#বসন্ত_এসেছে
#পর্ব_৪
#মাহিমা_রেহমান
চলছে সমান তালে মেহেদী পরা।হইহুল্লোড় পুরো দমে।
একপাশে অর্পিতা’কে মেহেদী পরাচ্ছে একজন।অপরপাশে কিয়ারা নিজের মেহেদী নিজের পরছে।সেই সময় হাঁপাতে হাঁপাতে নিচে এলো বেলা।দৌড় আসার ফলে খুব বিধ্বস্থ দেখাচ্ছে বেলাকে।চোখমুখ কেমন লাল হয়ে হয়েছে।সেদিক তাকিয়ে সকলে অবাক।বেলাকে নিজের কাছে ডাকল অর্পিতা।কম্পিত পায়ে সেদিক এগিয়ে গেল।একটানে নিজের পাশে বসিয়ে অর্পিতা জিজ্ঞেস করল,
-“কীরে ছাদে কে ডেকেছিল তোকে?”
মৃদু আওয়াজ তুলে বেলা বলল,
-“রায়ায ভাই।”
এবার সুর টেনে অর্পিতা বলতে লাগল,
-“ওহো…আমার ভাই কিন্তু সেই রোমান্টিক বল? তা কী কী করলো?”
অবাক নয়নে তাকিয়ে বেলা জিজ্ঞেস করল,
-“কী আবার করবে?”
ভ্রুক্ষেপহীন ভঙ্গিতে অর্পিতা জিজ্ঞেস করল,
-“তাই? কিছুই করেনি।”
কম্পণরত কণ্ঠে বেলার উত্তর,
-“কী…আবা..র করবে?”
-“আচ্ছা ছাড় এসব।তোদের পার্সোনাল কথা তোদের মধ্যেই থাক।ওই দেখ (আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে) তোর সতীন!”
বিস্মিত কণ্ঠে বেলা জিজ্ঞেস করল,
-“সতীন মানে!”
মৃদু কেশে নিজের গলা পরিষ্কার করল অর্পিতা। হামি তুলতে তুলতে বলে উঠল,
-“ওই আর কি রায়ায ভাইয়ের প্রেমে দিওয়ানি।”
এবার কিছুটা নড়েচড়ে বসল যেন বেলা।কৌতূহলবশত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
-“কে এই মেয়ে? চিনলাম না তো?”
-“কে আর হবে? আমার ছোট খালামুনির মেয়ে পায়েল।”
-“পায়েল আপু! চেনাই যাচ্ছে না।কত সুন্দর হয়ে গেছে আগের থেকে।”
-“হুম সেটাই তো কথা।এখন রায়ায ভাইয়া যদি পায়েলের প্রেমে পড়ে যায়? বেশ হবে বল! পায়েলকে কিন্তু আমার বেশ লাগে।মায়ের ও খুব পছন্দ।”
কথাটা বলেই বেলাকে কনুই দিয়ে গুতো মারল অর্পিতা।আতঙ্কের এক ভয়াবহ রেশ কেটে গেল বেলার চিত্তপটে।রায়ায ভাই যদি সত্যি সত্যি পায়েল আপুকে পছন্দ করে ফেলে তাহলে কী হবে? তিরতির করে ঘামতে লাগল বেলা।ভ্রু কুঁচকে অর্পিয়রা জিজ্ঞেস করল,
-“কীরে কী হয়েছে তোর? হটাৎ এমন ঘামছিস কেন?”
দুদিকে মাথা নাড়ল বেলা।যার অর্থ কিছুই হয়নি তার।অর্পিতা একজন আর্টিস্টকে বলল বেলার সাজ ঠিক করে দিতে। শঙ্কিত চিত্তে বেলা নাকচ করলো।কিন্তু কে শুনে কার কথা?অবশেষে বাধ্য হয়ে সাজ ঠিক করতে গেল বেলা।মেয়েটি সাজ ঠিক করার কথা বলে তাকে বেশ মেকআপ লাগিয়ে দিয়েছে।তপ্ত শ্বাস ত্যাগ করলো বেলা।রায়াযে ভাই নিশ্চয়ই তাকে এবার আচ্ছামত বকে দিবে!
.
.
বর পক্ষের মেয়েরা আজ মেহেন্দি অনুষ্ঠান উপলক্ষে এখানে অংশগ্রহণ করবে বলে,, সেই তোড়জোড় চলছে রওশন বাড়িতে।আয়োজনের কমতি নেই বিন্দু মাত্র।গেটের সামনে অহরহ গাড়ির আগমন দেখে সেদিক ছুটল সকলে।তবে মেহমানদের দেখে খুশি হওয়ার বদলে অবাকই বেশি হলো বৈকি! মেয়েদের অনুষ্ঠান হওয়ার সুবাদে কেবল মেয়েদের আনাগোনাই মুখ্য।কিন্তু অকস্মাৎ বেশ কিছু ছেলেদের আগমনে অবাক হওয়া স্বাভাবিক বিষয়।পরমুহুর্তে অবাকের রেশ কাটিয়ে মেহমানদের সাদরের সঙ্গে ভিতরে নিয়ে গেল সকলে।মেহমানদের খাবার দেওয়া হলো।খাবার-দাবার শেষে সকলে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করল। তবে বিবৃতিকর অবস্থায় পড়ে গেল মেয়েরা।অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল কেবল মেয়েদের।এরমাঝে ছেলেদের দেখে সকলের হাঁসফাঁস অবস্থা।অনেকক্ষণ যাবত রায়াযকে কোথাও দেখতে না পেয়ে তার খোঁজে বাগানের দিকে এলো বেলা। আঁখি ঘুরিয়ে খুঁজতে লাগল চারিপাশ।নিজের ভাবনার মাঝে আকস্মিকতায় কোন পুরুষালী কণ্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই চমকে উঠল।পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেল একজন সুদর্শন যুবককে।নিজের দিকে ফিরতেই যুবকটি বেলার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
-“এক্সকিউজ মি।ক্যান আই টক উইথ ইউ ফর সাম টাইম?একচুয়ালি আই ফিল্ট সো বোর!
-“জি বলুন, কী বলবেন?”
-“নাথিং সো স্পেশাল।এমনি একটু কথা বলতে এসেছিলাম।এই যা।
-“ও আচ্ছা।”
-“জি আমি রুশান।আপনি?”
-” রুবাইয়্যাত বেলা।”
-“বেশ সুন্দর।ঠিক আপনার চেহারার মতন।”
চকিতে ছেলেটির দিকে তাকাল বেলা।জিজ্ঞেস করল,
-“মানে?”
-“নাথিং। বায় দা ওয়ে আপনাকে কিন্তু শাড়িতে বেশ লাগছে।”
কিছু বলতে নিবে বেলা, তার পূর্বে ঝড়ের গতিতে রায়ায এসে বেলাকে টেনে হিচড়ে কোথাও নিয়ে যেতে লাগল।শঙ্কিত চিত্তে বেলা বলল,
-“হাতে আমার খুব লাগছে রায়ায ভাই! ছাড়ুন না প্লিজ।আর এভাবে কোথাও নিয়ে যাচ্ছেন আমার?”
হেলদুল নেই কোনো রায়াযের।পূর্বের ন্যায় টানতে টানতে বেলাকে নিজের রুমে নিয়ে আসে রায়ায।ধাক্কা মারে ফ্লোরে ফেলে এক প্রকার।ফলপ্রুশিতে হাতে-পায়ে কিছুটা ব্যথা অনুভব করে বেলা।অশ্রুসিক্ত নয়নে রায়াযের মুখপানে দৃষ্টিপাত করে সে।রক্তের ন্যায় লাল চোখ দুটো দেখে অন্তর-আত্মা কেঁপে উঠল যেন বেলার।রক্তিম চোখে তাকিয়ে বড় বড় কদম ফেলে বেলার দিকে এগিয়ে এলো রায়ায।শক্তপোক্ত পুরুষালী হাতের সাহায্যে একটানে নিচ থেকে দাঁড় করালো তাকে।হুংকার ছাড়ল,
-“কোন সাহসে ওই ছেলের সাথে কথা বলতে গেছিলি?বল বলছি! এতো সাহস এলো কোথা থেকে ?
ভয়ে বারংবার কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল বেলা।রায়ায পুনরায় হুংকার ছাড়ল,
-“এতবার না করার পরেও আবার সেজেছিস।”
কথাটা বলেই নিজের পকেট থেকে একটা রুমার বের করে তা ডাইরেক্ট বেলার মুখে চালান করে দিল। শুকনো রুমালের সাহায্যে সাজ মোছার প্রয়াস মাত্র।এবার এক বিভৎস চিৎকার দিয়ে উঠল বেলা।ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলল,
-“রায়ায কী করছেন কী?ছাড়ুন বলছি। খুব লাগছে আমার। চামড়াই মনে হয় উঠে যাবে।”
থমকাল রায়ায।টানতে টানতে বেলাকে নিয়ে গেল ওয়াশরুমের ভিতর।হাতে সাবান নিয়ে তা ডাইরেক্ট বেলার মুখে ঘসে দিল।পুনরায় চিৎকার দিয়ে উঠল বেলা।সেদিক ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের কাজ চালিয়ে যেতে লাগল রায়ায।সাজ পুরোপুরি ধোয়া কমপ্লিট হতেই হাত ধরে তাকে বাহিরে নিয়ে এলো।নির্জীব চোখে রায়াযের চোখে তাকিয়ে বেলা।গম্ভীর কণ্ঠে রায়ায বলে উঠল,
-“আমার কথা অমান্য করার ফল নিশ্চয়ই পেয়েছিস।আর শাড়ি! এসব শাড়ি পরার কোনো দরকার নেই যা দিয়ে পেট দেখা যায়।”
কথাটা শেষ করেই বেলার শাড়ির পেছনে পড়ে যায় রায়ায। রাগের বশে টেনে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে। আঁতকে উঠে অসহায় কণ্ঠে বেলা বলল,
-“রায়ায ভাই প্লিজ।আমি জানতাম না আজ কোন ছেলে মেহেন্দি ফাংশনে অ্যাটেন্ড করবে ট্রাস্ট মি।আর আমি কেনো সবাই এভাবেই শাড়ি পরেছে।”
কিছুটা শান্ত হয়ে এলো যেন রায়ায।ঘন ঘন নিশ্বাস ত্যাগ করে শান্ত করার চেষ্টা করল নিজেকে।এক পলক বেলার দিকে তাকিয়ে রাশভারী স্বরে আওড়ালো,
-“তোর আর কোনো ফাংশনে অ্যাটেন্ড করার দরকার নেই।এই রুমেই কন্ধি থাকবি তুই।”
বলেই গটগট পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে দিল রায়ায।আতঙ্কিত চিত্তে দ্রুত এগিয়ে এলো বেলা দরজার কাছে। কড়া নাড়তে নাড়তে লাগল জোরে জোরে। ডাকতে লাগল,
-“রায়ায ভাই দরজা খুলুন প্লিজ।কোথায় গেলেন আমাকে ফেলে।রায়ায ভাই প্লিজ! আমার কী দোষ? আমি ইচ্ছে করে কিছুই করি নি।প্লিজ খুলে দিন দরজা।”
বেশ কয়েকবার হাঁক ছাড়ার পরেও যখন কেউ দরজা খুলল না, তখন ক্লান্ত হয়ে বেলা বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। আস্তে করে নিজের মাথা এলিয়ে দিল একটা বালিশে।চোখের অশ্রু ফেলতে লাগল নিরবে।
.
.
রাত এগারোটা পঁয়তাল্লিশ রুমে প্রবেশ করল রায়ায।কাজের চাপে শ্বাস ফেলানোর সময়টুকু পায়নি সে।যার দারুণ বেলার বিষয়টা একদম মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিল।বাড়ির অনেকেই বেলার কথা জিজ্ঞেস করেছিল বৈকি,,সে অন্যকথা বলে কাটিয়ে দিয়েছে।কাজের চাপে সবাই অত খেয়াল ও করেনি।বিছানার দিকে তাকাতেই সহসা তার দৃষ্টিতে এসে হানা দিল ঘুমন্ত প্রয়শ্রীর মুখ।সেদিকে ছোট ছোট কদম ফেলে এগিয়ে গেল সে। উবুর হয়ে শুয়ে ছিল বেলা।সন্তর্পনে তাকে টেনে সোজা করে বালিশে শুইয়ে দিল।আলগোছে স্পর্শ করল কপাল জোড়া।ইশ! কী লাল লাল হয়ে গেছে পুরো মুখমণ্ডল।তার উপর কান্না করে চোখমুখ একদম ফুলিয়ে ফেলেছে।বেশ মায়া হলো রায়াযের।মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মৃদু স্বরে ডাকতে লাগল,
-“বেলা, এই বেলা উঠ দেখি।কিছু খেয়ে নে।”
পিটপিট করে চোখ মেলল বেলা।বেশ ক্লান্ত সে।তাই হালকা করে চোখ খুলে উঠে বসল।পুনরায় খাটের কর্নারে হেলান দিয়ে ঘুমাতে লাগল। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে রায়ায চলে গেল খাবার আনতে।খাবার এনে বেলাকে পুনরায় ডাকতে লাগল,
-“বেলা।বেলা রাণী উঠুন।আমার হৃদয়াসিক্ত চন্দ্রমল্লিকা উঠে পড়।”
তড়িৎ চোখ মেলল বেলা।ঘুমঘুম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
-“কী বললেন?”
গম্ভীর কণ্ঠে রায়ায সুধালো,
-“কিছু না।তাড়াতাড়ি উঠ।”
ঘুমে ঢুলছে বেলা।তাই রায়াযই তাকে খাইয়ে দিল।খাবার শেষে প্লেটগুলো নিয়ে নিচে গেল রায়ায।এসে দেখল বেলা পুনরায় ঘুমের দেশে তলিয়ে গেছে।মৃদু হাসল সে।বেশ কিছুসময় অবিহিত হওয়ার পর অতি সন্তর্পনে বেলাকে কোলে তুলে নিল ।বেলার রুমে প্রবেশ করে তাকে শুইয়ে দিল খাটে।গায়ে চাদর দিয়ে ঢেকে দিল গলা পর্যন্ত।কিছুটা ঝুঁকে পরল সে বেলার দিকে।অতি শীতলতা সহিত নিজের ওষ্ঠ স্পর্শ করল বেলার ললাটে।কিঞ্চিৎ নড়ে উঠল বেলা।পরমুহুর্তে বেলার পুরো মুখমণ্ডল জুড়ে নিজের ওষ্ঠের ছোট ছোট স্পর্শ দিতে লাগল রায়ায।
.
.
আযানের শব্দে ঘুম ভাঙ্গল বেলার।হামি তুলতে তুলতে উঠে বসল।অকস্মাৎ নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে চমকালো সে।তার হাতে মেহেদি দেওয়া! কিন্তু সে তো কাল মেহেদী পরতেই পারেনি রায়ায ভাইয়ের জন্য।পক্ষান্তরে মন খারাপ হলো বেলার। মনে পড়ে গেল কালকের সকল ঘটনা সংক্রান্ত।কিন্তু সে তো রায়ায ভাইয়ের রুমে ছিল,,তাহলে এখানে এলো কী করে? আর এই মেহেদী! ( দুহাত সামনে ধরে ) তার হাতে মেহেদীই বা দিল কে?
.
.
.
চলবে কী…?