বাইজি কন্যা পর্ব ২৩+২৪

#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_২৩
শারমিনের বলা কঠিন কঠিন উপদেশগুলো একদম মস্তিষ্কে গেঁথে ফেললো শাহিনুর। শারমিন কয়েক পল নিরবতা পালন করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সন্তর্পণে শাহিনুরের মাথাটা নিজ বক্ষঃ থেকে সরিয়ে নিজ মাথা উঁচু করে,সিনা টানটান হয়ে ওঠে দাঁড়ালো। শাহিনুর তার কৃষ্ণবর্ণীয় ভাসা ভাসা চক্ষুদ্বয়গুলো নিষ্পলকভাবে মেলে ধরলো তার মা’য়ের অভিমুখে। মা’য়ের পানে তাকিয়ে থাকতে ভীষণ ভালো লাগে তার। কারণ তার মা’য়ের মাঝে শুধু মা’কে দেখতে পায় না। দেখতে পায় নিজের আদর্শ’কে। দেখতে পায় মহীয়সী এক নারী’কে। যার দৃষ্টিতে নিজের জন্য আজ অবদি কোন ভয় দেখতে পায়নি। কিন্তু তার জন্য ভালোবাসা, স্নেহ,মায়া,ভয় সবটাই সুস্পষ্ট ভাবে দেখেছে। খুব বেশী মানুষ সম্পর্কে জানেনা সে। কিন্তু নিজের মা’কে যতোটুকু জেনেছে এতেই সে প্রশান্তি পেয়েছে। সাধারণত মেয়েরা মা’য়ের দুঃখ কষ্টগুলো একদম অন্তর থেকে অনুভব করে৷ শারমিনের জীবনের কঠিন সত্যিটা জানার পর শাহিনুরও অনুভব করেছে তার মায়ের যন্ত্রণাগুলোকে। মূলত সেদিন থেকেই মা’য়ের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস দ্বিগুণ বেড়ে গেছে৷ ইদানীংকালে নিজের মন’কে নিজেই খুব বোঝ দেয়, ‘একদিন অনেক বড়ো হবি নুর অনেক অনেক বড়ো। আর সেদিন মা’য়ের মতো সাহসী হয়ে সকল ভয়’কে জয় করে নিবি। সকল দুঃখ,কষ্ট’কে দূর করে মা’য়ের মুখে হাসি ফুটাবি। আর এই যে বদ্ধ কারাগারের মতো জীবন এটা থেকেও নিজে মুক্ত হবি এবং সকল’কে মুক্ত করবি। ‘
শাহিনুর সুদূরপ্রসারী এক ভাবনার অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে। আর শারমিন তার সর্বাঙ্গে দৃঢ়তা বজায় রেখে এক পা দু’পা করে এগিয়ে গেলো কক্ষের ভিতরে থাকা একটি কাঠের আলমারির সামনে। অত্যন্ত ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে আলমারি খুলে এক কোণা থেকে লাল কাপড়ে প্যাঁচানো একটি তলোয়ার বের করলো। কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে গেলো শাহিনুরের। বুকের ভিতর কেমন ধকধকানি শুরু হলো তার। এক ঢোক গিলে ভয়কাতুরে দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলো সে। শারমিন ধীরে ধীরে প্যাঁচানো লাল কাপড় খুলে তা মেঝেতে ফেলে দিলো। মা’য়ের হাতে অমন ধারালো তলোয়ার দেখে আরেক দফা ঢোক গিললো শাহিনুর। কিন্তু শারমিনের মুখোভঙ্গির কোন পরিবর্তন ঘটলো না। সে একই ভণিতায় পুরো কক্ষে পায়চারি করতে শুরু করলো৷ শাহিনুর লক্ষ করলো তার মা’য়ের মুখের পরিবর্তন ঘটছে। পুরো পৃথিবীসম ক্রোধে যেনো নিমজ্জিত হয়ে গেলো তার মা। চারদিক থেকে কেমন হিমশীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে দিতে থাকলো শারমিন, শাহিনুর দু’জন’কেই। লোমহর্ষক অনুভূতিতে সিক্ত হয়ে গেলো শাহিনুর৷ এমন পরিস্থিতি’তে সহসা শারমিন শাহিনুরের দিকে তাকালো। মধ্যবয়স্কা,মাঝারি গড়নের নারী’টির রূপে উত্তাপের কোন কমতি নেই৷ কমতি নেই সুদীর্ঘ দৃষ্টির প্রখরতারও। এক হাতে তলোয়ার উঁচিয়ে নিজ কন্যার দিকে প্রখর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো শারমিন। শাহিনুর ভয়ে সিঁটিয়ে গেলো। তবুও শারমিন একই মূর্তি’তে ঠাঁই হয়ে দাঁড়িয়ে তেজীয়ান ধ্বনি’তে বললো,
-‘ বহু বছর ধরে এই তলোয়ার’টি নিজের কাছে সযত্নে রেখে দিয়েছি নুর। এটা কিন্তু শুধু তলোয়ার নয়। এটা হচ্ছে সেই অস্ত্র যে অস্ত্র কোন মানুষ’কে হত্যা করবে না। এই অস্ত্র হত্যা করবে শুধু নরপশুদের! ‘
কথাগুলো বলতে বলতে শাহিনুরের দিকে এগিয়ে গেলো শারমিন। ধীরে ধীরে শাহিনুরের মুখোমুখি হয়ে রক্তিম চোখে তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বললো,
-‘ তুমি কি বুঝতে পেরেছো নুর? এই অস্ত্র দিয়ে কোন মানুষ হত্যা হবে না। যদি কখনো আমার অবর্তমানে মুখোশ পরিহিত মানুষ তোমার আশপাশে বিচরণ করে সেদিনই বুঝবে এই অস্ত্র ঠিক তার জন্যই তৈরি।’
শাহিনুর কেঁদে ফেললো। তবুও নম্র হলোনা শারমিন৷ কর্কশ গলায় একটি ধমক দিলো মেয়ে’কে। ধমক খেয়ে ডুঁকরে ওঠলো শাহিনুর। কিঞ্চিৎ দমে গেলো শারমিন। ক’দিন পর শাহিনুর’কে দূরে পাঠিয়ে দেবে। এখন থেকেই যদি মেয়েটা’কে গড়তে না পারে, তৈরি করতে না পারে তাহলে তো ভারী মুশকিল। আর মাত্র চার’টা মাস রয়েছে। এরপরই পনেরো পেরিয়ে ষোল’তে পদার্পণ করবে শাহিনুর৷ যতো দিন এগোচ্ছে ততো হায়েনার দলেরা আনন্দানুভূতি পাচ্ছে। দুঃস্বপ্নটা দেখে শারমিনের মনে সংশয়ও জেগেছে। কেন জানি মন বলছে অলিওর তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও করতে পারে। শাহিনুরের প্রতি অলিওরের কোন মায়া নেই, নেই কোন ভালোবাসা। সে যেটুকু করছে শুধুমাত্র তার জন্যই করছে দেখানো মাত্র। ভিতরে ভিতরে যে কোনো ছক কষে রাখছে না তারই বা নিশ্চয়তা কী? যতোই হোক পলাশ চৌধুরী তার ছেলে আর নুর? নুর তার পরম শত্রুরই অংশ। সবটা ভেবে আবারো কঠিন্যতা ভর করলো শারমিনের মাঝে। নুর’কে শক্ত করার জন্য জোরপূর্বক নুরের হাতে তলোয়ার তুলে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে হাঁপিয়ে ওঠলো শাহিনুর। ভয়ে জর্জরিত হয়ে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। শারমিন উচ্চ কন্ঠে ক্রমাগত বলতে লাগলো,
-‘ আমাকে কথা দে নুর প্রয়োজনের তাগিদে, নিজের সম্মান বাঁচাতে, এই তলোয়ার দিয়ে মানুষ নয় অমানুষদের হত্যা করতে কোন দ্বিধা করবি না। দুনিয়াটা বড়ো কঠিন, এ দুনিয়া’তে বেঁচে থাকাটা আহামরি কঠিন নয় কিন্তু বাঁচার মতো বাঁচা খুব কঠিন। কথা দে নুর, জীবনে চলার পথে কখনো অন্যায়ের সাথে আপোস করবি না। কথা দে মা, জান নিবি তবুও ইজ্জত নিতে দিবি না। ‘
শারমিনের তীব্র কন্ঠস্বরে শেষ বাক্যটি শুনতেই হৃদপিণ্ড কেঁপে ওঠলো শাহিনুরের। আকস্মাৎ কান্না থেমে গেলো তার। অদৃশ্য কোন এক শক্তি এসে ভর করলো তার সর্বাঙ্গে। মা’য়ের তীব্র চাহনিতে চেয়ে দৃঢ় হয়ে ওঠলো নিজের নম্র দৃষ্টিজোড়াও, কন্ঠে পেলো সীমাহীন তেজ। অজান্তেই বলে ওঠলো,
-‘ কথা দিলাম আম্মা জান নিবো তবুও ইজ্জত নিতে দিব না। ‘
[ ৩১ ]
মাঝরাত। মন’টা প্রচণ্ড বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে রঙ্গনের। জঙ্গলের ভিতর নিজের ছোট্ট কুটিরে বসে মদ্যপান করছে সে। একের পর এক বোতল শেষ করছে নিমিষেই। সর্বশেষ বোতলটি শেষ করে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে বলতে ডিভানে ধপাশ করে শুয়ে পড়লো সে। বেশ কিছু অসংলগ্ন বাক্যে একটি বাক্য স্পষ্ট বোঝা গেলো। ওষ্ঠকোণে তাচ্ছিল্য হাসি ফুটিয়ে তুলে তর্জনী আঙুল দ্বারা গাল চুলকাতে চুলকাতে বললো,
-‘ যারে মন, প্রাণ দিয়ে ভালোবাসলাম সে বড়ো ভাই’য়ের বউ হয়ে গেলো। যারে প্রেমিকা বানাইলাম সেও বড়ো ভাই’য়ের বউ হবো। শালার আমার জন্মই হইছে ভালোবাসার মানুষ আর প্রেমিকাদের ভাবি ডাকার জন্য! ‘
কথাগুলো বলেই চট করে ওঠে বসলো রঙ্গন। পাশে থাকা বোতলগুলোতে এক লাথি মেরে মাথা ঝাঁকিয়ে ওঠে দাঁড়ালো। কিছু অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে কুটির থেকে বেরিয়ে পা বাড়ালো বাইজি গৃহের উদ্দেশ্যে। মাতাল হয়ে রঙ্গন বাইজি গৃহে প্রবেশ করলেও সকল বাইজিরা তাকে স্বাগতম জানালো। দেখা হয়ে গেলো বড়ো ভাই পলাশের সঙ্গেও। পলাশ প্রথমে অবাক হলেও পরোক্ষণে বিকৃত ভঙ্গিতে হাসলো। রঙ্গনের গা ঘেষে ফিসফিস করে বললো,
-‘ এর আগে তো লুকিয়ে লুকিয়ে হাউস মিটাতি আজকে প্রকাশ্যে যে? বুকের পাটা কি শক্ত হয়ে গেলো নাকী! ‘
ভয়ংকর রেগে গেলো রঙ্গন। সকল বাইজিদের সামনেই পলাশের কলার চেপে ধরলো। রগচটা গলায় বললো,
-‘ এই বাল তুই আমার কোন বাল? শোন বাল আমার যা ইচ্ছা আমি তাই করবো তোর বাপের কী?’
প্রথমে রেগে গেলেও পরোক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো পলাশ। রঙ্গনের হাত ছাড়িয়ে কলার ঠিক করতে করতে বললো,
-‘ শালা আমার বাপের যা তোর বাপেরও তাই। ভেজা বেড়ালের জবান দেখে আমি শিহরিত। ‘
এটুকু বলেই বাইজি শিল্পা’কে ইশারায় ডাক দিলো পলাশ। অর্ধনগ্ন শরীরে কোমড় হেলিয়ে,দুলিয়ে শিল্পা সামনে আসতেই পলাশ বললো,
-‘ বেশ চটে আছে সব ঠাণ্ডা করে দিবি একদম। মনে রাখিস জমিদারের ছোট পুত্র সে। ‘
শিল্পা ঠোঁট কামড়ে হাসলো গদগদ হয়ে রঙ্গনের কাঁধ স্পর্শ করলো। সঙ্গে সঙ্গে রঙ্গন শিল্পার বক্ষে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো,
-‘ এই এই কাপড় খোল, খোল কাপড়। ‘
বলেই পলাশের দিকে তাকালো রাগান্বিত হয়ে বললো,
-‘ এই জমিদারের বাচ্চা এই বেশ্যার বাচ্চা’রে কাপড় খুলতে বল, বল কাপড় খুলতে। ‘
চোখ বড়ো বড়ো করে পলাশ শিল্পার দিকে তাকালো। বললো,
-‘ হয়ে গেছে কয় বোতল গিলছে কে জানে? যা তুই ওরে নিয়ে যা চোটপাট বেশী করবো সকালে ডাক্তার পাঠাই দিমুনি ভয় পাইস না যাহ। ‘
#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_২৪
শাহিনুর’কে নিয়ে অলিওরের সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনা সেরে নিজ কক্ষে স্বস্তি নিয়ে বসে ছিলো শারমিন। তখনি বাইজি গৃহের ভৃত্য এসে জানিয়ে গেলো, প্রণয় চৌধুরী এসেছে এবং জরুরি তলব করেছে তাকে।
বাইজি গৃহের প্রধান বৈঠকখানায় বসে আছে সে৷ ভ্রুদ্বয় কুঁচকে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো শারমিন। জমিদারের সেই পুত্র এসেছে? যাকে নিয়ে অনেক বাইজিদের মধ্যেই ভিন্ন ভিন্ন কল্পনা রয়েছে। পাঁচফোড়ন গৃহের কয়েকজন ভৃত্যদের নিকট শুনেছিলো, জমিদারের পুত্রদের মধ্যে একমাত্র প্রণয় চৌধুরী’ই বাইজিদের প্রতি কোন আগ্রহ দেখায় না৷ বোধ করেনা বিন্দু আকর্ষণও। শুধু কি শুনেছে সেই রাতে স্বচক্ষে দেখেও এসেছে বাইজিদের প্রতি জমিদারের এই পুত্রের ঘৃণার মাত্রাটুকু। তাহলে আজ কেন এ গৃহে তার প্রবেশ ? কেনই বা প্রধান বাইজি’কে ডাক? অসংখ্য প্রশ্ন মনে উঁকিঝুঁকি করতে শুরু করলো। সেসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে বৈঠকখানায় গেলেই৷ তাই দেরি না করে বৈঠকখানার দিকে পা বাড়ালো সে। তেজস্বী মুখশ্রী এবং প্রচণ্ড দাম্ভিকতার সহিত বৈঠকখানায় উপস্থিত হলো শারমিন বাইজি৷ ডিভানে পায়ের ওপর পা তুলে বসে ছিলো প্রণয়৷ শারমিন উপস্থিত হতেই অত্যন্ত গুরুগম্ভীর হয়ে গেলো সে। কিঞ্চিৎ ঘৃনার আভাস পাওয়া গেলো তার চোখে,মুখে। সে আভাসটুকু টের পেয়ে তাচ্ছিল্য হেসে তীক্ষ্ণ কন্ঠে শারমিন বললো,
-‘ এতোই যখন ঘৃণা এ গৃহে প্রবেশ কেন জমিদার পুত্র? ‘
শারমিনের এহেন বাক্যে সহসা তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো প্রণয়৷ পা থেকে মাথা অবদি শারমিন’কে অতি সুক্ষ্ম ভাবে দৃষ্টিপাত করে কেন জানি চোখ,মুখ থেকে ঘৃণাটুকু কেটে গেলো। কিঞ্চিৎ বিস্ময় ভর করলো দৃষ্টিতে। কেন জানি শারমিন’কে প্রচণ্ড সাহসী,প্রচণ্ড দাম্ভিক একজন নারী মনে হচ্ছে তার৷ শারমিনের দৃঢ় দৃষ্টি,দৃঢ় কন্ঠে একটুও মনে হচ্ছে না সে অতি কুণ্ঠিত এক বাইজি। বরং আত্মবিশ্বাসী এবং শক্তিশালী একজন নারী মনে হচ্ছে। কিন্তু এক প্রধান বাইজি’র মাঝে এমন কিছু সত্যি অকল্পনীয়। তাই দাপটের সঙ্গে উত্তর দিলো,
-‘ ঘৃণা আছে বলে প্রবেশ নিষেধ এ’কথা ভাবলে কি করে বাইজি? ‘
শারমিন মৃদ্যু হেসে বললো,
– ‘ শুনেছি জমিদারের এই পুত্র নাকি এ গৃহে কস্মিনকালেও পা রাখেনি। আজ কেন বা কি প্রয়োজনে এ গৃহে পা পড়লো জানতে পারি? ‘
একটু নড়েচড়ে বসলো প্রণয়। ডান পায়ের ওপর তুলে রাখা বাম পা’টা সন্তর্পণে নামিয়ে দু’টো পা’ই মেঝেতে স্থির রাখলো। সুস্পষ্ট দৃষ্টি দ্বয় শারমিনের দিকে নিক্ষেপ করে দ্বিধাহীন বাক্যে বললো,
-‘ তুমি বড়ো সৌভাগ্যবতী বাইজি। তোমার কন্যা শাহিনুরের বিবাহ পয়গাম নিয়ে এসেছে স্বয়ং জমিদার পুত্র এবং পাত্র স্বয়ং সে নিজেই। ‘
অহংকারে জর্জরিত প্রণয় চৌধুরী’র সোজাসাপ্টা বাক্য শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলো শারমিন। ক্রমশ চোয়ালজোড়া দৃঢ় হতে থাকলো তার। নিজের মেয়ে’কে নিয়ে এহেন প্রস্থাব পেয়ে শারমিনের মুখোভঙ্গি যেমনটা আশা করেছিলো প্রণয় তেমনটা না পেয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। শারমিনের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে দৃঢ়চিত্তে বললো,
-‘ জমিদার পুত্র হয়ে অতি সাধারণ এক বাইজি কন্যা’কে হৃদয়ে স্থান দিয়েছি আমি। পৃথিবীর সব জায়গায় মানুষের স্থান অনুমতি সহকারে হয়। একমাত্র হৃদয়ে স্থান পেতেই কোন অনুমতি লাগে না, স্থান দিতেও অনুমতির প্রয়োজন পড়েনা। শারমিন বাইজি… তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো? ‘
চৈতন্য ফিরে পেলো শারমিন। আকস্মাৎ প্রণয়ের দৃঢ় দৃষ্টি’তে স্থির চোখে তাকালো সে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো ঐ দৃষ্টি’তে যেমন ভাষা আশা করেছিলো তেমনটি দেখতে পেলো না। তাই অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,
-‘ আমি বিশ্বাস করিনা, আমি আপনার এই দৃষ্টি’কে বিশ্বাস করিনা। ‘
বাঁকা হেসে প্রণয় বললো,
-‘ আমার দৃষ্টি’কে বিশ্বাস করার প্রয়োজন নেই বাইজি। শুধু এটুকু নিশ্চিত থাকো সৃষ্টিকর্তা তোমার কন্যা’টিকে আমার জন্যই তৈরি করেছেন। ‘
-‘ ভুল। স্বয়ং অলিওর চৌধুরী’রও সাহস নেই নুরের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার। সেখানে আপনি আমার কাছে বড়োই তুচ্ছ। ‘
-‘ শুনেছি সন্তানের মঙ্গল চিন্তা করাই প্রতিটি মা’য়ের কর্তব্য। শারমিন বাইজি কি নিজের কর্তব্যটুকুও ভুলে গেছে? ‘
-‘ না ভুলেনি। কিন্তু এটুকু সারাজীবন মনে রেখেছে এবং রাখবে এই অভিশপ্ত গৃহ থেকে, জমিদার’দের অশুভ ছায়া থেকে নিজ কন্যা’কে রক্ষা করতে হবে। একটা সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নির্ণয় করতে হবে। ‘
-‘ যদি বলি নুরের সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আমি?’
-‘ অসম্ভব। ‘
-‘ তুমি উত্তেজিত হচ্ছো বাইজি। একটু ভেবে দেখো যে প্রণয় চৌধুরী এ গৃহমুখী হওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারেনি সেই প্রণয় চৌধুরী আজ স্বয়ং এসেছে শুধুমাত্র তোমার কন্যা শাহিনুর’কে নিজের অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে পাওয়ার জন্য। ‘
শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়ে ওঠলো শারমিনের। তীব্র অস্বস্তি নিয়ে বললো,
-‘ আমি ঘৃণা করি এই জমিদার বংশ’কে। আর আমি এও জানি গোপন কোন অভিসন্ধি নিয়ে আপনি এমন একটি প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। হয়তোবা এটা পলাশ চৌধুরী’র কোন চাল। ‘
চাপা নিঃশ্বাস ছেড়ে বক্ষঃস্থল টান টান করে দাঁড়ালো প্রণয়। দু’হাত সন্তর্পণে দু’পকেটে গুঁজে দিয়ে অত্যন্ত গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-‘ বেশী কথা আমার পছন্দ নয় । আমার অভিসন্ধি যদি খারাপ হতো এভাবে তোমার সামনে এসে কথা বা সময় কোনটাই অপচয় করতাম না। তাছাড়া আমি আমার নীতিতে সর্বদা অটল। তোমার কন্যা’কে আমার মনে ধরেছে। আমার সঙ্গে আমার ভাইদের গুলিয়ে ফেলো না বাইজি বড়ো ভুল হয়ে যাবে। ‘
এক ঢোক গিললো শারমিন। সন্দিহান দৃষ্টিতে একধ্যানে তাকিয়ে রইলো প্রণয়ের গম্ভীর মুখপানে। বললো,
-‘ হুমকি দিলেন? ‘
-‘ হবু শাশুড়ি’কে হুমকি দিতে নেই। ‘
বাঁকা হেসে কথাটি বলতেই শারমিনের ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেলো। বললো,
-‘ যদি বলি নুর অন্যকারো বাগদত্তা। ‘
-‘ সে তো আমিও ছিলাম। ‘
-‘ আমি নুর’কে এখান থেকে অনেক দূরে পাঠিয়ে দেবো। জমিদারের কোন পুত্রের হাতেই আমি আমার কন্যা’কে তুলে দেবো না। কোনভাবেই না। ‘
বুকের ভিতর তীব্র অস্থিরতা থাকলেও তা চেপে কিঞ্চিৎ ক্ষোভের সাথে প্রণয় বললো,
-‘ জমিদারের এক পুত্রের নিকটই তোমার কন্যা বন্দি পড়বে আর সে হলাম আমি। তোমার কন্যা’কে বড়ো মনে ধরেছে বাইজি। তোমার কন্যার প্রতি জমিদারের বাকি পুত্র’রা দেহের তাগদ অনুভব করলেও মনের তাগদ একজনই করে সে হলাম আমি। সু-চিন্তায়,সু-বাসনায় প্রস্তাব দিয়ে গেলাম। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত জানিও৷ তোমার সিদ্ধান্তের উপরই অনেক কিছু নির্ভর করবে। তুমি আমাকে তোমার কন্যা দান করো বিনিময়ে যা পাবে কল্পনারও বাইরে। ‘
চোয়াল শক্ত করে শারমিন কিছু বলতে উদ্যত হতেই হাত ওঠিয়ে থামিয়ে দিলো প্রণয়। মুচকি হেসে বললো,
-‘ ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত জানাবে। আর হ্যাঁ গোপনে কি পরিকল্পনা করেছো জানিনা। নুর’কে দূরে পাঠাবে এমন পরিকল্পনা যদি করে থাকো তাহলে তুমি বড়ো বোকামি করেছো বাইজি। পলাশ চৌধুরী থাকতে নুর’কে তুমি সঠিক জীবন দিতে পারবেনা। আর পলাশ চৌধুরী’র সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা আমি ব্যতিত স্বয়ং অলিওর চৌধুরী’রও নেই। আসি বাইজি, তোমার কন্যা’কে অতিশিঘ্রই আমার ঘরনি করে নিয়ে যাবো। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছের কাছে তোমার মতো মানবীর সিদ্ধান্ত বড়োই তুচ্ছ। ‘
[৩২]
গভীর রাত। শারমিনের বুকে মুখ গুঁজে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে আছে শাহিনুর। অথচ শারমিনের দু’চোখ তন্দ্রাহীন। ইদানীং কেমন যেনো হাঁসফাঁস লাগে শারমিনের। খেতে ইচ্ছে করেনা,ঘুমাতে ইচ্ছে করেনা। শুধু সবসময় শাহিনুর’কে বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে। বিরামহীনভাবে শাহিনুরের মুখপানে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে শাহিনুরের সাথে অনেক অনেক গল্প করতে। নিজের ভিতরকার সমস্তটাই মেলে ধরতে। সর্বোপরি নিজেকে প্রকাশ করতে। যাতে মেয়েটা কঠিন জীবনের কাঠিন্যতা অনুভব করতে পারে। একদিন তো সেও নুরের মতো অবুঝ ছিলো। তার জগৎটাও বড্ড ছোট ছিলো। কথায় আছে মানুষ ঠেকে শিখে। শারমিনও শিখেছে। এই শিক্ষা পুঁথিগত কোন শিক্ষা নয় বরং নিজের জীবন পরিধি থেকে শিক্ষালাভ। নিজের সে শিক্ষাটুকুই শাহিনুর’কে প্রদান করার চেষ্টা করছে। কিন্তু শাহিনুর কি ঠিক তার মতোই অনুভব করতে পারছে নাকি কমতি রয়ে গেছে? শারমিনের এরূপ নানারকম চিন্তার ভীড়ে নতুন চিন্তা যুক্ত হয়েছে তা হলো প্রণয়। গতকাল প্রণয়ের দেওয়া প্রস্তাবটির জন্য মনটা বেশ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। প্রণয়ের বলা সেই কথাগুলোও কোনক্রমে ভুলতে পারছেনা। সত্যি সত্যিই কি সে বোকামি করছে? অলিওর কি তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকা করবে? অলিওর চৌধুরী কি সত্যি বিশ্বাসযোগ্য? ভাবতে ভাবতেই শাহিনুরের দিকে দৃষ্টি পড়লো শারমিনের। কিছু একটা ভেবে মৃদ্যু সুরে ডাকলো,
-‘ নুর,নুর? ‘
ঘুমকাতুরে কন্ঠে শাহিনুর প্রশ্ন করলো,
-‘ আম্মা ডাকো? ‘
শাহিনুরের মাথায়, মুখে হাত বুলাতে বুলাতে শারমিন বললো,
-‘ হ্যাঁ মা ওঠো। ‘
শাহিনুর ধীরে ধীরে ওঠে বসলো। ঘুম ছাড়তে একটু সময় নিলো। যখন একদম ঘুম ছেড়ে গেলো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো মা’য়ের দিকে। শারমিনের দৃষ্টিজোড়া চিকচিক করছে। ধীরে ধীরে সে দৃষ্টি পুরোপুরি ঝাপসা হয়ে ওঠলো। একসময় চোয়াল বেঁয়ে অশ্রুপাতও হতে শুরু করলো। শাহিনুর ভয় পেয়ে গেলো হাত বাড়িয়ে অশ্রুকণা মুছে দিতে দিতে নম্র কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
-‘ ও আম্মা কি হইছে তোমার? ‘
শারমিন শাহিনুরের হাতের পিঠে চুমু খেলো,বললো,
-‘ নুর তোর কি আমাকে দেখে মনে হয় আমি বাঁধ্য হয়ে অলিওর চৌধুরী’র বাইজি গৃহে পড়ে আছি? ‘
চিন্তান্বিত হয়ে শাহিনুর বললো,
-‘ ঐ জমিদারের আম্মার জন্যই তো তুমি এখানে আছো আম্মা। ‘
-‘ নুর, সেদিন আমার একটি নিরাপদ আশ্রয় দরকার ছিলো৷ কিন্তু পরিস্থিতি আমার বিপক্ষে ছিলো বলে অলিওরের সাহায্য নিতে বাঁধ্য হয়েছি। শুধু মাত্র তোর কথা ভেবে আমি বাইজি উপাধি মেনে নিয়েছি। কিন্তু তারপর বহু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি এ গৃহ ত্যাগ করিনি৷ ‘
অবাকান্বিত হয়ে শাহিনুর প্রশ্ন করলো,
-‘ কেন আম্মা? ‘
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শারমিন বললো,
-‘ তুই জন্মানোর পর আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম এখান থেকে পালিয়ে যাব। দিন ক্ষণের অপেক্ষাতেও ছিলাম। অপেক্ষায় ছিলাম তোর বাবার থেকে একটি প্রশ্নের জবাব পাওয়ার। অনুভব করেছিলাম আমার একটা ভুল হয়ে গেছে। হওয়ারই কথা নেহাতই বাচ্চা একটা মেয়ে ছিলাম কিনা। কিন্তু এখানে থাকার সময় যতো বাড়তে থাকলো ততো আমার বুদ্ধি খুলতে শুরু করলো। সেই সাথে কুটিলতায় ভরপুর জমিদার অলিওর চৌধুরী’কে ধীরে ধীরে চিনতে, বুঝতে শুরু করলাম। যেদিন আমি সত্যি সত্যি তোকে নিয়ে এ গৃহ থেকে পালানোর জন্য সিদ্ধান্ত নিলাম সেদিনই সন্ধ্যাবেলা খবর পেলাম তোর বাবা আর এ পৃথিবীতে নেই। গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গেছেন। তখন আমি আর নিজেকে আঁটকে রাখতে পারিনি। রাতে পালানোর সময় ধরা পড়ে গেলাম। অলিওরের পা ধরে কতো আহাজারি করলাম কিন্তু মুক্তি পেলাম না৷ কতো কেঁদেছি,ছটফট করেছি মানুষ’টাকে শেষ বার দেখার জন্য কিন্তু অলিওর চৌধুরী কঠিন রূপ ধারণ করে আমাকে তোর বাবার কাছে যেতে দেয়নি। শেষ বারের মতো দেখতেও দেয়নি। তারপর থেকে কেমন একটা ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতো জমিদার। আমি বেশ বুঝতে পারি এই ভয় শুধু আমাকে হারানোর নয়৷ সাংঘাতিক কোন সত্যি প্রকাশ পেয়ে যাবারও ভয়। কিন্তু সেই সত্যিটা আঁচ করতে পারলেও যোগ্য প্রমাণের অভাবে নিশ্চুপ থাকলাম। তারপর থেকে আর চেষ্টা করিনি পালানোর। মনে মনে শুধু একটাই বিশ্বাস রেখেছিলাম যে জবাবটা আমি পাইনি সে জবাব’টা একদিন অবশ্যই পাবো। সেই জবাবের অপেক্ষা’তে আজো বসে আছি। আজকের শারমিনের কাছে সবটাই স্পষ্ট জবাবটাও স্পষ্ট তবুও অপেক্ষায় আছি প্রমাণ হওয়ার। দুনিয়ার বিচারালয় তো প্রমাণে বিশ্বাসী। কিন্তু আমি জানি আমার প্রতি হওয়া অন্যায়গুলোর বিচার কোথাও পাবো না। তাই নিজের প্রতি হওয়ার অন্যায়ের বিচারক আজ আমি নিজেই। একদিন না একদিন সাক্ষী জোগার করবো প্রমাণ নিশ্চিত করবো৷ শাস্তি দেবো বিশ্বাস ধ্বংসকারী’কে। আমার অনুভূতির খুনি’কে, আমার মানুষ’টার খুনি’কে। ‘
ক্রোধান্বিত শারমিনের তীব্র কন্ঠে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠলো শাহিনুরের। কম্পিত কন্ঠে সে মা’কে শুধালো,
-‘ আম্মা আব্বা’কে জমিদার খুন করেছে? ‘
চমকে মেয়ের দিকে তাকালো শারমিন। কপোল বেয়ে চলা অশ্রুকণা দু’হাতে মুছে নিয়ে বললো,
-‘ যদি সেসব ঘটনার পিছনে অলিওরের হাত থাকে তাহলে তো তোর বাবার দেহের আগেই মনের খুন হয়েছে মা। সেটাই বুঝিয়েছি। ‘
শাহিনুর’কে মুখে এ’কথা বললেও মনে মনে শাহিনুরের কথাটা ঠিক ভাবলো শারমিন আনমনেই বিরবির করে বললো,
-‘ এমনটাও তো হতে পারে। ‘
পরোক্ষণেই সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠলো তার। চোখ,মুখ শক্ত করে বললো,
-‘ এমন কিছু হলে সেদিন শুধু অলিওর নয় পুরো পৃথিবীকেই দেখিয়ে দেবো আমার নৃশংসতা! ‘

পরেরদিন রাত দশটায় –
শাহিনুরের গা’য়ে বেশ জ্বর। তাই জলপট্টি দিচ্ছিলো শারমিন। এমন সময় বাইজি চুমকি হাঁপাতে হাঁপাতে শারমিনের কক্ষের দ্বারের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। শারমিন’কে উদ্দেশ্য করে বললো,
-‘ আসতে পারি? ‘
শারমিন সম্মতি দিতেই হুড়মুড়িয়ে কক্ষে প্রবেশ করলো চুমকি। হাঁপাতে হাঁপাতেই বললো,
-‘ বুবু পলাশ চৌধুরী বেশ রাগ নিয়ে তোমার কক্ষের দিকে আসছিলো। তখনি জমিদার সাহেব পলাশ চৌধুরী’র কলার টেনে তার বিশেষ কক্ষে নিয়ে গেলো। ‘
একহাতে শাহিনুরের কপালে জলপট্টি চেপে ধরে চুমকির দিকে বিচলিত দৃষ্টিতে তাকালো শারমিন। চুমকি কয়েক পল সময় থেমে আবার বললো,
-‘ জানো পলাশ চৌধুরী কি বলতে বলতে আসছিলো? ‘
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই চুমকি বললো,
-‘ বলছিলো “একেবারে মেরে দিছি এইবার কার কাছে মেয়ে পাঠাবি শালী, খাতির করে সময় দিছি আর তুই আমার সাথে খেলতে আসোস? আজকে দেখামু খেলা কারে কয়! ‘”
থামলো চুমকি সহসা দু’পায়ে ওঠে দাঁড়ালো শারমিন৷ শান্ত গলায় চুমকি’কে নিজের কাজে যেতে বললো। চুমকিও বাঁধ্য হয়ে কক্ষ ত্যাগ করলো। শারমিন আর দেরি না করে পা বাড়ালো অলিওরের বিশেষ কক্ষে। মন বড়ো কুডাকছে তার। ঘটনা কি ঘটেছে জানতেই হবে তাকে৷ অলিওরের বিশেষ কক্ষ থেকে বেশ চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। শারমিন যতো এগুচ্ছে ততো পিতা-পুত্রের উচ্চধ্বনি স্পষ্ট হচ্ছে। রাগের বশে পিতাপুত্র কারোরি খেয়াল ছিলোনা যে তাদের বিশেষ কক্ষের দ্বার উন্মুক্ত রয়েছে। আর এই কক্ষটিতে প্রবেশের জন্য শারমিনের কোনকালেই অনুমতির প্রয়োজন পড়েনি। অলিওর চৌধুরীরই নির্দেশ এটা। তাই বিনা দ্বিধায় কক্ষের ভিতর দু’কদম পা বাড়াতেই শারমিন শুনতে পেলো অলিওরের ক্রুদ্ধ কন্ঠস্বর,
-‘ তুই ছেলেটা’কে মেরে দিয়েছিস এতে আমার সমস্যা নেই৷ কিন্তু তুই শারমিনের সাথে কোন প্রকার অসভ্যতা করতে পারবিনা৷ এর বিনিময়ে তুই যা চাস তাই পাবি প্রয়োজনে নুর’কে বিনা পরিশ্রমে তোকে পাওয়িয়ে দেবো। ‘
বৈদ্যুতিক শক খাওয়ার মতো সর্বাঙ্গে কেঁপে ওঠলো শারমিনের৷ অসাড় হয়ে আসলো তার পুরো দেহ। দু’জনের কেউই টের পায়নি শারমিনের উপস্থিতির। তাই নিঃশব্দে শারমিন পিছিয়ে গেলো৷ দ্বারের পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে নিজের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করলো। বিরবির করে আওড়ালো,
-‘ তবে কি আমার আনভীর বাবা আর নেই! ‘
পরোক্ষণেই থমকে গেলো অলিওরের কিছু গোপন সত্যি বাক্য শুনে। যা তার বক্ষঃস্থলে তিরের ন্যায় বিঁধল। অলিওর পলাশ’কে শারমিনের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে ঝোঁকের মাথায় বলে ফেললো,
-‘ তুই যেমন নুর’কে পাওয়ার জন্য আজ খুন করতে বাঁধ্য হয়েছিস ঠিক তেমনি বহুবছর আগে শারমিন’কে পাওয়ার জন্য আমি কারো সম্মান ধ্বংস করেছি,ভালোবাসা ধ্বংস করেছি। শেষ পর্যন্ত নিজের খালাতো ভাই’কে গাড়ি এক্সিডেন্ট করিয়ে হত্যা করেছি৷ নিয়তির নিষ্ঠুরতায় তবুও শারমিন’কে আমি পাইনি। জোর করে আমার সীমানায় বন্দি করতে পারলেও শারমিন’কে আমি পাইনি। এই বয়সে এসেও যার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমার মন ব্যাকুল থাকে সে এই শারমিন। শুধুমাত্র আম্মার কথায় ওকে আমি এই বাইজি গৃহে রাখতে বাঁধ্য হয়েছি। তাই বলে এই না ওর সঙ্গে যে যা খুশি তাই করবে করতে চাইবে আর তা আমি মেনে নেবো। ‘
-‘ আব্বা! ‘
বিস্ময়ে,ক্রোধে শরীর কাঁপতে শুরু করলো পলাশের৷ অলিওর বললো,
-‘ আমার কথা অমান্য করলে পরিণতি খুব ভয়ংকর হবে পলাশ। ‘
-‘ আপনি আমার আম্মা’কে এতোবছর ধরে ঠকাচ্ছেন আব্বা! ‘
-‘ সে তো তুইও মুনতাহা’কে ঠকাচ্ছিস। ‘
পিতাপুত্রের এ অবদি কথোপকথন শুনতে পেয়ে পাথর মূর্তি শারমিনের ওষ্ঠকোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠলো৷ কপোল বেয়ে গেলো অঝরে অশ্রু ধারা। বক্ষঃস্থলে শুরু হলো তাণ্ডব। শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে দাউদাউ করে অগ্নি জ্বলতে শুরু করলো। যে অগ্নিতে আজ ভষ্ম হয়ে যাওয়ার তীব্র সম্ভাবনা রয়েছে জমিদার অলিওর চৌধুরীর!

চলবে…
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here