ফিলোফোবিয়া পর্ব -০১

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির)

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

বাবার আবদারে প্রচন্ডরকম ক্ষে*পে উঠল প্রিয়। চেঁচিয়ে বলল,
‘ বড় বোন হয়েছি বলে এই না যে, বিয়ের যৌতুক হয়ে ওর শ্বশুরবাড়িতে যেতে হবে আমাকে।’
জাফর রহমান বিরক্তির ভঙ্গিতে বলল,
‘ আহা! যৌতুক হয়ে যাবি কেন? তোর জন্য তাদের বড় ছেলের সম্বন্ধ এসেছে। বলেছে..’
‘ কি বলেছে? যদি তাদের বড় ছেলের সাথে আমার বিয়ে হয় তবেই প্রভাকে ঘরের বউ করবে নয়তো না। তাই তো?’
জাফর সাহেবের মলিন মুখ, অর্থাৎ কথা সত্য। প্রিয় রাগ চেপে শান্ত গলায় বলল,
‘ আব্বা এটাকে সম্বন্ধ না শর্ত বলে। আর আমি কোন ব*লির পাঁঠা নই যে সু*লে চ*ড়ে যাবো।’
‘ছেলের সরকারি চাকরি। ডাক্তার। বিসিএস উত্তির্ন।’
‘ নামের পিছনে বিসিএস শুনেই বুঝি বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছ। তাদের ছেলের জন্য মেয়ের অভাব? নাকি বুড়ো ছেলের জন্য বউ খোঁজা মুশকিল।’
মেয়ের তিক্ত বুলিতে জাফর সাহেব হকচকিয়ে উঠলেন। কি বলা উচিত বুঝতে পারছেন না তিনি। খাবার টেবিলে পিনপতন নীরবতা। মুখোমুখি চেয়ারটায় বসে আছে প্রভা। আড়চোখে বোনের দিকে চাইল একবার। মিনমিনিয়ে বলল,
‘ তুই যেমন করে বুড়ো বলছিল উনি মোটেও বয়স্ক নয়। মাত্র টুয়েন্টি নাইন প্লাস।’
খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো প্রিয়। হাত ধুতে ধুতে কর্কশ কন্ঠে বলল,
‘ আমি আগেই জানিয়েছি কোন ডাক্তারকে বিয়ে করব না।’
‘ কেন করবিনা তোর এক্স ডাক্তার বলে?’
মুখ ফুসকে বলে ফেলল প্রভা। পরিবেশ গম্ভীর হলো। জাফর সাহেব মেয়েদের দিকে নিশ্চুপ তাকিয়ে।
‘ এমন মেরুদণ্ড ভা*ঙ্গা ছেলের সাথে প্রেম করতে গেলি কেন যার বউ হতে হলে শর্ত মানতে হবে পরিবারের।’
প্রভা তেতে উঠল এবার। আরমানের বি*রুদ্ধে কোন কথা শুনবে না সে। মানুষটা তাকে কত ভালোবাসে। বোনকে উদ্দেশ্য করে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
‘ অন্তত তোর এক্সের মত মেরুদণ্ডহীন তো নয়! বিয়ে করার ভয়ে মাঝরাস্তায় পালায়।’
ধমকে উঠল প্রিয়,
‘ মাত্রা ছাড়াচ্ছিস প্রভা!’
‘ ভাইয়ার মত তুইও স্বার্থপর আপু। শুধু নিজেরটাই বুঝিস। তোকে নিয়ে বাবা মায়ের কতটা চিন্তা সেদিকে কখনো লক্ষ করেছিস? শুধু ডাক্তারকে কেন, দুনিয়ার কোন ছেলেকেই বিয়ে করতে পারবিনা তুই। লোকে তোকে ঠিক বলে, ফিলোফোবিয়ার রোগী! প্রেম ভালোবাসায় ভয়। মানুষিক সমস্যা আছে তোর।’
ক্রো*ধে আশ্রুতে চিকচিক করছে প্রিয়’র চোখ। ভারী-ভারী নিশ্বাস ফেলে বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
‘ বোজা মনে হলে বলে দেও বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাই। বিবিএ কমপ্লিট হতে আর এক বছর তারপর এমনিতেই চাকরি খুঁজে ঢাকার বাহিরে দূরে কোথাও শিফট হয়ে যাবো। আর প্রভা তোকে বলছি, আমি তোর বোন। মা নই যে তোর জন্য নিজের জীবন বিস*র্জন দিবো। এই বিয়ে আমি করব না।’
বলেই হনহন করে নিজের ঘরে চলে গেল প্রিয়।
রান্না ঘর থেকে আড়ি পেতে সবটা শুনলেন আমেনা বেগম। বুক চি*ড়ে শ্বাস ফেলল হতাশ। এখন আর তার আশ্চর্য হয়না। এতবছরে এসব কোলাহলে অভস্ত হয়ে গেছেন তিনি। আজকাল তিনবেলা খাবারের মত পারিবারিক কোলাহলটাও যেন ডেইলি রুটিনে যোগ হয়েছে। এসব হৈচৈ ঝামেলা নিয়ে ভাবেন না তিনি। কিন্তু বড় মেয়ের ছন্নছাড়া জীবন নিয়ে ভীষণ চিন্তা হয়। বয়স তো আর কম হলোনা। প্রেম বিয়ে নিয়ে মেয়েটার এতো বি*রোধ, এত ভয়! আগে তো এমন ছিলনা। হ্ঠাৎ কি এমন ঘটলো! যে তার সেই হাস্যোজ্জ্বল প্রাণবন্ত মেয়েটাকে এতোটা বদলে দিলো । ঘিরে নিলো শক্তপোক্ত অন্ধকারের তি*ক্ত আদতে।

রাত দেড়টা। চারিদিক ডিসেম্বরের কুয়াশায় মাখানো। নিশ্চুপ অন্ধকার। দূরে রাস্তায় বেওয়ারিশ কুকুরদের আনাগোনা। ঘুম নেই প্রিয়’র। বারবার ঝাপসা হচ্ছে চোখ। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে অনবরত। আজ সন্ধ্যায় প্রভার বলা কথা গুলো তার মনে ভীষণ ছাপ ফেলেছে। সত্যি কি সে ফিলোফোবিয়াতে আক্রা*ন্ত? যেই কারণে প্রেম ভালোবাসায় তার ভ*য়! ভালোবাসা নামক অনুভূতির প্রতি এত বেশি ঘৃ*ণা। ছেলেদেরকে এত ভ*য়। কিন্তু কেউ কি জানে এই ফিলোফোবিয়া রোগী হওয়ার পেছনের অজানা সেই ভ*য়ঙ্কর গল্পটা? চোখের আড়ালে বুকে বিঁ*ধে থাকা নির্ম*ম ধারা*লো সত্যটা!
আচমকাই চোখের সামনে পুরানো স্মৃতির দ্বীপ জ্ব*লে উঠল। আবছা করে খুব পরিচিত একটা মুখ ভেসে উঠল। ফিসফিসিয়ে কিছু বলল। স্মৃতির পাতা উল্টে গিয়ে থামলো কোন এক ডিসেম্বরের বিকেলে।

অতীত,

দুইহাজার এগারো। বছরের শুরুটা বড় আপার বিয়ে নিয়ে যতটা আনন্দ উল্লাসে হয়েছিল, শেষটা ঠিক ততটাই বিষ*ন্নতায় ঘেরা ছিল। সংসার জীবনের মাত্র আটমাসের মাথায় আপার ডিভোর্স। তারপর সমাজের ক’টুকথা আর ডি*প্রেশনে হাঁপিয়ে গিয়ে গলায় দ*ড়ি দিয়ে সুই*সাইট! শুনতে যতটা সহজ শোনাচ্ছ ঘটনাটা ঠিক ততটাই জোরদার আঘা*ত করে গেছে প্রিয়’র পরিবারকে। চোখের সামনে নিমি*ষেই যেন সব শেষ। সকালে ঘুম ভা*ঙ্গার পর, মাথার উপর নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষের ঝু*লন্ত লা*শ দেখে সহ্য করতে পারেনি প্রিয়। ঘটনাটি প্রিয়’র ছোট্ট মনে ছাপ ফেলে যায় ভ*য়ংকর। সেদিন থেকে ডিপ্রে*শন প্যা*নিক এ*টাক হয়ে গেল নিত্যদিনের সঙ্গী। দিনদিন অবস্থা খারাপ থেকে আরো খারাপ হচ্ছিলো। প্রিয়’র এমন অবস্থা দেখে বড় খালা আয়েশা বেগম সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রিয়’কে তার সঙ্গে ইমান্দিপুরে নিয়ে যাবেন। শালির প্রস্তাবে অমত করলেন না জাফর সাহেব। বড় শালির উপর যথেষ্ট ভরসা আছে তার। শিক্ষিকা মানুষ, তার কঠোর নজরদারিতে মেয়ে পথভ্রষ্ট হবেনা। তাছাড়া ডাক্তার বলেছে, পরিবেশ বদল হলে ধীরেধীরে মেয়ে স্বাভাবিক হবে। ছোট মেয়েটা যথেষ্ট স্ট্রং আর ছোট। মেজো মেয়েটা বরাবরই কোমল। সবে কৈশোর কাটিয়ে যৌবনের দিক পা বাড়িয়েছে। মানসিক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটছে। বড় বোনের মৃ*ত্যুর সময় একমাত্র সেই পাশে ছিল। সেই থেকেই অনুতপ্ত অনুশোচনায় মানসিক ভাবে অসু*স্থ হয়ে পড়েছে। মেয়ের ভবিষ্যৎ আর মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে, শো*কের ছায়া থেকে বেরিয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিলেন জাফর সাহেব। এসব ঝামেলার মাঝে মেয়েকে আর রাখবে না। বড় শালির সাথে ইমান্দিপুরে পাঠাবেন। সেখানে খালার কাছে থেকে পড়াশোনা করবে প্রিয়।

ডিসেম্বরের পাঁচ তারিখ বাবার কথামতো দুপুরের পরপর-ই বড় খালার সাথে ইমান্দিপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলো প্রিয়। অনেকদিন পর বদ্ধ ঘর থেকে বেরিয়ে প্রশান্তির শ্বাস ফেলল। গাড়ির জানালায় মাথা হেলিয়ে দূর নভোমণ্ডলের পানে চেয়ে রইল। হিম হাওয়ায় দুলছে অবাধ্য কেশ। আলস্যে লেগে আসছে চোখ।
শীতকালের বিকাল। পাঁচটা বাজতে না বাজতেই চারিদিক অন্ধকারে তলিয়ে যেতে শুরু করে। দীর্ঘ জ্যামজট কাটিয়ে তিন ঘন্টার মাথায় গন্তব্যে পৌঁছালো । মিচমিচে কালো পিচ ঢালাইর রাস্তা ধরে গলির শেষ মাথায় দোতলা বাড়ির সামনে গাড়ি থামল। এটা প্রিয়’র নানা বাড়ি। মায়েরা তিন বোন। নানা নানী বড় খালা থাকতেন এই বাড়িটায়। ছোট খালা পরিবার সহ দেশের বাহিরে সেটেল্ড। ছোটবেলায় মায়ের সাথে এখানে আসা হতো খুব। নানা নানী মা*রা যাবার পর তেমন আসা হয়না আর। শেষ এসেছিল দুইবছর আগে বড় আপার সাথে গ্রীষ্মের ছুটিতে। পুরো এক সাপ্তাহ ছিল। দু’বছরে এখানকার রাস্তাঘাট পরিবেশ অনেক কিছু পাল্টেছে। আজ বড় আপা থাকলে দিনটা নিশ্চয়ই অন্যরকম হতো! হ্ঠাৎ বড় আপার কথা মনে করে প্রিয়’র মুখ মলিন হয়ে এলো।

‘ আহা! টলির চাকা ভা*ঙ্গবে আস্তে নামাও।’
বড় খালার আওয়াজে ঘোর কাটল। ড্রাইভার টেক্সি থেকে ব্যাগপত্র নামাচ্ছে। প্রিয়’র হাতে চাবি ধরিয়ে খালা বলল,
‘ যা গিয়ে দরজা খুল আমি ব্যাগপত্র নিয়ে আসছি’
‘ আমার হাতে কিছু দেও নিয়ে যাই’
‘ ভারী ব্যাগ পারবিনা তুই।’
জোর করল প্রিয়, শুনল না খালা। একপ্রকার ঠেলে ভিতরে পাঠাতে চাইল। যেই গেটের দিকে পা বাড়াবে অমনি এক পুরুষালি আওয়াজ কানে এলো। ছেলেটা খালাকে সালাম জানিয়ে বললেন,
‘কেমন আছেন?’
‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভালো, তোমার কি খবর?’
‘ ভালো’
‘এডমিশন টেস্টের প্রস্তুতি কতদূর?’
‘ এইতো চলছে। কোথাও গিয়েছিলেন?’
‘ হ্যাঁ, ছোট বোনের বাড়িতে।’
ছেলেটা ব্যাগপত্র দেখে বলল,
‘ সাহায্য করবো?’
‘ তার দরকার নেই আমরা পারবো। কোথাও যাচ্ছিলে নাকি?’
‘ হ্যাঁ, মোরের মাথায় বাবার সমাবেশ।’
‘ একদিন বিকালে সময় করে এসো চায়ের আড্ডা দিবো।’
‘ আসবো।’
এক গাল হেসে ছেলেটা চলে গেল। ছেলেটা কিছুদূর যেতেই খালা বলতে শুরু করল,
‘ জানিস প্রিয় ও আমাদের পাড়ার সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। আমারই ছাত্র। চোখের সামনে বড় হতে দেখা, ক্লাস টু থেকে সিক্স পর্যন্ত পড়িয়েছি। পড়ালেখায় বেশ তুখোড়। চিনেছিস? ‘
প্রিয় থম মে*রে খালার দিক তাকিয়ে থাকল। সে কি করে চিনবে? খালা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘আরে ভুলে গেলি? সেইবার গ্রীষ্মের ছুটিতে এসে মেলায় হারিয়ে গেলি একটা ছেলে তোকে খুঁজে এনেছিল? শতাব্দ। ওই তো সেই শতাব্দ!’
প্রিয়’র মনে পড়ল। এই লোকটাকে কি ভুলা যায়? সেই দিনের ধমকের কথা আজীবন ভুলবে না সে। কোনদিন না। কি ঝাড়াই না ঝেড়েছিল তাকে। যদিও সেদিন দোষটা প্রিয়’রই ছিল। হোক! তাই বলে কি এভাবে ধমকাবে?
প্রথমে ছেলেটাকে চিনতে পারেনি। না চেনার অবশ্য কারণ আছে। আগের থেকে আরো বেশি লম্বা হয়েছে। দুবছরে চেহারায়ও বেশ পরিপক্বতা এসেছে।
খালা গদগদ করে বলতে লাগল,
‘ গতবছর ঢাকা মেডিকেলে ট্রায় করেছে, এক নাম্বারের জন্য চান্স পায়নি। তাই এবার আরো ভালো প্রস্তুতি নিয়ে চেষ্টা করছে। হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। ভীষণ ভালো ছেলে। আন্তরিকতা দেখেছিস? ব্যবহারে কোন দম্ভোক্তি অহংকার নাই। কেউ বলবে এখানকার চেয়ারম্যানের ছেলে? এইতো এই পাশের বড় বাড়িটা ওদের। কি ভালো ছেলে। মাই ফেভারেট। ভেরি..ভেরি গুড বয়।’
ছেলেটাকে নিয়ে খালার বাংলা থেকে ইংরেজি অবধি প্রশংসা শুনে খানিক বিরক্ত হলো প্রিয়। এতটা পথ জার্নি করে ছেলেটার প্রশংসা শুনতে এখন একদম ভালো লাগছেনা তার। বিরক্তির মুখ করে বলল,
‘ বাবা চেয়ারম্যান, এতটাকা। ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাওয়ার জন্য ঘুরছে কেন? কোন প্রাইভেট হাসপাতালে পড়লেই পারে। ঝামেলা শেষ। তাছাড়া ডাক্তারি করে আর কয়টাকা বেতন? বাবার সাথে রাজনীতি করলেই তো হয়।’
ভাগ্নীর মুখে ছাত্রের বি*রুদ্ধে এমন কথা শুনে মোটেও ভালো লাগলো না আয়েশা বেগমের। অনেকটা ঝাঁ*জালো কন্ঠেই উত্তর দিলেন,
‘ বললি তো গণ্ডমূর্খদের মত কথা! ঢাকা মেডিকেল কলেজ আর প্রাইভেট মেডিকেল এক হলো? আর জীবনে কি টাকাই সব? ডাক্তারি প্রফেশনের মর্ম তুই ফেল্টু কি বুঝবি!’
খালার কথায় মুখ কালো হয়ে এলো প্রিয়’র। সহজে রেগে যাওয়ার মানুষ না তিনি । সে কি এমন বলল? যে রেগে গেল। তার প্রিয় ছাত্রের বিরুদ্ধে বলেছে বলেই কি!
ভ্রু কুঁচকে দূর কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তায় হাঁটতে থাকা মানুষটার দিকে তাকাল একবার, কালো হুডি পকেটে হাত। বেশ হাঁটছে। মানুষটা কি জানে, তাকে নিয়ে এখানে ছোটখাটো যুদ্ধ হয়ে গেল একখান?

চলবে কি?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here