বিয়েতে কবুল বলার আগ মুহূর্তে বান্ধবী দৌঁড়ে এসে বলল জারা প্লিজ এই বিয়েটা করিস না।আমি রোহানের সন্তানের মা হতে চলেছি।দোহাই লাগে তোর আমার সর্বনাশ করিসনা।
আমি চমকে উঠে তানিশার দিকে তাকালাম।রোহান বসা থেকে দাঁড়িয়ে গিয়ে কন্ঠে তীব্র প্রতিবাদ নিয়ে বলে ওঠে,এই মেয়ে কি বলছো তুমি?তোমার মাথা ঠিক আছে?
তানিশা টলমল চোখে রোহানের দিকে তাকিয়ে বলে,কেন এরকম করছো আমার সাথে?কি দোষ ছিলো আমার যে তুমি আমাকে ছেড়ে আমার বান্ধবীকে বিয়ে করছো?
রোহানের চোখমুখের ভাবগতি জানান দিচ্ছে সে কতটা ক্ষেপে আছে তানিশার উপর।বাজপাখির ন্যায় তানিশার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সবার উদ্দেশ্যে বলে,এই মেয়েকে তো আমি চিনিই না তাহলে ও আমার সন্তানের মা হয় কিভাবে?
তানিশা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,জানি তুমি এসবই বলবে কারণ এখন আর আমাকে প্রয়োজন নেই।
জারা শুধু নিষ্পলক তাকিয়ে দেখছে কিছুই বলছেনা।জারার বাবা মুহিব হাসান কন্ঠে কাঠিন্যতা বজায় রেখে বললেন,কি হচ্ছে এগুলো?
রোহানের বাবা তেজি কন্ঠে রোহানকে জিজ্ঞেস করলেন,মেয়েটা এগুলো কি বলছে?
রোহান কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,আমি জানিনা বাবা মেয়েটা কেন এসব মিথ্যে বলছে।
রোহানের বাবা তানিশাকে প্রশ্ন করলেন,আচ্ছা মা তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে না তো?জারার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার আগে আমরা রোহানকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি ওর কোনো পছন্দ আছে কিনা।যদি তোমার সাথে সম্পর্ক থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই তোমার কথা বলতো।
আমার প্রয়োজন তো ফুরিয়ে গেছে আঙ্কেল।আমার সাথে তিনবছর প্রেম করে বিয়ে করেছে।আর এখন নিজের সন্তানের দ্বায়ভার এড়াতে চাইছে আপনার ছেলে।
রোহান তেড়ে এসে বলল,একদম মিথ্যে কথা বলবেনা।
জারা নিচের দিকে তাকিয়ে বলল থামুন!তানিশাকে উদ্দেশ্য করে বলে,তোর কাছে কোনো প্রুভ আছে?যেটা দ্বারা তোর কথা গুলো সত্যি প্রমাণিত হয়।
তানিশা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলে,তোকে একটা ছেলের কথা বলেছিলাম না যার সাথে আমার রিলেশন চলছে?রোহানই সেই ছেলে।
রোহান চিল্লিয়ে বলছে এই মেয়ে সব মিথ্যে বলছে।নিশ্চয়ই কারো টাকার কাছে বিক্রি হয়ে এখানে অশান্তি সৃষ্টি করছে।
জারা হাত উঁচিয়ে রোহানকে থামিয়ে দিয়ে তানিশাকে বলল,আর কোনো যুক্তি সঙ্গত প্রমাণ আছে?
তানিশা নিজের ফোনটা জারার হাতে দিয়ে বলল,এই মেসেজ গুলো দেখ।কিছু অডিও ক্লিপ আছে সেগুলো ও শুনবি।সবাইকে তো আর মেসেজ দেখানো সম্ভব না তাই অডিও ক্লিপ সবাইকে শুনাবি।
কিছু মেসেজ চেইক করে জারা অডিও ক্লিপ চালু করলো।মেসেজ গুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে এগুলো কোনো কাপলের প্রেমময় কথন।ওদের কথোপকথন শুনে রোহানের বাবা মাথা নুইয়ে বললেন,ছিঃ তোর মতো ছেলে আমার ঘরে জন্ম নিয়েছে আমার শত্রুর ঘরে যেন আল্লাহ এরকম সন্তান না দেয়।
জারা রোহানের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,এবার আপনার পালা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার।কোনো প্রমাণ আছে কি আপনার কাছে?রোহান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।ও ভাবেনি তানিশা এভাবে সবকিছুর প্রমাণ রেখে দেবে।
জারার বাবা রোহানের বাবাকে বললেন,আপনারা নিজের বাড়ির বউকে বাড়ি নিয়ে যান।জারা ভেতরে গিয়ে চেঞ্জ করে নে।
রোহান অসহায় কন্ঠে বলল,আঙ্কেল!
জারার বাবা বাজখাঁই গলায় বললেন,তোমার লজ্জা হওয়া উচিত।গোপনে বিয়ে করে নিজের সন্তানকে অস্বীকার করছো আবার এসেছো আমার মেয়েকে বিয়ে করতে।তানিশার দিকে ইশারা করে দেখিয়ে বলল,এখন যদি এই মেয়েটা না থেকে অন্যকেউ থাকতো তাহলে তোমাকে আমি পুলিশে দিতাম।আজ এই মেয়েটার জন্য বেঁচে গেলে।
এবার জারার দিকে তাকাতেই জারা বলল,এবার কি আমার মুখ থেকেও কিছু শুনতে চান?দরজা দেখিয়ে বলে দয়া করে আপনারা আসতে পারেন দরজা খোলা আছে।অপমানে রোহানের মুখ লাল হয়ে গেছে।চোখ দিয়ে তানিশাকে ভস্ম করে দিচ্ছে।রোহানের বাবার সামনে গিয়ে জারা বলল,আঙ্কেল তানিশা আপনাদের বাড়ির পুত্রবধু ওর যাতে কোনো অসম্মান না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন।আজ আপনাদের সাথেই তানিশাকে নিয়ে যাবেন।বাকি ওর বাবা মায়ের সাথে আমার বাবা কথা বলে নেবে।
রোহানের বাবা বলল,আমি খুবই লজ্জিত মা!আমাদের ক্ষমা করে দিও আসি।
তানিশাকে সাথে নিয়ে বরযাত্রী বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।
জারা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিতেই সবাই চমকে ওঠে।ওর বাবা-মা,আত্মীয়রা দৌঁড়ে দরজার সামনে গিয়ে জারার নাম ধরে জোরে জোরে ডাকছে।জারা লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল,আমি ঠিক আছি চিন্তা করো না।শুধু কিছুক্ষণ একা থাকতে চাইছি।
জারার বাবা সবাইকে নিয়ে দরজার সামনে থেকে চলে গেলেন।কিছুক্ষণের জন্য মেয়েটাকে একা ছেড়ে দেওয়া উচিত।
বিয়ের সাজ পাল্টে বাসার একটা নরমাল জামা পড়ে খাটের উপর এসে বসে জারা।আজকে বিয়ে করে শশুর বাড়িতে পা রাখার কথা ছিলো।অথচ এখন বিয়ের সজ্জাহীন অবস্থায় নিজের ঘরে বসে আছে।বিয়ে ভেঙে যাওয়া প্রতিটা মেয়ের কাছেই কষ্ট আর অপমানের।জারা ঢাকায় খালার বাসায় থেকে পড়াশোনা করতো।বাবার ফোন পেয়ে গ্রামে আসে।এখানে এসে নিজের বিয়ের তোড়জোড় দেখে অবাক হয়ে যায় জারা।বাবা বুঝালেন ছেলেরা পুরো পরিবার শিক্ষিত।তোর যেটুকু পড়া বাকি আছে বিয়ের পর তুই পড়তে পারবি চাকরি করতে চাইলেও উনারা বাধা দেবে না।
ছেলের ছবি দেখে জারা ও আর অমত করেনি।ছেলে পছন্দের,শিক্ষিত,ভালো চাকরি করে।কিন্তু আজ এতবড় সত্যের সম্মুখীন হতে হবে জারা ভাবে নি।একটা মানুষ কিভাবে এতটা প্রতারণা করতে পারে ভেবে জারার চোখ থেকে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে।হাত দিয়ে ভালো করে চোখ মুছে লম্বা একটা ঘুম দেয়।এসব নিয়ে আর ভাববো না এখন থেকে নিজের ক্যারিয়ের দিকে ফোকাস করবো।ঘুম থেকে ওঠার পর আমার মাথায় শুধু নিজেকে নিয়ে চিন্তা থাকবে বলেই চোখ বন্ধ করে নেয় জারা।
রাত নয়টায় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে চলে আসে জারা।বেশ লম্বা ঘুম হয়েছে।এখন অনেকটা ভালো লাগছে।এখন আর অন্যকিছু নিয়ে ভেবে মন খারাপ করতে চায়না তাই নিচে চলে গেলো।রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দিয়ে দেখলো ওর মা আর চাচি মিলে খাবার গরম করছে।সবার রাতের খাবার সময় হয়ে গেছে।
জারা একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে।আস্তে আস্তে সবাই রাতের খাবার খেতে নিচে নেমে আসে।ডাইনিং টেবিল একেবারে স্তব্ধ যেন এখানে কোনো মানুষজন নেই।জারা ভ্রু কুচকে বলল,কি ব্যাপার সবাই এরকম চুপ মেরে আছো কেন?
জারার ছোট চাচা বলল,না মানে বাড়িতে আজ যা গেলো এতে কারো মনই ভালো নেই।বিশেষ করে তোর মনটাতো আরো খারাপ হওয়ার কথা।
জারা হেসে দিয়ে বলল,আমার কোনো মন-টন খারাপ না।আর যা হয়েছে ভালো হয়েছে কেউ মন খারাপ করে না থেকে আগের মতো বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখো।যদি আজ তানিশা সাহস করে সব কিছু না বলতো তাহলে কি হতো বলোতো?এখন তো সব ঠিক আছে।আমি ও আবার ঢাকায় ফিরে যাবো।
জারার খালাতো ভাই তাসিন বলল,তুই কি কালকে আমাদের সাথে ফিরে যাবি?
জারা খাবারটা মুখে দিয়ে বলল,নাহ দু’টো দিন সবার সাথে থাকবো।তারপর ঢাকায় ফিরবো।
তাসিন বলল,তোর জন্য একটা পার্ট টাইম জব পেয়েছি এখন তুই যদি জবটা করতে চাস তাহলে আমি কোম্পানির লোকেদের সাথে কথা বলতে পারি।
জারার বাবা চোখ গরম করে বললেন,তুই কিসের জব করবি?আমরা কি তোকে টাকা দিই না?
আমি কি বলেছি নাকি তোমরা আমাকে টাকা পাঠাও না।ভার্সিটি শেষে সময়টুকু জব করলে কাজের অভিজ্ঞতা বাড়বে।তাছাড়া আমার জন্য যদি বেশি প্রেশার হয়ে যায় তখন আর আমি জবটা করবো না।
তাসিন বলল,জ্বি খালু জারা ঠিক কথাই বলছে কাজ করলে আরো অভিজ্ঞতা বাড়বে।জারার বাবা বললেন,আচ্ছা ঠিক আছে যেটাতে তুমি ভালো মনে করো সেটাই করবে।কোনো সমস্যা হলে বাবাকে কল করবে।
বিকালে ছাদে বসে কাজিনদের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে জারা।তাসিন ওর মাকে নিয়ে সকালেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে।সবাই ঠিক করেছে কানা মাছি খেলবে কিন্তু কেউই চোখ বাঁধতে রাজি হচ্ছেনা।শেষে জারা নিজেই রাজি হলো।ওর কাজিন ওর চোখ বেঁধে একটু ঘুরিয়ে দাঁড় করায়।জারা সবাইকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদের কিনারায় চলে আসে।এক পা বাড়িয়ে ছাদের বাইরে রাখবে কেউ ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে।চোখের কাপড় সরিয়ে সামনে তাকাতেই ওর মায়ের অগ্নিমূর্তি দু’খানা চোখ জারার নজরে পড়ে।
উনি বাজখাঁই গলায় বললেন,এতবড় মেয়ে হয়েছিস এখনো জ্ঞান বুদ্ধি নেই।মনে হচ্ছে দিনদিন ছোট হচ্ছিস।এরা না হয় ছোট তুই তো সবার বড় তাহলে কিভাবে ছাদে সবাইকে নিয়ে কানামাছি খেলতে এসেছিস?তুইতো জানিস আমাদের ছাদের রেলিং নেই।এখনইতো এখান থেকে পড়ে যেতি।
মা!আমি
চুপ!নিচে চল।এই সবগুলো নিচে আয় জলদি।
এতবড় মেয়ের কিনা জ্ঞান বুদ্ধি কিছুই নেই।আজই ওই বুড়োকে এক ধোলাই দেবো ছাদে রেলিং দেয়নি কেন?আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে জারার মা শায়লা নিচে চলে গেলেন।
জারার ঢাকা যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।বাড়িতে দুদিন থাকার কথা বলে পাঁচদিন থেকেছে।ওদিকে জারার খালা আর তাসিন ঢাকা থেকে ফোন এর উপর ফোন দিয়ে যাচ্ছেন।ঢাকায় ফিরতে হবে বলে সকালে নামায পড়ে ব্যাগে নিজের মোবাইলসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছে।সাতটার দিকে গাড়িতে উঠতে হবে।
সকালে মা,চাচা-চাচি,কাজিন সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জারা বাবার সাথে বেরিয়েছে।বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দশমিনিট অপেক্ষা করার পর গাড়ি এসে যায়।জারার বাবা মেয়েকে সিটে বসেয়ে বিদায় জানালেন।বাস ছাড়া অব্দি দাঁড়িয়ে রইলেন।জারা ইশারায় বাবাকে বলছে চলে যেতে।এটা প্রথমবার নয় প্রতিবারই উনি এরকম করেন।জারা তখন নিজেকে সামলে রাখে।ও যদি এই দৃশ্য দেখে কেঁদে ফেলে ওর বাবা কি করবেন?
বাস ছেড়ে দিয়েছে জারা জানালা দিয়ে দূরে তাকিয়ে দেখে ওর বাবা চশমা খুলে চোখ মুচ্ছেন।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাসের সিটে মাথা এলিয়ে দেয় জারা।
পাঁচঘন্টার জার্নির পর গাড়ি ঢাকায় এসে পৌঁছায়।সব যাত্রী এক এক করে নেমে পড়ে।বাস থেকে নামার পর ঝপঝপ করে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়।জারা দৌঁড়ে একটা যাত্রী ছাউনির নিচে দাঁড়ায়।তাসিন কল দিয়ে বলেছিলো ও এসে নিয়ে যাবে কিন্তু জারা না করে দিয়েছে।আমি নিজেই আসতে পারবো ভাইয়া তোমাকে আর অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আসতে হবেনা।
ধীরে ধীরে বৃষ্টির তোড়জোড় বেড়েই চলেছে কমার নাম নেই।জারা হাত দিয়ে বৃষ্টিকণা গুলোকে ছুঁয়ে দিয়ে খেলা করছে।আশেপাশের লোকজন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জারার দিকে।যেন বৃষ্টির পানি নিয়ে খেলা করা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য।
#চলবে……।
#গল্পঃবর্ষণ_মুখর_দিন
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#সূচনা_পর্ব
(নতুন গল্প নিয়ে এলাম।গল্পটি কেমন হচ্ছে অবশ্যই জানাবেন।যাদের কাছে গল্প ভালো লাগবেনা তারা এড়িয়ে যাবেন।গল্পে কোন ভুল দেখলে ভুল ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো।হ্যাপি রিডিং।)