বসন্ত বিলাস পর্ব -০৩

#বসন্ত_বিলাস
#আমিনা_আফরোজ
#পর্ব :-০৩

(কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ)

কয়েক দিন পরের কথা। সেদিনের সেই জোৎস্না স্নাত রাতের পর কেটে গেছে দশ দিন। এই দশ দিনে শেষ হয়েছে অভিদের পরিক্ষা। বাকি পরিক্ষা গুলোতে আর কোন সমস্যা হয় নি অভিদের। পরিক্ষা শেষে আবারো যথারীতি শুরু হয়েছে ক্লাস। প্রতিদিন সকালে কোন রকমে নাকে মুখে কটা দিয়ে ব্যাগ কাঁধে ফেলে অভি আর মেহুল বেরিয়ে পড়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে। সারাদিন একটানা ছয়টা ক্লাস শেষ করে অভি আর মেহুল প্রথমে যায় মনা কাকার দোকানটায় , সেখান থেকে কখনো ঝালমুড়ি আবারো কখনো বা টক আচার কিনে রাস্তা দিয়ে খেতে খেতে দুজনে দুজনের হাত ধরাধরি ফিরে আসে বাসায়। এইটাই ওদের দুজনের নিত্যদিনের রুটিন।

আজও‌ অভিদের রুটিনের কোন হেরফের হয় নি।‌ অভিরা যখন স্কুলে গিয়ে পৌঁছল তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় দশের ঘরে। ওদের ক্লাস শুরু হয় দশটায়। ওরা দুজনে দৌঁড়ে ক্লাস রুমের দিকে ছুটলেও শেষ রক্ষা হয় নি। ওদের আগেই অবিনাশ বাবু ক্লাসে ঢুকে গেছেন। অবিনাশ বাবু ক্লাসে ঢুকবার পর আর কাউকে ক্লাসে ঢুকতে দেন না। যারা অবিনাশ বাবুর ক্লাসে ঢুকতে পারে না তাদের দেখা যায় ক্লাস রুমের সামনে, কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়। সেই কান ধরা অবস্থায় তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ক্লাস শেষ হওয়া অব্দি অর্থাৎ পাক্কা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আজ মেহুলদেরও ঠাঁই হয়েছে ক্লাস রুমের সামনে। অবিনাশ স্যার ওদের কান ধরিয়ে তো রেখেইছে তারওপর সেদিন পরিক্ষার হলে বেয়াদবি করার জন্য আজ ওদের শাস্তিস্বরূপ এক পায়ে দাঁড়িয়ে রেখেছে। অভি আর মেহুল অবিনাশ স্যারের শাস্তি স্বরূপ এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেহুল মনে মনে বেশ বিরক্ত স্যারের ওপর। সেদিনকে খাতা কেড়ে নিয়েও কি শাস্তি দেওয়া হয় নি যে আজ আবার নতুন করে এক পায়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে রেখে শাস্তি দিতে হবে। ক্লাসের সামনে দিয়ে যতজন টিচার যাচ্ছেন তারা সকলেই ওদের দুজনকে এভাবে এক পায়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই যে মিটমিট করে হাসছে এইটা মেহুল বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। মেহুল এইবার রাগে কটমট করে অভির দিকে ঝুঁকে ফিশফিশ করে বলল,

–” আমাদের এভাবে সবার সামনে অপমান করল তো ,দেখ এবার ঐ টাকলার কি অবস্থা করি আমি। মেহুলের সঙ্গে পাংঙ্গা, সেহেনা পারেগা বহুত প্যারা।”

এই এক মুদ্রাদোষ মেহুলের। কথায় কথায় বাংলা আর হিন্দি মিক্স করে জগাখিচুড়ী বানিয়ে ফেলে ও। এ নিয়ে কম ঝগড়া বাঁধে নি ওদের দুজনের কিন্তু যে কে সেই রয়ে গেছে। মেহুলের এই মুদ্রাদোষ ছাড়ে নি বরং বেড়েছে খানিকটা। আগে শুধু বাংলা আর হিন্দি মিক্স করে জগাখিচুড়ী বানাতো এখন বাংলা আর হিন্দির পাশাপাশি যোগ হয়েছে ইংরেজি। কথায় কথায় ভুলভাল ইংলিশ বকে চলে মেয়েটা। অভি বাঁধ সাধে মাঝেমধ্যে কিন্তু মেহুলের বাংলিশ বলা থামে না। চলন্ত ট্রেনের মতো চলতেই থাকে।

–” এই কি করবি তুই? দেখ এমনিতেই কিন্তু তোর কারণে বেয়াদবি না করেও আমি অপরাধীর শাস্তি ভোগ করছি। হাত জোড় করে বলছি আর ঝামেলা বাড়াস না। ”

–” ভিতুর ডিম একটা। কি করে যে তোকে আমি বন্ধু বানালাম কে জানে?”

বলেই অভিকে মুখ ভেঙ্গালো মেহুল। অভি আবারো ফিশফিশিয়ে বলে উঠল,

–” শোন এইবার কোন গন্ডগোল বাঁধালে আমি সোজা গিয়ে কাকিমাকে বলে আসবো। তখন বুঝবি কত ধানে কত চাল।”

মেহুল অভির কথা শুনে একগাল হেসে বলল,

–” তোকে নিচ্ছে কে শুনি? যা করা এই মেহুল একাই করবে। আই ক্যান ডু সবকিছু।”

–” মেহুলের বাচ্চা।”

–” এই এত গুজুর গুজুর হচ্ছে কেন? আমার কি বেত নিয়ে আসতে হবে নাকি?”

স্যারের থমকের কারনে তখন ওদের দুজনের ঝগড়াটা অসমাপ্তই থেকে যায়। শাস্তির বাকি সময়টা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে ওরা। ক্লাস শেষে ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে আসে অবিনাশ বাবু। মেহুল আর অভি তখনো এক পায়ে দাঁড়িয়ে। অবিনাশ বাবু ওদের দুজনের সামনে এসে চোখের মোটা ফ্রেমের চশমাটা ঠিক করে বললেন,

–” আশা করি পরর্বতীতে তোমরা আর কোন বেয়াদবি করবে না কোন শিক্ষকের সঙ্গে। যদি এই শাস্তির পরেও তোমাদের কোন আক্কেল না হয়ে থাকে অথবা যদি শুনি তোমরা দুজনে আবারো কোন বেয়াদবি করেছো তবে আজকের থেকেও আরো ভয়ঙ্কর শাস্তি হবে তোমাদের। মনে থাকবে?”

মেহুল ও অভি সুবোধ বালক-বালিকাদের মতো সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। অবিনাশ বাবু আগের থেকেও গম্ভির গলায় বললেন,

–” ঠিক আছে এবার ক্লাসে যেতে পারো তোমরা, এখানে এভাবে সং এর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।”

কথাটা বলেই সামনের করিডরে গটগট করে হেঁটে গেলেন তিনি। মেহুল ঈষৎ রেগে বলল,

–” আমাদের এতক্ষন সং এরর মতো দাঁড়িয়ে রেখে এখন আদিক্ষেতা দেখাতে এসেছে। এর পরিশোধ আই উইল লিফট।”

অভি মেহুলের দিকে কটমট করে তাকিয়ে ক্লাসে চলে গেলো‌ । মেহুল অভির রাগের কোন কারণ খুঁজে পেল না। মেহুল ক্লাসে এসে দেখলো পিছনের সিট ছাড়া আর কোন সিট ফাঁকা নেই। অভি বসেছে তৃতীয় বেঞ্চে। অগত্যা মেহুল পিছনের সিটে বসে পরবর্তী ক্লাসে মন দিলো।

বিকেল চারটা । মেহুলদের স্কুল ছুটি হয়েছে কিন্তু মেহুলের কোন দেখা নেই। অভি একা একা গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে মেহুলের জন্য। আর এদিকে মেহুল চুপি চুপি এসেছে গ্যারেজের দিকে। অবিনাশ বাবুর প্রিয় মোটরসাইকেলটা এখানেই থাকে। মেহুল ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো লাল মোটরসাইকেলের দিকে। তারপর একটা সুইপিন বের করে পিছনের চাকায় এক সাথে দুই তিনটে ফুঁটো করে পিন নিয়ে এক ছুটে মাঠের দিকে দৌঁড় দিলে। কিন্তু দৌঁড়াতে গিয়ে মেহুল ধাক্কা খেলো একজনের সাথে। মেহুল পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে সামনে তাকালো। দেখল মেহুলের সামনে ঝাঁকড়া চুলের এক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটাকে চিনে মেহুল। ছেলেটা মেহুলদের সাথেই পড়ে। একটু মাস্তান টাইপের ছেলে সে। নাম রিয়াদ। মেহুল রেগে গিয়ে বলল,

–” আর ইউ অন্ধ? দেখে চলতে পারো না।”

ছেলে মেহুলের সামনে এগিয়ে এসে বলল,

–” ধাক্কাটা তুমি দিয়েছো আমি নই। তা এদিকে কোথায় গিয়েছিলে? তোমার সাথের জনকে তো গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম।”

–” আমি কোথায় গিয়েছিলাম তার কৈফিয়ত কি তোমাকে দিতে হবে নাকি?”

–” আমাকে হয়তো কোন কৈফিয়ত দিতে হবে না কিন্তু অবিনাশ স্যারকে তোমার হাতের এই পিনের কৈফিয়ত ঠিকই দিতে হবে।”

রিয়াদের কথায় ভয় পেলো মেহুল। হাতের পিন লুকিয়ে বলল,

–” কি বলতে চাচ্ছ?”

–” আমি তো তোমাকে কিছু বলছি না, আমি বলছি অবিনাশ স্যারের কথা।”

–” দেখো…….

–” এই খোলা মাঠে কি দেখাতে চাও মেহুল?”

মেহুলের দিকে ঝুঁকে জিঙ্গাসা করল রিয়াদ। রিয়াদের কথায় গা গুলিয়ে উঠলো মেহুলের। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–” ঠিক করে কথা বলো রিয়াদ।”

–” বাহ্ রে তুমিই তো দেখাতে চাইলে। এখন আমি দেখতে চেয়েছি বলে রাগ করছে যে?”

–” মাত্রা ছাড়িয়ো না রিয়াদ নাহলে…….

রিয়াদ আচমকা মেহুলের হাত চেপে ধরে বলে,

–” নাহলে তোমার ঐ হিরো বন্ধুকে দিয়ে মাইর খাওয়াবে নাকি?”

মেহুল প্রতিউত্তরে কিছু বলে না শুধু রিয়াদের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে। অন্যদিকে অভি স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষন ধরে অপেক্ষা করার পর এগিয়ে আসে খোলা মাঠের দিকে। কিন্তু দূর থেকে রিয়াদের সাথে মেহুলকে কথা বলতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। মেহুলের এত কাছে রিয়াদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাগ উঠে যায় অভির। ছোটবেলা থেকে মেহুলের পাশে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারে না অভি। অভির রগ চড়া হয় মেহুলের এমন নির্লিপ্ততা দেখে। রাগে ওদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে অভি।

অনেক কষ্টে রিয়াদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে আর দেরি করে নি মেহুল। স্কুলের বড়ো গেটের দিকে দৌঁড়াতে থাকে ও যেখানে অভি অপেক্ষা করছে ওর জন্য। কিন্তু গেটের সামনে এসে কাউকেই দেখতে পায় না মেহুল। পুরো স্কুল ফাঁকা। কোথাও একটা ছাত্র-ছাত্রী নেই। জনশূন্য হয়ে পড়ে আছে মাঠ প্রাঙ্গন। মেহুল ভাবে অভি হয়তো ওর জন্য মনা কাকার দোকানে অপেক্ষা করছে। মেহুল ব্যাগ কাঁধে ফেলে ছুট লাগায় মনা কাকার দোকানের দিকে।

চলবে

( আসসালামু আলাইকুম। আজকের পর্বটা কতটা সাজিয়ে লিখতে পেরেছি জানি না। যদি আপনাদের গল্পটা ভালো লাগে তবে অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন এবং বেশি বেশি শেয়ার করবেন ,যেন সবার কাছে গল্পটা পৌঁছে যায়। ভালো থাকবেন সবাই।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here