বসন্ত বিলাস পর্ব -১০

#বসন্ত_বিলাস
#আমিনা_আফরোজ
#পর্ব:-১০

কাঠের ভারি দরজা খুলতেই অতিশ বাবুর চোখে পরল কালো শার্ট পরিহিত ছেলের উপর যার ঠোঁটের আগায় সেই পরিচিত হাসির সাথে তিনি অনেককাল আগে থেকেই পরিচিত। অতিশ বাবু চমকালেন। এতদিনপর এভাবে ছেলেটিকে দেখতে পাবেন এইটা তিনি কখনোই কল্পনাও করেন নি। মানুষ যখন অবাকের শীর্ষে পৌঁছায় তখন বোধহয় তারা তাদের স্বাভাবিক বোধ বুদ্ধির খেই হারিয়ে ফেলে। অতিশ বাবু নিজেও আজ অনেক দিন পর খেই হারিয়ে ফেলেছেন। তাই দরজায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি।

এদিকে অপূর্ণা দেবী অভিকে বাড়ির দরজায় এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত এগিয়ে এসে বলল,

–” আরে অভি তুই? কখন এসেছিস? আর ভেতরে না এসে এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো শুনি?”

অভি মুচকি হেসে বলে উঠলো,

–” কি করে আসবো কাকিমা? কাকু তো দরজা ছেড়ে ভেতরে আসতেই দিচ্ছে না।”

অভির কথা শুনে অপূর্ণতা দেবী অতিশ বাবুর দিকে তাকিয়ে বিরক্তিস্বরে বলে উঠলেন,

–” বলি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কি মাথার বুদ্ধিও শেষ হয়ে গেছে তোমার? কোথায় ছেলেটাকে ঘরে আনবে,তা না করে ওনি দরজায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছেন। বুড়ো বয়সে বাপ মেয়ের ভিমরতি দেখতে দেখতে আমার জীবনটাই কয়লা হয়ে গেলো। যতসব।”

কথাগুলো বলেই অপূর্ণ দেবী অভিকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। অতিশ বাবু ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন দরজার পাশে। অভিকে ড্রয়িং রুমে বসতে দিয়েই অপূর্ণ দেবী ছুটলেন খাবার পরিবেশন করতে। সময় গড়িয়ে দুপুর পেরোবার যোগাড় হয়েছে। মিনিট পাঁচেক পর অতিশ বাবুও অভির সামনের সোফায় এসে বসল। অভি অতিশ বাবুকে দেখে হাসল। প্রতিউত্তরে অতিশ বাবুও হাসলেন। তারপর এদিক সেদিক পানে তাকিয়ে উশখুশ করতে লাগলেন তিনি। অভি অতিশ বাবুর এমন অবস্থা দেখে হেসে বলল,

–” আমাকে কিছু বলতে চাও কাকু?”

–” হ্যাঁ মানে না না। তোকে আবার কি বলবো আমি। কিছুই বলার নেই আমার।”

একটু ততলিয়েই কথাগুলো বললেন অতিশ সাতরা। অভি আবারো হেসে বলল,

–” চোখের আড়াল হলে মনেরও আড়াল হয়ে যায় , তাই না কাকু?”

অতিশ বাবু চমকে বলে উঠলেন,

–” কি বললি?”

–” তেমন কিছু নয় কাকু। ভেবেছিলাম এতদিন পর আমাকে দেখে তুমি খুশি হবে। জড়িয়ে ধরবে আমায় কিন্তু এসে দেখছি তুমি আমাকে দেখে মোটেও খুশি হও
নি বরং আমাকে দেখে তুমি ভয় পাচ্ছ। এত কেনো ভয় পাচ্ছ কাকু?”

অতিশ বাবু মিথ্যে হাসি দিয়ে বললেন,

–” শোন ছেলের কথা , তোকে দেখে ভয় পাবো কেনো রে ? তুই কি বাঘ না ভাল্লুক, যে তোকে দেখে ভয় পাবো। আসলে অনেক দিন পর তোকে দেখে খেই হারিয়ে ফেলেছি এই যা। তা তোর বাবা কত দূর বলতো? সেই কখন আসার কথা, এখনো এলো না।”

অতিশ বাবুর কথা শেষ না হতেই বাসার কলিংবেলটা তাড়স্বরে বেজে উঠলো আবার। অতিশ বাবুর হেসে বললেন,

–” এইবার বোধহয় তোর বাবা এলেন। যাই দরজাটা খুলি গিয়ে। ”

কথাগুলো বলেই অতিশ বাবু ছুটলেন দরজার পানে। অভি সোফায় বসেই অবাক চোখে দেখছিলো অতিশ বাবুর ছেলেমানুষী রূপ।

–” এই অভি ওখানেই বসে থাকবি? যা ফ্রেশ হয়ে আয় । আমি টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিচ্ছি, ফ্রেশ হয়েই খেতে বসবি কেমন।”

অভি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। তারপর কাঁধের ব্যাগটা সোফায় রেখেই সোজা চলে গেলো মাঝের একটি ঘরের দিকে। এদিকে অভি চলে যেতেই ড্রয়িং রুমে আগমন ঘটল অতিশ বাবু ও মেহুলের। অতিশ বাবুর মুখটা তখনো ভার হয়ে রয়েছে। মেহুল ঘরে এসে সোফা লক্ষ্য করে কাঁধের ব্যাগটা ছুড়ে মারতেই ধমকে উঠলেন অপূর্ণ দেবী। বললেন,

–” এই ব্যাগ সোফায় ছুড়ছিস কেনো? যা ঘরে গিয়ে রাখ। শোন মেহুল বড়ো হচ্ছিস এখন তুই, তাই নিজেকে বাচ্চামো স্বভাবগুলো বদলা এবার। যা ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়।”

মেহুল অপূর্ণা দেবীর কথার পৃষ্ঠে কথা বাড়ায় নি তবে ওর চোখে মুখে তখন রাজ্যের বিরক্তি। অকারনেই আজ মেহুলের মন তিক্ত হয়ে আছে। এর আগেও বেশ কয়েকবার হুটহাট করেই মেহুলের মন এমন হয়েছে। সেদিনগুলো বেশ খারাপ কেটেছিল মেহুলের। হুটহাট মাথা গরম হতো, সবাই সাথেই রাগারাগি হতো এমনকি মাঝেমধ্যে ভাংচুরও করে ফেলতো মেহুল। তবে আজ মন খারাপের দিক ভিন্ন। তাই তো মনে ,মাথায় রাগের ছাপ স্পষ্ট না হয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কান্নার দল। আঁখি পল্লব ঠেলে চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়তে চাইছে তারা। কিন্তু মেহুল তাদের সে ইচ্ছা পূর্ণ করছে না। জোর করে আটকে রেখেছে চোখের ভেতরেই। চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়লেই যে বিপদ! নিজের ঘরে এসে ব্যাগটা বিছানার একপাশে ছুঁড়ে ফেলে লম্বালম্বিভাবে শুয়ে পড়লো বিছানায়। মেহুলের মাথার উপরে ঘুরতে লাগলো সবুজ রঙের সেলিং ফ্যানটা। মেহুলের দৃষ্টি সেদিকেই স্থির হলো। এভাবেই কেটে গেল প্রায় বেশ খানিকক্ষন। এর মধ্যে পরিবর্তন হয়েছে মেহুলের দৃষ্টি। সেলিং ফ্যানের দিক থেকে দৃষ্টি সরে গিয়ে এইবার তা নিবদ্ধ হয়েছে জানালার ওপারের আকাশের সীমানায়।

এমন সময় খুট শব্দ করে খুলে গেলো মেহুলের ঘরের ওয়াশরুমের দরজাটা। মেহুলের ভাবনায় ভাটা পড়লো। চমকে উঠে বসলো বিছানায়। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন পানে তাকালো। দেখল ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসছে শ্যাম বর্ণের একটা পরিচিত মুখ। মেহুল অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। ততক্ষণে রুমের ভেতরে এসে পড়েছে অভি। অভি নিজেও মেহুলকে এসময় ঘরে দেখে একটু ঘাবড়ে গেলো। বলা তো যায় ওকে দেখে আবার কি করে বসে মেহুল! যদি আবারো আগের মতো পাগলামি জুড়ে দেয় তবে খুব কেলেংকারী কান্ড হবে আজ। এসব ভেবে অভি ঘর থেকে বেরিয়েই যাচ্ছিলো ঠিক তখনি অভি পিছন থেকে শুনতে পেলো মেহুলের রিনরিনে কন্ঠস্বর,

–” এই ছেলে এই, তুমি তো দেখছি সাংঘাতিক ছেলে হুম। কলেজে ঝগড়া করে মনে হয় আশ মিটে নি তোমার তাই না? সেই জন্যই আমার বাড়ি অব্দি চলে এসেছো তুমি। শুধু কি আমার বাড়িতে এসেই ক্ষান্ত হয়েছ আমার ঘর অব্দি চলে এসেছো তুমি। আমি তো তোমার সাহস দেখে অবাক হয়ে গেছি। এই ছেলে সত্যি করে বলো তোমার আসল উদ্দেশ্য কি? কি উদ্দেশ্যে তুমি আমাদের বাড়িতে এসেছো?”

অভি ভেবেছিল মেহুলের সাথে কোন বাক-বিতন্ডতায় না জড়িয়ে সোজা চলে যাবে ড্রয়িং রুমের দিকে কিন্তু অভি ভুলেই গিয়েছিল মেহুল কি ধরনের মেয়ে। এই মেয়ে যে এখন ওকে হাজারটা প্রশ্ন করে ওর মাথা চিবিয়ে খাবে এইটা আগে থেকেই আন্দাজ করতে পেরেছিল অভি। হলোও তাই। সময়ের কাঁটা মিনিটের ঘর না গড়াতেই মেহুলের একের পর এক প্রশ্ন ধেয়ে এলো অভির দিকে। অভি দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিছন ফিরে তাকালো। মেহুল অভির থেকে মাত্র তিন কদম সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অভি আরো এক পা সামনে এগিয়ে এসে ধীর গলায় বলল,

–” আমার মনে হয় তুমি ভুল বুঝছো। আমি সে নই যাকে তুমি খুঁজছো। আমি তোমার বাবার বন্ধুর ছেলে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুমি তোমার বাবাকে বলে দেখতে পারো। আশা করি তিনি অন্তত তোমাকে মিথ্যে বলবেন না। আর হ্যাঁ , তোমাকে তুমি করে বলছি দেখে আবার কিছু মনে করো না। তোমাকে দেখে আমার জুনিয়র বলেই মনে হয়েছে তাই তুমি করেই বললাম তোমাকে। আমার মনে হয় তুমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছো এবার আসি তাহলে ।”

মেহুল অভির কথা শুনে কিছুক্ষণ তব্দা খেয়ে তাকিয়ে রইল অভির মুখ পানে। তারপর ঘোর কাটিয়ে একটু রাগত স্বরেই বলে উঠল,

–” এই ছেলে, তোমার কি আমাকে গাধী বলে মনে হয়? যে তুমি আমাকে যা বুঝাবে আমি তাই বুঝবো। শোন, এই মেহুলকে বোকা বানানো এত সোজা নয় বুঝেছো। এখন ভালোই ভালোই বলো আমাদের বাড়িতে কেনো এসেছো? যদি প্রশ্নের উত্তর না পাই তবে আজ আমি তোমাকে উত্তম মাধ্যম খাইয়েই ছাড়বো এই বলে দিলাম আমি। মেহুলকে বোকা বানানো তাই না……..

–” তুমি দেখছি আমার কথা বিশ্বাসই করছো না? পৃথিবীতে সাতজন মানুষ হুবহু একই রকম দেখতে হয় জানো তো? আমার তো মনে হয় জানো না। তাই এমন করছো। এক কাজ করি আমি তোমার বাবাকেই বরং ডাক দেই কেমন। ”

মেহুলের কথা থামিয়ে অভি কথাগুলো বলল মেহুলকে। তারপর তাড়স্বরে ডাক ছাড়লো অতিশ বাবুর উদ্দেশ্যে। মেহুল চুপচাপ দাঁড়িয়ে অভির কান্ডগুলো দেখতে লাগলো। আজ এই ছেলের শেষ কান্ডকারখানা ওর দেখেই ছাড়বে।

চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here