#বর্ষণের সেই রাতে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৫৩
.
আদ্রিয়ান, অনিমা, তীব্র স্নেহাদের বাড়ির ড্রয়িং রুমে বসে আছে। স্নেহার বাবা মা গম্ভীর মুখ করে বসে আছে। আর সেন্হা এক সাইডে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তীব্র যদিও আসতে চায়নি কিন্তু অনিমা আর আদ্রিয়ান মিলে জোর করে নিয়ে এসছে ওকে। স্নেহার বাবা আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” আরে তোমারা কিছু নিচ্ছোনা কেনো?”
আদ্রিয়ান স্নেহার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
— “এসব ছাড়ুন। আপনি তো জানতেন যে স্নেহা আর তীব্র একে ওপরকে ভালোবাসে। তবুও নিজের জেদটাকে টিকিয়ে রাখতে স্নেহার বিয়ে অন্যকারো সাথে দিতে চাইছেন সেটাকি ঠিক করছেন?”
আদ্রিয়ানের কথাটা শুনে ভ্রু কুচকালো স্নেহার বাবা, তারপর একটা শ্বাস নিয়ে বলল,
— ” মেয়েটা আমার। ওর কীসে ভালো হবে কীসে খারাপ হবে সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। আমি যেই ছেলে ঠিক করেছি যে যথেষ্ট ভালো।”
আদ্রিয়ান ওনার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” আর তীব্র? ওকে কোন দিক দিয়ে খারাপ মনে হলো আপনার?”
স্নেহার বাবা গম্ভীর কন্ঠে বলল,
— ” ও শুধুমাত্র একজন জার্নালিস্ট।”
কথাটা শুনে তীব্র ওখান থেকে চলে যেতে নিচ্ছিলো কিন্তু আদ্রিয়ান ওর হাত ধরে আটকে নিয়ে স্নেহার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” তো স্যার আপনার কী মপে হয় আপনার দেখা ছেলের সাথে স্নেহা ভালো থাকবে?”
স্নেহার বাবা একবার স্নেহা দিকে তাকিয়ে বললেন,
— ” অবশ্যই থাকবে। কী আছে তীব্রর শুধু একটা জব ছাড়া? আমি যেই ছেলেটা দেখেছি যে তার বাবার একমাত্র সন্তান। বাবার পর ওদের বিজনেস ওই সামলামে, কোনো রকমের অভাব নেই। কী নেই ওখানে?”
তীব্র কিছু বলবে তার আগেই আদ্রিয়ান বলল,
— ” ভালোবাসা আছে স্যার ? ওখানে কী স্নেহা ওর ভালোবাসা পাবে? স্যার ওরা একে ওপরকে ভালোবাসে এটাকী যথেষ্ট নয়? এমন তো নয় তীব্র বেকার! তীব্রর কাছে স্নেহার সমস্তরকম ভরনপোষণের ক্ষমতা আছে। তাহলে সমস্যা কোথায়? জানি ঐ ছেলেটার ফিউচার তীব্রর চেয়ে বেশি উন্নত। কিন্তু আপনার মেয়ে তীব্রর কাছেই বেশি ভালো থাকবে তার গ্যারান্টি আমি আপনাকে দিতে পারি।”
অনিমাও স্নেহার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” হ্যাঁ আঙ্কেল। তীব্র আর স্নেহা একে ওপরের সাথে খুব ভালো থাকবে। আর ভালো থাকার জন্যে প্রচুর টাকা থাকার প্রয়োজন পরে না। শুধু ভালোবাসা থাকতে হয় যেটা ওদের দুজনের মধ্যে আছে। আঙ্কেল স্নেহাও আপনাকে খুব ভালোবাসে তাই আপনার কথা ভেবে, আপনার কথা অমান্য করবেনা বলে নিজে এতো কষ্ট পেয়েও আপনার পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে। আপনারাও তো উচিত তাইনা স্নেহার ভালোর কথা ভাবা?”
আদ্রিয়ান আবারও বলল,
— ” তবে আঙ্কেল কোনোকিছু ভাবার আগে এটা মাথায় রাখবেন যে কোনটা আপনার কাছে বেশি ইম্পর্টেন্ট? নিজের জেদ নাকি নিজের মেয়ের খুশি?”
স্নেহার বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ভাবলেন। তারপর স্নেহার মা এর দিকে তাকালেন। তারপর গলা ঝেড়ে বললেন,
— ” ঠিকাছে আমার মেয়ে যদি তীব্রর কাছেই ভালো থাকে তাহলে তাই হোক। ওর বিয়ে তীব্রর সাথেই হবে। আর হ্যাঁ আমি মন থেকেই বলছি কথাটা। ”
সকলের মুখেই হাসি ফুটে উঠল শুধু তীব্র বাদে, ও এখোনো গম্ভীর মুখেই দাঁড়িয়ে আছে। অনিমা উঠে গিয়ে স্নেহাকে জরিয়ে ধরল। স্নেহার বাবা তীব্রর কাছে গিয়ে বললেন,
— ” যা বলেছি তার জন্যে কীছু মনে করোনা বাবা। আসলে মেয়েকে আরামে রাখার আশা করে গিয়ে ভুলেই গেছিলাম যে মেয়ে কোথায় ভালো থাকবে, সুখে থাকবে।”
তীব্র মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে বলল,
— ” ইটস ওলরাইট আঙ্কেল আমি কিছু মনে করিনি।”
আদ্রিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলল,
— ” আঙ্কেল আপনি হয়তো জানেননা যে তীব্রর বাবাও একজন বিজনেসম্যান।”
স্নেহার বাবা আর মা দুজনেই চমকে গেলেন। স্নেহার বাবা অবাক হয়ে বললেন,
— ” তীব্রর বাবা বিজনেসম্যান? তাহলে ও জার্নালিস্ট মানে..”
আদ্রিয়ান মুখে হাসি রেখেই বলল,
— ” ইচ্ছে আঙ্কেল! জার্নালিসম ওর প্যাশন ছিলো। তাই ও এটাকেই প্রফেশন হিসেবে বেছে নিয়েছে। যেমন আমি মিউসিক কে। কারণ এগুলোতে আহামরি টাকা না পাওয়া গেলেও শান্তি পাওয়া যায়।”
স্নেহার বাবা বেশ লজ্জিত হলেন এসব শুনে। কী ভেবেছিলো তীব্রখে আর ও কী বেড়োলো।এরপর সবাই একসাথে গল্পগুজব করতে শুরু করলো। তীব্র ‘এক্সকিউজ মি’ বলে গার্ডেন এরিয়ার দিকে চলে গেলো। অনিমা ইশারা করতেই স্নেহাও পেছন পেছন গেলো। গিয়ে দেখে তীব্র পকেটে হাত ঢুকিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পুলের পানির দিকে। স্নেহা মুচকি হাসি দিয়ে পেছন জরিয়ে ধরলো তীব্রকে। তীব্র বুঝতে পারলো এটা স্নেহা তাই ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই স্নেহা বলল,
— ” আই এম সরি…”
তীব্র পাত্তা না দিয়ে দিয়ে ছাড়াতে নিলেই স্নেহা আবার বলল,
— ” এমন করোনা প্লিজ। সরি বলছি তো আমি। আর এমন করবোনা!”
তীব্র এবার বিরক্ত হয়ে বলল,
— ” এমন কী আর করার দরকার আছে?”
স্নেহা মুখ ফুলিয়ে বলল,
— ” সরি বললাম তো?”
তীব্র স্নেহাকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুরে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” হ্যাঁ পারো তো সেটাই। যা খুশি তাই করে এরপর একটা সরি বললেই সব শেষ।”
স্নেহা এবার কিউট ফেস করে কান ধরে বলল,
— ” প্লিজ এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। দেখো সব ঠিক হয়ে গেছে তো এখন। বাবা মা ও মেনে নিয়েছে। ইটস টাইমস টু সেলিব্রেট। প্লিজ রাগ করে থেকে মুমেন্ট টা নষ্ট করোনা প্লিজ!”
তীব্র কোমরে হাত দিয়ে নিচের ঠোঁট টা কামড়ে ধরে চোখ সরিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
— ” সাচ আ ড্রামাকুইন।”
স্নেহা হেসে দিয়ে তীব্রকে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো। তীব্রও আর নিজের রাগ ধরে রাখতে পারলোনা। ওও হেসে জরিয়ে ধরলো স্নেহাকে। এতবছরের ভালোবাসা আজ সার্থক হলো এখন আর ওদের মধ্যে কোনো বাধা নেই। আছে শুধু ভালোবাসা,অফুরন্ত ভালোবাসা।
অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলে স্নেহাদের বাড়ি থেকে ফিরে আসার সময় স্নেহা আর তীব্র দুজনেই আদ্রিয়ান আর অনিমাকে হাগ করে ধন্যবাদ জানালো, কারণ এসবের পেছনে পুরো কৃতিত্ত্বই ওদের দুজনের। ওখান থেকে বেড়িয়ে তীব্র ওর গাড়ি করে নিজের বাড়ি চলে গেলো।অাদ্রিয়ান আর অনিমা ও বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল। গাড়িতে অনেক্ষণ দুজনেই চুপচাপ ছিলো। কিছুক্ষণ পর অনিমা আদ্রিয়ানে দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— ” থ্যাংকস্।”
আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে একবার অনিমার দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতে বলল,
—- ” হঠাৎ থ্যাংকস কেনো?”
অনিমা সিটে হেলান দিয়ে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” আপনার জন্যেই আজ সবটা সম্ভব হলো। আপনি স্নেহার বাবাকে ওভাবে না বোঝালে উনি বুঝতে পারতেন না। সো থ্যাংকস।”
আদ্রিয়ান হালকা হাসলো অনিমার কথায় তারপর বলল,
— ” আমাদের মধ্যে আমার বা তোমার বলে কোনো শব্দ নেই, সবটাই আমাদের। আমার সবকিছুই তোমার আর তোমার সবকিছুই আমার। ইনফ্যাক্ট তুমি আমার, আর আমি পুরোটাই তোমার।”
এটুকু বলে অনিমার দিকে তাকাতেই অনিমা সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিলো। আদ্রিয়ানের কথাগুলো শুনে ওর হার্ট তীব্র গতিতে বিট করা শুরু করে দিয়েছে। তাই আর আদ্রিয়ানের দিকে তাকালো না ও বাইরে তাকিয়ে রইলো। আর আদ্রিয়ান মুচকি হেহে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো।
_____________________
আবরার মেনশন আজ খুব চমৎকার করে সাজানো হয়েছে। চারপাশটা বিভিন্ন রংয়ের লাইটিং এর আলোয় ঝকঝক করছে। খুব চমৎকার লাগছে দেখতে। বিভিন্ন অতীথি, ফিল্ম এন্ড মিউসিক ইন্ডাস্ট্রির মানুষ এসছে। আর তারসাথে মিডিয়ার লোকেরা তো আছেই, প্রায় সব নিউস কম্পানির রিপোর্টার রাই উপস্হিত এখানে। একজন এতোবড় সিঙ্গার এর এনগেইজমেন্ট বলে কথা। মিস্টার এন্ড মিসেস আবরারও খুব ব্যাস্ত আছে বিভিন্ন কাজে। আদিব,আশিস, তীব্র ওরা গেস্টদের ওয়েলকামিং করছে, সামলাচ্ছে। আশিস হাসি মুখে সব কাজ করলেও ওর মুখে বিষন্নতা স্পষ্ট, চোখের নিচে কালো দাগ পরে গেছে, মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সেই দুষ্টু স্বভাবের ছেলেটা যেনো পাল্টে। সবাই ব্যাপারটা বুঝতে পারলেও ইচ্ছে করেই কিছু বলছেনা কারণ ওর একটা শিক্ষা হওয়া দরকার আছে। আদ্রিয়ান আর রিক দুজনেই গেস্টদের সাথে কথা বলছে। আদ্রিয়ান আজকে পুরো ফরমাল ড্রেস পরেছে। ব্লাক কোট, ব্লাক প্যান্ট, হোয়াইট শার্ট আর রেড টাই। হঠাৎ করেই অনিমা আসার এনাউসমেন্ট করতেই সবার দৃষ্টি সিড়ির দিকে গেলো। আদ্রিয়ান আর রিক দুজনে একসাথেই সিড়ির দিকে তাকিয়ে দুজনের চোখই আটকে গেলো। অনিমা হোয়াইটের মধ্যে সিলভার স্টোনের সুন্দর একটা লেহেঙ্গা পরেছে, তেমন গর্জিয়াস কোনো সাজ না সাজলেও সিলভার স্টোনের হালকা কিছু ওর্নামেন্টস পরেছে ও। তাতেই অসাধারন লাগছে ওকে দেখতে। ওর এক পাশে স্নিগ্ধা আরেকপাশে অরুমিতা আর পেছনে স্নেহা দাঁড়িয়ে আছে। আদ্রিয়ানের তো হার্ট বেড়িয়ে আসার উপক্রম হয়েছে। আর রিকও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে কিন্তু পরোক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো আর সরিয়ে নিলো। অনিমার দিকে ওভাবে তাকানোর অধিকার তো ওর নেই, সেই অধিকার শুধু আদ্রিয়ানের। এসব ভেবে নিজেকে শক্ত করার বৃথা চেষ্টা করতে লাগল ও। আদ্রিয়ান মুচকি হেসে সিড়ির কাছে গিয়ে অনিমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো, অনিমা কয়েক সেকেন্ড আদ্রিয়ানের হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে হাত ধরলো। সকলেই খুব জোরে হাততালি দিয়ে উঠলো। এরপর অনিমার হাত ধরেই অাদ্রিয়ান ওকে সেন্টারে নিয়ে গেলো। এখন রিং পরানো হবে তাই সবাই একজায়গায় ভীর করে দাঁড়ালো আদ্রিয়ান সকলের সামনেই অনিমার সামনে হাটু ভেঙ্গে বসল। সাথেসাথেই কলহলপূর্ণ পরিবেশটা শান্ত হয়ে গেলো। অনিমাও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান ওর দিকে রিং টা এগিয়ে দিয়ে বলল,
— ” প্রথম তোমাকে দেখেছিলাম মোমবাতির আবছা হলদে আলোতে। ভেজা চুল, মুখে জমা বিন্দু বিন্দু পানি, এক অদ্ভুত সৌন্দর্য বিরাজ করছিলো তোমার মধ্যে। কিন্তু প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছি বলবোনা তবে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এরপর তোমার ওনেস্টি, কাইন্ডনেস, এন্ড স্পেশিয়ালি তোমার ইনোসেন্সি আমাকে ধীরে ধীরে তোমার প্রতি দূর্বল করে দিচ্ছিল। আর এরপরেই ধীরে ধীরে বুঝতে পারি যে ভালোবাসি আমি তোমাকে। কিন্তু শুরুতে বলিনি, না ভয় বা সংকচের জন্যে নয়। ইচ্ছে করেই। ইচ্ছে করছিলো না বলতে। তবে এখন তুমি আমার জীবণের সেই অংশ হয়ে গেছো যাকে ছাড়া নিশ্বাস নেওয়ার কথাও ভাবতে পারিনা আমি। আমার হৃদপিন্ড তুমি আর আমার হৃদপিন্ডের প্রতিটা স্পন্দনও তুমি। বর্ষণের সেই রাতকে আমি কোনোদিন ভুলতে পারবোনা কারণ আমার জীবনের সেই রাতে তুমি এসছিলে। এন্ড থ্যাংক ইউ সো মাচ ফর কামিং ইন মাই লাইফ। খুব ভালোবাসি আমি তোমাকে আর তোমার সাথেই সারাটা জীবণ কাটাতে চাই আমি। তাই আজ আমার পরিবার, বন্ধু, মিডিয়া সকলের সামনে তোমার কাছে জানতে চাইছি, উইল ইউ ম্যারি মি জানপাখি?”
কারো মুখে কোনো কথা নেই সবাই নিরব দর্শক হয়ে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। অনিমার চোখ দিয়ে ওর অজান্তেই এক ফোটা জল গড়িয়ে পরল। কখনো ভাবেনি যে কেউ ওকে সত্যিই এতোটা ভালোবাসবে, এতোটা ভালোবাসাও ওর পাওনা ছিলো। অনিমা মুচকি হেসে আদ্রিয়ানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
— ” ইয়েস আই উইল।”
আদ্রিয়ান ও হেসে ওকে রিং পরিয়ে ওর হাতে একটা কিস করে উঠে দাঁড়ালো। এরপর অনিমাও আদ্রিয়ানকে রিং টা পরিয়ে দিলো। আদ্রিয়ানকে যেই রিং টা পরানো হয়েছে সেটা অনিমা নিজের টাকা দিয়েই, নিজে পছন্দ করে কিনেছে। আদ্রিয়ান অনিমাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরল। সকলেই জোরে হাততালি দিলো। রিক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো ওদের দিকে আর অনিমাকে প্রথম দেখার সেই দিনটার কথা ভাবছিলো, হাততালির আওয়াজেই হুস এলো ওর। নিজেকে সামলে নিয়ে নিজেও হাততালি দিতে লাগল। ভালোয়ভালো ওদের এনগেইজমেন্ট হয়ে গেলো। এরপর প্রেস কনফারেন্স হলো। আদ্রিয়ানকে গান করতে হলো। আদ্রিয়ানেরই এক গানে অনিমা আর আদ্রিয়ান কাপল ডান্স করলো। রিক একদৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে ওদের দিকে কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছেনা এক অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে ওর মধ্যে।রিকের এই অস্হিরতা কারো চোখে না পরলেও স্নিগ্ধার চোখে ঠিকিই পরেছে।
______________________
গভীর রাত রিক ওর বাড়ির ছাদে বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। চারপাশের পরিবেশটা নিস্তব্ধ হয়ে আছে। এই পরিবেশেও কোথা থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে চাইছে কিন্তু কোথাও একটা চাপাও পরে যাচ্ছে। কিছু কিছু যন্ত্রণা থাকে যেটা খুব অসহ্যকর হয়, যা কারো কাছে প্রকাশ করা যায় না, কাউকে বলা যায় না, একা একাই গুমের মরতে হয় ভেতর থেকে, সেটাও গোপনে কারণ কারো সামনে সেই কষ্ট সেই যন্ত্রণা প্রকাশ করাটাও যে অন্যায়। স্নিগ্ধা ছাদে এসে দেখে যে রিক এক কর্ণারে বসে বসে আকাশ দেখছে। স্নিগ্ধার মনে হয়েছিল যে রিক ছাদেই থাকবে তাই এসছে। আস্তে আস্তে রিকের কাছে গিয়ে রিকের পাশে গিয়ে বসল। পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে রিক তাকালো। তাকিয়ে স্নিগ্ধাকে দেখে কিছু না বলে আবার সামনে তাকিয়ে বলল,
— ” ঘুমোস নি এখনো?”
স্নিগ্ধাও সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” তুমিও তো ঘুমাও নি।”
রিক কিছু না বলে চুপ করে রইলো। রিককে চুপ থাকতে দেখে স্নিগ্ধা নিজেই বলল,
— ” আচ্ছা তুমি তো হসপিটাল জয়েন করতে পারো তাইনা? কেনো করছোনা? ডাক্তারি তো তোমার প্যাশন ছিলো? সার্জারি তে কতো পার্ফেক্ট ছিলে তুমি”
রিক আকাশের দিকে তাকিয়ে স্হির গলায় বলল,
— ” হুমম প্যাশন ছিলো। কিন্তু কিছু কিছু সময় পরিস্হিতি এমন হয়ে যায় যে শখ বা নেশা কোনোটাই পৃরণ করতে ইচ্ছে করেনা। আমারও আর ডাক্তারি করার কোনো ইচ্ছাই অবশিষ্ট নেই। ইনফ্যাক্ট কোনোকিছুর ইচ্ছেই আর নেই। তবে হ্যাঁ যদি কোনোদিন এমন কোনো পরিস্হিতি এসে পরে, আমার ও.টি তে ঢোকাটা যদি খুব বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে পরে সেদিন আমি আবার ও.টি তে ঢুকবো আর সার্জারিও করবো।”
রিকের কথার কোনো উত্তর দিলোনা স্নিগ্ধা। এক শ্বাস ফেলে বলল,
— ” আদ্রিয়ান আর অনিমাকে একসাথে দেখলো তোমার খুব কষ্ট হয় তাইনা?”
রিক হালকা হেসে বলল,
— ” আজব! কষ্ট কেনো হবে? এখানে কষ্ট পাওয়ার কী আছে?”
স্নিগ্ধা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— ” তোমার এই রূপটার সাথে আমি নতুন করে পরিচিত হলাম। এতোটা কষ্ট চেপে রেখে মুখে এভাবে হাসি ফুটিয়ে রাখতে আমার রিক দা জানতো না।”
রিক এবার একটু শব্দ করে হাসলো তারপর স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” কীসব পাগলের মতো বকছিস বলতো? আমার কোনো কষ্ট নেই। ”
স্নিগ্ধা হালকা একটু হেসে বলল,
— ” তুমি সবার কাছে নিজের ইমোশনকে লুকোতে পারলেও আমার কাছে পারবে না এটা তুমিও জানো। আমি জানি তুমি ভেতরে ভেতরে কতোটা কষ্ট পাচ্ছো। খুব ভালোবাসা না ওকে?”
রিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— ” হুমম বাসি। সাত বছর। সাত বছরের ভালোবাসা ও আমার। হ্যাঁ এটা ঠিক যে ওর দুই হাত ধরে কখনো বলতে পারিনি যে ভালোবাসি আমি ওকে। বলতে চাই ই নি কখনো। ধরেই নিয়েছিলাম ও শুধু আমার। ও কী চায়? ওর জীবণে কী চলছে এসব নিয়ে মাথাই ঘামাই নি কোনোদিন। আমি সবসময় ওকে নিয়ে ইনসিকিউর ফিল করতাম। অন্য কোনো ছেলেকে ওর সাথে দেখলে, কাউকে ওর দিকে তাকাতে দেখলে ভীষণ ডেসপারেট হয়ে যেতাম, রাগ লাগতো আমার, ভয় করতো যে ও অন্যকারো হয়ে যাবে তাই সেই রাগ সেই ভয়ের বসে ওর গায়ে হাত তুলতাম। ও পালাতে চাইলেও ভয় লাগতো যদি সত্যিই চলে যায় তাহলে আমার কী হবে? তাই ওভাবে শাস্তি দিতাম যাতে ভয় পেয়ে হলেও আর না পালায়। কিন্তু তখন বুঝতেই পারিনি যে ভালোবাসা জোর করে নয় ভালোবেসেই আদায় করতে হয়, এটা তো আদ্রিয়ান আমাকে শিখিয়েছে। কিন্তু দুঃখ একটাই ভালোবেসেছিলাম ঠিকি কিন্তু ভালোবাসাকে ভালো রাখতে পারিনি। ভালোবাসার মানুষের প্রতি দ্বায়িত্বটা কী সেটাই বুঝতে পারিনি আর যখন বুঝতে পেরেছি ইটস টু লেইট। তবে বিশ্বাস কর স্নিগ্ধু আমি ওখে ভালো রাখতে না পারলেও আমার ভালোবাসাটা মিথ্যে ছিলোনা রে। সত্যিই ভালোবাসি আমি ওকে, খুব ভালোবাসি। আর ভালোবাসলেই যে পেতে হবে তার কোনো মানে নেই সেটাও বুঝতে শিখেছি আমি। আমি এতেই খুশি যে ও আদ্রিয়ানের সাথে ভালো আছে। আর ও ভালোআছে এটুকুই আমার ভালো থাকার জন্যে যথেষ্ট। ও আমার সাথে থাকবেনা ঠিকি কিন্তু আমার মনে সারাজীবন থাকবে। শুধু যন্ত্রণা হচ্ছে এটা ভেবে যে কোনোদিন ওকে বললাম না যে আমি ওকে ভালোবাসি আর যখন বলতে চাই তখন সেটা বলার কোনো অধিকার আমার নেই। ”
রিক অনেক চেষ্টা করেও চোখের কোণের জলটা আর আটকে রাখতে পারলোনা স্নিগ্ধা রিকের কাধে হাত রাখতেই রিক স্নিগ্ধাকে জরিয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে দিলো। রিক কে তো স্নিগ্ধা কাঁদতেই দেখেনা সেইজায়গায় এভাবে কাঁদতে দেখে স্নিগ্ধার কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে। ওও কাঁদছে নিঃশব্দে। ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়ার কষ্টটা ও তো জানে। আর তাকে অন্যকারো সাথে দেখাতো আরো বেশি কষ্টকর।সেই কষ্টের পরিমাপ করা ওই ব্যাক্তি ছাড়া কারো পক্ষে সম্ভব না।”
#চলবে…