বসন্ত এসেছে পর্ব -১১ ও শেষ

#বসন্ত_এসেছে
#মাহিমা_রেহমান
#অন্তিম_পর্ব

_”নে এটা খা।”

গোল গোল চোখ করে বেলা জিজ্ঞেস করল,

-“এটা আবার কী?”

-“এটা একটা জুস খা খা।”

দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে ভুগতে বেলা হাতে তুলে নিল গ্লাস টা।কেবল সে না, সকলের হয়ে একটা করে গ্লাস। হয়তো সকলে এই জুসটা খাবে। তাই সে আর কোনকিছু চিন্তা ভাবনা না করে শেষ করল পুরো গ্লাস। তৎক্ষণাৎ ঈষৎ মাথা ঘুরে উঠল বেলার। মেয়েগুলোর উদ্দেশ্যে অকপট কণ্ঠে বলে,

-“আমার কেমন মাথা ঘুরাচ্ছে।”

ফিসফিস করে একটা মেয়ে বলল,

-“যাক কাজ শুরু হয়ে গেছে।”

পরমুহুর্তে বেলাকে উদ্দেশ্যে করে বলল,

-“বেলা তুই বরং নিজের ঘরটায় চলে যা। তোর তো শরীর খারাপ করছে বললি,,তুই গিয়ে কিছুক্ষন বিশ্রাম কর।”

মাথা নেড়ে বেলা ঢুলতে ঢুলতে চলে গেল রুমের উদ্দেশ্যে।রুমে প্রবেশ করে ঝাপসা চোখে আশেপাশে রায়াযকে খুঁজতে লাগল।রুমের কোথাও হদিস মিলল না তার।
কেমন হাসফাঁস লাগছে বেলার। তাই আর মাথা না ঘামিয়ে ধরাম করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল।

বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত কাজিনদের সাথে এতক্ষণ আড্ডায় মেতে ছিল রায়ায। অবশ্য তাকে একপ্রকার জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেখানে। কিন্তু তার মন টিকছিল না। তার মন তো অন্যদিকে! চোখ তার সারাক্ষণ বেলাকেই খুঁজে চলছিল। যেই বেলা কে রুমের দিকে অগ্রসর হতে দেখল,,
হাঁসফাঁস করতে করতে সে কোন রকম বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। রুমে প্রবেশ করতেই তার চোখ চড়কগাছ। দ্রুত গিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে ফ্লোর থেকে বেলার পরিহিত শাড়িটি হাতে তুলে বেলার কাছে এগিয়ে গেল সে। মৃদু কন্ঠে ডেকে উঠল,

-“বেলা, এই বেলা কি হয়েছে তোর? এভাবে শাড়ি খুলে শুয়ে আছিস কেন?”

ঝাপসা চোখের রায়াযের দিকে তাকিয়ে বেলা উত্তর দিল,

-“আমার খুব গরম লাগছে তাই।”

গরম তো তার নিজের ও লাগছে। তাই বলে এতো গরমও না যে এসি থাকা শর্তেও এত শোচনী অবস্থা হবে। অকস্মাৎ বেলা জোরে হেসে উঠল। ঢুলতে ঢুলতে উঠে বসলো। যাই নয় তাই বকে যেতে লাগলো মুখ দিয়ে। খটকা লাগল রায়াযের। উল্টোপাল্টা আবার কিছু খায়নি তো? বিয়ে বাড়ি বলে কথা,, খাওয়াটা অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। বেলাকে নিজের কাছে টেনে নিল রায়ায। ফলস্বরূপ কথা বলার দারুণ বেলার মুখ থেকে ভেসে এলো এক তিক্ত ঝাঁঝালো গন্ধ। যা বোঝার বুঝে নিল সে। দ্রুত তাকে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো সে। ফ্রেশ করিয়ে এনে বসিয়ে নিজে চলে গেল বাহিরের দিকে। এক গ্লাস লেবু জলের আশায়। কাঙ্খিত জিনিসটি হাতে পেতেই দ্রুত রুমে প্রবেশ করলো সে। বেলার দিকে দৃষ্টি ফেলতেই কদম থমকে গেল তার। নিঃশ্বাস হতে লাগলো ভারী। মৃদু মৃদু কদম ফেলে এগিয়ে গেল সে সমীপে। সামনে এগোতেই তাকে একপ্রকার জাপটে ধরলো বেলা। নেশা ঝরানো কন্ঠে শুধালো,

-“জানেন ঐ আপু গুলো আমাকে কী জিজ্ঞেস করেছিল? জিজ্ঞেস করেছিল আমাদের বাসর হয়েছে কিনা? কিন্তু আমাদের তো হয়নি। তাই আমি নিষেধ করে দিয়েছি।”

বলেই মাথা নত করে কিছু একটা ভাবতে লাগলো। পরমুহূর্তে নিজ থেকেই আবার বলে উঠলো,

-“কিন্তু কেন হয়নি? হওয়া উচিত। তবে আজকেই হোক। চলুন আমরা বাসর করি।”

এদিক দিয়ে রায়াযের অবস্থা খারাপ। তার চোখ আটকে আছে বেলার পরিধেয় বস্ত্রের উপর। কী পরে আছে এই মেয়ে এটা! তার উপর তার এইসব উল্টাপাল্টা কথাবার্তা। নিজেকে আর কোনোভাবেই দমানো যাচ্ছে না,, এরই মাঝে বেলার রায়াযকে জোর করতে লাগলো,

-“চলুন না,,চলুন আজকে আমরা বাসর করেই ছাড়ব। কী হলো! বাসর আজকে হবেই হবে।”

নিয়ন্ত্রণের বাঁধ ভাঙলো এবার রায়াযের। ঘন হাস্কি স্বরে সে বলল,

-“তবে তাই হোক।”
.
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে বিধ্বস্ত অবস্থায় বিছানায় আবিষ্কার করল বেলা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে খুঁজতে লাগলো রায়াযকে। মাথায় অজস্র যন্ত্রণা হচ্ছে তার। ব্যথায় এক প্রকার ফেটে যাচ্ছে যেন। মাথা চেপে ধরে উঠে বসলো সে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর চলে গেলে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলো রায়াযের খোঁজে। লিডিং রুমের এক পাশে দাঁড়িয়ে রায়ায। তারই সামনে কালকের সেই মেয়েগুলো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। রায়াযের মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে খুব রেগে আছে বর্তমানে। তারই সমীপে মেয়ে গুলো মাথা নিচু করে কাঁচুমাচু করে যাচ্ছে। সেদিক পা বাড়ালো সে। গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-“কি হয়েছে এখানে?”

বেলার কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই কিছুটা শান্ত হয়ে এলো যেন রায়ায। ফিরে তাকালো সে। মেয়েগুলোর দিকে এক প্রকার অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এগিয়ে গেল বেলার দিকে। আলতো করে গাল স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করল,

-“ঠিক আছিস তুই? কোন সমস্যা হচ্ছে না তো।”

মাথা নাড়লো বেলা। কৌতূহল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করল,

-“আমার আবার কী হবে।”

দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল রায়ায। এই মেয়ের দেখি কাল রাতের কথা কিছুই মনে নেই! সে বলল,

-” না কিছু না। চল কিছু খেয়ে নিবি।”

রাতের বেলা খুবই অল্প সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে ঘরোয়া ভাবে কিয়ারার আকদ সম্পন্ন হলো।পুরোটা সময় বেলার একহাত নিজের হাতের মুঠো বন্ধি করে নিজের সাথে নিয়ে ঘুরেছে রায়ায।
.
.
পরের দিন সকল মেহমান এক এক করে ছুটল যার যার নিজ আঙিনায়।রায়াযরা ও চলে এলো।

দেখতে দেখতে কেটে গেল কয়েকমাস।এখনো বাড়ি থেকে তাদের সম্পর্কের কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।তবে মনে মনে সকলেই মেনে নিয়েছে সবটা।এখন কেবল মুখে স্বীকার করাই বাকী বৈকি!
বর্তমানে নিজ শহরে নেই রায়ায।ব্যবসায়িক কাজে ছুটতে হয়েছে তাকে চট্টগ্রাম। ফিরবে সে দিন কয়েক পর।

সকাল টেবিলে বসে নাস্তা খাচ্ছিল বেলা।অকস্মাৎ তার গা কেমন গুলিয়ে এলো। বমি হবে বুঝি! সত্বর উঠে দাঁড়াল সে। দৌঁড়ে বেসিনের সামনে গিয়ে গড়গড় করে বমি করে দিল।মেয়েকে আচানক বমি করতে দেখে ঘাবড়া*লেন রুমি রওশন।ছুটে গেলেন মেয়ের কাছে। মাথায় হাত চেপে ধরে রইলেন।ক্লান্ত বেলা ভরসার এক স্থল পেয়ে নিজের সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে দিল মায়ের উপর। মেয়েকে নিয়ে তিনি নিজের রুমে এলেন। বিছানায় শুইয়ে দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন,

-“কী হয়েছে? এমন বমি করলি কেন হঠাৎ? উল্টা পাল্টা কিছু খেয়েছিস কী?”

ক্লান্ত কণ্ঠে বেলা উত্তর দিল,

-“না তেমন কিছুই খাই নি। কয়েকদিন ধরেই এমন বমি বমি হচ্ছিল।”

বেলার কথা সমাপ্তি ঘটতেই এবার মেয়ের দিকে সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন রুমি রওশন।মেয়ে তার এমনিতেই যা পাকা পেকেছে! কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে নিল। এবার না জানি….সন্দেহ হলো তার।তাই নিজের কাছে থাকা প্রেগনেন্সি কিট মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিইয়ে বললেন,

-“নে টেস্ট কর।”

ভ্রু কুঁচকে সে জিজ্ঞেস করল,

-” কী এটা।”

ধমকে উঠলেন রুমি রওশন।বললেন,

-“এতো বেশি কথা বলিস না। যা বলছি কর তাড়াতাড়ি।”

-” কীসের টেস্ট ?আর এটা কীভাবে ব্যবহার করে আমি জানি না।”

-” আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।”
.
.
মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন রুমি রওশন।এই টুকুন একটা বাচ্চা মেয়ে কিনা আরেক বাচ্চার মা। কথাটা ভাবতেই মাথা ঘুরে উঠলো ওনার। ইচ্ছা করছে চাপড়ে গাল লাল করে দিতে। বয়স কতই বা হবে? কেবল সতেরো! এই বয়সে আরেকটা প্রজন্মকে নিজের মধ্যে নিয়ে ঘুরছে এই মেয়ে! রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে তিনি বেলার গালে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে দিলেন এক চড়।
.
.
দু*দিন বাদে ফিরার কথা হলেও,,,আজকে ফিরেছে রায়ায। নিজের ছোট্ট বউকে রেখে এতদিন অদূরে থাকতে তার মন টিকেনি।তাই দ্রুত কাজ সেরে ফিরে এসেছে সে। নিজের রুমে ফ্রেশ হয়ে সে বেলার রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।রুমের মধ্যে আশেপাশে কোথাও তাকে দেখতে না পেয়ে কপাল কুঁচকে নেয় সে। কিছুদূর এগোতেই ছোটমায়ের ( রুমি রওশনের) রুমের ভেতর থেকে শোরগোলের শব্দ শুনতে পায়।কৌতহল বসত সেদিকে এগোয় সে।কিছু বাক্য নিজের কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই থমকে যায় যেন তার পা জোড়া।

রুমি রওশনের রুমে উপস্থিত বাড়ির সকলে।ডক্টর বেলাকে চেকাপ করছে। চৈতন্য হারিয়ে বিছানায় পড়ে বেলা। চেকআপ শেষে ডক্টর সকলের উদ্দেশ্যে বলল,

-“সি ইজ প্রেগনেন্ট।এই অবস্থায় মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া খুবই নরমাল একটা বিষয়।তাই ঘাবড়ানোর কিছুই নেই।খেয়াল রাখবেন তার। আজ আমি আছি। আর কোনো প্রয়োজন পরলে ডাকবেন।”

ডাক্তারের কথা শুনে উপস্থিত সকলের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। পরমুহুর্তে সকলেই নিজেদের সামলে নেয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই নেয় বিষয়টা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল রায়ায। ধীরে ধীরে কদম ফেলে সে এগিয়ে আসে ভিতরে।রায়াযকে এই সময় ঢাকায় দেখে সকলে অবাক হয় বৈকি! নিজেদের ধাতস্থ করে এক এক করে সকলে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। বেলার পাশে গিয়ে বসে রায়ায। আলতো করে নিজের হাতের মুঠোয় আগলে নেয় বেলার ডান হাত। হাতের পাতায় নিজের ওষ্ঠ স্পর্শ করে। মৃদু কম্পিত হয় বেলার চোখের পাতা। কিয়ৎ কাল ব্যয় হতেই চোখ মেলে তাকাল সে। রায়াযকে নিজের নিকটবর্তী দেখে চমকায় বেশ। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-“আপনি।”

মৃদু হাসে রায়ায। খাটের কার্নিশে আধশোয়া হয়ে বেলাকে নিজের বুকে টেনে নেয়। রায়াযের হৃদস্পন্দন মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগে বেলা। আবারো জিজ্ঞেস করে,

-“বললেন না।”

-“মন টিকছিল না। তাই ছুটে চলে এলাম। আর এসেই এতো সুখময় বার্তা কর্নপাত হবে ভাবিনি।”

মন খারাপের ভঙ্গিতে বেলা বলল,

-“সুসংবাদ কোথায়? আমি তো অসুস্থ হয়ে পড়েছি।এটা বুঝি আপনার কাছে সুখের খবর।”

-“তোর এই অসুস্থতার মাঝে এক বিশাল সুখ নিমজ্জিত।”

অবাক চোখে তাকিয়ে বেলা জিজ্ঞেস করে,

-“কী সেটা?”

বেলার কোলে মাথা রেখে তার উদরে মাথা গুঁজে দিয়ে রায়ায উত্তর করে,

-“এখানে, সেই সুখ লুকায়িত ! নতুন মেহমানদের আগমন ঘটেছে।”

আপনা আপনি বেলার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরল এক ফোঁটা অশ্রু। কম্পন্তত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

-“সত্যি?”

বেলার কপালে নিজের ওষ্ঠের সিক্ত স্পর্শ এঁকে দিয়ে রায়ায উত্তর দেয়,

-“হুম।”

তৎক্ষণাৎ রায়াযের বক্ষঃস্থলে মুখ গুঁজল বেলা।

~~ সমাপ্ত~~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here