বন্ধ দরজা পর্ব ৩৪

বন্ধ_দরজা
পর্ব-৩৪
লেখা-মিম
ঘড়িতে এখন সাড়ে আটটা বাজে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে রেডি হচ্ছে সুহায়লা। আজ রাতে ওকে নিয়ে ঘুরতে যাবে তানভীর। বলেছে দূরে কোথাও নিয়ে যাবে। কিন্তু কোথায় যাবে সেটা বলেনি। ওটা ওর জন্য সারপ্রাইজ হিসেবে রেখে দিয়েছে তানভীর। ঠোঁটের কোনা থেকে মৃদু হাসিটা যেনো আজ সরতেই চাচ্ছে না। অদ্ভুদ রকমের ভালো লাগা কাজ করছে। বিয়ের পর এই প্রথম দূরে কোথাও তানভীরের সাথে ঘুরতে যাবে সে। বাসার কলিংবেল বাজছে। বোধহয় তানভীর এসেছে। কি একটা কাজে বাহিরে গিয়েছিলো। বলেছিলো তুমি রেডি হতে হতে আমি চলে আসবো। রুম থেকে বেরিয়ে এলো সুহায়লা। সাবা গেইট খুলেছে। তানভীর আসে নি। দুজন মহিলা এসেছে। সুহায়লার খোঁজ করছে গেইটে দাঁড়িয়ে। দুজন মহিলার দিকে দূর থেকে ভালোমতো একবার চোখ বুলিয়ে নিলো সে। বয়স ৫০-৫৫ এর মধ্যে হবে। দুজনই মোটামোটি ভারী মেকআপ করে এসেছে। কাছে এগিয়ে এসে সুহায়লা বললো,
-” জ্বি আমিই সুহায়লা। আপনাদের তো ঠিক চিনতে পারলাম না।”
-” ভেতরে এসে না হয় পরিচয়টা দেই?”
-” জ্বি আসুন।”
নিজের রুম থেকে সুহায়লার মা বেরিয়ে এসেছেন। মেয়েকে ইশারায় জিজ্ঞেস করছেন মহিলা দুজন কারা? সাবাও ইশারায় বললো সে জানে না।
ওরা তিনজনই মহিলা দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে তাদের মুখ থেকে কিছু শোনার আশায়। দুজনের থেকে একজন সুহায়লাকে জিজ্ঞেস করলো,
-” বেশ সুন্দর করে সেজেছো। কোথাও যাচ্ছো নাকি?”
-” জ্বি আমার হাজবেন্ডের সাথে বাহিরে যাবো।”
-” তানভীর তোমাকে নিয়ে বেড়াতেও যায়?”
-” আপনি কিভাবে জানেন আমার হাজবেন্ডের নাম তানভীর?”
-” নিজের ছেলের নাম নিজে জানবো না?”
ওদের তিনজনের বুঝতে আর বাকি রইলো যে এটাই তানভীরের মা তনু। ভূত দেখারমতো চমকে গেছে ওরা। এই মহিলা এখানে কি করতে এসেছে? সুহায়লার মা উনার মুখোমুখি এসে বসলেন।
-” আপনি এখানে কি মনে করে?”
-” আসলাম একটা প্রয়োজনে।”
-” কি প্রয়োজন?”
-” বলছি, আগে পাশের জনের সাথে ইনট্রোডিউস করিয়ে দেই। রাহাতকে চিনেন নিশ্চয়ই? ও হচ্ছে রাহাতের মা রুনা।”
সুহায়লার মায়ের বুঝতে বাকি রইলো না যে এই মহিলা নির্ঘাৎ এখানে কোনো আগুন লাগাতে এসেছে। বেশ চটে গেলেন সুহায়লার মা। চেহারায় প্রচন্ড বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছে তার।
-” নিজে এসেছেন ভালো কথা। সাথে করে উনাকে কেনো নিয়ে এসেছেন?”
-” আপনাদের বাসায় গেস্ট আসলে কি আপনারা এভাবেই বিহেভ করেন?”
-” বিহেভটা কেমন করবো সেটা নির্ভর করে গেস্টের উপর। অনাকাঙ্খিত গেস্টদের সাথে আমরা এভাবেই ব্যবহার করি।”
-” আমরা এখানে আপনার আতিথেয়তা পেতে বা নাস্তা খেতে আসি নি।”
-” তাহলে কেনো এসেছেন?”
-” আপনার সাথে কথা বলতে আমি মোটেই ইন্টারেস্টেড নই। আমি সুহায়লার সাথে কথা বলতে এসেছি ওর সাথেই কথা বলবো। রাহাত লাভস ইউ সুহায়লা। হি লাভস ইউ এ্য লট। বেচারা কষ্ট পাচ্ছে প্রচুর।”
-” তো এখন আমি কি করবো? আমি কি তাকে বলেছে আসো আমার সাথে প্রেম করো? ”
-” দেখো সুহায়লা, টাইম ওয়েস্ট করা আমার মোটেই পছন্দ না। আমার ছেলেকে কত টাকার বিনিময়ে বিয়ে করবে বলো? তুমি যাস্ট এ্যামাউন্ট বলো।”
-” আপনার ছেলের নজর খারাপ। নোংরা নজরের মানুষদের ছায়াও মারাই না আমি।”
-” নোংরা নজরের কি দেখলে? তোমার গায়ে হাত দিয়েছে? তোমার শরীরের দিকে বাজে ভাবে দেখেছে? তোমার কাপড় খোলার ট্রাই করেছে? কিছুই তো করেনি। তোমাকে বিয়ে করবে বলেছে। তোমাকে সে সমাজে একটা সম্মান দিবে যেটা তোমার সো কলড হাজবেন্ড তোমাকে দেয় নি। সোসাইটিতে তোমাকে নিয়ে যে আজকাল সমালোচনা ঝড় চলছে তা কি জানো? তোমার হাজবেন্ড তোমাকে নূন্যতম সম্মান দেয় না তবু তার সংসারে পড়ে আছো। কেনো? নিশ্চয়ই তোমার স্বার্থ আছে। স্বার্থটা কি সেটা আমরা সবাই বুঝি। সেটা হচ্ছে তানভীরের প্রপার্টি। দেখো মেয়ে, তানভীর কিন্তু তোমার নামে কোনো প্রপার্টি লিখে দেয়নি। কখনো দিবেও না। কিন্তু আমার ছেলে ওর প্রপার্টির ফিফটি পার্সেন্ট তোমার নামে ট্রান্সফার করবে বিয়ের আগেই। তুমি যদি চাও তাহলে এই প্রপার্টি তোমার ডিভোর্সের আগেই তোমার নামে ট্রান্সফার করে দিবো। ফিফটি পার্সেন্ট প্রপার্টিকে তুমি ছোটখাটো কিছু ভেবো না। ঐ প্রপার্টি দিয়ে তোমার পরবর্তি দুই জেনারেশন বসে বসে খেয়ে যেতে পারবে। তোমার ফ্যামিলিতে প্রতিমাসে আমি টাকা দিবো। যত চাও তত দিবো।”
-” সুহায়লা এটা তোমার জন্য একটা বিগ অপোরচুনিটি। রুনার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাও। তোমার মতো মেয়ের জন্য এর চেয়ে ভালো বিনিময় মূল্য হতেই পারে না। এত টাকা দিয়ে তোমাকে কেউ কিনতে আসবে না।”
সুহায়লার মনে হচ্ছে দুচোখ ফেটে কান্না আসছে। কিন্তু এদের সামনে কাঁদা যাবে না। ওদেরকে বুঝতে দেয়া যাবে না ও ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়ছে। চোখের পানি আটকে রেখে কঠিন গলায় সে বললো
-” কেমন মা আপনি? তানভীর আপনার ছেলে। নিজের ছেলের সংসার ভাঙতে চলে এসেছেন? নিজের মতো দুনিয়ার অন্য সবাইকে ভাবেন তাই না? সবাই আপনার মতো ফালতু না যে পয়সাওয়ালা পুরুষ লোক পেলাম আর তার সামনে যেয়ে কাপড় চোপড় খুলে ঘেষাঘেষি শুরু করবো।”
-” শোনো, নিজেকে ধোয়া তুলসি পাতা প্রুফ করতে চাওয়ার বাজে চেষ্টা করতে যেও না। কোনো লাভ হবে না। তুমি যে এই পথেরই লোক সে কথা ভালোই জানা আছে। আর নয়তো এতটা ইনসাল্ট সহ্য করা সত্ত্বেও তানভীরের সংসার করতে না। তোমার ভালোর জন্য বলতে আসলাম উল্টো তুমিই আমাকে শোনাচ্ছো। তানভীর একটা বেয়াদব। রাহাত মোটেই ওরকম না। ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নাও।”
-” আমার মাথা ঠান্ডাই আছে। বেয়াদব ছেলে মানুষ আমার খুবই পছন্দ। সভ্য ছেলে আমার ভালো লাগে না। আর আপনি, আপনার ছেলে অন্যায় করতে চাচ্ছে আর আপনি কি না তাতে সায় দিচ্ছেন? এতো নোংরা মেন্টালিটি কেনো আপনাদের? আজকে যদি আমার ভাই এমন কিছু আবদার ধরতো আমার আম্মা জুতা দিয়ে পেটাতো ওকে। আপনাদের হাই সোসাইটিতে বিয়ে না হলে জীবনেও জানতাম না যে আপনারা এত খারাপ। আল্লাহ আপনাদের টাকা দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আপনাদের মধ্যে নূন্যতম সভ্যতা নেই। আমরা মিডেল ক্লাস রা আপনাদের চেয়ে হাজারগুনে ভালো আছি। আপনাদের মতো নোংরা মেন্টালিটির মানুষ আমরা না। এটা আমার চরম দুর্ভাগ্য যে আপনাদের মতো মানুষদের সমাজে আমার বিয়ে হয়েছে। কেনা-বেচা করার ইচ্ছা থাকলে বলেন, আপনার সাথে লেনদেন করি। আমার ঘরে ছিঁড়া একজোড়া স্যান্ডেল আছে ওগুলা আপনাকে আমি দেই, বিনিময়ে আপনার ছেলে আমাকে দিয়ে দিন। খুব যত্ন সহকারে রাখবো।”
-” এতো ঝাঁঝ কিসের তোমার?”
” প্রেগনেন্সি টাইমে আম্মা অনেক মরিচ খেয়েছিলো তাই আমার এতো ঝাঁঝ।”
-” নিজেকে দেখেছো একবার আয়নায়? কি আছে তোমার মধ্যে?”
-” কিছু নেই তবুও তো চলে এসেছেন ফিফটি পার্সেন্ট প্রপার্টির বিনিময়ে আমাকে কিনে নিতে।”
-” শুধুমাত্র রাহাতের মুখের দিকে তাকিয়ে এসেছি। বুঝে পাচ্ছি না কি দেখেছে তোমার মাঝে যে তোমাকে বিয়ে করার জন্য মরতে বসেছে।”
-” দেখেন, অনেক কথা হয়েছে। অনেক কিছু বলেছেন আমার মেয়েকে। এখন ঘর থেকে বের হন। অসভ্য মেহমান আমার মোটেই পছন্দ না।”
-” রুনা, উঠো। এসব দুই পয়সার ভিখারিদের সাথে কথা বলে লাভ নেই।”
-” কে কাকে ভিখারি বলছে? বড় ভিখারি তো আপনি। টাকার লোভে নিজের ছেলে হাজবেন্ডকে ছেড়ে চলে গেছেন। দুলাভাইকে বেয়াদব তো আপনিই বানিয়েছেন। যেই ছেলের মা এমন তার ছেলে কি সভ্য হবে নাকি? ভালোয় ভালোয় ঘর থেেকে বিদায় হোন। আর নয়তো মুখে জুতার কালি মেখে এরপর ঘর থেকে বের করবো।”
ওরা দুজন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রাস্তায় যেয়ে গাড়িতে উঠার আগে কিছুক্ষন ওদের তিনজনকে ছোটলোক, ভিখারি, ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে কিসব কুকর্ম করে বেড়ায় সেসব কথা বকবক করলো। রাস্তার কিছু মহিলা দাঁড়িয়ে সেসব শুনলো এবং নিজেদের মাঝেও কানাঘষা করলো। সবটা ব্যাপারই সুহায়লার মা ঘরে বসে দেখেছেন। এতক্ষন চেপে রাখা কান্নাটা এখন কাঁদছে সুহায়লা। জীবনটা কি এমন হওয়ার খুব প্রয়োজন ছিলো? কি হতো ঐ হাই সোসাটিতে বিয়ে না করলে? কি প্রয়োজন ছিলো তানভীরের এমনটা করার? আজ তাকে নিলামে উঠাচ্ছে লোকজন শুধুমাত্র তানভীরের কারনে। মাথার ক্লিপ, কানের দুল, চুড়ি সব এলোপাথারিভাবে ছুঁড়তে ছুঁড়তে নিজের রুমে চলে গেলো সে। সাবা আর তার মা চুপচাপ সোফায় বসে আছে। বিশ মিনিট বাদে ছোট একটা কাপড়ের ব্যাগ হাতে রুম থেকে বেরিয়ে এলো সুহায়লা।
-” আম্মা আমি সোনিয়ার বাসায় যাচ্ছি। তিন চারদিন পরে আসবো। খবরদার তুমি তানভীরকে বলবা না আমি কোথায় আছি।”
-” এতরাতে ওখানে কেনো যাবি?”
-” তানভীরের কাছ থেকে দূরে থাকতে চাই। শান্তি চাই আমি…. শান্তি!”
-” কাল সকালে যা।”
-” না। আমি ওর সামনে কোনোভাবেই যেতে চাচ্ছিনা। ওর সাথে কথা বলার তিল পরিমান রুচি আমার নেই।”
-” ও জিজ্ঞেস করলে কি বলবো?”
-” বলবা সুহায়লা মরে গেছে।”
কথাটা বলেই বেরিয়ে গেলো সুহায়লা।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here