বর্ষার_এক_রাতে পর্ব ৬

#বর্ষার_এক_রাতে
#সাদিয়া


তূবার মন টা আজ ভালো। কাজ থেকে ছুটি পেয়েছে সে আজকের জন্যে। আজকের ছুটিটা দরকার ছিল। কাকতালীয় ভাবে হয়েও গেল। খুব ভালো লাগছে তার। মন টা ফুরফুরে। রিকশা না নিয়ে হেটেই চলছে একা পথে। দোকান থেকে সে তুসির ঔষধ আর ভালো কিছু খাবার নিয়ে বাড়ি ফিরল। আজো ফিরার পথে গলির আনাচেকানাচে কাঙ্ক্ষিত লোকটা কে খুঁজেছে। পায় নি।

তূবা গিয়ে তুসির কাছে নিচে বসল। তার গালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“দেখ আজ তাড়াতাড়ি চলে এসেছি।”
তুসি হাসল।
“দেখবি আমরা খুব তাড়াতাড়ি এক সাথে হাটব। তোর পায়ের চিকিৎসা করব আমি।”
“সত্যি আপা?”
“একদম সত্যি। তোর পা ঠিক হয়ে গেলে আমরা এই শহর ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবো। ওখানে একটা বুটিক শপ খুলে জীবন চালাব।”
“আপা তুমি সত্যি বলছো।”
“হুম। আল্লাহ চাইলে হবে।”
তুসি খুব খুশি হলো। শিরিন খাবার দিয়ে গেল দুই বোনের সামনে। তূবা তুসি কে নিজ হাতে খায়িয়ে দিল।

আজ সে ঘুমায় নি। রেডি হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে পড়ে। শহর থেকে অনেক দূরে একটা গ্রামের মতো জায়গায় এসেছে তূবা। নীরব শান্তির পরিবেশ সেখানে। তূবার মন টা ভালো হয়ে গেল। আগেও আসার মতোই শান্তি লাগছে। তূবা একটু হেসে হাটতে লাগল। অনেক দূর চলে এসেছে। আর একটু দূরেই এতিমখানা টা। তূবা বুকে শান্তি পুষে রেখে এগিয়ে গেল সেখানে।

ভেতরে যেতেই বাচ্চারা এসে তাকে ঘিরে ধরল। তূবা হাসি মুখে তাদের মাথায় হাত রাখল। ম্যাম তূবা কে দেখে হেসে ভেতরে চলে যায়। তাদের নিয়ে তূবা বড় বটগাছ টার নিচে গেল। শত বছরের বট গাছ টার পাশ ঘিরে সুন্দর পাকা করে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তূবা ব্যাগটা রেখে বাচ্চাদের সাথে কথা বলতে লাগল। কিন্তু কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। কে কি বলছে তা বুঝার উপায়ই নেই। সবাই এক সাথে পাখির মতো কিচিরমিচির করছে। তূবা খিলখিল করে হেসে সবাই কে শান্ত করল হাত উঁচু করে।
“বাচ্চারা সবাই চুপ। চুপ কোনো কথা নেই।”

তূবা আবার বললো।
“কেমন আছে আমার মিষ্টি বাচ্চারা?”
সবাই এক সাথে জবাব দিল “ভালো।” কেউকেউ বলল “তুমি কেমন আছো মিষ্টি?”

তূবা কে তারা মিষ্টি বলে ডাকে। সে প্রতি বছর এই দিনটায় এখানে আসে। এই এতিম বাচ্চাদের সাথে বিকাল পর্যন্ত কাটায় সে। এতিম হয়ে এতিম এই বাচ্চাদের সাথে দিনটা কাটালে ভালো লাগে তার। এতিম হওয়ার জ্বালাটা সে বুঝে। আজ তার মার মৃত্যু বার্ষিকী। তাই বছরে এই দিনটা সে এমন মানুষদের সাথে থাকে। এদের জন্যে সামান্য খাবার নিয়ে আসে।

তূবা জবাব দিল “আমিও ভালো আছি আমার বাচ্চারা।”
তূবা ব্যাগ থেকে চিপস, কেক আর চকলেট বের করল। এই টাকা গুলি তার হালাল পথে রোজগার করা টাকা। জমা ছিল তার কাছে। আগে যেই চাকরিটা করত তার থেকে জমা করত সামান্য করে। এটাই সে টাকা।
তূবার হাত থেকে বাচ্চারা কাড়াকাড়ি করে নিয়ে নিতে লাগল ওগুলি। আর তূবা মন খুলে খিলখিল করে হাসছে।

হঠাৎ আহফিন সজোরে ব্রেক কষল। পাশের গ্লাস টা নামিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তূবার দিকে। আজই তূবা কে হাসতে দেখছে সে। তার হাসি যেন মধুর। হাসলে তূবার চোখ গুলি ছোট হয়ে যায়। সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলে তার হাসি। আহফিন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তূবার দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে। ভেতরে উতালপাতাল কলরবময় ঢেউ শুরু করে দিয়েছে। আহফিনের শিরায় শিরায় শিহরণ জাগছে। বুক ধরাক ধরাক প্রতিধ্বনি তুলছে।

তূবা বাচ্চাদের কে খাবার দিয়ে তাকে আদর করতে বলল। একে একে সবাই তূবার গালে চুমু দিয়ে দিয়ে যেতে লাগল। তূবার মুখে সে কি হাসি।
আহফিনের চোখে পলক পড়ছে না। ইচ্ছে করছে এখনি গিয়ে জড়িয়ে ধরতে তূবা কে। তার ভেতরের এমন অনুভূতির সাথে সে নতুন পরিচিত। এমন অনুভূতি, শিহরণ, প্রশান্তি এর আগে সে পায় নি জীবনে। আহফিনের গলায় এসে অশ্রু আটকাল। তূবা কে তার জন্যেই বানিয়েছে সৃষ্টিকর্তা।
“তূবা আরো আগে কেন আসো নি আমার জীবনে? কেন প্রশান্তিতে ভরিয়ে তুলো নি আমায়? তোমার জন্যে আমি হাজারো বার মরণ পথে হাটতে রাজি।”

বিকেল হয়ে গেল তূবা ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে। চুপচাপ বাথরুমে চলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল।
খাবার মুখে দিতে যাবে তার আগে ফোন বেজে উঠল। তূবা বিরক্তি নিয়ে ফোন নিতেই ঘাবড়ে যায়। আরো বিরক্ত হয়ে কল ধরল। সে হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে শুনা গেল।
“৮ টার আগে চলে আসবে।”
তূবা রাগে দাঁত কিড়িমিড়ি করে উঠল। রাগ সংযত রেখে বলল,
“আপনি না বলেছিলেন আজ আসতে হবে না।”
“আগে আসতে না করেছি এখন আসতে বলছি। তাই আসবে।”
“আজ আমি পারব না। যাবো না আমি।”
“তাহলে কি আমি যাবো?”
“মানে?”
“মানে আমি গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসব।”

তূবার রাগ এবার চরম হলো।
“আপনি কিন্তু বেশি করছেন।”
তূবা গলার আওয়াজ নিচু করে দাঁত কেটে বলল “আপনি কিন্তু আমায় কিনে নেন নি। যে যখন বলবেন তখনি আসতে হবে।”
“টাকা তো পাও?”
“আজ লাগবে না আমার টাকা।”
“তোমার টাকা লাগবে না কিন্তু আমার তোমাকে লাগবে।”
“দেখুন ভালো লাগছে না কিন্তু। আজ আমি আসতে পারবো না।”
“তবে আমিই যাচ্ছি।”
তূবা রাগে বলল “আমি আপনার এখানে কোনোদিন যাবো না। আমার কোনো দায় পড়ে নেই ওখানে। আমি শুধু না পেরে টাকার জন্যে যাই। আপনার কাছে যাবো না। লিলা কে কল দিলে আমার টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না।”
“…
“হ্যালো।”
তূবা আরো কয়েকবার ডাকল সাড়া নেই। খেয়াল করল কল কেটে গেছে। রাগে বিদ্বেষে তূবা ফোন রেখে মাথা উপর দিকে তুলে নিশ্বাস ফেলে দিল। একবার চাইল ভাতে হাত ধুয়ে নিবে। কিন্তু খিদেও লেগেছে খুব। ঠিক করল খাবে।

তুসি হুইল চেয়ার নিয়ে এগিয়ে এলো তূবার ঘরে।
“আপা কার সাথে ঝগড়া করছিলে?”
“কোথায় কারো সাথে না তো।”
“আমি শুনলাম কি কি বলছিলে তুমি। কোথায় যাবে না বললে, টাকার কথাও কি যেন শুনলাম। কি হয়েছে আপা?”

তূবা কি বলবে বুঝতে পারছে না। তুসি এতটাও ছোট নয় যে যা তা বলে বুঝ দিবে। ১৬ বছরের মেয়েকে আর যাই হোক বাচ্চা বলা সাজে না। তূবা আমতাআমতা করে বলল,
“আরে চাকরি টা ভাবছিলাম করব না।”
“কেন আপা তোমার খুব কষ্ট হয়?”
তুসির কথা শুনে তূবার বুক টা ভারি হয়ে আসল। চোখে পানি হুট করেই চলে আসে। তুসি কে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেলল তূবা।
“না রে বোন আমি তোর জন্যে সব করতে পারি। তোর ভালোর জন্যে নিজেকে আগুনেও দিতে পারি রে তুসি।”

বোনের কান্না দেখে তুসিরও চোখে পানি চলে এলো।
“আপা তোমার বেশি কষ্ট হলে চাকরি টা ছেড়ে দাও। আমি হাটতে চাই না আপা। খেয়ে যেতে পারলেই হবে। না খেয়েও থাকতে রাজি আছি আপা।”
তূবা তাড়াতাড়ি উঠে তুসির গালে হাত দিয়ে তার চোখ মুখ মুছে দিয়ে বলল,
“একদম না এসব কথা একদম বলবি না। তুই হাটবি। আমি আর তুই একসাথে হেটে অনেক দূর যাবো। অনেক পথ হাটব। এসব কথা বলতে নেই সোনা। আমার কোনো কষ্ট হয় না। আমি ভালো আছি তুসি। আর চাকরিটাও ছাড়ব না। তোকে সুস্থ হতে হবে বোন। আমার সাথে হাটার জন্য হলেও তোকে সুস্থ হতে হবে।”
তুসি তখনো কেঁদে চলছিল। তূবার চোখ দিয়ে গরগর করে পানি ঝরছে। শিরিন বেগম আড়াল থেকে দুই বোনের কান্না দেখে চলে গেলেন। তূবা কে কথা শুনাতেও উনার ভালো লাগে না। মেয়ে টা তাদের জন্যে নিজের জীবনটা কেই শেষ করে দিচ্ছে। শিরিন নিঃশব্দে কেঁদে উঠলেন।

আহফিনের নাম্বার থেকে দুইবার কাল চলে এসেছে এর মধ্যে। তূবার কেন যেন আজ যেতেই মন চাইছে না। তাই চুপচাপ বসে আছে ফোন টা সাইলেন্ট করে। একটুপর একটা ম্যাসেজ এলো। তূবা দেখতে পেলে আহফিনের নাম্বার থেকে আসা ম্যাসেজ।
“৫ মিনিট সময় দিলাম গলির মুখে আসবে। নয়তো আমি ঢুকব তোমার বাসায়।”

তূবা চিন্তা করল। এমনিতেই সমাজে তাদের পরিবার কে কত কিছু শুনতে হয়। কত কথা তাকে নিয়ে। কেউ দেখতে পারে না। এখন এমন হলে আরো অনেক বাজে কথা ছড়াবে। আর বড় কথা তার জন্যে এখন টাকার দরকার। তূবা নিজের রাগে পানি ঠেলে ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে গেল।

গলির মুখে যেতেই আহফিন কে দেখতে পেল। ল্যাম্পপোস্টের সামনে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মৃদু আলোয় খোঁচা দাঁড়িতে লোকটা কে বেশ সুদর্শন লাগছিল। তূবা এগিয়ে যেতে যেতে ভাবতে লাগল আজ তিনি নিজে এসেছেন কেন?

তূবা যেতেই আহফিন চুপচাপ ভেতরে চলে গেল। তূবা তখনো দাঁড়িয়ে ভাবছিল। আহফিন পাশের দরজা ঠেলে দিয়ে দুইবার হর্ন বাজাল। তূবা ভাবনা রেখে গাড়িতে উঠে বসল।

আহফিন খুব দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছে। কিন্তু কোনে কথা বলছে না। বোরটের মতো চালিয়েই যাচ্ছে। তূবা বারবার তাকাচ্ছে লোকটার দিকে। খুব অসুবিধা হচ্ছে তার। সিটবেল না বাঁধায় বারবার হেলে পড়ছে। তবুও আহফিনের সেদিকে খেয়াল নেই। যন্ত্রের মতো ড্রাইভ করছে।
তূবা বিরক্তিকর চোখ মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। এটাকে মানুষ ভাবতেই ভুল হচ্ছে তার। সে ভাবছে এত নীরব কেন লোকটা? আজ কিছু জিজ্ঞেসও করছে না। কথায় আছে ঝড়ের পূর্বে পরিবেশ শান্ত থমথমে হয়। তবে কি তাই? তূবা ঘনঘন চোখের পাতা ফেলল।

চলবে♥
(আশা করি গঠনমূলক কমেন্ট করবেন। আমার প্রেরণা প্রাপ্তি ওটুকই। আর নাম ছাড়া গল্প কেউ কোথাও পোস্ট করবেন না।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here