাঁপছে। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠছে একটু পরপর। মুচড়ে উঠছে শরীর। ব্যথাতুর মায়াবী মুখশ্রী লাল বর্ণে রাঙিয়ে।

তন্ময় পাজাকোলে অরুকে তোলার প্রচেষ্টায়। দু’হাতে তুলতে নিলেই অরু অস্পষ্ট স্বরে কেঁদে দেয়। শরীরে সামান্য নড়াচড়া টুকুও সহ্য করছে না। একেকটি শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গেও ব্যথা জর্জরিত হয়ে আছে যেন। তন্ময় পুনরায় কোমর বেঁকিয়ে ঝুকে। বিছানার চাদর সহ অরুকে হুট করে ফট করে পাজা’কোলে তুলে নেয়। অরুর নাজেহাল অবস্থা! সে চোখ মেলে তাকাতে চায়। জানতে চায় তন্ময় এখনো এমন কেন করছে! তুলতুলে বিছানায় ঘুমোতে কেন দিচ্ছে না! অস্পষ্টভাবে চোখ মেলে তাকায় বহুক্ষণ পর। সে ওয়াশরুম। তন্ময় তাকে আড়ষ্টভাবে জড়িয়ে। পরপর ঠান্ডা পানি শরীর ছুঁতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। মৃদু আর্তনাদ করল, ‘জ্বলছে!’

তন্ময়ের ধীর গলার স্বর ‘একটু সহ্য করে নে জান।’

চোখের কোণ ভিজে গিয়েছে অরুর। শরীর জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে যেন। তন্ময়ের বাহু থেকে ছোটার আপ্রান চেষ্টা। তাকে ছোটার সুযোগ দেওয়া হলোনা। পুনরায় একজোট পানি এসে ছুঁয়ে গেল। গোসল করতে হচ্ছে! এতরাত করে! তন্ময়ের হাতে! তাও ঠান্ডা আবহাওয়ায়। লজ্জায় হতভম্ব অরুর জমিন ফাঁক করে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। তবে সেই শক্তিটুকুও নেই। সে’তো অজ্ঞান হবার পথে।

সোফায় শুয়ে আছে অরু। জড়সড় হয়ে। শরীরে শার্ট জড়ানো। তন্ময় শুইয়ে দিয়ে গিয়েছে কিছুক্ষণ হবে। অস্পষ্ট ভাবে শুনতে পারছে ওয়াশরুম হতে আসা পানির শব্দের। তন্ময় গোসল নিচ্ছে। সময় নেয়নি বেশি। খুব দ্রুত ফিরে এসেছে। কোমরে তোয়ালে পেঁচানো। এসেই বিছানায় নতুন চাদর বিছিয়ে নিয়েছে। ইতোমধ্যে অরুকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে। পাতলা কম্বল শরীরে মেলে রেখেছে। জানালার পর্দা টেনে দিল। তবে জানালা লাগালো না। মেলে রাখল। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। অরু বিছানায় হাসফাস করছে। ছটফট করছে। বড্ড অশান্ত সে। যন্ত্রণায় পেট গুলিয়ে আসছে। তন্ময় প্যান্ট পরে ফিরে এসেছে। আলগোছে অরুর পাশে বসেছে। কপালে হাত ছুঁয়েছে। ভেজা চুল মেলে দিয়েছে, ‘খুব খারাপ লাগছে?’

দুর্বল হাতে অরু তন্ময়ের হাত ধরলো। হালকা টান লাগালো। অনুসরণ করে তন্ময় বিছানায় পা ওঠাল। পাশে শুয়ে পড়লো। অরু মুহুর্তে তন্ময়ের খোলা প্রসস্থ বুকে থুবড়ে লেপ্টে গেল। আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। এতটুকু ব্যথা সে চুপসে সহ্য করে নেবে, যদি তন্ময় তার পাশে থাকে। তার কাছে থাকে। তাকে ধরে রাখে। তার যত্ন করে। আদর করে। তাকে আদুরে গলায় ছোট নামে ডাকে! এসবের জন্যে হলেও অরু এতটুকু কষ্ট সহস্রবার সুগভীরে মেনে নিবে। দুর্বল কন্ঠে বলল, ‘খারাপ লাগছে না আমার। একটুও লাগছে না।’

তন্ময় অরুর মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছে সমানে। কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে। মুখশ্রী করুণ দেখাল। ব্যাকুলতা আষ্ঠেপৃষ্ঠে লেপ্টে রয়েছে। বড্ড হেল্পল্যাস লাগছে তাকে। অরুর পিঠে থাকা হাতের বাঁধন দৃঢ় হল। আঁধার কক্ষে তার গলার স্বর বড়ো গভীর, ‘তোর সব কষ্ট আমার হোক।’
___________
‘শাবিহা!’

নরম মৃদুস্বরে নড়েচড়ে ওঠে শাবিহা। চোখ মেলে তাকায়। মুখের সামনে ঝুকে অয়ন। পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে। শাবিহা ভড়কে গেল। অয়ন শুধালো, ‘খিদে পেয়েছে না!’

শাবিহাকে মুহুর্তে চিন্তিত দেখাল। হাত ঘড়িতে রাত তিনটা ত্রিশ। এতরাত করে কোনো হোটেল রেস্টুরেন্ট কি খোলা? তার খাবারের বিষয়টা মাথায় আসেনি। আরাম পেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অসহায় গলায় বলল, ‘আশেপাশে হোটেল আছে? এতরাতে খোলা পাব?’

অয়ন হাসলো, ‘খাবার নিয়েছি।’

চমকাল শাবিহা, ‘কখন?’
‘তুমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন যখন।গাড়িটা কোথাও সাইড করে নেই। প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে তাই না? আমারও। আজ জম্বেশ খেতে পারবো বুঝলে। খাবার গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধে থাকবে না!’

শাবিহা অগোচরে তাকাল। মন খারাপ করল। নিঠুর অয়ন! কি সুন্দর অনায়াসে বলে দিল। কই শাবিহাও তো পর্যাপ্ত ঘুমোতে পারেনি, খেতে পারেনি। সে তো এভাবে বলতে যাচ্ছে না। অয়ন পুনরায় গাড়ি স্টার্ট করেছে। শাবিহা আলগোছে নিজের পেট ছুঁয়ে দিল। আসলেই অসম্ভব খিদে পেয়েছে তার। চোখের তৃষ্ণা মিটেছে ওমনি পেটের গহ্বর বেজে উঠছে।

বৃষ্টিস্নাত রাতে গাড়ি মেঠোপথ ধরে যাচ্ছে। কাঁচে স্পষ্ট বৃষ্টির রেখা বইছে। বাহিরে সবুজ গাছপালাদের ভেজা-ভেজা দৃশ্য। রাস্তাঘাট পরিষ্কার এবং নির্জন। আশেপাশে গাড়ি নেই। শুধু তাদের গাড়ি একান্তই ছুটে যাচ্ছে। শাবিহা দু’বার কাঁচ নামিয়েছে। অয়ন নির্বিকার ভঙ্গিতে লাগিয়ে দিয়েছে। খুলতে দিচ্ছে না। শাবিহা শক্ত চোখে তাকাল, ‘কি সমস্যা!’
‘অনেক সমস্যা!’
‘পাগল।’
‘শুধু তোমার জন্য।’

বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো অয়ন। শাবিহার মুখশ্রীতে রাগরাগ ভাব লেপ্টে। তবে সত্যিকার অর্থে তার রাগ লাগছে না। বরং আড়চোখে অয়নের হাস্যজ্বল মুখশ্রী দেখে, তারও হাসতে ইচ্ছে করছে।
অন্যপাশ ফিরে নিঃশব্দে হেসেও নিল। নিস্তব্ধতা ভেঙে বলল, ‘কাঁচ নামাতে দিচ্ছ না কেন!’
‘এসি ছাড়া!’
‘বন্ধ করে দাও।’
‘বৃষ্টি আসে।’
‘ফোঁটা ফোঁটা! ঝুম বৃষ্টি নামেনি তো।’
‘ভিজে যাবে। ঠান্ডা লাগবে।’
‘অয়ন তুমি কী খুলবে?’

এসি বন্ধ করে অয়ন কাঁচ নামিয়ে দিল শাবিহার পাশের। মুহুর্তে ঠান্ডা হাওয়া বেগতিক বেগে ছুটে এলো। চোখমুখে ছিটিয়ে দিল ঠান্ডা বৃষ্টির স্পর্শ। চোখবুঁজে এলো শাবিহার। শান্তিতে বুকে স্রোত বইছে। চোখ মেলে তাকাল। স্বতঃস্ফূর্ত নিয়ে বলল, ‘গান ছাড়ো!’

অয়নের ইচ্ছে করছে গাড়িটা থামাতে। অনিমেষ নজরে শাবিহাকে দেখতে। কতটা আদুরে লাগছে সেটা কী জানে? একনজর দেখে হাত বাড়িয়ে রেডিও ছাড়লো। একটা গান প্লে হচ্ছে। বৃষ্টির দিনে বৃষ্টির গান। গানটি শাবিহা বেশ কয়েকবার শুনেছে। একসময় বেশ জনপ্রিয় ছিল। এখনো অনেকেই শোনে। গানের সঙ্গে অয়ন শব্দ করে গাইতে শুরু করলো,
‘রিমঝিম এ ধারাতে চায় মন হারাতে
এই ভালোবাসাতে আমাকে ভাসাতে।
এলো মেঘ যে এলো ঘিরে
বৃষ্টি সুরে সুরে শোনায় রাগিনী।
মনে স্বপ্ন এলোমেলো,
এই কি শুরু হল প্রেমের কাহিনী ।

হুট করে ঘুরে তাকাল অয়ন। দৃষ্টি ঠেকল শাবিহার অপলক মুগ্ধ নয়নে। চোখাচোখি হলো। শাবিহা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ব্যস্ত হাতে চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজতে লাগলো। অয়ন শব্দ করে হাসলো। দৃষ্টি সামনে রেখে বলল, ‘তুমি একজন বেস্ট ভাই পেয়েছ শাবিহা!’
‘হু? হ্যাঁ। সে তো সর্বদাই বেস্ট। সবকিছুতে বেস্ট!’
‘তন্ময় ভাই আর অরুর বিয়েটা মেনে নিয়েছে? কোনো গন্ডগোল হয়নি?’

শাবিহা ভাবুক হয়ে পড়লো, ‘সপরিবার রাজি। শুধু আত্নীয় স্বজন নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছিল। এখন ঠিকাছে। অরু ছোটো। সবে ইন্টার শেষ করেছে। বাবা এরজন্য দোটানায়। ভাবছে অরুর উপর চাপ না পড়ে যায়। পড়াশোনায় অমনোযোগী না হয়ে পড়ে!’
‘অরু তো পাগল তন্ময় ভাইয়ের জন্য। ছোটাছুটি করতে থাকে পিছেপিছে। ওকে বেশ হ্যান্ডেল করতে পারে ভাইয়া। বিয়েটা মেনে নিলে তো আরও ভালো হয়। পড়াশোনায়ও দুর্দান্ত করবে।’
‘এখনই না। অনুষ্ঠান করবে। বছর খানেক সময় নিবে হয়তো!’
__________
নতুন দিনের সূচনা। রাতের বৃষ্টির ছিটেফোঁটা নেই। সূর্য উঠেছে। সাদা পাতলা পর্দা ভেদ করে আসছে আলো। অতিষ্ঠ হয়ে চোখ মেলে তাকাল অরু। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলো সিলিন ফ্যানের দিক বেশ কিছুক্ষণ। অদ্ভুত সব দৃশ্য মস্তিষ্কে হানা দিতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। দ্রুত পাশে ফিরল। তন্ময় নেই। কক্ষের কোথাও নেই! স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে, উঠে বসতে নিতেই লজ্জায় কুঁচকে গেল। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেললো। এসব কী হয়ে গেল! অরু বাকরুদ্ধ! বিমুঢ়! বড্ড অস্থির। গলা শুকিয়ে কাঠকাঠ। শুকনো ঠোঁট জোড়া জিহ্বা দ্বারা ভিজিয়ে নিল। কম্বল সরাতে নিয়ে আবারো পেঁচিয়ে নিল। তন্ময়ের শার্ট শরীরে শুধু। ইশ!

অরুর বক্ষস্থলে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ধুকপুক ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। মস্তিষ্কে বেজে উঠছে তন্ময়ের বলা সব আদুরে কথাবার্তা। দূর হতে পায়ের শব্দ ভেসে আসছে। অরু হন্তদন্ত ভঙ্গিতে পুনরায় শুয়ে পড়েছে। কম্বল মাথা অবদি টেনে নিয়েছে। নিজেকে পুরোপুরি লুকিয়ে রেখেছে। এই মুখ সে তন্ময়ের সামনে কীভাবে নিবে! অরু বেশ উপলব্ধি করতে পারছে একজনের অস্তিত্ব। তন্ময় বিছানার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কম্বল মুখের সামনে থেকে নামাতে চেয়েছে। অরু শক্ত করে ধরে রাখল। তন্ময় ডাকল, ‘অরু!’

অরু অস্পষ্ট স্বরে আওড়াল,’হু।’

জবাব দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। মুখটা এতো আগে আগে চলে কেন! তন্ময় বলল,’উঠে বোস। খেয়ে নে প্রথমে। ওষুধ খেতে হবে।’
‘না।’
‘আমার দিকে তাকিয়ে বল।’

অরু নাকমুখ কুঁচকে রাখল। ধমকানো হচ্ছে! রাতে, জানপ্রাণ, শোনা কে ডাকল! অরু নির্লজ্জ হলে ঠিক মুখের উপর বলে দিতো। দুষ্টু লোক! তন্ময় কিছুটা শক্তি প্রয়োগ করেই সরিয়েছে কম্বল। অরু এবার দু’হাতে মুখ ঢেকে রাখল৷ কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে তাকাল৷ দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলে গেল। তাজ্জব বনে অরু আবারো শক্ত করে চোখ ঢেকে ফেললো। তন্ময়ের গলার স্বর নরম হয়ে এলো,
‘খারাপ লাগছে? ব্যথা হচ্ছে?’

লালিত মুখশ্রী ঢেকে রাখা অরু মাথা নাড়াল, ‘অল্প!’
‘ঔষধ নিলে চলে যাবে।’

অরু হাত সরাল। আঁড়চোখে তাকাল। তন্ময় প্যান্ট শার্ট পরে ফিটফাট হয়ে আছে। পারফিউম ঘ্রাণ আসছে নাকে। অরুর চোখের সামনে ভেসে উঠল তন্ময়ের নগ্ন সুঠাম দেহের দৃশ্য। লজ্জায় কাবু হয়ে পড়লো মুহুর্তে। অরুকে চমকে তন্ময় হুট করে মাথা ঝুকাল। তার ঠোঁটে শক্ত চুমু খেয়ে বসলো আচমকা। বড়সড় চোখে তাকানো অরুর ঠোঁটে আরেকদফা চুমু পড়লো।

ব্রেকফাস্ট খাওয়া হয়েছে। ঔষধ তন্ময় নিজ হাতে এগিয়ে দিয়েছে। অরু প্রশ্ন করল, ‘কীসের ওষুধ?’
‘ব্যথার।’

অরু মুখে পানি নিয়ে খেল। পরপর আরেকটি ওষুধ এগিয়ে দিল তন্ময়। অরু এবারও প্রশ্ন করল, ‘এটা কীসের ওষুধ?’
‘চুপচাপ খা।’

বাইরে থেকে ইব্রাহিমের চওড়া গলা শোনা যাচ্ছে, ‘তন্ময় তাড়াতাড়ি আয়। দেখে যা…’
‘আসছি।’

তন্ময় পুনরায় অরুকে বলল, ‘খা।’
‘খাচ্ছি তো।’
‘খেয়ে নে, আমি একটু আসছি।’

টেবলেট তালুতে দিয়ে দরজার দিক অগ্রসর হলো। দরজার সামনে থেকে ফিরে তাকাল। পুনরায় খেতে বলে গেল৷ এতো তাড়া কীসের! অরু টেবিলের দিক এগোল৷ টেবলেটের পাতা রাখা। এখান থেকেই ওষুধ বের করেছিল। অরু নাম দেখল! কী মনে করে গুগলে নাম লিখে সার্চ করলো। ‘বার্থ কন্ট্রোল’!
সময় নিয়ে পড়লো। সবকিছু জেনে সে আর টেবলেট খেল না। আলগোছে জানালা দিয়ে ফেলে দিল।
____________
চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক’
_________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here