বসন্ত বিলাস পর্ব -১০ ও শেষ

#বসন্ত_বিলাস
#আমিনা_আফরোজ
#অন্তিম_পর্ব

পড়ন্ত বিকেল। নীল আকাশ রাঙিয়ে আছে গাঢ় কমলা রঙের আভায়। সূর্যের কমলা আভা ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। আর কিছুকাল পর অস্ত যাবে সে। ফুরফুরে হাওয়া খেলে যাচ্ছে প্রকৃতিতে। মাথার উপর কমলাটে রক্তিম আকাশটা তখন বড্ড ব্যস্ত। একদল শালিক পাখির দল কিচিরমিচির শব্দ করে উড়ে চলেছে রক্তিম আকাশের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত বরাবর। পাখিগুলো তাদের নীড়ে ফেরবার তাল করছে। বেলা শেষ হয়ে এলো যে! সূর্য্যি মামা অস্ত যাবার সাথে সাথেই পুরো ধরনীর রাজত্ব চলে যাবে অন্ধকারের দখলে। এখন অমাবস্যা তিথি। তাই সন্ধ্যার পর চারিদিক ঢেকে যাবে মিশমিশে কালো অন্ধকারে। বড্ড নিশ্ছিদ্র সে অন্ধকার।

ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে মেহুল। ঝিরিঝিরি হাওয়ার তালে উড়ছে মেহুলের কালো অবাধ্য চুলগুলো। পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে অভি। দুজনের মধ্যে হাত ঘানেকের দুরুত্ব কেবল। দুজন দুজনের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে বেশ স্পষ্টভাবে। হঠাৎ করে একদল অবাধ্য হাওয়া এসে আরো খানিকটা এগিয়ে আনলো ওদের দুজনকে। দুজনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে নিরবতা পালনে ব্যস্ত, যেন আজ তাদের নিরবতা পালনের দিন। কেউ কোন কথা বলছে না। অবশেষে এই নিরবতার প্রহর শেষ করে কথা বলে উঠল অভি নিজেই। বলল,

–” এতদিন সবটাই তবে নাটক ছিলো তোর মেহুল?”

মেহুল সহসাই পিছন ঘুরে ওর ডাগর ডাগর চোখ দুখানা তুলে তাকালো অভির দিকে। তারপর মৃদুস্বরে বলল,

–” সবটা নাটক ছিলো ,এ কথা কখন বললাম তোকে আমি?”

–” দেখ মেহুল কথা প্যাচাবি না। যা বলবি সরাসরি বলে। নীচে যে বললি বড়ো……

একটু রাগেই কথাগুলো বলে উঠেছিল অভি কিন্তু পুরো কথা শেষ করতে পারে নি ও। তার আগেই মেহুল বলে উঠল,

–” কি বলেছি? কিছু বলেছিলাম বুঝি?”

মেহুলের কথায় তব্দা খেয়ে গেলো অভি। একবার ভাবলো এখনো বোধহয় মেহুল নাটকই করছে ওর সাথে আবার পরক্ষনেই মেমোরি লস নামের শব্দটা এসে আচমকা আক্রমন করে বসলো ওর মাথায়। অভি অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইল মেহুলের। মেহুলের তখন হাসির দমকে পেট ফেটে যাবার দরুন।

ঘন্টা দুয়েক আগের ঘটনা,

মেহুলের ঘরে অভি ও মেহুলের ঝগড়ার সূত্রপাত ঘটলে সেখানে উপস্থিত হন মেহুলের বাবা অতিশ বাবু নিজে। একে তো বন্ধুর এখনো দেখা পান নি তিনি তার ওপর ওদের দুজনের ঝগড়া দেখে রেগে গিয়েছিলো অতিশ বাবু। রগচটা স্বভাবটা আবারো দেখা দিয়েছে ওনার মধ্যে। অতিশ বাবু রেগে বললেন,

–” বলি তোমাদের কি হয়েছে টা কি ? বাড়িটাকে কি মাছের বাজার পেয়েছো নাকি দুজনে যে এতো চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছো?”

বাবার রাগী কন্ঠে ভয় পায় না মেহুল। কাঠ কাঠ গলায় বলে,

–” এই ছেলেটা কে বাবা?”

অতিশ বাবু এবার নাক ছিটকালেন। মুখ বেঁকিয়ে বলল,

–” দেখ, মেহুল অনেক নাটক হয়েছে। এবার অন্তত নাটকের শেষ ঘটাও। দুটো বছর বেচারাকে কষ্টে রেখেছো। এবার অন্তত রক্ষা করো।”

অতিশ বাবুর কথায় মেহুল মিটিমিটি হাসলেও অভি পড়ে যায় বিপাকে। কাকুর কথার কোন অর্থই বুঝতে পারছে না সে। তাই একরকম বোকার মত অতিশ বাবুকেই প্রশ্ন করে বসে ও। বলে,

–” কিসের নাটক কাকু? কি সব বলছো,কিছুই তো বুঝতে পারছি না আমি?”

–” এই এলেন আরেক হাঁদারাম। এক হাঁদরামের এখনো আসার সময় হয় নি তাই সে তার গুনধর হাঁদারামকে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই যে হাঁদারাম শোনো, তোমার মেহুল বছর খানেক আগেই সুস্থ হয়ে গেছে। আগের সব কথায় তার মনে আছে এখন। বুঝেছো? সেজন্যই তো আজ তোমরা সপরিবারে এখানে আসছো। এর পেছনে অবশ্য আরো একটা কারন আছে যা পরে তোমাদের জানানো হবে।”

কথাগুলো বলেই গটগট করে তিনি বেরিয়ে যান মেহুলের ঘর থেকে। তারপরের ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত। এতো উত্তেজনা নিতে পারে নি অভির শরীরখানা। তাই মিনিট খানেকের মাঝেই শরীরের ভার হারিয়ে মেঝেতে চৈতন্য হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে সে। এরপর অভির যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন তপ্ত দুপুরের অবসান ঘটিয়ে প্রকৃতিতে উপস্থিত হয়েছে পড়ন্ত বিকেলের। অভি আর ঘরে বসে থাকে নি। মেহুলকে নিয়ে দ্রুত চলে এসেছে ছাদে।

বর্তমান ঘটনা,

ড্রয়িং রুমের নরম গদির সোফায় বসে আছে মেহুল ও অভির দুই পরিবার। ওনাদের সাথে যোগ দিয়েছেন অভিদের পারিবারিক পুরুত মশায়। কষ্ঠি মিলানো আগেই হয়ে গেছে। এখন শুধু শুভ লগ্ন দেখা বাকি। তাই আজ পুরুত মলাইকে সাথে নিয়ে বিয়ের লগ্ন দেখে বিয়ের কথাবার্তা পাকা করতে এসেছেন মৃন্ময় বাবু।বিয়ের কথা মেহুল বা অভি কাউকেই জানানো হয় নি আগে। ওনারা চেয়েছিলেন ওদের দুজনকে এক গাদছোড়ায় বেঁধে চমকে দিবেন ওদের। হয়েছেও তাই। বিয়ের কথা শুনে দুজনেই বেশ চমকে গেছে। অভি প্রথমে আপত্তি জানিয়েছিল মেহুলের কথা ভেবে পরে অবশ্য মেহুলের সম্মতি পেয়ে আর বাগড়া বাঁধায়নি । পুরুত মশায় পাঁজি দেখে দুটো শুভ লগ্ন পেলেন। একটা হলো দিন পনেরো পর গোধুলী লগ্ন আর একটা অবশ্য মাস দুয়েক পরের লগ্ন। অভি দুই পরিবারের সবাইকে মানিয়ে দিন পনেরোর পরের লগ্ন ঠিক করলো বিয়ের জন্য। মেহুলকে আপন করে নেওয়ার জন্য আর যে তর সইছে না ওর। তাই আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে চাই নি অভি। শুভ কাজ যত দ্রুত করা যায় ততই ভালো। বিয়ের আনন্দে দুই পরিবারের লোক বেজায় খুশি। বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি করে মৃন্ময় বাবু ও ওনার স্ত্রী সেদিনই সিলেট ছাড়লেন ঢাকার উদ্দেশ্যে। ওনাদের চলে যাবার দিন তিনেক পর মেহুলরাও চলে এলো ঢাকায়। বিয়েটা মেহুল ওদের ঢাকার সেই পুরোনো বাড়িটাতেই করতে চায়।

দেখতে দেখতে চোখের পলকে কেটে গেল পনেরোটা দিন। আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আজ অভি ওর মেহুলকে অগ্নিকুন্ডকে সাক্ষী রেখে সাত জনমের অর্ধাঙ্গিনী করে পাবে। যথা সময়ে বর কনেকে নিয়ে পুরুত মশায় বিয়ের কাজ সম্পন্ন করলেন। প্রথমে শুভদৃষ্টি তারপর সাতপাক ঘোরা অতঃপর সিঁদুর দান। অভিদের বিয়ের রীতি অনুসারে বিয়ের প্রথম রাত বাসর জাগতে হয় সবার সঙ্গে। অভিদের বাসরের আয়োজন করা হলো মেহুলদের বাড়িতে। মেহুলদের আত্মীয় স্বজন কেউ ছিলো না,অভিদের পক্ষ থেকে যারা ছিলো তারা সবাই প্রবীনের খাতায় নাম লিখিয়েছে। জ্যোতি অবশ্য এসেছিল বিয়েতে কিন্তু ও বেচারি একা একাই বা কি করবে! তবুও সকলে মিলে রাতের প্রথম প্রহরটা রইলো অভিদের বাসরে। তারপর সবাই ঢলে পড়লো ঘুমে। অভি তখন মেহুলকে কোলে করে চুপিচুপি নিয়ে এলো ছাদে।

বছর দুই আগের সেই পুরোনো ছাদ। মেহুলদের ছাদের পাশেই লাগোয়াভাবে অভিদের ছাদটা। অভি মেহুলকে কোলে নিয়ে ওদের ছাদে চলে এলো। ছাদের পুরোনো ভাঙ্গা কার্ণিশটা এখনো সেভাবেই পড়ে আছে। গত দুবছরে অভি সেইটা ঠিক করাতে দেই নি ওর বাবাকে। কারন হিসেবে দেখিয়েছিলো মেহুলের সাথে কাটানো শেষ স্মৃতির চিহ্ন। তবে পুরো দোলনাটা আজ বেলিফুলে সাজিয়েছে অভি। শুভ্র চাদরে ঢেকে আছে পুরো দোলনা। বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে বেলিফুলের কড়া সুমিষ্ট গন্ধটা। আকাশে আজ গোল চাঁদ উঠেছে। চাঁদের ভরা জোছনা এসে পড়েছে ছাদের মেঝে, দোলনা এমনি দূরের নারিকেল গাছের মাথাতেও। অভি মেহুলকে কোল থেকে নিচে নামালো। ছাদে পা রেখে চারিদিকটা ভালো করে দেখে নিলো মেহুল। কতো পুরানো স্মৃতি জুড়ে আছে এ ছাদকে ঘিরে। কথাগুলো ভাবতেই মেহুলের চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনা জলের ধারা । চোখ মুছল না মেহুল। আজ নাহয় আনন্দের স্মৃতিগুলো রোমন্থন হোক। পিছন থেকে বলিষ্ঠ হাতে অভি আঁকড়ে ধরলো মেহুলকে। তারপর পিঠের চুলগুলো একপাশে রেখে কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

–” এই জায়গাটার কথা মনে আছে তোর? সেই পূর্ণিমার দিনের কথা। সেদিনের সেই প্রথম চুম্বনের কথা মনে পড়ে? সেদিন প্রথমবার আমি আমার অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। সেদিনের তোর সেই তপ্ত নিঃশ্বাস এখনো আমি আমার মাঝে জমিয়ে রেখেছি। আমার ঠোঁটে, নাকে ,বুকে এখনো তোর সেই ঘ্রাণ জমিয়ে রেখেছি আমি। কিন্তু বছর দুইয়ের দুরত্বে ঘ্রাণটা বড্ড ফিকে হয়ে এসেছে জানিস। এখন আর আমার শরীর থেকে তুই নামক ঘ্রাণটা পাই না। আজ আবারো তোর ঘ্রাণটা আমি আমার শরীরে মেখে নিতে চাই। সেই সাথে তোকেও নিজের বাহু বন্ধনে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধতে চাই। তোর হাতে হাত রেখে কাটাতে চাই হাজরো বসন্ত। দিবি আমাকে সেই সুযোগ? ”

অভির তপ্ত নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে মেহুলের গলা জুড়ে। মেহুল নিজেকে ধীরে ধীরে সমার্পন করে দিলো অভির হাতে। তারপর পূর্ণিমার ঝকঝকে সাদা আলোয় এক জোড়া কপোত কপোতি ভেসে গেলো তাদের ভালোবাসার অতল গহ্বরে।

সমাপ্ত

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here