রুমে ঢোকা মাত্র বউ এক হাতে বটি অন্য হাতে শার্টের কলার ধরে একশান শুরু করে দিলো,– ‘ আড্ডা মারা শেষ হইছে আপনার? সারাদিন খেয়েদেয়ে কাজকাম নাই, বন্ধুদের সাথেই যদি দিনরাত সময় কাটানোর এত হাউস, তাইলে বিয়ে করছেন ক্যান?’
পাশের রুমে আব্বা-আম্মা সজাগ দেখে বিষয়টা মীরাকে বললাম, ‘ যা বলার আস্তে বলো সোনা।’
ওম্মা! এই কথা বলায় মীরার গলার ভলিউম অটোমেটিক দ্বিগুণ বেড়ে গেল।
আব্বা-আম্মা এতে খুশি, কারণ আমাকে সায়েস্তা করার জন্যই তারা এ বাড়িতে মীরাকে আমার বউ করে এনেছে।
এদিকে মীরার মুখে শব্দবোমা অনর্গল ফাটছে তো ফাটছেই, থামানোর জন্য মুখ চেপে ধরতেই কামড় বসিয়ে দিলো হাতে। ‘ মা গো ’ বলে মনে মনে চিৎকার দিয়ে উঠলাম, জোরে চিৎকার দেয়া যাবেনা; পাসের রুমে আব্বা-আম্মা, ভাইবোন রয়েছে। সবাই ভাববে বউয়ের হাতে ধোলাই খাচ্ছি। কিএক্টা অবস্থা!
টেবিলে খাবার রাখা, চুপচাপ খেতে বসলাম, বিশেষ দরকারী, যেমনঃ ভাত, পানি, তরকারি, এসব নিজেই নিয়ে নিয়ে খাচ্ছি, এই মূহুর্তে মীরাকে কিছু বলা মানেই কানের পর্দায় বাড়তি প্রেশার প্রয়োগ।
মীরা গিয়ে শুয়েছে, আমিও এসে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম, বিয়ের পরে থেকে মীরা আর আমার মধ্যিখানে দুটো মোটাতাজা কোলবালিশের দূরত্ব।
ভুলে হোক বা ঘুমের ঘোরে, কোনভাবে যদি বালিশের সিমান্ত পার করে ওপাশে চলে যায় আমার হাত, তাহলে মীরার একটা চিমটি আমার সারারাতের ঘুম হারাম করে দেয় সযত্নে।
চুপচাপ পকেট থেকে মীরার প্রিয় চকলেট বের করে দুই বালিশের মধ্যিখানে রেখে দিলাম। এই চকলেট ওর ভীষণ প্রিয়, প্রতিরাতে বাসায় ফেরার সময় নিয়ে আসি কিনে।
চুপচাপ চকলেট দুটো নিয়ে চুকচুক করে খেয়ে সাবাড় করে দিয়ে ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে। কি অকৃতজ্ঞ রে বাবা, মুখে একটু ধন্যবাদ বললে কি হয়!
আমিও উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ পিঠের ওপর দুম করে একটা কিল পড়তেই লাফিয়ে উঠলাম। পিঠ ডলতে ডলতে বললাম, ‘ কি হইছে?’
মীরা কটকট করে বললো, ‘ বলছিনা উপুড় হয়ে শোয়া ঠিক না, হৃদপিণ্ডে চাপ পড়ে।’
আমি মিনমিন করে বললাম, ‘ হৃদপিণ্ডের ভেতরে যার বসবাস সে-ই দিনদিন হৃদপিণ্ডের বারোটা বাজাচ্ছে, হৃদপিণ্ড দিয়ে আর কি হবে।’
এক কথায় দুই কথায় আবার হাল্কা ভলিউমে ঝগড়া শুরু। আমি বিছানা ছেড়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে উঠোন পেরিয়ে রাস্তায় এসে বসলাম, ঝগড়ার উছিলায় শান্তিতে একটা বিড়ি তো খেতে পারবো, আহ! শীতল হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে গেল। একটা সিগারেট ধরিয়ে এক টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়বো এমন সময় আমার আসেপাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সিগারেট পায়ের নিচে ফেলে পিষে চ্যাপ্টা করে ফেললাম; কিন্তু মুখের ধোঁয়া ছাড়তে পারলাম না, পাশে বসে মীরা বললো, ‘ চলো চাঁদ দেখি।’
আমার কিছু বলার উপায় নেই, বলতে গেলেই মুখের ধোঁয়া বেড়িয়ে যাবে, তারপর মীরার একশান শুরু হবে।
আমি কিছু বলছিনা দেখে মীরা “ কথা কানে যায়নি ” বলে পিঠের ওপর দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিলো, সেই কিল ফুসফুসে প্রেশার ক্রিয়েট করতেই মুখের ধোঁয়া বেড়িয়ে গেল। জলদি করে বললাম, ‘ চাঁদ কী আমার আব্বার যে আমার অনুমতি নিয়ে দেখতে হবে! নাকি তুমি একলা দেখলে চাঁদকে সূর্যের মতো দেখা যায়?
মীরা আমার মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হতে দেখে চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অসংখ্য কিল আমার পিঠের দিকে ধেয়ে আসছে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। বুদ্ধি করে বলে ফেললাম, ‘ আজকে নিজের চোখে দেখলে তো তোমার কিল খেলে বুকের ভেতর জ্বলে পুড়ে কি পরিমাণ ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় কষ্টে, দেখলে তো স্পষ্টে?’
কিল আরও একটা হজম করে চুপচাপ চাঁদের দিকে তাকিয়ে মীরার কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘ তোমার কিল না খেলে চাঁদের এই অপরুপ সৌন্দর্য আমার অজানা রয়ে যেতো, কারণ আগে কোনদিন এতটা মনোযোগ সহকারে চাঁদ দেখিনি।’
ধাক্কা মেরে মীরা চলে গেলো ঘরে, আমিও পেছন পেছন এসে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম।
পরেরদিন সকালে বিড়ি খাবার বিষয়টি নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে ফেললো মীরা, একেবারে সবার সামনে বেইজ্জতি করে ছাড়লো।
দুপুরে রুমে বসে এই বিষয়ে আবার কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে মীরার গালে একটা চড় মেরে দিলাম।
ঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম। খারাপ লাগছে ভীষণ নিজের কাছে, বিয়ের বয়স একবছর, এই এক বছরে চুপচাপ সহ্য করে গেছি মীরার সমস্ত ছেলেমানুষী। সহ্য না করে উপায় নেই, মীরার বয়স এখন সতেরো, আমার সাতাশ, বয়সের দশ বছরের ব্যবধান। তার থেকেও বড়ো বিষয় মীরা আমার বড়ো খালার মেয়ে। খালা-খালু গাড়ি এক্সিডেন্ট করে মারা যাবার পরে আম্মা মীরাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসে, তারপর আমার আর মিরার বিয়ে পড়িয়ে দেয়।
এই বয়সটা’ই তো ছেলেমানুষী করার, ছেলেমানুষী করবেই, তার ওপর মা-বাবা নেই, এর জন্যই ওর হাজারটা কিল খেয়েও বিন্দুমাত্র অভিযোগ থাকেনা আমার। ভালোবাসা কতপ্রকার আছে জানা নেই, তবে মীরার প্রতি আমার ভালোবাসা সবার উর্ধ্বে, অফুরন্ত, সীমাহীন। ওর সবকিছু আমার ভালোলাগে, হাতের কিল, রাগ করে কামড়, কানের কাছে প্যানপ্যান, ঘ্যানঘ্যান, রাগ, অভিমান। পিচ্চি বউকে নিয়ে টম-জেরির মতোই জীবন যাপন করছি। ওর সব ছেলেমানুষী ধীরে ধীরে বুকের সবটা জুড়ে ওর প্রতি ভালোবাসার মহল গড়ে তুলেছে, সেই মহলের রানি আমার পাগলী মীরা। মীরার বড়ো একটি বোন আছে, তার-ও বিয়ে হয়েছে, মীরা ছোট বলে সংসারে আহ্লাদী মেয়ে ছিল, মা-বাবার অতি আদরের ; মা-বাবা হারিয়ে ওর মনের কী অবস্থা সেটা ভাবলেই চোখে জল আসে আমার।
আমার দেরি করে ঘরে ফেরা, দীর্ঘসময় কোথাও থাকা মীরা একদম সহ্য করতে পারেনা, ওর হয়তো একা লাগে, খারাপ লাগে। আমি যতক্ষণ ঘরে ততক্ষণ হয়তো আমাকে কিলিয়ে, তাড়িয়ে ওর ভালো লাগে। সময়টা ভালো কাটে। কিন্তু ওর এই কিল, প্যানপ্যানানি, ঘ্যানঘ্যানানি থেকে বাঁচতেই আমি বাইরে থাকি বেশিরভাগ। তবুও যতক্ষণ সম্ভব ওকে সময় দেবার চেষ্টা করি, যতক্ষণ সাধ্যে কুলোয়।
বউ আমার পরাণের পরাণ, বউয়ের কাছে আমি আজও খালাতো ভাই, অতিরিক্ত উত্তেজিত হইলে এখনো মাঝেমধ্যে তুই-তুকারি করে। তখন বউয়ের সামনে নিজেকে বউয়ের খালাতো ভাই’ই মনে হয়, স্বামী নয়। এতদিনে বুঝলাম স্বামী হওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। বিয়ে করছি ঠিকই, স্বামী স্বামী অনুভূতি আর অনুভব করা হইলোনা, হইবো কেমনে, বউয়ের কিল খাইয়া’ই দিশা পাইনা। স্বামী হিসেবে স্ত্রীর কাছে যাওয়া তো দূরের কথা, দুই-একটা রোমান্টিক কথা বললেও লুচ্চা-মুচ্চা বলে একাকার করে ভাসিয়ে দেয়। তাই কোলবালিশের এপার ওপারেই সীমাবদ্ধ আমাদের স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক। এসব দুঃখ নিবারনের জন্যই মাঝেমধ্যে দু’একটা বিড়ি খাই অনিচ্ছা সত্বেও। কিন্তু সব ভুয়া কথা, বিড়ি এবং দুঃখের মধ্যে তেমন সংযোগ নেই। বরং বিড়ি খেলে টেনশন আরও বাড়ে, মীরা যদি কোনমতে ঘ্রাণ পায়, তাহলে একটা বিড়ি খাওয়ার অপরাধে দশটা কিল খেতে হবে। আসুন আমরা ধুমপান বর্জন করি।
মীরার মুখটা কালো দেখলে মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত কষ্ট এবং হতাশা এসে বুক ভারী করে ফেলেছে আমার, আর সেই আমি আজ মীরাকে থাপ্পড় মারলাম। কি বলবো, কি করবো কিছুই খুঁজে পাচ্ছিনা।
রাতে খেয়াল করলাম মীরা ফুপিয়ে কাঁদছে, আমার ভেতরটা কেমন জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। মনে চায় বালিশে কিক মেরে খাটের নিচে ফেলে মীরাকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইতে, আবার ভয় হয়; এমনিতেই মীরার মাথায় রাগ, যদি চেচিয়ে বলে উঠে, “ ছাড়ো আমাকে,” তাইলেই কেলেংকারী, সবাই শুনে কী ভাববে! তবুও সাহস করে হাত বাড়িয়ে মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘ আর কোনদিন এমন হবেনা, এবারের মতো ক্ষমা করে দাও।’ মীরা কিছুই বললো না, আমার হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সেভাবেই কাঁদতে লাগলো। আমি বাইরে বেরিয়ে গিয়ে অনেক রাত অব্ধি বসেছিলাম। কারণ মীরার কান্না সইবার ক্ষমতা আমার নেই। ফিরে এসে দেখলাম মীরা ঘুমিয়ে আছে। আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম। ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্ন দেখে অজানা ভয়ে এবং আতঙ্কে ঘুম ভেঙে গেল আমার, হুড়মুড় করে উঠে বসলাম, মীরাকে দেখছি না পাশে, বুকের ভেতরটা ধড়াম করে উঠলো, এত সকাল সকাল তো কক্ষনও মীরা ঘুম থেকে ওঠেনা। পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজলাম, কোথাও মীরা নেই! তাহলে কোথায় গেল মীরা?
চলবে…
গল্পঃ বউ ( ১ম পর্ব )
আবীর হোসেন।