“সন্তান জন্মদানে অক্ষম আমি, এটা জানার পরও কি আপনি আমাকে কবুল করবেন?”
কিছু রিপোর্ট আসিফের দিকে মেলে ধরে বলে মৌনতা।তার ঐকান্তিক উক্তি শুনে থমকে যায় আসিফ।হলুদসন্ধ্যার দিনে হবু বঁধুর মুখে এমন উক্তি শুনে থমকে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।প্রতিউত্তরে নিশ্চুপ রয় সে।সামনে মেলে ধরা রিপোর্ট মৌনতার কথার সত্যতা প্রকাশ করছে।এমন অবস্থায় কোন প্রতিউত্তর যথার্থ আকষ্মিক ঘটনায় ভুলে বসেছে যেন।মলিন মুখে রিপোর্টের দিকে চেয়ে আছে মৌনতা।আড়চোখে একবার আসিফের অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করে।লোকটা বেশ শকড হয়েছে স্পষ্ট।কিয়ৎক্ষন পর মৌনতার মন আকাশের আশার সঞ্চারকে ধুলিসাৎ করে লোকটি বলে,
“আল্লহর উপরে তো আমাদের কারো হাত নেই।আল্লাহকে ডাকেন।কখনো নিরাশ করবেন না তিনি।এখন তো চিকিৎসা ব্যবস্থাও উন্নত।”
“তারমানে কি ধরেই নিব আমাদের বিয়েটা হচ্ছে তাই তো?”
প্রতিউত্তরে ভ্যবলাকান্তমার্কা হাসি দেয় আসিফ।যে হাসিতে আহত হয় মৌনতা।মেয়েদের হাসিতে মুক্তো ঝরে আর ছেলেদের হাসিতে মাদকতা।নাটক,
সিনেমাসহ বিভিন্ন উপন্যাসের পাতাজুড়ে সকল দৃশ্যপটে এসবই উপলব্ধি করেছে মৌনতা।সেও ছোট থেকেই সেই মাদকতা কাম্য করে।কিন্তু তার সামনে বসা ব্যক্তিটির হাসি দেখলে মনে হয় বাঁদরে উল্লাস করছে।মানুষটাকে একদমই অপছন্দ মৌনতার।তার সাথে বিয়েটা মতের বিরুদ্ধে বলেই বিয়ে ভাঙতে এই মিথ্যা প্রয়াস চালাচ্ছে সে।কিন্তু নিজের কাজের ব্যর্থ ফলাফল দেখে আহত হয় সে।আসিফ শূন্য প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে কোন প্রতিউত্তর ছাড়াই উঠে চলে যায়।সেদিকে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে রয় মৌনতা।পাশ থেকে ভাসে হিয়ার কণ্ঠধ্বনি,
“কি রে তুই বন্ধ্যা হলি কখন?”
“যখন এই রিপোর্ট হাতে পেয়েছি ঠিক তখন।”
আনমনে বলে মৌনতা।বিষ্মিত হয়ে পাল্টা প্রশ্ন জুড়ে দেয় হিয়া,
“কিন্তু এই রিপোর্টের আমদানি হল কোথা থেকে?”
“এমনি এমনি কি আর সবার সাথে সখ্যতা গড়ি বল!এভাবেই কাজে দেয়।”
হাসির ঝংকার তোলে মৌনতা।সাথে তাল মেলায় হিয়াও।মৌনতার কথার অর্থ স্পষ্ট তার নিকট।হিয়া মৌনতার চাচাতো বোন।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ডিপার্টমেন্ট এ অধ্যয়নরত সে।মৌনতার সকল অপকর্মের সাক্ষী এই মেয়ে।বয়সটা পাশাপাশি হওয়ায় দুজনের সখ্যতাও প্রচুর।হিয়া নিরব স্বভাবের শান্তশিষ্ট মেয়ে।কিন্তু প্রচুর চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে মৌনতা।এবার সবে ইন্টার পরীক্ষা শেষ করেছে সে।ভার্সিটির গন্ডিতে পা রেখে মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়াল দেয়ার স্বপ্নে বিভোর দীর্ঘদিন ধরে।।কিন্তু তার আবডালে তাকে বিয়ে দেয়ার ছক আঁকে তার পরিবার।নিজস্ব পরিবারে মতামত প্রকাশ করেও লাভ হবে না জানে মৌনতা।তার পরিবারের বেশিরভাগ প্রানের নিকট অপছন্দনীয় পাত্রী সে।তাকে উটকো বোঝা ভেবে বিয়ে দিয়ে ঝামেলা দূর করতে চায় তার বাবা মইন আহমেদ।মইন আহমেদের সিদ্ধান্তের উপর কেউ কথা বলতে পারে না কখনো।মৌনতাও তার বাবার দু চোখের বিষ।সে কারনেই ভিন্ন পরিকল্পনা মাথায় আনে মেয়েটি।নিকটস্থ ক্লিনিকের প্যাথোলজিস্ট নাজমুস সাকিবের সাথে বেশ খাতির মৌনতার।পরিবারে বিদ্যমান থেকেও মোনতার কষ্টময় সংগ্রামের জীবন বেশ দয়া জাগায় সাকিবের মনে।মৌনতা কেঁদে কেঁদে সাকিবকে তার সকল স্বপ্নকে ধুলিসাৎ হয়ে যাওয়ার আক্ষেপ করে।সাকিব তখন এই ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে বিয়ে আটকানোর পরিকল্পনা দেয় মৌনতাকে।শতভাগ কার্যকরী হবে ভেবে আনন্দিত হয়েছিলো মৌনতা।হলুদসন্ধ্যা উপলক্ষে পার্লারে সাজতে বেরিয়ে পাত্রের সাথে সাক্ষাত করে সে।কিন্তু আশানুরূপ ফলাফল না দিয়ে উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে চলে যায় লোকটি।মনের দুঃখ কষ্ট নিয়ে প্রস্থান করে মৌনতা।মনে মনে কাম্য করে লোকটির পরিবার যেন বিয়েটা ভেঙে দেয়।তার প্রার্থনা হয়তো সৃষ্টিকর্তার হৃদয় স্পর্শ করে।সন্ধ্যালগ্ন অতিক্রম না হতেই হলুদের তত্ব আনার পরিবর্তে মইন আহমেদকে ফোন দিয়ে বিয়েটা নাকচ করে দেয় আসিফের বাবা।
“সরি মইন ভাই।আপনার মেয়েকে বিয়ে করানো আমাদের পক্ষে সম্ভব না।আমার ছেলে স্পষ্ট চিরকুটে বিয়ে করবে না লিখে বাসা থেকে পালিয়ে গিয়েছে।”
“যদি আপনার ছেলের অমতই থাকে তবে আগে নাকচ করল না কেন?আজ বিয়ের আগমুহূর্তে আমাদের এভাবে অপমান করার মানেটা কি?”
গম্ভীর কণ্ঠে প্রতিউত্তর করে মইন আহমেদ।আসিফের বাবাও দ্বিগুন বেগে ক্ষোভ প্রকাশ করে,
“আপনার মেয়ে যে অপয়া এটা আগে জানালে শুরুতেই নাকচ করে দিতাম।এখন বিবাহলগ্নে আমাদেরও অপমানিত হতে হত না।”
কচু পাতায় পড়ন্ত পানির মতো নিজের গাম্ভীর্যপূর্ন তেজ গড়িয়ে পড়ে মইনের।তার মেয়েকে সে নিজেই অপয়া জ্ঞান করে।প্রতিউত্তরের সৎ সাহস করে না আর।এমন মেয়ে জন্ম দেওয়ায় শুরু থেকেই খেসারত দিতে হচ্ছে তার।কিন্তু মৌনতাকে তার অপয়া জ্ঞান করার যে ঠিক ভিন্ন কোন মিথ্যা খবরে অপয়া অপবাদ দিয়ে বিয়ে ভেঙে দিয়েছে আসিফ তা অজানাই রয় মৌনতার পরিবারের।তবুও এর ক্ষোভে মৌনতাকে নাজেহাল হতেই হয়।রাগে গজগজ করতে করতে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার অপমানটা প্রকাশ করে মইন।ভিতরে আসমান ছুঁই খুশি হলেও বহিঃপ্রকাশ মলিন রাখে মৌনতা ও হিয়া।তারা দু’জনে যা চেয়েছিলো তা ঘটলেও প্রকাশ করার মতে পরিবেশ নেই।মুহুর্তেই থেমে যায় সাউন্ড বক্সের মত্ত কোলাহল।নিরবতার করালগ্রাসে ঢেকে যায় সম্পূর্ন দোতলা বাড়িটি।বিরক্তিতে স্থান ত্যাগ করে মইন।শুধু একটি মাত্র প্রানের আক্ষেপ ইটের প্রতিটি দেয়ালে বারি খেতে থাকে।মৌনতার দাদি বৃদ্ধা মনজুরা বিলাপ শুরু করে দিয়েছেন,
“এমন অপয়া কুফা মাইয়া কেই বা বিয়্যা করব?জেনেশুনে নিজের পায়ে কেউ কুড়াল মারে নাকি?তোর মাইয়া যে কুফা এটা পুরা দুনিয়া জাইনা যাইতাছে মইন।তোরে আগেই কইছিলাম এই মাইয়া বিয়া দিয়া বিদায় কর।তাইলে আমাদের এতো ক্ষতিও হইত না।এখন আর এই মাইয়া কই বিয়্যা দিবি তুই?”
মইনকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো শেষ করেই মৌনতার দিকে এগোয় মনজুরা।ছোটখাটো অনুষ্ঠান হলেও বাড়িভর্তি লোকসমাবেশ।এসবে তোয়াক্কা না করেই মৌনতাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে মনজুরা।
“কেরে অপয়া মা’গি মরব্যার পারিস না তুই?আমাদের ঘাড়ে বসে বসে আর কত অন্ন নষ্ট করবি তুই?…..”
বদ্ধ দরজার ভিতরে থেকে মনজুরার গালিগালাজ কানে ভাসে মৌনতার।ছোট থেকেই এসবে অব্যস্ত সে।তাই সেদিকে তোয়াক্কা না করে গায়ে জড়ানো হলুদের সাজ পোশাক খুলতে উদ্যত হয় মৌনতা।কাচা ফুলের গহনা খুলে শাড়ির ভাজ খুলতে উদ্যত হয় সে।গায়ের আঁচল সরানোর সাথে সাথেই কানে বাজে পুরুষালী আতংকিত কন্ঠস্বর,
“আস্তাগফিরুল্লাহ!”
বদ্ধ ঘরে গাম্ভীর্যপূর্ণ পুরুষালী গলা শুনে চমকে ওঠে মৌনতা।পুনরায় গায়ে কাপড় জড়িয়ে নেয়।উৎস স্থল খুঁজতে ঘরে চোখ বুলাতেই দেখে ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করছে কেউ।
“এই কে ভিতরে?জলদি বের হয়ে আসেন।”
কিছুটা সময় নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয় পারভেজ।পারভেজকে নিজের ওয়াশরুমে দেখে ভড়কে যায় মৌনতা।পারভেজ তার বড় বোনের দেবর।ছয় ফুট লম্বা সুঠাম দেহের অধিকারী এই পুরুষটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মাতক চতুর্থ বর্ষের ছাত্র।সবসময় গাম্ভীর্যপূর্ণ একাকিত্ব থাকাই তার অভ্যেস।উপরন্তু ছোট খাট ভুল নিয়েই মানুষকে চড়া শাসন করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মানো লোক উনি।মেয়েদের থেকে দশ হাত দুরে থাকে।হটাৎ তাকে নিজের রুমে দেখে মৌনতা জিজ্ঞেস করে,
“আপনি এখানে কি করছেন?”
“আড়ামে ঘুমাচ্ছিলাম।তোমার রুমের যে হাল সেখানে থাকাটা অসম।তবে ওয়াশরুমটা ঘুমের জন্য একদম উপযুক্ত।”
পারভেজের গাম্ভীর্যপূর্ন এহেন উত্তরে রুষ্ট হয় মৌনতা।লোকটার এই রুষ্ট আচরণের জন্যই তাকে ভীষণ অপছন্দ মৌনতার।পুরো ঘরে একবার চোখ বুলায় মৌনতা।ব্যস্ততায় তাড়াহুড়ো করে ঘরের বিভিন্ন জায়গায় জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেড়িয়ে গিয়েছিলো সে।এ কারনে তাকে এভাবে অপমান করা হচ্ছে।রাগে গা পিত্তি জ্বলে যায় তার।
“আমার ওয়াশরুম পরিপাটি হোক বা বেডরুম পরিপাটি হোক তাতে আপনার কি?একটা মেয়ের ঘরে অনুমতিবিহীন ঢুকে এভাবে তার ইজ্জত দেখছেন লুচ্চাদের মতো।”
“আমি কি তোমাকে শাড়ি খুলতে বলেছি নাকি যে লুচ্চা বলছো!আশেপাশে পর্যবেক্ষণ না চালিয়ে ফাঁকা মাঠে এমন কাজ সাড়তে তোমার লজ্জা করে না?”
দাঁতে দাঁত চেপে বলে পারভেজ।প্রতিউত্তরে তিক্ততা ভরে মৌনতা বলে,
“যে কাজ আপনি করেছেন এটা বাহিরের লোক জানলে কি আল্লাহর ফেরেস্তা ভাববে আপনাকে।যদিও এমনিতে ফেরেস্তা জানে।কিন্তু আসল রুপ তো ফুটে উঠবে তখন।”
“আমার প্রকৃত রুপ ফুটবে কিনা জানিনা।কিন্তু তোমার ভেঙে যাওয়া বিয়েটা আমার সাথে জোরপূর্বক জুটিয়ে দেওয়া হবে।লসটা কিন্তু তোমারই।উপরন্তু আসিফকে বলা তোমার মিথ্যা কাহিনি যদি তোমার বাবাকে বলি কি হবে ভাবতে পারছো?”
চমকে ওঠে মৌনতা।এমনিতেই তার বাড়িতে টিকে থাকা মুশকিল।তারউপর এটা জানলে তার জান আস্ত থাকবে না নিশ্চিত।আতংকিত হয়ে বলে,
“বিয়ে ভাঙার মূল কারণ যে আমি তা আপনি জানলেন কি করে?”
“চোর চুরি করার পর তার মুখশ্রী জুড়ে চুরির পৈশাচিক আনন্দ লুকিয়ে থাকে।যেটা স্পষ্ট ফুটে আছে তোমার মুখে।উপরন্তু একটা দরকারে তোমারের সাক্ষাৎ স্থলে আমিও উপস্থিত ছিলাম।স্বচক্ষে সব দেখেছি।”
“যদি জানেনই সবটা তবে বাড়ির কাউকে বলছেন না কেন?”
“কতটা অসহায় হলে একটা মেয়ে পূর্ণ সুস্থ থেকেও নিরুপায় হয়ে নিজেকে বন্ধ্যা দাবি করে তা বুঝেই নিশ্চুপ আছি।তাছাড়া এমন অপরাধের শাস্তি তোমাকে পেতেই হত।”
প্রতিউত্তরের অপেক্ষা না করে দরজা খুলতে এগোয় পারভেজ।ভরা বাড়িতে মৌনতার রুম ফাঁকা পেয়ে এখানেই প্রাকৃতিক কাজ সম্পন্ন করতে আসে সে।কিন্তু সে কি জানতো এমন অঘটন ঘটবে!
“আমার পিছনে গোয়েন্দাগিরি করেন তাই না!আপনাকে দেখে নিব আমি।মৌনতা অত সহজ মেয়েও নয়।”
অস্ফুটস্বরে বিড়বিড় করে মৌনতা।
“আমার পিছে লাগতে এসো না মেয়ে।নিজেই ফেঁসে যাবে।”
প্রতিউত্তর করে হনহন করে বেরিয়ে যায় পারভেজ।বিষ্মিত হয় মৌনতা।লোকটি এমন চতুর কেন?এত ক্ষীন স্বরে বলা কথাও তার কান অবধি পৌঁছে গেল!
চলবে
#বসন্তের_অচেনা_সুর
#সুচনা_পর্ব
#লেখিকা_নূরজাহান_ফাতেমা