বসন্তের অচেনা সুর পর্ব -০২

#বসন্তের_অচেনা_সুর
#পর্ব_২
#লেখিকা_নূরজাহান_ফাতেমা
_______
রাত্রি দ্বি প্রহর।রজনীর গভীরতা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে অন্তরীক্ষের চন্দ্রিমা নিজেকে পূর্ণ রুপে ছড়িয়ে দিচ্ছে ভুবন জুড়ে।হাসনাহেনার সুগন্ধ ভাসছে মৃদু বাতাসে।ছাদে চিলেকোঠার পিছে দাঁড়িয়ে ফোনে প্রিয়তমের সাথে মধ্যে সময় কাটাচ্ছে হিয়া।মাঝে মাঝে লজ্জা পাচ্ছে।আবার পর মুহুর্তেই হেসে কুটি কুটি হচ্ছে।খাঁ খাঁ জোসনায় প্রেমময়ীর প্রেম বিলাস এক অন্যরকম মাধুর্য সৃষ্টি করছে।সেদিকেই পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে মৌনতা।বাতাসে উড়ছে তার রেশমি এলো চুল।হিয়ার মধুর সময় তার মনেও ভালোলাগার জোয়ার সৃষ্টি করছে।অপর পুরুষটিকে জীবনে পেয়ে মেয়েটি কত সুখী তা স্পষ্ট বোঝে মৌনতা।ইশ!তার জীবনেও যদি এমন কেও আসতো।ল!তবে সেও এমন মধুর সময়ের স্মৃতি সৃষ্টি করত।মনে মনে ভাবে মৌনতা।ছাদের কোন ঘেঁষে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে।হিয়া বাড়িতে আসার পর থেকেই তার প্রেমিকের সাথে কথা বলতে পারেনি।এতে ভীষন ক্ষেপেছে ছেলেটি।তার রাগ ভাঙাতেই মধ্য রাতে ছাদে এসেছে সে।পাহাড়াদার হিসেবে মৌনতাকে নিযুক্ত করা।যেন কেউ এলেই তাকে সতর্ক করতে পারে।বাড়ির লোক এ সম্পর্কের কথা জানতে পারলে ঝামেলা হবে।তা এড়াতেই এই সতর্কতা তাদের।হটাৎ পুরুষালী ভরাট কন্ঠস্বর শুনে ভাবনার ছেদ ঘটে মৌনতার।

“এতো রাতে নির্ঘুম কেন?”

আকষ্মিক পুরুষ কন্ঠ শোনায় ভয়ে কেঁপে ওঠে মৌনতা।পাশ ফিরে পারভেজকে দেখতে পেয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে নেয়।মাথা নিচু করে ফেলে সে।লোকটাকে ভীষণ অপছন্দ তার।উপরন্তু তখনের সে ঘটনার পর পারভেজের উপস্থিতি অসস্তি দিচ্ছে তাকে।লোকটা কেমন বেয়াহা,নির্লজ্জ।লুকিয়ে তার পোশাক বদলানো দেখে ফেলতে নিয়েছিলো।ভাগ্যিস নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে সে।কিন্তু উন্মুক্ত পেট তো দৃশ্যমান হয়েছে।কোন মেয়ের সামনেই পেট পিঠ অনাবৃত রাখে না সে।সেখানে পারভেজ!কেমন লজ্জাবতী গাছের ন্যায় মিইয়ে যাচ্ছে মৌনতা।পারভেজের আশেপাশে অসস্তি হচ্ছে তার।যা ঢের বোঝে পারভেজ।যে মেয়ে সবসময় শালীন পোষাকে নিজেকে আবৃত করে রাখে।হটাৎ পর পুরুষের সান্নিধ্যে শরীর উন্মুক্ত হয়েছে এটা বিব্রতকরই বটে।মৌনতা লম্বা পা ফেলে চলে যেতে উদ্যত হচ্ছিলো।তখন তার জড়তা কাটাতে পারভেজ বলে,

“আমি কিছু দেখিনি তখন।উল্টো দিকে ঘুরে ছিলে তুমি ভুলে গিয়েছ?ঘটনার আগাম বার্তা পেতেই ওয়াশরুমে আবারও ঢুকে পড়েছিলাম।আর সতর্ক বার্তা স্বরুপ মুখে শব্দ উচ্চারন করেছি।যেন নিজেকে পূর্ন রুপে আবৃত করতে পারো।অথচ তুমি আমাকে লু’চ্চা উপাধি দিলে। উপরন্তু নিজেই উল্টা পাল্টা ভেবে লজ্জা পাচ্ছো তখন থেকে।আসলেই কি লজ্জা পাওয়ার মতো এমন কিছু হয়েছে?”

পারভেজের গাম্ভীর্যপূর্ন বক্তব্য শুনে স্থির হয়ে যায় মৌনতা।মনে মনে ভাবে সত্যি তো!পারভেজ যেখানে মেয়েদের থেকে দশহাত দারে অবস্থান করে সেখানে তাকে নিয়ে এমন নোংরা চিন্তা কিভাবে করল সে।উপরন্তু তার চরিত্র নিয়ে কটাক্ষ করে বসেছে।লোকটার তো আদোও কোন দোষ ছিলো না।পিছু ঘুরে তাকায় সে।প্রতিউত্তরে মিহিয়ে যাওয়া গলায় বলে,

“মাথা ঠিক ছিলো না তখন।তাই অত সাত পাঁচ কিছু ভাবিনি।আপনাকে ওভাবে বলার জন্য দুঃখিত।”

“মাথা ঠিক না থাকাটাই স্বাভাবিক।বাড়ির সবার ক্রো’ধ যখন তোমার উপরেই পড়েছে তখন মাথার দুই একটা তার ছিঁড়তেই পারে।সাধে কি আর ভুল বোঝ?”

পারভেজের শুরুর বাক্যগুলোতে খানিকটা স্বাভাবিক হলেও পরের কথাগুলো শুনে চটে যায় মৌনতা।লোকটা অদ্ভুত রকমের।তার কথায় বোঝার উপায় নেই মনে কি চলছে।এই ভালো ব্যবহার করবে তো পরক্ষনেই রাগিয়ে দেবে।রুষ্ট হয় মৌনতা।কঠোর কন্ঠে বলে,

“কি বললেন আমার মাথার তার ছেঁড়া?আপনার যে বউ হবে তার মাথার তার ছেঁড়া।আপনার চৌদ্দ গুষ্টির মাথায় তার ছেঁড়া।”

রাগে ফোঁস ফোঁস করে মৌনতা।নাকের পাটা ওঠানামা করছে ক্রমাগত।চোখমুখ রক্তিমতায় ছেয়ে গেছে।স্মিত হাসে পারভেজ।যা দৃষ্টিগোচর হতেই মৌনতার রাগ তিরতির করে বেড়ে যায়।খাঁ খাঁ চাঁদের আলো উপচে পড়ছে তার রক্তিম চোখে মুখে। মেয়েটিকে রাগলে বড় সুন্দর লাগে।চাঁদের স্নিগ্ধতা সে সৌন্দর্য আরও কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে যেন।সেদিকে নিস্কম্প দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পারভেজ।এই অপরুপ সৌন্দর্যমন্ডিত রুপ দেখবে বলেই তো ইচ্ছাকৃতভাবে রাগিয়ে দিয়েছে মেয়েটিকে।উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে মৌনতা।লোকটার এমন চাহনিও অসহ্য লাগে তার।ইচ্ছে করে এখনি নিচে নেমে যেতে।কিন্তু হিয়ার জন্য এখান থেকে নড়ে না মৌনতা।পাছে পারভেজ জেনে যায় হিয়া কারো সাথে কথা বলছে।হিয়ার ক্ষীন স্বরের বুলি ছাদপর এপাশটায় শোনা যায় না।উপরন্তু চিলেকোঠার আড়ালে চাঁদের আলো পৌঁছায় না বলে ছাদে হিয়ার উপস্থিতি বোঝা যাচ্ছে না।মৌনতার দিকে একটু ঝুঁকে দাঁড়ায় পারভেজ।ফিসফিস করে বলে,

“চন্দ্রিমার রুপালি আলোয় কারো রুষ্ট রক্তিম চেহারাও যে এতোটা আকর্ষণীয় হতে পারে তাকে না দেখলে বুঝতাম না।”

চমকে ওঠে মৌনতা।অদ্ভুদ এক শিহরন বয়ে যায় তার শিরা উপশিরায়।কথাটি কি তাকে বলল?ইদানীং পারভেজের প্রায় কথাবার্তাই কেমন অস্বাভাবিক লাগে।আড়চোখে পারভেজকে পরক্ষ করে দেখে সে বেশ উদাসীন হয়ে আছে।দৃষ্টি আকাশের পানে।যেই চাঁদটিকে এতোসময় দেখছিলো মৌনতা।সে দিকেই আকৃষ্ট হয়ে তাকিয়ে আছে সে।কিছুটা ইতস্তত করে মৌনতা।কম্পিত কন্ঠে প্রশ্ন করে,

“কার রক্তিম চেহারা চাঁদের আভায় আকর্ষণীয় হয় পারভেজ ভাই?”

প্রতিউত্তরে চাঁদের দিকে তাকিয়েই মুচকি হাসে পারভেজ।জিভ দিয়ে শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে নেয়।রসিকতা করে বলে,

“ভয় পাবেন না বেয়াইনসাব।ওটা আমার হৃদয়হরিনীর কথা বলছি।”

আহত হয় মৌনতা।প্রতিত্তোরে ছোট্ট করে বলে,

“ওহ।”

নিরাবতা গ্রাস করে দুজনকে।একটু পরেই হিয়ার আগমন হয়।পারভেজকে দেখে একটু ইতস্তত করে হাসি বিনিময় করে।মৌনতা প্রায় পালিয়ে চলে যায়।পারভেজের সান্নিধ্য ভীষণ অপছন্দনীয় অনুভুত হয়।হিয়াও প্রস্থান করে কিছু গল্প করে।কেবল ঠায় দাঁড়িয়ে রয় একটি প্রান।

_________
আত্মীয় স্বজন সব বিদায় নিয়েছে।পুরো বাড়ি শূন্য।কিন্তু পরিস্থিতি খুব একটা সুবিধার নয়।প্রিয়তার শশুর বাড়ির লোক উপস্থিত থাকায় কিছুটা গুমোট হয়ে আছে মইন।তাদের প্রস্থানের পরেই যে মৌনতা প্রতিকুল অবস্থায় পড়বে বুঝে ফেলে অভিজ্ঞ প্রিয়তা।প্রিয়তা মৌনতার বড় বোন।পারভেজের বড় ভাই আদিবের সাথে বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচ আগে।পাক্কা গৃহিনী সে।ব্যস্ততার কারণে সে আজ শশুরবাড়ি চলে যাবে।মৌনতার জীবনের আগাম ঘুর্ণিঝড় অনুভব করেও চিন্তিত হয় সে।ও বাড়িতে ঝামেলা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিছু সময় ভেবে চিন্তে প্রিয়তা তার বাবার কাছে গিয়ে বলে,

“আব্বু ও বাড়িতে অনেক কাজ জমেছে আমার।বিয়ে যখন হল না আজই ফেরত যাব আমি।আমার শাশুড়ীও তাই চাচ্ছে।”

“আচ্ছা আজই যেও।থেকেই আর কি করবে।”

গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দেয় মইন আহমেদ।প্রিয়তা হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে,

“কিন্তু বলছিলাম কি এতো কাজ আমি একা সামলাতে পারব না।শাশুড়ী কিছুদিন যাবত অসুস্থ।কোন কাজে সেও সাহায্য করে না।তাই বলছিলাম কি…।”

“তা বেশ।তোমার মা যাবে তোমার সাথে।”

প্রিয়তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে বলে মইন।প্রিয়তা বাধ সেধে বলে,

“তা হয় না আব্বু। আম্মু আমার শশুড়বাড়ি গিয়ে কাজ করবে এটা অসম্মানজনক।তাছাড়া আম্মু গেলে এ বাড়ি দেখবে কে।”

“তো কি চাচ্ছো তুমি?”

“মৌনতা যাক তোমার সাথে।”

“তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে পারভেজ?ওমন অপয়া মেয়ে নিয়ে গেলে দেখবে কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে।বরং হিয়া যাক তোমার সাথে।”

“দুই দিন পর হিয়ার ভার্সিটি খুলবে আঙ্কেল।তাছাড়া হিয়া আমাদের বাড়ি গিয়ে কাজ করলে আমারা লজ্জিত হব।মৌনতার মতো তুচ্ছ মেয়ে কাজ করলে কিছু মনে হবে না।তাই ওর যাওয়াই ভালো।হিয়া গেস্ট হিসেবে সাথে যাবে।”

কথাটা মনে ধরে মইনের।পারভেজ মন্দ বলেনি।মেনে নেয় সে।মৌনতা ও হিয়াকে সাথে নিয়ে তারা পাড়ি জমায় ঢাকায়।হিয়া ছুটির দু’দিন ওখানেই কাটাবে।
এভাবে মৌনতাকে সেফ করায় পারভেজের উপর সন্তুষ্ট হয় প্রিয়তা।কিন্তু রুষ্ট হয় মৌনতা।লোকটা বার বার তাকে অপমান করে।তাকে তুচ্ছ মেয়ে বলল।রাগে দুঃখে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় মৌনতা।

_______
ঢাকায় এসেই সুযোগ পেয়ে নিজের মুঠোফোনটা বের করে মৌনতা।অনলাইনে গিয়ে প্রিয়াকে ভিডিও কল দিতেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে প্রিয়া।

“আমি তোর কি হই যে কল দিয়েছিস?খবরদার তুই আমাকে কল দিবি না।তোর মতো স্বার্থপরের সাথে আমার কোন কথা নেই।”

ভড়কে যায় মৌনতা।তটস্থ কন্ঠে বলে,

“কি হয়েছে দোস্ত?এমন করিস কেন?”

“এই কয়দিন সারা রাত অনলাইন ছিলি।অথচ আমার মেসেজের রিপ্লে তো দূরে থাক সিন অবধি করিস নাই।নতুন বন্ধু জুটিয়েছিস তাই না?”

“এসব কি বলিস দোস্ত?”

“প্লিজ দয়া করে এখন নাটক করিস না আমার সাথে।বলিস না যে টেকনিক্যাল প্রবলেম হবে।মেসেজ তো ঠিকি ডেলিভারি হইছে।”

ভড়কে যায় মৌনতা।প্রিয়ার আচরণে স্পষ্ট মৌনতার আইডি অনলাইন ছিলো।কিন্তু এই দুইদিনে তো সে অনলাইনে যায় নি।তবে অন্য কেউ কি তার আইডিতে লগ ইন করেছিল?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here