#বর্ষার_এক_রাতে
#সাদিয়া
৪
মিষ্টি সকালের রোদ দুনিয়াকে সোনালি আলো ছড়িয়ে দিল। আঁধার শেষে আলো এলো। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে পাখির কিচিরমিচির বাড়ল। নেতিয়ে যাওয়া বাগানের ফুল গুলিও সূর্যের আলোয় চাঙ্গা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল খিলখিল করে হেসে। পাখিরা নীড় থেকে জীবন চলার পথে ছুটল। খাবার সন্ধানে হাজারো মানুষ ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। দুনিয়া থেকে আরেকটা রাতও বিদায় নিল।
আহফিনের চোখ টা খুলে গেল। দেখতে পেল তূবা তার বুকের একপাশে গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে। যেন গাছে ফুটা তরতাজা এক গোলাপ সে। আহফিনের ঠোঁটের কুর্নিশ টা প্রসারিত হলো। হঠাৎ চোখ গেল ঘাড়ে। সাদা গলায় কালো তিলটার পাশেই কামোড়ের দাগ। প্রথমদিন যে কামোড় টা রাগের বসে দিয়েছিল সেই কামোড়ের দাগ। আহফিন আলতো করে দুইটা আঙ্গুল রাখল। তূবা জ্বালায় হয়তো ঘুমের ঘোরে কপাল কুঁচকে এনেছে। তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নেয় সে। অবাক নয়নে তূবা কে দেখতে লাগল সে। মেয়েটার দিকে তাকালে তার বুকটা কেন যেন শান্ত হয়ে যায়।
“মেয়ে তুমি কি জাদু জানো? নাকি মায়া শক্তি আছে তোমার? কি করে আমার অশান্ত বুকটা কে শীতল করে দিতে পারো?”
আহফিন তূবার কপালের কোণায় লেগে থাকা চুল গুলি উপরে তুলে দিল। নরম গালে নিজের দুই আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করতে লাগল।
তূবার কপাল কুঁচকে এসেছে দেখে আহফিন ফের তাড়াতাড়ি ঘুমের অভিনয় করে আগের মতো শুয়ে পড়ল। তূবা পিটপিট করে চোখ খুলে দেখতে পায় আহফিন কে। হাল্কা লোমযুক্ত সাদা বুকের এক কিনারে শুয়ে আছে সে। লোকটাও এক হাতে তাকে আঁকড়ে রেখে ওপাশে মুখ করে ঘুমিয়ে আছে। তূবা আহফিনের ভারি হাতটা কোনো রকম সরিয়ে উঠে পরল। আজ দেরি হয়ে গেছে উঠতে। মাঝ রাতে খুব ঘুম পাচ্ছিল তার। তখন হয়তো অতল ঘুমে চলে গিয়েছিল। তূবা তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে গেল।
ফ্রেশ হয়ে এসে টেবিলের উপর চোখ দিল। কিন্তু কালকের মতো আজ আর কোনো খাম নেই। তূবা বুঝতে পারছে না কি করা উচিৎ তার। তাই কিছু না ভেবে ব্যালকুনিতে চলে গেল সে। এখান থেকে নিচের খোলা গাছ যুক্ত জায়গাটা বেশ সুন্দর লাগছে। তূবা স্লান হাসল। নীরবে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে তূবা নিজের নিষ্পল জীবন নিয়ে চিন্তা করতে লাগল।
অনেকক্ষণ পাড় হয়। হঠাৎ নিচ থেকে আসা ঘড়ির শব্দে তূবার ভাবান্তর হয়। সে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল লোকটা তখনো ঘুমে। তূবা ভাবল ‘আজকেই তো আমার টাকা লাগছে না। দরকার পরলে হাতে যেটা আছে সেটা দিয়ে চলে যাবে। আর আমাকে যেহেতু কালও আসতে হবে টাকাটা একেবারে নিলেই হলো।’ এই ভেবে তূবা ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পরল।
নিচে নেমে এক মহিলা কে দেখে থমকে যায় তূবা। ভূত দেখার মতো চমকে উঠে দুই পা পিছিয়ে নিল। জামা ফাঁক করে বুকে থুথু দিয়ে সেখানে হাত রাখল। ভয়ে ভয়ে বলল “আপনি কে?”
মধ্যবয়স্ক মহিলা জবাব দিলেন না। কিন্তু তিনি তাকে দেখে অবাক হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না।
তূবা চিন্তা করল “একটা লোক কি নিজের মা যেখানে থাকে সেখানে কোনো মেয়ে কে এনে তার সাথে রাত কাটাবে?” তূবা চিন্তা করে পারছে না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিল মহিলার উপর। গলা পরিষ্কার করে বলল,
“আপনি কি ওই লোকটার মা?”
“না।”
“ও।”
“তোমারই আসার কথা ছিলো বোধ হয়। তাই আহফিন বাবা আমায় দুই জনের রান্না করতে বলেছে। আমি তার একার রান্না ছাড়া আর কারো রান্না করি নি। তাই কাল জিজ্ঞেস করেছিলাম কেউ আসবে কি না সে বলেছিল হ্যাঁ। কিন্তু রান্নাঘরে গিয়ে দেখি যেমন খাবার তেমনি। কেউ খায় নি।”
মহিলার কথায় তূবার কপাল বিস্ময়ে কুঁচকে এলো। লোকটা কি না তার জন্যে খাবার রান্না করতে বলল? কিন্তু কেন? কিন্তু লোকটার নাম টা শুনে ভালো লাগল তূবার। খুব সুন্দর একটা নাম উনার। তবে রান্না করিয়েও খেতে বলেনি কেন?
“তুমি আহফিন বাবার বান্ধবী তাই না?”
তূবা কি বলবে বুঝতে পারছে না। আমতাআমতা করে হ্যাঁ জবাব দিল। মহিলাটা মুচকি হাসলেন। তূবাও হাসি বিনিময় করে বলল “আমি আসি।”
অমত জানিয়ে মহিলাটা বললেন,
“এখনি কোথায় যাবে? বসো খেয়ে তারপর যাও। আমি আহফিন বাবা কে ডাক দেই।”
“উনি তো ঘুমাচ্ছে।”
মহিলার মুখটা কালো হয়ে গেল। তূবার আগ্রহ হলো। মনে হলো মহিলাটা কিছু জানে, বলতে চায়। তূবা জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে আপনার?”
“আহফিন বাবা এমন ছিলো না। নিয়ম মেনে সব করত। কিন্তু এখন আগের মতো নেই। কখন কি করে নিজেও হয়তো জানে না। কোনো নিয়ম নেই যখন যা মন চায় করছে। কিছুই তার ঠিক নেই। কোনো দিন একটা সিগারেট খায়নি পর্যন্ত সে। একা একা ভালো ছিল পড়াশুনা ব্যবসায় নিয়ে। সেই ছোট থেকে দেখে আসছি তাকে। নিজের হাতে পিঠে বড় করেছি। জীবনে বড় ধাক্কা পেয়ে ছেলে টা এখন এমন পথে। মদ খায় কোনো নিয়ম কানুন নেই। খাওয়া দাওয়া নেই, নিজের প্রতি কোনো যত্ন নেই। কেমন যেন অচেনা হয়ে গিয়েছে।”
বলেই তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিল। তূবার আগ্রহ জাগল খুব। কেন একজন ভালো মানুষ এমন হয়ে যাবেন? কি এমন ধাক্কা? তূবা জানার জন্যে কিছু বলতে যাবে তখন তার রিংটোন বেজে উঠল। বাসা থেকে কল এসেছে। তূবা ভীত স্বরে বিদায় নিয়ে ওখান থেকে বের হলো। কল টা কেটে দিয়ে সে কল দিল। তুসি ফেন ধরেই বলতে লাগল,
“আপা তুই আসছিস না কেন? কত বেলা হয়ে যাচ্ছে। এখনো কি তোর কাজ শেষ হয়নি?”
“না তুসি আমি চলে আসছি। দেরি হবে না।”
“হুম তাড়াতাড়ি আয়।”
তূবা গেইট থেকে পাড় হয়ে পিছন ফিরে বাড়িটা দেখল। দুই সেকেন্ড তাকিয়ে ব্যাগ ঠিক করে হাটা শুরু করল।
রিকশা চলছে নিজ গতিতে। তূবা বসে বসে ভাবছে। আজকাল ভাবনায় তার সঙ্গী। কিন্তু চোখ দুটি একজন কে খুঁজে চলছে। যাকে তার দরকার। এলাকা দিয়ে যখন যায় কাঙ্ক্ষিত লোকটা কে পায় না। হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে। কিন্তু তাকে যে খুব দরকার ওর।
হাতে থাকা টাকা দিয়ে তুসির জন্যে কিছু খাবার নিয়ে গেল তূবা। যেতেই অভিমানী স্বরে বলল,
“সারারাত আসো না সকালেও কল দিয়ে আনতে হয় তোমাকে কাজ থেকে। কি এমন কাজ তোমার এতক্ষণ।”
পাশ থেকে শিরিন বলে উঠলেন,
“আল্লাহ জানে তোর বইনে কি এমন কাম করে। আল্লাহ জানে কার কাছে যায়। কি অকাম করে।”
তূবা শান্ত থেকে তূসির গালে হাত রেখে বলল,
“আমি তোকে বলেছিলাম না আমার আসতে দেরি হবে। তুই ঠিক মতো খেয়ে নিবি। অপেক্ষা কেন করিস বল তো?”
“তোমাকে ছাড় আমার খেতে ভালো লাগে না আপা।”
“এমন আর করবি না। যখন খাওয়ার দরকার খেয়ে নিবি। আর এই নে এই গুলি তোর।”
বসা থেকে উঠে তূবা মায়ের দিকে তাকাল।
“যাই করি না কেন দুই বেলা ভাত খেতে তো পারি, বোনের ঔষধ কিনতে পারি, সংসারের খরচ চালাতে পারি। আর কি চাই? আর তোমার এই কথা গুলি কবে বন্ধ হবে বলো তো।”
“করবিই তো। যা মন চায় করতি না? এমন খাওনের দরকার নাই আমরার। না খাইয়া মইরা যাইয়াম তোর অকাম করনের দরকার নাই। আল্লাহ নেয় না কেরে আমারে?”
শিরিন কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন আঁচলে মুখ দিয়ে। অন্য রুমের দরজার সামনে গিয়ে তিনি কাঁদলেন। তিনি বুঝেছেন তূবার রাতের বেলায় কিসের নাইট ডিউটি। কিন্তু তবুও অসহায়, জীবনের কাছে।
তুসি বলল,
“আপা রাগ করিস না আম্মার কথায়। আম্মা না কাঁদে।”
মেকি হাসির ব্যর্থ চেষ্টায় তূবা বলল
“জানি আমি। আর আম্মার কথায় কিছু মনেও করি না। উনি কঠিন দেখাতে চাইলেও পারেন না। তুসি রে মানুষের এক জীবনে সব চাওয়া পাওয়া পূরণ হয় না। আর এই দুনিয়াটা বড্ড কঠিন। এখানে কঠিন না হলে চলা যায় না রে। নরম হহলে ভাবে দূর্বল। তাই পায়ে দুমড়ে মুচড়ে তারা চলে যেতে চায়। এই কারণে কঠিন হওয়াই ভালো। তবেই এখানে টিকা যায়। তুই এসব বুঝবি না। এখনো অনেক ছোট তুই। বড় হো দেখবি দুনিয়া, সেখানে থাকা নানান রূপী মানুষদের চিনে ফেলেছিস। এবার তুই থাক আমি গোসল সেরে আসি।”
“আচ্ছা আপা।”
বুক ফাটা কষ্ট নিয়ে তূবা বাথরুমে ছুটল।
আহফিন ঘুম থেকে উঠে দেখে ১২ টার উপরে বাজে। আশেপাশে তাকিয়ে তূবা কে সে পেল না। নিচে নেমে ফরিদা আন্টি কে জিজ্ঞেস করল তূবার কথা। তিনি জবাব দিলেন,
“সে তো চলে গেছে।”
“চলে গেছে..”
“হ্যাঁ বাবা। বলেছিলাম বসতে বসে নি।”
“তোমায় কিছু বলে গেছে আন্টি?”
“না তো।”
“আচ্ছা ঠিকাচ্ছে।”
“আহফিন বাবা মেয়েটা দেখতে কিন্তু মিষ্টি।”
আহফিন শুধু একটু হেসে উপরে চলে গেল।
“ডেমিট আজও চলে গেল? খাম রাখিনি ভেবেছি অপেক্ষা করবে। কিন্তু তা না করে আজও চলে গেল? স্টুপিড মেয়ে একটা।”
তূবা বাথরুম থেকে গামছায় চুল পেঁচিয়ে বের হতেই ফোন বেজে উঠল।
চলবে♥