বন্ধ দরজা পর্ব ৫

বন্ধ দরজা ৫

গুঁটিসুটি হয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুহায়লা। নাইট ড্রেস টা সাইজে একটু বেশিই ছোট। এত ছোট পোশাকে সুহায়লা অভ্যস্ত নয়। বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে খাটো ড্রেসটাকে টেনেটুনে লম্বা বানানোর চেষ্টায় আছে সুহায়লা। তানভীর খাটে হালকা হেলান দিয়ে পায়ের উপর ল্যাপটপ রেখে তার কোন ক্লাইন্টের সাথে ইংলিশে বকবক করছে। সে এখনও সুহায়লাকে খেয়াল করেনি। সুহায়লা ব্যাপক চিন্তিতো কিভাবে এত ছোট ড্রেসে তানভীরের সামনে যেয়ে দাঁড়াবে। গতকাল রাতে নানী আর খালাতো ভাইয়ের বউ অনেক সময় নিয়ে তাকে বুঝিয়েছে স্বামীর সামনে লজ্জা করতে নেই। সুহায়লা তখন কথাগুলো বুঝেছেও। কিন্তু এখন সে তার লজ্জাটাকে কোনোভাবেই কন্ট্রোলে আনতে পারছেনা। তানভীর ভিডিও কলে কথা বলার ফাঁকে আড়চোখে সুহায়লাকে দেখলো সে দাঁড়িয়ে কাপড় টানছে। এরপর সে ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে সুহায়লাকে হাতের ইশারা দিয়ে বললো সে যেনো তানভীরের পায়ের সাইডে এসে বসে। সুহায়লা একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। এর মাঝে তানভীর কল কেঁটে দিয়ে সুহায়লাকে ভ্রু কুঁচকে বেশ জোরেই ধমক দিলো।
-” এই মেয়ে, বাথরুমের দরজার ওখান থেকে খাট পর্যন্ত আসতে এত সময় লাগে?”
তানভীরের ধমক খেয়ে সুহায়লা পায়ের গতি বাড়ালো। খাটের উপর সুহায়লা বসা মাত্রই ওকে একটানে নিজের বুকের উপর টেনে আনলো তানভীর। এক হাত সুহায়লার কোমড়ের উপর রেখে অন্য হাত দিয়ে সুহায়লার এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে তানভীর। ভ্রু কুঁচকে চোখ জোড়া খুব শক্ত করে বন্ধ করে রেখেছে সুহায়লা। পুরো শরীর শক্ত হয়ে জমে আছে। সুহায়লাকে আরো কাছে টেনে গলায় চুমু খেলো তানভীর। তানভীরের চুমুতে কুঁকড়ে যাচ্ছে সুহায়লা। মূহূর্তেই সুহায়লাকে বুকের উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায়ফেলে দিলো তানভীর। এবার সুহায়লা চোখ মেলে তাকালো তানভীরের দিকে। উনি এমন করে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো কেনো? আবার তখন এক ঝটকায় এতকাছেই টেনে নিয়ে এলো কেনো? তানভীর বিছানা ছেড়ে লাইটের সুইচ অফ করে দিলো। ঘরে আবছা আলোতে দেখা যাচ্ছে তানভীর আবার সুহায়লার কাছে এগিয়ে আসছে। সুহায়লার পাশে শুয়ে তার কানের পাশে হাত বুলাচ্ছে আর বলছে,
-” তোমার সাথে আমার বয়সের পার্থক্য কত জানো সুহায়লা?”
-” জানি। তেরো বছরের।”
-” তোমার বয়সী মেয়েরা আমার বয়সী ছেলেদের বিয়েকরতে চায় না। কেনো জানো? তাদের ধারনামতে ৩০ বছর পেরোলেই পুরুষ মানুষ বুড়ো হয়ে যায়। তাদের পছন্দ ২৫-২৬ বছর বয়সী ছেলে। সে হিসেবে আমিও তো বুড়ো। তোমার চেয়ে তেরো বছরের বড়, ৩৩ বছর বয়সী একজন লোক তোমার শরীরে হাত দিচ্ছে। তোমার গা ঘিনঘিন করছে না?”
তানভীরের এমন প্রশ্নে আকাশ ভেঙে নিচে পড়ে গেলো সুহায়লা। এটা কেমন প্রশ্ন? গা ঘিনঘিন করবে কেনো?
-” আপনার সাথে আমার বয়সের পার্থক্য বেশি সেটা তো আমি জেনেই বিয়ে করেছি গা ঘিনঘিন করার তো কোনো প্রশ্নই আসে না।”
-” এত পার্থক্য জেনেও কেনো বিয়ে করেছো?”
-” আমার ফ্যামিলি আপনাকে পছন্দ করেছে তাই।”
-” ফ্যামিলির পছন্দে বিয়ে করে নাকি কেউ আজকাল? প্রতিটা মেয়েই বিয়ের আগে যাচাই বাছাই করে নেয় যে বিয়ে করে সে কতটুক লাভবান হবে। অন্য দশটা মেয়ের মতো তুমিও তাই বিবেচনা করেছো। ”
-” মানে?”
-” এতটা ন্যাকা সাজার প্রয়োজন নেই সুহায়লা। আমি সোজাসাপ্টা কথা পছন্দ করি। তোমার মতো মিডেল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়েরা বিয়ের আগে চিন্তা করে পাত্রের ব্যাংক ব্যালেন্স, প্রপার্টি, আর মান্থলি ইনকাম। ম্যাক্সিমাম মেয়েরাই চায় পয়সাওয়ালা ছেলেকে বিয়ে করে নিজের ফ্যামিলিকে ফিন্যান্সিয়ালি সাপোর্ট করার। তুমিও তার ব্যতিক্রম না। আমার মতো এত বড়লোক ফ্যামিলিতে তোমার বিয়ে হবে এটা তোমার ফ্যামিলির লোকেরা আদৌ কোনোদিন স্বপ্নেও ভেবে দেখেছে কি না সন্দেহ আছে। প্রস্তাব পাওয়া মাত্রই তোমার ফ্যামিলি সেটা লুফে নিলো। বিগত একুশ দিনে তোমার সাথে কোনো কন্টাক্ট করিনি কেনো জানো? আমি চাচ্ছিলাম যে তুমি বুঝো আমি তোমাকে বিয়ে করতে আগ্রহী নই। কিন্তু না, তুমি বুঝা সত্ত্বেও আমাকে বিয়ে করেছো। এর মানে কি দাঁড়ায়? আমার ইচ্ছা অনিচ্ছাটা তোমার দেখার বিষয় না। তোমার কথা হচ্ছে পয়সাওয়ালা ছেলে পেয়েছি, এবার যেভাবেই হোক তার গলায় ঝুলতে হবে। আর তুমি সাকসেসও হয়েছো।”
সুহায়লার গলায় কথা আটকে গেছে। কি শুনছে এসব? এটা কি কোনো দুঃস্বপ্ন? শেষমেষ তাকে এইকথা শুনতে হচ্ছে যে টাকার জন্য সে তানভীরকে বিয়ে করেছে? তানভীর আবার বলতে শুরু করলো ,
-” টাকা যেহেতু তোমার প্রয়োজন, ঠিকাছে টাকা তুমি পাবা। কিন্তু তোমাকে তো আমি এমনি এমনি টাকা দিবোনা। তুমি আমার শারীরিক চাহিদা মিটাবে আর আমি তোমার টাকার চাহিদা মিটাবো। আমি যখন যেভাবে তোমাকে দেখতে চাইবো নিজেকে এক্স্যাক্টলি সেভাবেই প্রেজেন্ট করতে হবে তোমাকে। বুঝেছো?”
সুহায়লা কোনো উত্তর দিচ্ছেনা। নিঃশব্দে ওর দুচোখ বেয়ে পানি ঝড়ছে। সে পানি তানভীরের হাত গড়িয়ে বিছানায় পড়ছে। সুহায়লার কান্নাকে উপেক্ষা করে তার ঠোঁট জোড়া নিজের অধীন করে নিলো তানভীর। তার চোখের পানিতে তানভীরের কিছুই আসে যায় না। সে তো মাত্রই সুহায়লার সাথে বিনিময় করেছে । টাকা এবং দেহের বিনিময়। অতএব কারও চোখের পানিতে এই বিনিময় স্থগিত হবার নয়।
ভোর সোয়া চারটা বাজে। তানভীর ক্লান্ত হয়ে বেঘোর ঘুম ঘুমুচ্ছে। বাথরুমে শাওয়ার ছেড়ে ফ্লোরে বসে কাঁদছে সুহায়লা। গতরাতে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত তার উপর নিজের সর্বোচ্চ অধিকার খাটিয়েছে তানভীর। তার প্রতিটা স্পর্শে বিন্দুমাত্র ভালোবাসা অথবা আন্তরিকতার ছোঁয়া ছিলো না। থাকবেই বা কি করে? তানভীর তো তার সাথে বিনিময় করেছে। নিজেকে কোনো মানুষ মনে হচ্ছেনা সুহায়লার। মনে হচ্ছে সে শুধুমাত্র একটা মাংসের দলা। এ কোন জীবনে পা রেখেছে সে? সবকিছুইকেই নরক মনে হচ্ছে। এই জীবনে কি কখনো সে তার পূর্ন সম্মান পাবে নাকি আজীবন একটা মাংসের দলা হয়েই থাকতে হবে?
গোসল সেড়ে ফজরের নামাজ পড়ে নিয়েছে সুহায়লা। সারারাত কাঁদার ফলে মাথা ঝিমঝিম করছে তার। চোখ দুটোও ব্যাথা করছে। এই মূহূর্তে তার ঘুম প্রয়োজন। পুরো আধাঘন্টা ঘুমানোর আপ্রান চেষ্টা করার পরও ঘুম আসছে না সুহায়লার। এমন পরিস্থিতিতে ঘুম আসার কথাও না। সে বারবার তানভীরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। যতবারই তার মুখের দিকে তাকাচ্ছে ততবারই কান্না পাচ্ছে সুহায়লার। স্বপ্ন ছিলো এই মানুষটার সাথে তার একটা সুখের সংসার হবে। অথচ……. দীর্ঘশ্বাস ফেললো সুহায়লা। খাটের এপাশ ওপাশ করতে করতে সকাল সাতটা বেজে গেছে। আর শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না। তাছাড়া বাড়ির বউ সে। নাস্তা বানানোর দায়িত্বটাও তারই। তাই আর শুয়ে থাকাটাকে ভালো মনে করলো না সুহায়লা। নিচে নেমে দেখে ড্রইংরুমে বসে চা খাচ্ছে তার শ্বশুড়। ওকে দেখামাত্রই ফরহাদ সাহেব বললেন,
-” কি ব্যাপার আম্মু? এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লে যে?”
-” আব্বা, আসলে আমার ঘুম আসছিলো না তো তাই। তাছাড়া নাস্তাও তো বানাতে হবে।তাই চলে এলাম।”
সুহায়লার মুখ দেখে বিশেষ ভালো ঠেকছে না ফরহাদ সাহেবের। উনি বেশ ভালোই বুঝতে পারছেন এই মেয়ে সারারাত কেঁদেছে। রফিকের ধারনা বোধহয় ঠিক হয়েছে। তানভীর নিশ্চয়ই ওকে উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে। উনি সুহায়লাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-” মা, কোনো সমস্যা?”
সুহায়লা চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রশ্নটা শুনে চোখের পানি উপচে পড়তে চাচ্ছে তার। বহু কষ্টে সামলে রেখেছে সে। ফরহাদ সাহেব আবার বললেন,
-” মা তুমি আমাকে বলতে পারো?”
-” তেমন কিছু না আব্বা। বাসার মানুষদের জন্য কষ্ট হচ্ছে।”
-” ওহ্। এটা কিছু না। আস্তে আস্তে দেখবে নিজের সংসারটাকেই কাছের মনে হবে। তখন আর বাবার বাড়ির লোকদের জন্য কষ্ট হবে না। যাও, রান্নাঘরে নয়ন আছে। ও তোমাকে সব দেখিয়ে দিবে কোথায় কি আছে।”
ফরহাদ সাহেব বেশ ভালোই বুঝেছেন যে সুহায়লা তার বাবার বাড়ির মিথ্যা অযুহাত দেখিয়েছে। উনি জানেন এ মূহূর্তে আর কথা বাড়ালে সুহায়লা তার চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারতো না।
কিচেনে সুহায়লা পা রাখা মাত্রই নয়ন সবকটা দাঁত বের করে বললো,
-” আপনে রান্নাঘরে আইছেন কেন ভাবী?”
-” নাস্তা বানাবো।”
-” আপনে নতুন বউ। হুদাই কষ্ট করবেন কেন ভাবী। আপনে ফ্যানের তলে গিয়া বইয়া থাকেন। নাস্তা বানায়া টেবিলে সাজানো হইলে আপনেরে আমি ডাকুম।”
-” না আপা। এটা তো আমার নিজের সংসার। আমি কাজ করবো না তো কে করবে? তাছাড়া আপনি তো আছেনই হেল্প করার জন্য।”
-” এ আল্লাহ…. আপনে আমারে আপা ডাকতাছেন ক্যান? আমি এই বাড়ির কাজের মাইয়্যা। আপনে আমার নাম ধইরা ডাকবেন।”
-” আপনি আমার বয়সে বড়। কাজের লোক হয়েছেন তো কি হয়েছে? তাই বলে কি আপনাকে সম্মান দিবোনা?”
-” ভাবী আপনে ভালা মানুষ। খুব চিন্তায় আছিলাম নতুন বউ কেমন না কেমন পড়বো। আমারে না আবার এইখান থেইকা ছাটাই কইরা দেয়। ছাটাই করলে মাইয়্যা নিয়া যামু কই। খামু কি?”
-” আপনার মেয়ে আছে?”
-” হ আছে একটা। সাত বছর বয়স। বাইরে বাগানের গাছে পানি দিতাছে।”
-” আপনার হাজবেন্ড কি করে?”
-” সে আমারে ছাইড়া দিছে আরো ছয় বছর আগে। আমার মা আগে এই বাড়িতে কাম করতো। জামাই ছাইড়া দেওনের পর থেইকা এই বাড়িতে কাম করি। আরও দুইজন মাইয়্যা আছে এই বাড়িতে কাম করে। চুমকি আর টুনি। তারা আটটার দিকে আসে আর সন্ধ্যার দিকে চইলা যায়।”
-” উনি আর বাবা সকালে নাস্তা কি খায়?
-” তানভীর ভাই সকালে ডিম সিদ্ধ, তিনটা রুটি , মাংস তরকারি আর নয়তো সবজি , একটা আপেল আর এক মগ কালা কফি খায়। বড়সাহেব একগ্লাস ফলের জুস, দুইটা রুটি , সবজি ভাজি আর নয়তো ডাল ভাজি খায়।”
-” আপনি তো সবজি কেটেই ফেলেছেন। আমি রান্না এক চুলায় বসাচ্ছি। আপনি রুটিগুলো বানিয়ে দিন আমি অন্য চুলায় সেঁকে নিচ্ছি।”
নাস্তা বানানো শেষে টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে সুহায়লা আর নয়ন। ড্রইংরুমে ফরহাদ সাহেব তানভীরের সাথে কথা বলছেন আজ রাতের রিসিপশন পার্টি নিয়ে। কথা বলতে বলতে দুজনই টেবিলে এসে বসলো।
-” সুহায়লা তুমিও বসো।”
-” না আব্বা আমি পরে খাবো।”
তানভীর মাত্র মুখে রুটি ঢুকিয়েছে। সুহায়লার কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেলো তানভীরের।
-” আব্বা কি হ্যাঁ? এগুলো কি ধরনের ভাষা? তোমার এসব মিডেল ক্লাস ল্যাঙ্গুয়েজ এখানে বলতে আসবে না। তোমার শ্বশুড়বাড়ি কোনো মিডেল ক্লাস না যে তুমি এখানে আব্বা শব্দ ইউজ করবে। আমার বাবাকে হয় আব্বু ডাকবে আরনয়তো বাবা ডাকবে।”
-” সুহায়লা আমাকে আব্বাই ডাকবে। আমার কোনো সমস্যা নেই। তোর এত সমস্যা হচ্ছে কেনো?”
(চলবে)
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here