বউ পর্ব ৩

গল্পঃ বউ ( ৩য় পর্ব )

আমি মিমকে আমার কাছ থেকে ঠেলে সরিয়ে দিতেই মীরাকে দেখে মিম দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মীরা রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো।

আমি তো নির্দোষ, মীরা তো বুঝেছে উল্টো, এতদিন মীরার হাতে কিল খেয়েছি, আজকে হয়তো মাইরের খিচুড়ি খেতে হবে। মানে বিভিন্ন টাইপের ক্যালানির মিশ্রণ।

মীরা ধীর পায়ে আমার সামনে এসে দাড়ালো, চোখে তার জল টলমল, চোখের জল মুছে কাঁপা কণ্ঠে মীরা বললো,– অন্তত আপনার চরিত্রে আমার বিশ্বাস ছিল, সেটা আজ ভুল প্রমাণিত হলো, আপনার প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা আমার মনে যদি থেকেও থাকে, সেটা আজ শেষ।

: মীরা তুমি যেটা বুঝেছো সেটা ভুল।

: কানে শুনলে হয়তো ভুল হবার চান্স ছিল, চোখে দেখাটা ভুল হতে পারেনা।

: মীরা চোখের দেখাও কখনও ভিন্ন কিছু হয়।

: আচ্ছা, আপনি চিৎপটাং হয়ে ছিলেন আর মিম আপনার ওপর ঝুকে পড়ে পুজো করছিল প্রেম দেবতাকে! নাকি চোখে ময়লা পড়েছিল তাই তুলে দিচ্ছিল?

: মীরা, আমার কথা বুঝতে চেষ্টা করো।

: আপনি যে মস্তবড় লুচু একটা, সেটা আমার বোঝা শেষ, আর কিছু বুঝতে হবেনা।

: আচ্ছা যদি তাই হতো, তবে বিয়ের পরে এতগুলো দিন একত্রে থেকেও তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনও যাইনি কেন? দুজনের মাঝখানের কোলবালিশের সীমানা কখনও অতিক্রম করিনি কেন।

: করবেন কেন, ওরকম মিম-ডিম হয়তো ছিল গোপনে।

: মীরা প্লিজ।

: আপনি যদি আর একটা কথা বলেন তাহলে কিন্তু ভালো হবেনা, এই ঘটনা তাহলে আপুর কানে পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।

আমি উঠে মীরাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপালে একটা চুমু খেতে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম, কিছু সময় মীরা স্থির থেকে তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,– স্বামী হিসেবে এই অধিকার আপনার ছিল, কখনও সুযোগ দেইনি বলে আজকে জড়িয়ে ধরতে বারণ করিনি। এখন যদি আপনি আর একটা কথা বলেন তাইলে খবর আছে।

কথা শেষ করে দরজা খুলে মীরা হনহন করে হেটে চলে গেল।

আমি ভীষণ অবাক, ছোটখাটো বিষয় নিয়েও যার কিল খেতে খেতে পিঠে তিল পরিমাণ যায়গা খালি নেই। আজ এতবড় একটা ভুল বোঝাবুঝির পরেও মীরা কিল দিলোনা! তবে কি মীরার কিলের স্টক শেষ! নাকি কিল শূন্যতায় ভুগছে!

আসলে মীরা আজ ভীষণ থমকে গেছে, বোঝার ভুল হলেও আমার কাছে এরকম কিছু আশা করেনি মীরা, মিমকে আমার অত কাছাকাছি দেখে ভেতরে ভেতরে প্রচুর ভেঙে পড়েছে মীরা সেটা স্পষ্ট।

আর ঐ মিম কামডা করলো কি, এতদিন যা-ও বউয়ের দু’একটা কিল খেতাম তা-ও বরবাদ করে দিলো। আমার পৃথিবী জুড়ে তো শুধু মীরা, এই পৃথিবীতে এলিয়েন হয়ে আশার কোনো দরকার ছিল মিমের! কি একটা অবস্থা।

মীরা যে পাগলী, এই মুহূর্তে বুঝাতে গেলে চেচিয়ে আমার প্রেস্টিজ চৌচির করে ফেলবে। তারচেয়ে চুপচাপ থাকি, ততক্ষণে মীরার মস্তিষ্কের ওয়েদার ঠান্ডা হোক।

সারাদিন মীরা নিজেকে সেচ্ছায় রুম কোয়ারান্টাইনে রেখেছে, আর মীরাকে না দেখতে পেয়ে আমার মনের আকাশে দুঃখের ভারী মেঘ জমেছে।

সন্ধ্যায় খারাপ লাগা মারাত্মক অস্থিরতার রূপ ধারণ করলো। বাসার ছাঁদে এসে সিগারেট ধরিয়ে একটা টান দিতেই পেছনে কারো উপস্থিত টের পেলাম। ঘুরে দাড়িয়ে মীরাকে দেখে সিগারেট ফেলে দিলাম।

মীরা একেবারে সামনে দাড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,– আমার যেটা অপছন্দ সেটাই আপনি করছেন, আবার সিগারেট?

: এই দুঃখ কষ্ট লইয়া সিগারেট খাবোনা তো কি বিরিয়ানি খাবো।

: সেটা আপনার ইচ্ছা, আমি এখানে এসেছি বলে ভাববেন না যে আপনাকে হারাবার ভয়ে আমি নত হয়েছি, আপনার প্রতি আমার সবকিছু শেষ ইতিমধ্যে। শুধু বলতে এসেছি এসব সিগারেট বিড়ি খাবেন না, নিজের খেয়াল রাখবেন, এটা বলা আমার দায়িত্ব। আর শেষ কথা আমি আর আপনার সাথে বাকিটা জীবন পার করার আশা করছি না, কথাটা মাথায় রেখে আমাকে মুক্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করলে খুশি হবো।

কথা শেষে মীরা চলে যাবার উদ্দেশ্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে হাত ধরে টান মেরে বুকে এনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,– হৃদয় দিয়ে আমার প্রতিটি হৃৎস্পন্দন অনুভব করো মীরা, দ্যাখো প্রতিটি হার্টবিট তোমার কথাই বলছে। এতদিন তোমার সব ছেলেমানুষি সহ্য করলাম, এত এত কিল হজম করেও তোমার বিশ্বাস অর্জন করতে পারলাম না, এর চেয়ে বড়ো কষ্ট আর কি হতে পারে।

ভাইরে ভাই, পছন্দের বিরিয়ানি খাবার সময় দাঁতের নিচে এলাচ পড়লে যেমন অনুভূতি হয়, হঠাৎ মিম আসায় আমার অনুভূতি তেমন।

মীরা চুপচাপ বুকের সাথে লেগে ছিল, মিম হনহন করে ছাদে এসে বললো,– আপনাকে নিচে কোথাও খুঁজে না পেয়ে ছাদে চলে এলাম।

মীরা হুড়মুড় করে নিজেকে আমার বাহু থেকে সরিয়ে নিয়ে চলে যেতে যেতে মিমকে বললো,– যাক খেয়াল রাখার মতো তো কেউ একজন আছে, ভালো করে খেয়াল রেখো মিম।

কথা শেষে মীরা নিচে নেমে গেল।

আমি মিমকে বললাম,– কাজটা করলা কি, আসার আর সময় পেলে না!

: আসলে আমার কারনে আপনি ঝামেলায় পড়েছেন তো, তাই খুজতে এসেছিলাম স্যরি বলার জন্য।

: মিম, তুমি কি সত্যি আমাকে ভালোবাসো?

: অনুভূতি তেমনই। আসলে আপনি মীরাকে যেভাবে পাগলের মতো ভালোবাসেন, খেয়াল রাখেন, এরকম একটা ছেলেকেই মেয়েরা জীবন সঙ্গী হিসেবে পেতে চায়। জানিনা কীভাবে আপনার প্রতি দূর্বল হলাম, এটা আমারই দোষ।

আমি ছাদের ওপর বসে মিমকে আমার পাশে বসতে বললাম। মিম আমার পাশে বসলো। তারপর মিমকে চাঁদের দিকে তাকাতে বললাম, মিম তাকালো। এবার বললাম,– আমি চারটা লাইন বলবো মনোযোগ দিয়ে শোনো।

চাঁদকে কভু যায়না ছোঁয়া,
তবুও সে ভীষণ প্রিয়।
এমন কিছু ইচ্ছে তোমার,
হাওয়ায় হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ো।

মিম চুপ হয়ে আছে। আমি বললাম,– এর মানে চাঁদ আমাদের ভীষণ প্রিয়, আমরা চাইলেই তাকে ছুঁতে পারিনা। কিন্তু ছুঁতে পারিনা বলে কি চাঁদটা আমাদের কাছে অপ্রিয় হয়ে যায়? কক্ষনও না। কারণ আমরা ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছি চাঁদ আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে, তাই এই বিষয়ে আমাদের কোনো আক্ষেপ নেই। পার্থিব জগতে চলার পথে কতকিছু আমাদের ভালো লাগে, কত স্বপ্ন জাগে, কত আশা, কতকিছুই অপূর্ণ থেকে যায়, তাই বলে আমরা হাতাস হবো! একদম না, ওটা ভাগ্যে ছিলনা তাই পেলাম না, অথবা ওটা আমার হবার ছিলনা ভেবে মেনে নিয়ে জীবনকে সুন্দর ভাবে এগিয়ে নেবার চেষ্টা করবো। কোথাও আটকে থাকতে নেই বুঝলে।

মিম চুপ করে মনোযোগ সহকারে কথাগুলো শুনছে।

আমি আবার বলতে শুরু করলাম,– মীরার প্রতি আমার ভালোবাসা, কেয়ার এসব দেখে আমাকে তোমার ভালো লেগেছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো আমি আর মীরা স্বামী স্ত্রী। আর আমার প্রতি তোমার যে অনুভূতি সেটা হলো ভালোলাগার, এবার পরিস্থিতি হিসাবে তোমার ভালোলাগাকে ভালোলাগার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিৎ। পৃথিবীতে যত্নশীল শুধু আমি একলা নই, তুমি বলেছিলে মেয়েরা আমার মতোই কাউকে চায়, এরকম যত্নশীল লোকের অভাব নেই জগতে, আসল বিষয় হলো একজন অন্যজনকে বুঝে ব্যালেন্স করে চলা, এতেই একে অপরের প্রতি ভালোবাসা বাড়ে। তুমি আমার মতোই কাউকে চাও, আল্লাহ যেন তোমার মনের আশা পূর্ণ করে।

মিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,– বাহ! কত সুন্দর করে বুঝালেন, এতে তো আপনার প্রতি আরও দূর্বল হয়ে পড়লাম।

মিমের কথা শুনে হেসে উঠে বললাম,– মিম, আমাদের সবকিছুতে তাড়াহুড়া, আমরা যাচাই বাছাই না করে প্রেমে পড়ি ধুম করে, তারপর দেখা যায় হৃদয় ভাঙে নিঃশব্দে, তারপর আজীবন সেই বেদনা বয়ে বেড়াই আর যত দোষ দেই সব ভাগ্য ও কপালের। জলদি এবং তাড়াহুড়ো বেশীরভাগ মঙ্গলজনক হয়না।

মিম মিষ্টি হেসে বললো,– তবুও আমি আপনাকে ভালোবাসি, একজন ভালো মানুষের প্রতি অন্য একজনের যেমন ভালোবাসা থাকে তেমন, ভয়ের কিছু নেই।

আমি বললাম,– তেমন ভালো আমিও তোমাকে বাসি মিম।

হঠাৎ নিচ থেকে মীরার চিৎকারের আওয়াজ ভেসে এলো। আমি লাফিয়ে উঠে নিচে যাবার জন্য দৌড় শুরু করলাম, কি হলো হঠাৎ করে মীরার?

চলবে…

লেখাঃ আবীর হোসেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here