বন্ধ দরজা পর্ব ৩৩

বন্ধ_দরজা
পর্ব-৩৩
লেখা-মিম

এক ঘন্টা যাবৎ তানভীরের ফোনে ট্রাই করছে সুহায়লা। ফোন বারবার ওয়েটিংয়ে পাচ্ছে সে। এত কার সাথে বলছে ও? ফোনটা কিছুক্ষন বাদে বেজে উঠলো ওর। তানভীর ফোন করেছে।
-” সেই কখন থেকে ফোন করছি? ফোন কেনো রিসিভ করছো না? এতক্ষন কার সাথে কথা বলছিলে?”
-” আমার কলেজের এক বান্ধবী ফোন করেছিলো। কত কথা! ফোন রাখতেই চাচ্ছিলো না।”
-” তোমাকে আমি বারো বার ফোন করেছি। নিশ্চয়ই কোনো কাজে ফোন করেছি। অাজাইরা প্যাচাল পারার জন্য ফোন দেইনি। ”
-” ক্ষেপে যাচ্ছো কেনো বলো তো?”
-” ক্ষেপবো না তো কি করবো? তুমি আমার ফোনগুলো দেখা সত্ত্বেও রিসিভ না করে ঐ মেয়ের সাথে বকবক করেই যাচ্ছো।”
-” আরে বাবা, থামো তো। কেনো ফোন করছিলে সেটা বলো?”
-” কাল দুপুরে কোন কাজ হাতে রেখো না। তোমার সাথে বাহিরে যাবো।”
-” সরি সুহায়লা, আমি তো নিশিকে প্রমিজ করে ফেলেছি কাল দুপুরে ওকে সময় দিবো। তোমাকে নিয়ে অন্য কোনোদিন বাহিরে যাবো। ঠিকাছে?”
-” থাক যেতে হবে না কোথাও।”
ফোনটা কেটে দিলো সুহায়লা। তানভীর ব্যাপকআনন্দ পাচ্ছে। হিংসা হয়না আবার? হিংসায় লুচির মতো ফুলে উঠছে সুহায়লা। রাগের চোটে দুপুরে ঠিকমতো ভাতও খায়নি সুহায়লা। ব্যাপারটা মা আর সাবা ভালোভাবেই লক্ষ্য করছে।
-” কি রে ক্ষেপে আছিস কেনো? তানভীরের সাথে কিছু হয়েছে?”
তানভীরের নাম শোনা মাত্র আরও চটে গেলো সুহায়লা। ভাত রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। জোরে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো
-” সারাক্ষন তানভীর তানভীর করো কেনো আম্মা? তানভীর ছাড়া কি চোখে কিছু দেখো না নাকি?কিচ্ছু হয়নি ওর সাথে আমার। যত্তসব ফালতু প্যাচাল।”
বেসিনে হাত ধুয়ে রুমে যেয়ে দরজা আটকে দিলো সুহায়লা। আসরের আযান দিয়েছে পনেরো মিনিট হলো। সে আজ ভেবেছিলো ছাদে যাবে না। পরক্ষনেই মনে হলো ছাদে না গেলে তো আবার ফোন করে চেঁচামেচি শুরু করে দিবে। তাই রুম থেকে বেরিয়ে ছাদে গেলো সুহায়লা। ছাদে উঠেই দেখতে পেলো তানভীর এপাশ থেকে ওপাশ হাঁটছে আর ভিডিও কলে কথা বলছে। সে কি হেসে হেসে কথা! সুহায়লার সাথে তো কখনো এমন ভাবে কথা বলেনি তানভীর। পুরো দশমিনিট ধরে দেখছে তানভীরকে সে। শেষমেষ ফোন করলো তানভীরকে।
-” কার সাথে কথা বলছিলে তুমি?”
-” নিশির সাথে। অনেকদিন হয় আমাকে দেখে না তাই বললো, ভিডিও কলে কথা বলবে। জানো, ও আগের চেয়ে আরো বেশি সুন্দর হয়ে গেছে। এত্ত সুন্দর হয়েছে কি আর বলবো? মেয়েটা স্টিল নাউ সিংগেল। একটু আগেই ওকে বলছিলাম আমি ম্যারিড না হলে ওকে বিয়ে করে ফেলতাম।”
-” এখনই করে ফেলো। না করেছে কে?”
-” এই শুনো না, নিশি ফোন দিচ্ছে মোবাইলে। ওয়েটিং পাচ্ছে মেয়েটা। তুমি ফোনটা একটু কাটো।”
-” আমি যে এখানে তোমার জন্য ঘুরঘুর করছি?”
-” তুমি বাসায় চলে যাও।”
সুহায়লা একটা কথাও আর বলেনি। ফোনটা কেটেই নিচে চলে যাচ্ছে ও। দু গাল বেয়ে পানি ঝড়ছে সুহায়লার। বাসায় ফিরেই দরজা আটকে ইচ্ছেমতো কেঁদেছে কতক্ষন। এটা কি কষ্টের কান্না ছিলো নাকি রাগের সেটা তার জানা নেই। মা বোন অনেকবার দরজা ধাক্কাদিয়েছে। কিন্তু সে খুলেনি। দুঘন্টা হয়ে গেছে এখনো সুহায়লা গেট খুলছে না। শেষমেষ দিশেহারা হয়ে সাবাকে দিয়ে তানভীরের কাছে খবর পাঠিয়েছেন। তানভীরের বাসায় যেয়েই ড্রইংরুমে দেখতে পেলো তানভীরকে।
-” দুলাভাই সুহার সাথে আপনার ঝগড়া হয়েছে?”
-” আরে নাহ। তোমার বোনের সাথে একটু মজা নিচ্ছি। ও খুব বড় মুখ করে বলছিলো আমি অন্য মেয়ের সাথে কথা বললে ওর নাকি হিংসা হয় না। তাই একটু বাজিয়ে দেখছি আর কি।”
-” রাত পোহালেই সুহার জন্মদিন। আর আপনি আজকে এসব ফাযলামি শুরু করেছেন? ও শখ করেছিলো কাল দুপুরে ওর ফ্রেন্ডদের সাথে বাহিরে বার্থডে সেলিব্রেট করবে। সেখানে আপনাকেও নিয়ে পরিচয় করাবে সবার সাথে। কখনো তো ওদের সাথে আপনি মিট করেননি। তাই এই সুযোগে আপনার সাথে পরিচয়টা সেড়ে নিবে। যেভাবে ক্ষেপে আছে মনে হচ্ছে না ও আর বার্থডে সেলিব্রেট করবে।”
-” কালকে ওর বার্থডে?”
-” হুম।”
-” আমার একদম মনে ছিলো না।”
-” থাকবে কিভাবে? ওকে তো আপনার পছন্দই হয়নি।”
-” খোঁচাচ্ছো কেনো?”
-” তো আর কি করবো? দুইঘন্টা যাবৎ দরজা আটকে বসে বসে কাঁদছে ও। খুব কি প্রয়োজন ছিলো ওকে এভাবে ক্ষেপানোর?
তানভীর আর কোনো কথা না বলে সোজা বাসা থেকে বেরিয়ে সুহায়লার বাসায় চলে এলো। দরজার বাহির থেকে একনাগারে দরজা ধাকাচ্ছে আর সুহায়লা কে ডাকছে। কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তানভীরের। কি প্রয়োজন ছিলো আজকেই এমন একটা অঘটন ঘটানোর? বাসাত বাহিরে বেরিয়ে সুহায়লার রুমের জানালায় এলো তানভীর।গ্রিলের ওপাশ থেকে সুহায়লাকে দেখতে পাচ্ছে সে। মেয়েটা খাটের উপর বসে আছে। কাঁদতে কাঁদতে নাক চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে ।
-” সুহা, দরজাটা খুলো।”
-“…………।”
-” তোমার সাথে কথা আছে। প্লিজ দরজাটা খুলো।”
-“………..”
-” ঠিকাছে। দরজা খুলতে হবে না। তুমি আমার দিকে তাকাও।”
-“………..”
-” এই মেয়ে, তাকাও না আমার দিকে। আমি কি বলি সেটা একটু শুনো।”
-“………..”
-” আমি তোমার সাথে মজা করেছি সুহা। তুমি সেদিন বলেছিলে তোমার হিংসা হয় না এজন্যই একটু…… বিশ্বাস করো আমার কোনো কালেই মেয়ে ফ্রেন্ড ছিলো না। সকালে বিদেশ থেকে এক বন্ধু ফোন করেছিলো ওর সাথে কথা বলেছি। বিকালে ফাহিমের সাথে ভিডিও কলে কথা বলেছি। বিশ্বাস না হলে ফাহিমকে ফোন করে জিজ্ঞেস করো। আমি জাস্ট দেখতে চাচ্ছিলাম তুমি কি করো।”
তানভীর ওকে নিয়ে মজা করেছে শুনে আরো ক্ষেপে গেলো সুহায়লা। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে শুরু করলো সে,
-” দেখেছো? কলিজা ঠান্ডা হয়েছে তোমার?”
-” দেখার শখ মিটে গেছে বউ। আর জীবনেও এই কাজ করবো না। সরি। দরজাটা খুলো প্লিজ।”
-” অন্যের ফিলিংস নিয়ে মজা করতে খুব ভালো লাগে তাই না? যত্তসব নোংরা মেন্টালিটির লোক।”
-” দরজাটা খুলো। আমি ভিতরে আসি। আমাকে ধরে মনমতো পিটাও।”
-” তোমাকে আমি যাস্ট সহ্য করতে পারছিনা। অসহ্য লাগছে তোমাকে। যাও, সরো এখান থেকে।”
সুহায়লাকে কখনো এভাবে ক্ষেপতে দেখেনি তানভীর। সুহায়লার এমন রাগে অভ্যস্ত না সে। মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে ওর। কিভাবে সে এই রাগ সামাল দিবে বুঝে পাচ্ছে না।
-” তুমি কি যাবা এখান থেকে নাকি………”
-” আমি যাবো না। যতক্ষন না দরজা খুলছো এক পাও নড়বো না এখান থেকে। দেখি তুমি কতক্ষন দরজা না খুলে থাকতে পারো?”
সুহায়লা উঠে ঘরের লাইট অফ করে বিছানায় অন্য পাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে রইলো। বাহির থেকে লাগাতার সুহায়লাকে ডেকেই যাচ্ছে ও। ইতিমধ্যে সাদমান বাসায় চলে এসেছে। বাসায় এসে সাবার মুখে সব শুনেছে। বাড়ির বাহিরে তানভীরের পাশে যেয়ে দাঁড়ালো সাদমান।
-” দরজাটা খোল না সুহা। ভাইয়া কখন থেকে তোকে ডাকছে।”
সুহা লাইট জ্বালিয়ে একহাত কোমড়ে রেখে সাদমানকে বললো,
-” আজকেই একটা দফারফা করবো। কে তোর আপন? আমি না তানভীর?”
” এটা কেমন প্রশ্ন? আমি তোদের দুজনকেই ভালোবাসি। তোদেরকে আলাদা দেখলে কষ্ট হয়। তুই না কত লক্ষী। প্লিজ গেইট টা খুলে দে।”
-” তোমার বোনকে সেই কখন থেকে লক্ষী,সোনা, জাদুমনি ডাকতে ডাকতে এই ঠান্ডার মধ্যেও গায়ের ঘাম ছুটিয়ে ফেলেছি। তবুও ও গেইট খুলছে না। এখন কিন্তু আমি দরজা ভেঙে ফেলবো।”
-” আপনিও তো কম যান না। কি দরকার ছিলো এত সিরিয়াস টপিক নিয়ে মজা করার? ও ছোটবেলা থেকেই একটু পজেসিভ মাইন্ডের। ও আপনাকে খুব ভালোবাসে। আপনার কি উচিত হয়েছে আমার বোনের সাথে এমন করা? দেখেন তো মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে কি হাল করেছে নিজের। আপনাকে শাস্তি দেয়া উচিত। শাস্তি হচ্ছে আজকে আপনি সারারাত ওকে নিয়ে বাহিরে ঘুরবেন।”
-” আমি রাজি।”
-” সুহা আমি উনাকে বকে দিয়েছি। শাস্তিও মেনে নিয়েছে। রেডি হয়ে আয়। তোকে নিয়ে ঘুরতে যাবে।”
-” চামচামি বন্ধ কর সাদি।”
-” আচ্ছা তাহলে তুই অন্য কিছু চাস? বল ভাইয়াকে। যা বলবি তাই এনে দিবে।”
-” ডিভোর্স চাই আমি। এনে দিতে বল।”
-” তুই এটা কি বললি? সামান্য একটা ব্যাপারকে তুই এত বড় কেনো করছিস? ডিভোর্স মানে বুঝিস তুই?”
-” হ্যা বুঝি। বুঝি দেখেই এতদিন চুপ ছিলাম।”
কথাটা বলেই হুট করে তার মনে পড়ে গেলো এটা সে কি বললো? সব সত্যি তো এখনই বলে দিতে যাচ্ছিলো ও। তানভীর চোখ বড় করে সুহায়লার দিকে তাকিয়ে আছে। কি করতে যাচ্ছিলো মেয়েটা? এখনই তো আগুন লাগিয়ে দিচ্ছিলো।
-” কি বলতে চাচ্ছিস? ভাইয়া তোকে ভালোবাসে না? বড় কিছু হয়েছে তোদের মাঝে?”
-” না।”
-” তাহলে এমন করছিস কেনো? দরজা খুলে বেরিয়ে আয়। যদি না খুলিস তাহলে বুঝবো বড় কিছু হয়েছে কিন্তু তুই লুকাচ্ছিস।”
নিজের কথার প্যাচে নিজেই ধরা খেয়ে গেছে সুহায়লা। কোনো উপায়ন্তর না দেখে দরজা খুলে দিলো ও। তানভীর দৌড়ে ঘরে এসে ঢুকলো। এসে দেখে সাবা আর তার মা রুমে আছে। ওদেরকে বললো,
-” প্লিজ আপনারা দশ মিনিটের জন্য একটু বাহিরে যাবেন? আমি ওর সাথে একটু কথা বলবো।”
ওরা দুজন রুম থেকে বেরিয়ে এলো। দরজা আটকে দিলো তানভীর। সুহায়লাকে জড়িয়ে ধরেছে সে। সুহায়লা আপ্রান চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়ানোর। কিন্তু পারছেনা। যত চেষ্টা করছে ছাড়ানোর তানভীর তত বেশি ওকে শক্ত করে আটকাচ্ছে।
-” তুমি আমাকে ধরবা না।”
-” কাকে ধরবো?”
-” তোমার নিশিকে যেয়ে ধরো। আমি দেখতে সুন্দর না। ঐ মেয়ে দেখতে সুন্দর ঐ মেয়েকেই কোলে নিয়ে বসে থাকো।
-” নিশি নামের কেউ নেই সুহা। বিলিভ মি। আমি যাস্ট মজা করেছি তো…….”
-” মজা? তাই না? আর কত করতে চাও? আমার ফিলিংস নিয়ে এতদিন মজা করে তোমার শখ মিটে নি?”
-” সরি।”
-” কিসের সরি? এখন আমি তোমাকে প্রায়োরিটি না দিয়ে অন্য কাউকে দেই? তোমার ফোন রিসিভ না করে আসিফের সাথে ঘন্টা ধরে কথা বলি? কেমন লাগবে?”
মূহূর্তে চেহারার রঙ পাল্টে গেলো তানভীরের। আসিফের নাম তার সহ্য হয় না। তবু কেনো বলে এসব?
-” জানে মেরে ফেলবো একদম। এখানে আসিফ আসছে কোথ্থেকে? কথা হচ্ছে তোমার আর আমার মাঝে। আসিফকে টানছো কেনো?”
-” তুমি নিশিকে টেনেছো কেনো?”
-” ঝাড়ুপেটা হয়েছে আমার নিশিকে টেনে এনে। ঐ নামের কাউকে আমি চিনি না। বিশ্বাস করো। প্লিজ….।”
সুহায়লা নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে। তানভীরের গলা পেঁচিয়ে ধরেছে সে।
-” তুমি অনেক খারাপ তানভীর।”
-” সরি।”
-” আমাকে কষ্ট দিতে মজা পাও তাই না?”
-” সরি।”
-” আমি দূরে চলে গেলে বুঝবা।”
-” তোমাকে যেতে দিলে তো? তোমার পিছু আমি ছাড়ছি না। তুমি যেখানে যাবা সেখানে ছায়ার মতো আমিও যাবো

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here