বাইজি কন্যা পর্ব ২৫+২৬

#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_২৫
[ ৩৩ ]
বহুবছর আগে জমিদার অলিওর চৌধুরী নিখুঁতভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো, বাইজি শারমিন শায়লার সাথে। তার করা বিশ্বাসঘাতকতার জন্যই আজ শারমিনের পরিচয় এক বাইজি প্রধান। সেদিন যদি অলিওর পরিকল্পনা করে শাহিন’কে না ফাঁসাতো শারমিন শাহিন’কে ছেড়ে আসতো না। আর অলিওরের মা’ও প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে শারমিন’কে বাইজি গৃহে স্থান দিতো না। নিরপরাধ শাহিন’কে কতোটা জঘন্য ভাবে ঠকিয়েছে অলিওর। শাহিন তার ভালোবাসার মানুষ, তার স্বামী শাহিন। সবচেয়ে বড়ো কথা তার সন্তান নুরের বাবা ছিলেন তিনি। অলিওর যদি তাদের সঙ্গে এই জঘন্য খেলাটা না খেলতো, আজ শারমিন,শাহিন, এবং নুরের জীবনটা অন্যরকম হতো। না সে বাইজি হতো আর না নুরের পরিচয় শুধুমাত্র এক বাইজি কন্যা হতো। শাহিনের মতো একজন সম্মানিত ব্যক্তির স্ত্রী, সন্তানের এমন পরিচয়ের জন্য শুধুমাত্র অলিওর চৌধুরীই দায়ী। এতো কিছু করেও অলিওর চুপ করেনি৷ নিজের স্বার্থের জন্য নিজের ছেলের কামনা পূরণ করার জন্য আবারো বিশ্বাসঘাতকতা করলো! শাহিনুর’কে সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ দেওয়ার জন্য দূরে পাঠাতে চেয়েছিলো। সুপাত্রের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলো৷ সবটাই গোপনভাবে অথচ পলাশ চৌধুরী সবটা জেনে গেলো। তার বাবা যেমন শারমিন’কে পাওয়ার লোভে শাহিন’কে হ’ত্যা করেছিলো তেমনি নুর’কে পাওয়ার জন্য সেও আনভির’কে হত্যা করলো। এক মা’য়ের কোল খালি করলো! সবটা মস্তিষ্কে নাড়া দিতেই ঘৃণায় মনটা বিষিয়ে ওঠলো শারমিনের। কতোটা নৃশংস এই জমিদার আর তার এই পুত্র! এতোটা বছর যে সন্দেহ, যে ভয় মনে পুষে রেখেছিলো আজ সেটাই সত্যি হলো। হৃৎপিণ্ড অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে তার। মনে পড়ে যাচ্ছে শাহিনের সাথে কাটানো একেকটা ভালোবাসাময় দিনগুলোর কথা। অস্থিরতায় সারা শরীরে ঘাম ছেড়ে দিয়েছে। অতিরিক্ত উত্তেজিত হওয়ার ফলে ঘনঘন শ্বাস গ্রহণ এবং ত্যাগ করছে। মস্তিষ্ক কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। চারদিক থেকে ক্রমশ শূন্যতা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে তাকে। অসহায় লাগছে খুব। আফসোসের আর্তনাদে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ঠিক এজন্যই, ঠিক এজন্যই আজ অব্দি অলিওর শাহিনের পাঠানো বিবাহ বিচ্ছেদের কাগজটি দেখাতে পারেনি। দেখাবে কি করে তার স্বামী,তার নুরের বাবা তো তাকে এমন কাগজ পাঠায়নি। মানুষটা তো তাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো। কতো স্বপ্ন ছিলো মানুষটার, কতো আশা ছিলো নুর’কে নিয়ে। সেসবের কোনটাই যে পূরণ হলো না। কালবৈশাখী ঝড়ের আঘাতে যেমন প্রকৃতি’তে ধ্বংসলীলা সৃষ্টি হয় তেমন তাদের জীবনেও অলিওর নামক ঝড়টি এসে সবটা ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। দু’হাত মুখে চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো শারমিন। একসময় একদম নিশ্চুপও হয়ে গেলো। ভিতর থেকে অস্পষ্ট কন্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে অলিওর এবং পলাশের। সহসা দু’হাতে কপোল বেয়ে চলা সমস্ত অশ্রুই মুছে নিলো শারমিন৷ নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক করে অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিতে নিজের কক্ষের উদ্দেশ্যে ধীর গতিতে চরণদ্বয় আগাতে লাগলো। তার পরিহিত গাঢ় হলুদ রঙের জর্জেট শাড়িটির লম্বা আঁচল তখন মেঝেতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। মাথার লম্বা লম্বা চুলগুলোর বড়ো খোঁপাটিও আধখোলা অবস্থায় রয়েছে। কিছু সময়ের ব্যবধানে হয়তো তা পুরোপুরিই খুলে যাবে,হয়তো ঘিরে থাকবে তার পিঠ এবং কোমড়’কে। তার নিষ্পলক, দৃঢ় দৃষ্টিজোড়ায় এক ফোঁটা অশ্রুকণাও নেই। সবটা যেনো নিমিষেই কেউ শুষে নিয়েছে। এ সময় প্রখর সে দৃষ্টিজোড়ায় তাকালে যে কারোরি হৃৎপিণ্ড ভয়ংকর মাত্রায় কেঁপে ওঠবে। নিজ কক্ষে গিয়ে শারমিন সর্বপ্রথম শাহিনুরের পাশে গিয়ে বসলো৷ কিছুক্ষণ শাহিনুরের মাথায় এবং মুখে হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেলো। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বিরবির করে বললো,
-‘ সোনা মা আমার ছোট্ট ভুলে আজ তোর পরিচয় বাইজি কন্যা। আমার কলিজা, ঐ বিশ্বাসঘাতক জমিদারের জন্য তুই আজ পিতৃহীন। ‘
একটু থামলো শারমিন দুফোঁটা অশ্রু ঝড়ে পড়লো তার চোয়াল বেয়ে। তর্জনী আঙুল দ্বারা সে অশ্রুকণা মুছে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো শারমিন। পুনরায় শাহিনুরের ললাট চুম্বন করে নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
-‘ জানিস সোনা, ঐ অলিওর শুধু তোর বাবার সম্মান নষ্ট করে চুপ হয়নি। ঐ নরপশুটা তোর বাবার থেকে স্ত্রী, সন্তান’কে দূরে সরিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। শেষ পর্যন্ত জা’নো’য়ারটা তোর বাবাকে খু’নও করেছে! ‘
কথা জড়িয়ে যাচ্ছিলো শারমিনের তাই নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে আবারো বললো,
-‘ এমন সম্মানিত একজন ব্যক্তি’কে এভাবে অসম্মান করে, পুরো দুনিয়ার কাছে অসম্মানিত,ঘৃণিত,চরিত্রহীন চিহ্নিত করে মৃত্যু দিয়ে দিলো! নিরপরাধ মানুষ’টাকে এভাবে ঠকালো, আমার সঙ্গে এতো বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা করলো, আর আমি এতো দেরিতে তা টের পেলাম? আর পলাশ চৌধুরী সেও তো কম করলো না। শেষমেশ আনভীর’কে খুঁজে বের করে শেষ করে দিলো। এইবারেও বিশ্বাসঘাতকতা করলো অলিওর আমার সঙ্গে। ওর র’ক্তে মিশে গেছে বিশ্বাসঘাতকতা। আজ ওর র’ক্ত দিয়ে গোসল করবো আমি! নুর মা আমি আমার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছি। আজ এই বাইজি গৃহে সবচেয়ে নি’কৃষ্ট দু’টো প্রাণের বিনাশ ঘটবে! ‘
জ্বরের ঘোরে তন্দ্রায় মগ্ন শাহিনুর৷ শারমিন ঘুমন্ত শাহিনুরের সঙ্গেই আপনমনে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললো। কথা শেষে শান্ত দৃষ্টিতে চারপাশে তাকিয়ে দেখলো। মনে মনে স্থির করলো জমিদার এবং জমিদারের ছেলের বিনাশ ঘটিয়ে এই অভিশপ্ত গৃহ আজ ত্যাগ করবে সে। শাহিনুর’কে নিরাপদ স্থানে রেখে,নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করে তারপর না-হয় পুলিশের কাছে ধরা দেবে। আর সময় নিলো না শারমিন মৃদ্যু পায়ে এগিয়ে গিয়ে নিজের কাছে সংরক্ষিত সেই অস্ত্র’টি বের করলো। যে অস্ত্র
দেখিয়ে শাহিনুর’কে সে শিক্ষা দিয়েছিলো,
– ‘ এই অস্ত্র কোন মানুষ কে হত্যা করার জন্য নয়৷ এই অস্ত্র শুধুমাত্র অমানুষদের হত্যা করার জন্য। ‘

[৩৪]
চারপাশ ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। রাত তখন ক’টা বাজে অনুমান করা গেলো না। আজ আকাশে চাঁদ নেই,নেই অগণিত তাঁরাদের মেলা। বিশাল আকাশটায় থেকে থেকে মেঘেরা গর্জন করে ওঠছে। এই বুঝি আকাশ কাঁপিয়ে, ভূমি কাঁদিয়ে বর্ষণ শুরু হবে। প্রকৃতির এমন থমথমে আবহাওয়ায় বাইজি গৃহ’টি ঘুঙুরের শব্দে মুখরিত হয়ে আছে। শারমিন বাইজি এক হাতে তলোয়ার নিয়ে একধ্যানে এগিয়ে চলেছে। বাইজি গৃহে বরাবরের মতোই আজো চমকপ্রদ আলোকসজ্জায় সজ্জিত৷ প্রতিটি কক্ষের সামনের বারান্দা দিয়ে একের পর এক কক্ষ পার করছে শারমিন৷ বাইজি গৃহে প্রবেশের মেইন গেট থেকে গৃহের বারান্দা স্পষ্ট দেখা যায়। রঙ্গন এ গৃহে আসার জন্য সবেই গেটের সামনে এসেছে৷ তখনি দূর থেকে শারমিন’কে অমন ভয়ানক দৃশ্যে দেখে দ্রুত পা বাড়ালো রঙ্গন। শারমিন যখন অলিওরের বিশেষ কক্ষে প্রবেশ করলো তখন অলিওর পলাশের সঙ্গে গোপন আলোচনায় মগ্ন ছিলো। শারমিন কোন কিছু না ভেবে সরাসরি অলিওরের পিঠ বরাবর তলোয়ারের মাথা ঢুকিয়ে দিলো। অলিওর আর্তনাদ করে ওঠতেই এক ধাক্কায় তাকে মেঝেতে ফেলে পেট বরাবর একবার,দু’বার, তিনবার তলোয়ার ঢুকালো এবং বের করলো। হিংস্র বাঘিনীর মতো করে গর্জন দিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
-‘ বিশ্বাসঘাতক, তোর সব খেলা আজ শেষ। ‘
দাঁতে দাঁত চেপে এ’কথা বলতেই পলাশ আতঙ্কিত হয়ে শারমিনের বুক বরাবর লাথি দিলো। ছিঁটকে দূরে গিয়ে পড়লো শারমিন। অলিওরের দিকে চেয়ে আব্বা বলেই অলিওর’কে ধরলো পলাশ। চিৎকার করে ডাকতে লাগলো,
-‘ এই কে আছিস আমার আব্বারে মাইরা ফেলছে তাড়াতাড়ি আয় আব্বা’কে হাসপাতাল নিতে হবো। ‘
অলিওর’কে হাসপাতাল নিয়ে যাবে পলাশ। এক শ’য়তান প্রাণ বাঁচাবে আরেক শ’য়তানের। কখনোই না। জীবন দিয়ে হলেও এই দুই পিশাচ’কে ধ্বংস করবে আজ শারমিন। এই বাসনা নিয়েই চারগুণ হিংস্র হয়ে ওঠলো শারমিন। হাতের শক্তমুঠে তখনো তলোয়ার রয়েছে তার। সেটা নিয়েই পলাশ চৌধুরী’র ঘাড় বরাবর যেই আঘাত করতে গেলো৷ উদ্দেশ্য দেহ থেকে মাথা খণ্ডন করা। কিন্তু তার পূর্বেই থেমে দাঁড়ালো শারমিন, ভয়ংকর সুরে আর্তনাদও করে ওঠলো। বিক্ষিপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বড়ো বড়ো চোখ করে নিজের পেটের দিকে তাকাতেই সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠলো তার। র’ক্তাক্ত ধারালো তলোয়ারের মাথা দেখেই অসাড় হয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাতেই ক্রোধান্বিত মুখশ্রী’তে রঙ্গন’কে দেখতে পেলো। রঙ্গনের হাতের দিকে তাকাতেই দেখলো তার পিঠ সই করে তলোয়ার ঢুকিয়েছে রঙ্গন। যা তার পিঠ, পেট ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। চোয়াল শক্ত করে রঙ্গন তলোয়ার’টি একটানে বের করে ফেলতেই আহত শারমিন বাইজি নিজ শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারলোনা। শরীর ছেড়ে দিয়ে একহাত পেটে চেপে ধরে অলিওরের পাশেই ধপাস করে পড়ে গেলো। পলাশ শারমিনের দিকে চেয়ে বিকৃত ভঙ্গিতে হেসে ওঠলো,পরোক্ষণেই আবার কেঁদে ওঠলো, অলিওরের দিকে চেয়ে বললো,
-‘ আব্বা,আমার আব্বা। ‘
রঙ্গন, পলাশ দু’জনই গিয়ে অলিওর’কে ধরলো। দু’জনই একডাকে বললো,
-‘ আব্বা আপনার কিছু হবে না আমরা আছি। ‘
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম অলিওর চৌধুরী ক্ষীণ স্বরে বললো,
-‘ তোরা চুপ কর, তোরা আমাকে নিয়ে টানাটানি করিস না। ‘
এটুকু বলে চোখ বন্ধ করে ফেললো অলিওর।পরোক্ষণেই অসহনীয় ব্যথায় গোঙানি দিলো কয়েকবার। শুনতে পেলো শারমিনের গেঙানিও৷ ঘাড় কাত করে শারমিনের দিকে তাকালো। করুণ কন্ঠে বললো,
-‘ তুমি আর আমি আরো কিছুকাল বাঁচতে পারতাম শারমিন। ‘
গোঙাতে গোঙাতেই শারমিন অলিওরের মুখে থুতু ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে পলাশ শারমিনের গালে ঠাশিয়ে এক থাপ্পড় মারলো। বৃদ্ধ অলিওর তার ক্ষতবিক্ষত বলহীন দেহটি কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে বলহীন হস্ত দ্বারাই পলাশের গালে দু’টো চড় মারলো। বললো,
-‘ এতো বড়ো সাহস তুই আমার শারমিনের গায়ে হাত তুলিস। দূর হয়ে যা চোখের সামনে থেকে। আমি আমার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস তোর মতো বেয়াদবের সামনে ত্যাগ করতে চাই না। ‘
পলাশ ক্রোধে চুপ থাকলেও রঙ্গন ওঠে দাঁড়ালো এবং সকল ভৃত্যদের ডাকার জন্য উদ্যত হলো। কিন্তু অলিওর মৃদ্যু হুংকার দিলো তাদের দুজন’কেই বেরিয়ে যেতে। পলাশ রঙ্গন কেউ রাজি হলো না। ইতিমধ্যে বাইরে ভারী বর্ষণ শুরু হয়েছে। যার ফলে কক্ষের ভিতরের আওয়াজ বাইরে যাচ্ছে না। বাইজিরা তাদের কাজে মগ্ন, ভৃত্যরাও হয়তো সারাদিনের ব্যস্ততার পর বিছানায় আরাম করছে। সবটা বিবেচনা করেই অলিওর চৌধুরী বললো,
-‘ রঙ্গন তুই চলে যা বাপ তুই শহরে চলে যা। একমাসের আগে এখানে আসবি না। পলাশ বাপ আমার রাগারাগি না করে এই ঘটনা চেপে যাস। নয়তো রঙ্গনের বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে। ‘
এটুকু বলে শারমিনের দিকে দৃষ্টিপাত করলো অলিওর৷ শারমিন কেমন নিথর হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু তার শ্বাস তখনো চলছে। শরীরে একটুখানি শক্তি ভিক্ষা চাইছে উপরওয়ালার কাছে। অলিওর সেদিক তাকিয়ে ক্ষীণ কন্ঠেই বললো,
-‘ কি আনন্দ! কি নিরানন্দ! শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় শুধু তোমাকে পাশে চেয়েছিলাম। কি সৌভাগ্য! আমার পুত্র’রা আমার চাওয়ার থেকেও দ্বিগুণ পাওয়া দিলো। তোমাকে সঙ্গে নিয়েই পরপারে চলে যাচ্ছি। আহ, আর কোন চিন্তা নেই মরে শান্তিই পাবো। কিন্তু হায়, ভয় একটাই এপারের মতো ওপারেও আবার লড়াই না চলে? যদি উপায় হয়, যদি সুযোগ পাই ওপারে গিয়ে আমার প্রধান লক্ষ হবে শাহিনের থেকে তোমাকে দূরে দূরে রাখা। শারমিন, তোমার হাতে মৃত্যু পেয়েও বড়ো প্রশান্তি অনুভব করছি। কতো ভালোবাসি আমি তোমায় বুঝলে না শারমিন তুমি বড়ো অবুঝ। আমার প্রাণ প্রিয়া অবুঝ শারমিন অনেক ভালোবাসি তোমায়। ‘
কথাগুলো বলতে বলতে শারমিনের একদম কাছে এসে মেঝেতে শুয়ে পড়লো অলিওর। শারমিনের একটি হাত টেনে নিজের বুকে চেপে ধরে বললো,
-‘ আমার শেষ স্পন্দনটুকুও তোমার নামে শারমিন অথচ তোমার? ‘
এটুকু বলে শারমিনের বুকে হাত রাখলো অন্যহাতে তলোয়ার টেনে গায়ের সর্বশেষ শক্তিটুকু দিয়ে শারমিনের বক্ষঃস্থলে বেশ কয়েকবার আঘাত করলো। বারকয়েক গোঙানি দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো শারমিন। তার শুভ্র মুখশ্রী’তে তাকিয়ে মুচকি হেসে অলিওর বললো,
-‘ মৃত্যু সঙ্গী হলে তবুও হৃদয়ে স্থান দিলে না। ‘
আফসোসের সাথে শেষ এটুকু বাক্য উচ্চারণ করে চিৎ হয়ে শুয়ে নিজের পেট বরাবর দু’হাতে তলোয়ার চেপে ধরলো অলিওর। চোখ উল্টে দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো সে নিজেও। পলাশ,রঙ্গন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। একধ্যানে তাকিয়ে রইলো শারমিন বাইজি এবং জমিদার অলিওর চৌধুরী’র মৃত দেহের দিকে। তাদের পাঁচ ভাই’য়ের সম্মানিত পিতার লাশের দিকে! ভীতিগ্রস্থ হয়ে এক ঢোক গিলে রঙ্গন পলাশের পানে তাকাতেই পলাশ চোয়াল শক্ত করে বললো,
-‘ দু’টো পথের কাঁটা একসাথে শেষ। ‘
রঙ্গন বিস্মিত হয়ে কেঁদে ফেললো। বললো,
-‘ ভাই আমাদের আব্বা! ‘
-‘ আব্বার কথা না ভেবে বাঁচতে চাইলে এ গৃহ ত্যাগ কর। পারলে শহরে চলে যা। সবটা সামলে যখন খবর দেবো তখনি আসবি। ‘
[৩৫]
সারারাত ভারী বর্ষণ হওয়ার ফলে প্রকৃতির নিয়মানুসারে আজকের সকালটি বৃষ্টিস্নাত। সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই শাহিনুর অনুভব করলো তার মা পাশে নেই। মৃদু ভাবে চোখ খোলার চেষ্টা করতেই কর্ণকুহরে ভেসে এলো একাধিক মেয়েলি কন্ঠে ক্রন্দন ধ্বনি। কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকিয়ে সন্তর্পণে ওঠে বসলো সে। বার, দুয়েক আম্মা, আম্মা করে ডেকেও যখন সারা পেলো না, তখন হাই তুলতে তুলতে বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। শুনতে পেলো একাধিক ক্রন্দনধ্বনি। বুকের ভিতরটা অকস্মাৎ কেমন করে যেনো কেঁপে ওঠলো। ‘ আম্মা, আম্মা’ করে ডাকতে গিয়েও কন্ঠস্বর কেঁপে ওঠলো। পরনের শাড়িটা ভালোভাবে গা’য়ে জড়িয়ে আঁচলটুকু কোমড়ে গুঁজে প্রথমে ধীরে পা বাড়ালো, কয়েক পা বাড়াতেই আপনাআপনিই তার পায়ের গতি বেড়ে গেলো। অস্থিরচিত্তে কোথায় থেকে কান্নার শব্দ আসে ভাবতে ভাবতেই ছুটে গেলো সেই বিশেষ কক্ষে। সেখানে গিয়ে সর্বপ্রথম যে দু’টো মানুষ’কে তার চোখে ভেসে ওঠলো তারা হলো – প্রেরণা এবং প্রণয় চৌধুরী!
#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_২৬
অলিওরের বিশেষ কক্ষটির দ্বারের বাইরে বাইজি গৃহের ভৃত্যদের থেকে শুরু করে প্রায় সকল সদস্যেরই ভীড় জমেছে। পাঁচফোড়ন গৃহ থেকে শুধু অলিওরের দুই স্ত্রী, তিন পুত্র এবং ভৃত্য’রা এসেছে৷ শাহিনুর সেই ভীড়ের মধ্যখানে দাঁড়িয়েই সর্বপ্রথম দৃষ্টিপাত করলো প্রেরণা এবং প্রণয়’কে। তার ভীত দৃষ্টিজোড়ায় ঐ দু’জন মানুষের পরই অকস্মাৎ অলিওরের রক্তাক্ত দেহটির সম্পূর্ণ দৃশ্য ভেসে ওঠলো। নিথর দেহটির পাশে মাথা নিচু করে বসে আছে প্রণয়, পাশে অলিওরের মাথা কোলে নিয়ে বসে আর্তচিৎকার করছে অরুণা এবং প্রেরণা। এমন দৃশ্য দেখে মস্তিষ্ক কেমন ফাঁকা হয়ে বক্ষঃস্পন্দন থেমে গেলো শাহিনুরের। ক্ষণকাল চারপাশে অবুঝভাবে দৃষ্টি বুলিয়ে যখন একে একে সকল পরিচিত মুখ দেখতে পেলো, দেখতে পেলো পরিচিত বুবুদের আঁচলে মুখ ঢেকে কান্না করার দৃশ্যটি, তখন আরেকবার কক্ষের ভিতরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কক্ষের ভেতরে সম্পূর্ণ মেঝেতেই রক্তিম তরল পদার্থের স্রোত দেখতেই তার থেমে যাওয়া বক্ষঃস্পন্দন সহসা কেঁপে ওঠলো।অরুণা,প্রেরণা,প্রণয়’কে পেরিয়ে পেছন থেকে কারো করুণ আর্তনাদ শুনতেই শাহিনুরের সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠলো। শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসা অবস্থায় রুদ্ধ কন্ঠেই জোর পূর্বক উচ্চারণ করলো,
-‘ মা-ন্না-ত বুবুহ! ‘
শাহিনুরের ভীতিকর ভাঙা কন্ঠে ‘মান্নাত বুবু’ শুনতেই বাবার ক্ষতবিক্ষত, নিথর দেহ থেকে চমকিত ভঙ্গিতে দৃষ্টি তুললো প্রণয়৷ নির্লিপ্ত দৃষ্টিদ্বয়ে ভেসে ওঠলো শাহিনুরের শঙ্কিত মুখশ্রী। যা দেখে সহসা বুকের ভিতর চিনচিনে এক ব্যথাকে টের পেলো সে। শ্রদ্ধেয় পিতার মৃত্যু শোকে শোকাহত বক্ষেঃ আচম্বিতভাবে সম্মুখে থাকা কিশোরী’টির জন্য অদৃশ মায়া, আশঙ্কিত বিপদের সম্ভাবনা দৃঢ় হয়ে ওঠলো। বিনিময়ে তার রক্তিম আভাযুক্ত দৃষ্টিজোড়ায় ভর করলো সীমাহীন কাতরতা। কিন্তু সে কাতর দৃষ্টিদ্বয়ে এক পলকের জন্যও তাকালো না শাহিনুর। আর না তোয়াক্কা করলো চারপাশের মানুষজনদের। কোনরকম শারমিন’কে দেখতে পেয়েই ত্বরিতগতিতে এগিয়ে আর্তচিৎকার করে ওঠলো। ডাকলো,
‘ আম্মা! ‘
প্রণয়’কে পাশ কাটিয়ে ঠিক প্রণয়ের পিঠ মুখী হয়ে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো সে। ঘাড় বাঁকিয়ে আচম্বিত দৃষ্টি’তে কয়েকপল শাহিনুর’কে দেখলো প্রণয়৷ পরোক্ষণেই আবারো সে তার বাবার মৃত দেহের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো৷ কিন্তু সজাগ রইলো তার কর্ণদ্বয়, রুদ্ধ হয়ে আসলো শ্বাসপ্রশ্বাস।
শারমিনের খোলা চুল মেঝেতে বিছিয়ে পড়ে আছে। চুলের ভাঁজে ভাঁজেও রক্তিম তরলে নিমজ্জিত। পরিহিত হলদে রঙের জর্জেট শাড়িটি দেখে বোঝার উপায় নেই তার রঙ হলুদ ছিলো! মান্নাত বাইজি ক্ষণে ক্ষণে শারমিনের গালে মৃদু থাপ্পড় দিচ্ছে আবার আর্তচিৎকার করে বলছে,
-‘ তুমি মরতে পারো না, তুমি এভাবে চলে যেতে পারো না। নুর’কে ছেড়ে এভাবে কেন চলে গেলে তুমি, তোমার নুর’কে এবার কে রক্ষা করবে! ‘
শারমিন’কে অমন নিশ্চলভাবে দেখে মান্নাতের অমন আহাজারি শুনে সহ্য করতে পারলো না শাহিনুর। বীভৎস এক চিৎকার করে ওঠলো সে। শারমিনের রক্তেমাখা নিথর কাঁধে মৃদ্যুভাবে ধাক্কা দিতে দিতে ডাকলো,
-‘ আম্মা, আম্মা। ‘
বারকয়েক ডেকেও যখন উত্তর মিললো না৷ মান্নাত বাইজি ডুঁকরে ওঠলো। শাহিনুর করুণ চোখে মান্নাতের দিকে চেয়ে ঠোঁট উল্টে কেঁদে দিলো। ভাঙা কন্ঠে বললো,
-‘ বুবু আম্মার কি হইছে? আম্মা কথা কয় না কেন! ‘
গগনবিদারী এক চিৎকার দিলো মান্নাত। বললো,
-‘ নুর’রে তোর আম্মা আর নাই তোর আম্মা নাইরে নুর।’
মান্নাতের হৃদয়বিদারক কন্ঠে কক্ষ যেনো কেঁপে ওঠলো। স্তম্ভিত হয়ে মা’য়ের পানে নির্বাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো শাহিনুর। তার ছোট্ট কোমল হাতটি বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো মা’য়ের শান্ত গালে। ধীরে ধীরে দৃষ্টি নিচের দিকে নামালো অতি সুক্ষ্ম ভাবেই নজরে পড়লো মা’য়ের বক্ষঃস্থলের ক্ষতের দিকে৷ যেই বুকে পরম শান্তিতে সে হেসেছে,কেঁদেছে, দিনশেষে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে। তার এই পরম সুখময় জায়গাটি’কে এভাবে ধ্বংস করতে একটুও কি বুক কাঁপেনি জমিদারের? ভেবেই কম্পিত হস্তে ক্ষত হওয়া বুকের স্থানটিতে হাত চেপে ধরলো শাহিনুর৷ যখন সে হাতটি ওঠিয়ে হাতের তলার অংশ সম্মুখে মেলে ধরলো পুুরো শরীর অসাড় হয়ে আসলো তার। ব্যথাহত কন্ঠে মৃদু চিৎকার করে বললো,
-‘ আম্মাগো! কতো কষ্ট তুমি পাইছো আম্মা। ‘
পুরো শরীর ভয়ংকর রক্তে মাখামাখি। শাহিনুর সে শরীরে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে কিছুক্ষণ আদর করলো, কিছুক্ষণ কাঁদলো। কিছুক্ষণ নিথর রক্তাক্ত বুকটায় মাথা রেখে চুপটি মেরে রইলো। অপরূপা শারমিন বাইজি’র রক্তাক্ত দেহ দেখে তার সুশ্রী কন্যার মুখটাও নিমিষে বিধ্বস্ত হয়ে ওঠেছে। যে বাইজি গৃহের আনাচে-কানাচেতে সর্বক্ষণ ঘুঙুরের আওয়াজে মুখরিত থাকতো, যে গৃহের প্রতিটি রুদ্ধদ্বার শাক্ষি থাকতো সর্বোচ্চ ঘৃণ্যতম ঘটনার, যে বাইজি গৃহে জমিদারের পুত্র’রা অশ্লীলতার সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে যেতো। যে গৃহের গোপন পাপের খবর জমিদার’রা এবং বাইজি গৃহের সদস্যরা ছাড়া জানতে পারেনি কেউ, সেই গৃহের প্রতিটি কোণায় কোণায়, প্রতিটি ইষ্টকে আজ যেনো মৃত্যু শোক! একটি গাছের আগা যতো নড়বড়ে থাকুক না কেন যতোক্ষণ গোড়া শক্ত থাকবে ততোক্ষণে তার বিনাশ নেই। কিন্তু গোড়া বিহীন আগা টিকিয়ে রাখার জেদ মৃত মানুষ জিন্দা করার মতোই। যা কখনো, কোনকালেই সম্ভব হবার নয়। পল্লব এবং পলাশ চৌধুরী অলিওরের মৃত দেহটি নিজেদের গৃহে নেওয়ার ব্যবস্থা করলো। ভৃত্যদের দিয়ে অলিওরকে নিজেদের গৃহেও নিয়ে গেলো। মহিলা ভৃত্যরা অরুণা আর প্রেরণাকে নিয়ে গেলো। জমিদার এবং বাইজি শারমিন শায়লার মৃত্যু রহস্য উদঘাটন করলো পলাশ চৌধুরী। পুলিশের নিকট সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণনাও করলো সবটা। বললো, অলিওরের বাইজি গৃহে শারমিন আর থাকতে চাচ্ছিলো না। অলিওরও তাকে এ গৃহ থেকে বিদায় দিতে ইচ্ছুক ছিলো না। তাই দু’জনের মধ্যে বেশ ঝামেলা সৃষ্টি হয়। এক কথায়, দু’কথায় শারমিনই আগে আঘাত করে অলিওরকে। কিন্তু সে জমিদার, তলোয়ার তার চেয়ে ভালো ব্যবহার করবে সামান্য বাইজি? তাই জীবন দিয়ে হলেও তার সঙ্গে করা বেয়াদবির শাস্তি দিয়েছে অলিওর। আর যাইহোক এক বাইজির কাছে জমিদার কখনো হার মানবে না। পুলিশ’কে টাকা খাওয়ালো পলাশ চৌধুরী। যাতে এই খ’নগুলোর জন্য তদন্ত না হয়। টাকা খাওয়িয়ে মিথ্যা কথায় ভুলিয়ে পুলিশদের পাঠিয়ে দিলেও, গ্রামের মানুষ’দের বোঝাতে পারলেও প্রেরণা আর অরুণা’কে সত্যি বললো পলাশ। শারমিন বাইজির হাতে অলিওর প্রথম আঘাত পেলেও শারমিন’কে রঙ্গন এবং অলিওর দু’জনই খু’ন করেছে। আর অলিওরও বাঁচতে চায়নি বলে শেষে নিজেই নিজের দেহে শেষ আঘাত করেছে। পলাশের মুখে সবটা শুনে অরুণা, প্রেরণা সবটা বিশ্বাস করতে বাঁধ্য হলো। কারণ তারা জানে অলিওর চৌধুরী শারমিন’কে মন,প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো। শারমিনের প্রতি তার তীব্র আকর্ষণ বহুবছরের। আর শারমিন বাইজির ব্যক্তিত্ব সম্পর্কেও নিখুঁত ধারণা রয়েছে তাদের। তাই শারমিনের দ্বারা জমিদারের এই মৃত্যু অসম্ভব কিছু নয়৷ আর পলাশের বর্ণনা অনুযায়ী শারমিনের এমন মৃত্যুও বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু সবশেষে বিপদ রইলো রঙ্গনের জন্যই তাই আসল সত্যিটা চাপা রইলো অরুণা,প্রেরণা আর পলাশ চৌধুরী’র মধ্যে।
[ ৩৬ ]
জমিদার অলিওর চৌধুরী’র মৃত্যু সংবাদ শুনে শতশত মানুষ জনের ভীড় পড়লো জমিদার বাড়িতে। রোমানার মৃত্যুর পর আরো একটি মৃত্যুর শোকে পাঁচফোড়ন গৃহের অবস্থা খুবই বেদনাপূর্ণ হয়ে ওঠলো। অঙ্গনের অবস্থা দ্বিগুণ খারাপ হয়ে গেলো৷ প্রণয় দু’জন নার্স’কে খবর পাঠাতেই তারা এসে অঙ্গন’কে সামলালো। এদিকে প্রেরণা,অরুণা দু’জনই ভীষণ ভেঙে পড়েছে। পল্লব, পলাশ আর প্রণয় মিলে সবটা সামলাচ্ছে। রঙ্গনের কথা ওঠতেই প্রেরণা জানিয়েছে তাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজে শহরে পাঠিয়েছে সে। তাকে যেনো কোনক্রমেই বাবার মৃত্যু সংবাদ না জানানো হয়। যদিও মা’য়ের বলা মিথ্যা কথাটি ধরে ফেলেছে প্রণয় কিন্তু তার মা কেন রঙ্গন’কে নিয়ে মিথ্যা বললো? তাহলে কি আড়ালে ভয়ংকর কিছু ঘটেছে? খালি চোখে যা সহজভাবে দেখা যাচ্ছে তার ভিতরেও কঠিন কোন সত্য রয়েছে? এসব প্রশ্ন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠলেও চুপ রইলো প্রণয়৷ সকল আত্মীয়, স্বজন, অলিওরের শহুরে বন্ধু-বান্ধব সকলের উপস্থিতি’তে জানাজা পড়িয়ে জমিদার বাড়ির গোরস্থানে কবর দেওয়া হলো অলিওর চৌধুরী’কে। বাড়ির বউদের দায়িত্ব দেওয়া হলো দুই শাশুড়ি মা’কে সামলানোর। শারমিন বাইজির কবর দেওয়া হলো বাইজি গৃহের পিছনে। যেখানে পূর্ব বংশের জমিদার’রা শতশত বাইজি’কে খুন করে মারিতে পুঁতে দিয়েছে সেখানেই জানাজা পড়ে স্বাভাবিকভাবে কবর দেওয়া হলো শারমিন’কে। যা পুরোটাই প্রণয় নিজ দায়িত্বে সম্পন্ন করেছে। পল্লব বা পলাশ কারোরি মত ছিলো না এতে। তাদের কথা ছিলো কোনরকম পুঁতে দেবে, তবে এতে ঘোর বিরোধিতা করে প্রণয় সম্মানের সঙ্গে জানাজা পড়ানোর ব্যবস্থা করে অতঃপর কবর দেওয়া হয়। বাইজি গৃহের সকল কার্যক্রম সাতদিনের জন্য বন্ধ থাকবে এটাও ঘোষণা করে দেয় প্রণয়৷ এতে পলাশ তীব্র প্রতিবাদ জানালে প্রণয় তাকে বেশ কঠিন গলায় সংযত থাকতে বলে।
বদ্ধ ঘরে নিশ্চুপ হয়ে বসে একধ্যানে নিজের হাতে থাকা তলোয়ারটির দিকে তাকিয়ে আছে শাহিনুর৷ অবিরতভাবে কাঁপছে তার হাতটি। তবুও চেষ্টা করছে নিজের হাতটিকে নিয়ন্ত্রণ করার। আজ চোখের সামনে নিজের মা’কে বাইজি গৃহের পিছনে কবর দিতে দেখলো সে। গতরাতে যে মানুষ’টার আদরে মাখামাখি হয়ে ছিলো,তীব্র জ্বরের ঘোরেও বারংবার যে মানুষ’টার স্নেহের স্পর্শ অনুভব করেছে, প্রানখুলে শেষবার যাকে আম্মা আম্মা ডেকে বিনিময়ে পেয়েছে মাতৃস্নেহ, একরাতের ব্যবধানে,দীর্ঘ তন্দ্রাঘোর কাটতেই যখন সেই মানুষ’টার ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত প্রাণহীন, নিথর দেহটি চোখের সামনে ভেসে ওঠলো, কলিজায় ঠিক কয়টা ছিদ্র হয়েছে জানেনা শাহিনুর। কিন্তু যে ক্ষত,যে ছিদ্র তার কলিজাতে হয়েছে এ জীবনে কোন কিছুর বিনিময়ে তা সারিয়ে তোলা সম্ভব নয়৷ রক্তেমাখা তলোয়ারটি আঁচল দিয়ে সযত্নে মুছতে মুছতে শাহিনুর বললো,
-‘ আম্মা তুমি অন্ধকারে ওখানে থাকতে ভয় পাচ্ছো? ভয় পেওনা আম্মা আমি এখুনি আসছি। ‘
দুর্বলচিত্তে ওঠে দাঁড়ালো শাহিনুর। মাথাটা কেমন ঝিম ঝিমিয়ে ওঠলো তার৷ তবুও পাত্তা দিলো না। গোপনীয় ভাবে তলোয়ারটি তুলে রেখে পা বাড়ালো মা’য়ের কবরের উদ্দেশ্যে। যদিও মান্নাত তাকে খুব বুঝিয়ে শুনিয়ে রেখে গিয়েছিলো। দরজা আঁটকে বসে থাকতে বলেছিলো। সে ব্যতিত কেউ এলে যেনো দ্বার না খুলে এ বিষয়ে কড়া নিষেধাজ্ঞাও করেছিলো৷ কিন্তু মাতৃহারা অবুঝ শাহিনুরের তখনো চৈতন্য ফেরেনি। শারমিনের অবর্তমানে মান্নাত কতটুকু নিরাপত্তা দিতে পারবে শাহিনুর’কে জানেনা। তবে সে পণ করেছে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ মূহুর্ত অবদিও সে নুরের পাশে থাকবে৷ তাই তো ঘরে এসে নুর’কে না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে শারমিনের কবরস্থানে ছুটে যায় সে৷ সেখান থেকে নুর’কে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘরে নিয়ে আসে৷ সারারাত মেয়েটা’কে বোঝায়। জীবন সম্পর্কে ধারণা দেয়। এজন্য অবশ্য তার জীবন বৃত্তান্তও পুনরায় আবৃত্তি করে।
[৩৭]
অলিওর শারমিনের মৃত্যুর চতুর্থ দিন আজ৷ রোজ রাতে মান্নাত’কে ফাঁকি দিয়ে মা’য়ের কাছে আসে শাহিনুর৷ কবরের ওপর মাথা রেখে কখনো নিশ্চুপ থাকে, কখনো বা অভিযোগ করে,কখনো আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। আজো এসেছে শাহিনুর৷ কবরের পাশে বসে মাথাটা কবরের ওপর রেখে শুয়ে আছে৷ দৃষ্টিজোড়া বদ্ধ। বাইজি গৃহে আজ চারদিন পর প্রবেশ করলো পলাশ৷ সকল বাইজিদের মুখে বিষাদ ভাব দেখে বিরবির করে কিছু গালিগালাজ করতে করতে শারমিনের ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। কারণ সে নিশ্চিত শাহিনুর’কে ঠিক সেখানেই পাবে৷ কিন্তু যখন শাহিনুর’কে পেলো না। তখন মান্নাত’কে ডাকলো। মান্নান শঙ্কিত হয়ে ছুটে এসে শাহিনুর’কে না পেয়ে কিঞ্চিৎ স্বস্তি পেলো। আবার দুঃশ্চিন্তাও হলো। পলাশ অশ্লীল ইশারায় মান্নাত’কে প্রশ্ন করলো,
-‘ নুর কোথায়? ‘
মান্নাত তেজি কন্ঠে বললো,
-‘ জানিনা আর জানলেও তোমাকে বলবো না। ‘
মান্নাতের এরূপ জবাবে আচমকা ক্ষেপে গিয়ে তার চুলের মুঠী শক্তহাতে চেপে ধরলো পলাশ৷ এক ধাক্কায় ঘরের ভিতর ধাক্কা দিয়ে ফেলে বাইরে থেকে দরজা আঁটকে দিলো। মান্নাত হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো দ্বারে কড়াঘাত করতে করতে বললো,
-‘ তুমি এমনটা করোনা পলাশ দোহাই তোমার। হে আল্লাহ তুমি নুরের সহায় হও। ‘
বিকৃত ভঙ্গিতে হেসে ওঠলো পলাশ চারিদক তাকিয়ে হুংকার ছাড়লো,
-‘ আমাকে ছাড়া এই দরজা কেউ খোলার সাহস দেখাবি তো শারমিন বাইজির বুকে পাঠাই দিব একদম। ‘

পুরো গৃহ তন্নতন্ন করে খুঁজলো পলাশ, কোথাও পেলো না নুর’কে। শেষে কি ভেবে যেনো পা বাড়ালো বাইজি গৃহের পশ্চাতে। জোৎস্নার রাত্রিতে কবরের পাশে চুপটি করে শুয়ে আছে শাহিনুর৷ স্বল্প আলোতে স্পষ্ট শাহিনুর’কে দেখতে পেয়ে মনে পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করলো পলাশ। নিঃশব্দে পা এগিয়ে একদম শাহিনুরের পিছনে হাঁটু গেঁড়ে বসলো। থেকে থেকে ফোঁপাচ্ছে শাহিনুর৷ যার ফলে থেকে থেকে তার শরীরও মৃদ্যুভাবে কাঁপছে। পরনে অতি সাধারণ একটি সুতি শাড়ি আঁচল পেরে মাটিতে শোয়ার ফলে ধবধবে ফর্সা মেদহীন কোমরের কিছু অংশ উন্মুক্ত হয়ে আছে। পলাশের অশ্লীল দৃষ্টিজোড়া সর্বপ্রথম সেখানেই পড়লো৷ এক হাঁটু মাটিতে গেঁড়ে বসে কিঞ্চিৎ মাথাটা ঝুঁকিয়ে ডান হাত বাড়িয়ে নিবিড়ভাবে খামচে ধরলো শাহিনুরের কোমল, মসৃণ কোমরে। মৃদ্যু সুরে আর্তনাদ করে ওঠলো শাহিনুর৷ বড়োসড়ো বলপূর্ণ হাতের থাবা এবং নখের আঁচড়ে কোমরের কিছু অংশে নখ ডেবে রক্তপাতও ঘটলো। পলাশ শাহিনুরের আঁতকে ওঠায়,মৃদ্যু আর্তনাদ শোনায় অশ্লিলভাবে অধর কামড়ে ধরলো। শাহিনুরের দিকে আরেকটু ঝুঁকে লম্বা এক নিঃশ্বাস নিলো। বললো,
-‘ আজ এই জোৎস্নামাখা রাতটি স্মরণীয় হবে তোমার আমার মাখামাখি তে! ‘

চলবে…..
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here