বউ পর্ব শেষ

গল্পঃ বউ ( ৫ম ও শেষ পর্ব )

মীরা আমি মুখোমুখি দাড়িয়ে, মীরার জবাবের অপেক্ষায়। মীরা যদি বলে সে আমার থেকে মুক্তি চায়, তবে এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাবার প্রস্তুতি নেয়া আমার। এ জীবনে আর কখনও মীরার সামনে এসে দাড়াবো না। একতরফাও ভালোবাসা হয়, আমি নাহয় দূরে থেকেই, নিজেকে আড়ালে রেখেই মীরাকে ভালোবেসে যাবো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

আপনি যদি সত্যিই কাউকে ভালোবাসেন দেখবেন তার হাসিতেই আপনার আনন্দ, তার দুঃখেই দুঃখ, তা নাহলে সেটাকে ভালোবাসা বলেনা। আমিহীন মীরা যদি নিজেকে মুক্ত মনে করে, যদি সুখী হয়, তবে সেই সুখের জন্য দুঃখ যন্ত্রণা আমার জীবন সঙ্গী করে মীরাকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত আমি। ভালোবাসা সুখে থাক। এটাই কাম্য।

মীরা চুপচাপ আছে বলে বললাম,– এই প্রেশার আর নিতে পারছি না মীরা, তুমি কি চাও, সোজাসাপটা জবাব দাও।

এমন মূহুর্তে হঠাৎ মজনুর উদয়, সে আমাদের কথায় নাক গলিয়ে বললো,– এই ভরদুপুরে এগুলা কি, এইডা কি জবাব চাওয়ার সময়! কেন সারারাত দুই স্বামী স্ত্রী কি মশা মারছো, তখন জবাব টবাব যাকিছু চাবার চাইলেই তো পাইতা। কি ঘটনা কি, কিসের জবাব মোরে কও দেহি।

আমি বললাম,– না মানে আমাদের পার্সোনাল ব্যাপারে কথা বলছি।

মজনু বললো,– পার্সোনাল ব্যাপার নিয়ে রাতে রুমের দরজা বন্ধ করে আলাপ কইরো তোমরা, মুই তো শ্যাষ।

আমি অবাক হয়ে বললাম,– শ্যাষ মানে?

মজনু আমার হাত ধরে টেনে ওর রুমে নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে বললো,– আয়াম ইন লাভ। মজনু এখন পিওর লাভার।

আমি বললাম,– পিওর লাভার, তা-ও এক ঘন্টায়! বাহ মজনু ভাই। আলোর গতিতে ভালোবাসা, এখানে তো বিজ্ঞানও হেরে গেল মনে হচ্ছে!

মজনু গম্ভীর গলায় বললো,– ইতিহাসের পাতা ঘাটাঘাটি করিয়া কোথাও খুঁজিয়া পাইলাম না যে ভালোবাসা বিজ্ঞানের ধার ধারে! আরও শুনছি বিশাল বিশাল বিজ্ঞানীও ভালোবাসার কাছে কট খায়, ভালোবাসা বিজ্ঞানীর কাছে কট খায়না।

আমি বললাম,– তাই বলে ফাইব-জি স্পিডে প্রেম।

মজনু আবারও গম্ভীর গলায় বললো,– ভাই প্রেমে পড়তে সময় লাগেনা যদি মন সায় দেয়। যেমন চলার পথে হাজার জনকে ভালো লাগে, কিন্তু হাজার জনের প্রেমে আমরা পড়ি না। একজনকে দেখে হৃদয় আন্দোলিত হয়, নিজের অজান্তে মন তার মাঝে হারিয়ে যায়, মনে হয় এই মানুষটাকে পেলে জীবনে সুখী হবো, এই মানুষটাকে পেলে জীবন পরিপূর্ণ হবে। এই তো মনের কাম, এর জন্যই আরশিকে মুই অলরেডি দিল দে চুকি সানাম, বোজজো মোর কথা?

আমি বললাম,– আসলেই আজ তোমার কথা প্রমাণ করলো তুমি সাচ্চা দিলের মজনু। শুভ কামনা তোমাদের জন্য।

এদিকে মার্কেট থেকে ফেরার পথে মিমের পথ আটকে দাড়ায় বজলু ভিলেন, কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তল বের করে নলের ডগায় হাত বুলাতে বুলাতে মিমকে বললো,– এই বজলু ভিলেনের বুলেট প্রুফ হৃদয় ভেদ করে বহু আগেই তোমার প্রেমের বুলেট হিট করছে মিম, আমার হৃদয় তোমার প্রেমে জর্জরিত। কবিরাজ বলেছিলেন– জেনেশুনে বিষ করেছি পান।

মিম অবাক হয়ে বললো,– কবিরাজেরা কবিরাজি ছেড়ে গীতিকার হওয়া শুরু করলো কবে থেকে আবার!

বজলুর শিষ্য ওসমান বললো,– আপা এই কবিরাজ মানে কবিদের রাজ, ওস্তাদ অতি আবেগে ভুলভাল বকতেছে।

বজলু আবার বললো,– এই বজলু ভিলেনের পিস্তলের ডগায় দুনিয়া কাঁপে, কিন্তু সেই পিস্তলের ডগা তোমার সামনেই কাঁপে, ভাবাযায় এগুলো।

ওসমান বললো,– ওস্তাদ তাইলে সেদিনের সেই মৃদু ভুমিকম্পের জন্য আপনি আর আপনার পিস্তলই দায়ী?!

বজলু মেজাজ গরম করে বললো,– চুপ থাকবি নাকি কানের নিচে একটা দিয়ে চুপ করাতে হবে।

মিম মুচকি হেসে বললো,– কিন্তু আপনার মতো গুন্ডার সাথে প্রেম করার কোনো ইচ্ছা নেই আমার।

বজলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,– গুন্ডা হয়ে কেউ পৃথিবীতে আসেনা মিম।

ওসমান বললো,– এইডা সত্যি কথা ওস্তাদ, পৃথিবীতে আসার সময় সবাই ল্যাংটা আসে মানে বস্ত্রহীন, নিষ্পাপ হয়ে আসে।

বজলু মেজাজ গরম করে ওসমানের কান টেনে ধরে বললো,– কানের উপরে হাই পাওয়ারি নাপা এক্সট্রা মেরে দেবার আগে চুপকর হারামজাদা, এত গভীরে গিয়ে তোরে বিশ্লেষণ করতে বলছে কেউ!

মিম হাসতে হাসতে চলে আসলো।

আসলে বজলু অনেক আগে থেকেই মিমকে পছন্দ করে, কিন্তু মিম পাত্তা দিতো না।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল, মীরা দরজা বন্ধ করে রুমের ভেতরে বসে আছে। বাইরে থেকে মীরার মতামত জানতে চাইলাম। মীরা সাফ সাফ বলে দিলো– আপনি যেতে পারেন।

মীরার উত্তর শুনে চোখের সামনে পুরো পৃথিবী যেন ঝাপসা হয়ে গেল। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার নয়।

কিছু বলার নেই আর, চলে যাবার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম, ড্রইং রুম পার করে আসতেই শুনলাম মীরার রুমের দরজা খটাস করে খুলে গেল, পেছন থেকে মীরার কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো– হ্যালো মিস্টার স্বামী, ভিরমি খেতে চাও, তাহলে পেছনে তাকাও।

আমি ঘুরে দাড়িয়ে মীরাকে দেখে আসলেই ক্রাশ খাবো, নাকি টাশকি খাবো, নাকি ভিরমি খাবো সেই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে জ্ঞান হারানোর উপক্রম।

আমার সামনে দাড়িয়ে আছে একটি হলুদ পাখি, চোখ ফেরানো দায়। মীরা হলুদ শাড়ী পরেছে। আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছি মীরার দিকে। মীরা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খেয়ে বললো,– আমাকে একা ফেলে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি।

মীরাকে জড়িয়ে ধরলাম শক্ত করে, বুকে চাপা কষ্টগুলো নিমিষেই উড়ে গেল যেন। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে আমিই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যাক্তি। মীরার গালে কপালে চুমু খাচ্ছি আনন্দে এমন সময় দরজা দিয়ে বজলু ভিলেন কয়েকজন ছেলে নিয়ে ঢুকে বললো,– এ্যাহ! এখানে দেখছি কিসমিস পাইকারি দরে দেয়া হচ্ছে, এগুলা কি!

মীরা সরে গেল, আমি বজলুকে বললাম,– স্বামী স্ত্রীর এমন রোমান্টিক মুহুর্তে বিরক্তির কারন হয়ে ঢুকতে লজ্জা করেনা?!

বজলু বাজখাঁই গলায় বললো,– আরে রাখো লজ্জা, আমার বোন বহুদিন পরে গতকাল হাসছে।

: তো সেই খুশিতে আমরা এখন নাচবো? আপনার বোন হাসছে সেটা বাসায় বাসায় গিয়ে বলার কি আছে?

বজলুর শিষ্য ওসমান বললো,– ভাইয়ের একটাই বোন, মা বাবার মৃত্যুর পরে বোনকে সে কখনও হাসতে দেখেনি, কতকাল এই বাসার কেউ ভাইয়ের বোনকে হাসাইছে।

আমি বললাম,– ওনার বোনের নামটা কি?

ওসমান বললো,– আরশি।

এইরে, কাম সারছে! তার মানে গতকাল ছাদে মজনু যাকে পটিয়েছিল সে বজলু ভিলেনের বোন!

মজনু গায়েব, আরশি বজলু ভিলেনের বোন শুনে মজনুর হালুয়া টাইট। দিশা হারিয়ে বাথরুমে আত্মগোপন করলো মজনু।শেষমেশ বাথরুমের দরজা ভেঙে মজনুকে বের করে পাঁজা কোলা করে আরশিদের ছাদে নিয়ে গেল বজলুর লোকজন।

আমি, মীরা, ইরা আপা, মিম সবাই আরশিদের ছাদে উপস্থিত।

আরশি মজনুকে বললো,– গতকালের পর থেকেই আমার মনে হচ্ছিল আমি আপনাকে পেলে সুখী হবো, আমি আপনাকে স্বামী হিসেবে পেতে চাই।

মজনু অতি আনন্দে বলে ফেললো,– ও খোদা, এই কথা সোজা কইলেই হইতো, মুই নিজে কাজী লইয়া উপস্থিত হইতাম, তোমার ভাইয়ের ভিলেনি স্টাইলে এন্ট্রি নেবার কি দরকার ছেলো, মোর কলিজার পানি তো ভয়ে বাষ্প হইয়া উইরা গ্যাছে।

বজলু কোমরের পিস্তল বের করে নলের ডগায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,– বজলু ভিলেন নামডা কি খালি খালি রাখছি, প্রয়োগ তো করা লাগবে নাকি।

মজনু মিনমিন করে বজলুকে বললো,– ভাই তুমি কি কখনো ভালো হবেনা?

বজলু টেবিলের ওপর পিস্তল রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,– আমি তো ভালো হতেই চাই রে, কিন্তু ও আমাকে ভালো হতে দিলনা।

আমি বললাম,– ও টা কে আবার ভাই?

বজলু হাতের ইশারায় মিমকে দেখিয়ে দিলো।

তারপর সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম।

মিম বললো,– আপনি যদি সত্যিই ভালো হয়ে যান, তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই।

দিন তারিখ দেখে মজনু ও আরশির এবং বজলু ও মিমের বিয়ে হয়ে গেল।

রাত গভীর, মীরা আমার বুকে মাথা রেখে বললো,– গল্পের পাঠকরা তো এই পর্যন্ত জানলো। আমাদের পরবর্তী জীবনের কথা তারা জানতে পারবেনা বলে আফসোস হয়।

আমি মীরাকে বললাম,– ও নিয়ে তুমি টেনশন কোরো না, কোন একদিন ভিন্ন কোনো গল্পের মাধ্যমে ঠিকই জানিয়ে দেবো আমার লক্ষী বউ।

সমাপ্ত।

লেখাঃ আবীর হোসেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here