বাতাসা
শেষ পর্ব.
মাসখানেক পরের কথা। পরীক্ষা শেষে হল থেকে বের হচ্ছিল দিশা। লিও-কে আগে আগে হাঁটতে দেখে অনেকটা কথা বলার উদ্যোগেই পিছু নিলো তার। উঁচু স্বরে ডাকলো,
—“লিও, লিও দাঁড়াও। তোমার সাথে কথা আছে আমার। লিও, দাঁড়াও বলছি।”
লিও দাঁড়ালো। দিশা দু’কদম এগোতেই আবার কি মনে করে সেখান থেকে চলে যেতে লাগলো সে। আশ্চর্য হয়ে দিশা আবারো ডাকলো। কিন্তু এবার আর দাঁড়ালো না লিও। বড় বড় পা ফেলে চলে গেল বিস্তর মাঠ পেরিয়ে। দিশা আবারও পিছু নিতে গেলেই তার হাতে সরব টান পরলো। ভীষণ চমকালো সে। পাশ হতে জেনের থমথমে কণ্ঠ ভেসে আসলো,
—“সমস্যা কি? ওর পিছু নিচ্ছো কেন?”
জেনের হঠাৎ উপস্থিতি থতমত খাইয়ে দিলো দিশাকে। খানিকটা সময় লাগিয়ে আমতা আমতা স্বরে সে বললো,
—“কথা ছিল।”
—“কি কথা?”
—“ওর আর আমার মাঝে না চাইতেও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে জেন। তাছাড়া ও আমার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। আমার জন্য নিজের বন্ধুবান্ধবের সাথেও ঠিকভাবে কথা বলছে না। তাই আমাদের মাঝেকার ঝামেলা কথা বলে মিটিয়ে ফেলতে চাইছি আমি।”
বলে জেনের দিকে আশা ভরা দৃষ্টিতে তাকালো দিশা। ভাবলো, জেন হয়তো তাকে বাঁধা দিবে না, কিংবা যেতে বলবে। কিন্তু জেন কিছু না বলে বেশ কিছুক্ষণ নাক, মুখ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো তার মুখপানে। অসন্তুষ্ট আর বিরক্তি ভাব যেন চুইয়ে চুইয়ে পরছে তার সর্বাঙ্গ থেকে। পরমুহূর্তেই দিশার হাত শক্ত করে চেপে পার্কিং এরিয়ার দিকে যেতে লাগলো জেন। দিশা হকচকালো। হাতের বাঁধন ছাড়াতে ছাড়াতে বাঁধা দিয়ে বললো,
—“কি করছো কি জেন? ছাড়ো আমাকে। এমন করছো কেন?”
প্রবল আক্রোশে জেন মুখ খুললো এবার, “তুমি কি চাচ্ছো আমি জেলাস হয়ে মারাত্ত্বক কিছু ঘটিয়ে ফেলি?”
দিশা আবারও হকচকালো। দিরুক্তি করে বললো,
—“না।”
—“তাহলে চুপ থাকো। নয়তো ব্যাংলাডেস যাওয়া ক্যানসেল!”
ততক্ষণে গাড়ির ডান পাশের দরজা খুলে দিশাকে জোড় করে বসিয়ে দিয়েছে জেন। অপর পাশের দরজা খুলে সেও ভেতরে ঢুকতেই দিশা অসহায় কণ্ঠে বললো,
—“আচ্ছা ঠিক আছে, লিওর সাথে কথা বলবো না। কিন্তু রিক আর লিয়ার সাথে তো কথা বলতে পারি, তাই না? বিদায় নিয়ে আসি?”
—“ফোন আছে কথা বলার জন্য। ফোনেও বিদায় নেওয়া যায়।”
অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো দিশা,
—“এটা কেমন কথা জেন?”
রেগে তাকালো সে। একরোখা ভাবে উত্তর দিলো, “যেতে হবে না ব্যাংলাডেশ। বিদায়ও নিতে হবে না। হানিমুনে অন্য জায়গায় যাবো আমি। নোট করে রাখো।”
দিশা ঠোঁট উলটে তাকালো। কিছু বলতে চাইলেও জেনের রাগী মুখশ্রী দেখে আর বলার সাহস পেল না। মনের খুব গোপনে ফুঁসতে ফুঁসতে ভাবলো, “দ্যা হ্যান্ডসাম বাতাসাকে আমি একটুও ভয় পাই না। এক চিমটি লবণ সমানও ভয় পাই না!”
_____
স্যুপের বাটি থেকে একচামচ স্যুপ পান করে রুমাল দিয়ে ওষ্ঠের আশপাশ মুছতে মুছতে রবার্ট এন্ডারসন বললেন,
—“তোমাদের পরীক্ষা তো আজ শেষ। বাংলাহডিশ যখন যাচ্ছ তোমরা?”
জেন খেতে খেতে উত্তর দিলো,
—“কাল সকালে ফ্লাইট।”
শুনে রবার্ট নিঃশব্দে কয়েকবার মাথা দোলালেন। দিশার দিকে তাকিয়ে বললেন,
—“তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে, বুঝলে রিহটিয়া? আমরা মিস করবো তোমায়।”
দিশা মুচকি হেসে প্রফুল্ল কণ্ঠে বললো,
—“জি ড্যাড।”
ওদিকে তাদের দেখে মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হলেন ইলিনা। যতসব আদিখ্যেতা!
জেনের খাওয়া শেষ হলো তার কিছুক্ষণ পরই। দিশা তখনও আস্তে-ধীরে, একটু একটু করে চামচ হতে স্যুপ পান করছিল। চেয়ার ছেড়ে উঠার আগে জেন তখন তার কানে খুব আস্তে করে বললো,
—“তাড়াতাড়ি আসো। কাজ আছে।”
দিশা আড়চোখে জেনের দিকে তাকালো মাত্র। অভিব্যক্তি দ্বারা বিশেষ কিছুই বোঝালো না। তারপর অনেক রয়েসয়ে, সময় লাগিয়ে রুমে ঢুকলো সে। জেন তখন ভীষণ রেগে বিছানায় বসে ছিল। ফর্সা হলে এই এক সমস্যা! একটুখানি রাগলেই নাক, মুখ লাল হয়ে কি নিদারুণ ভয়ংকর দেখায়। জেনকেও ঠিক তেমনই লাগছে। দিশা প্রথমে একটু ভয় পেলেও পরে নিজেকে ধাতস্ত করলো। চুপচাপ ট্রলিব্যাগ নিয়ে আলমারি থেকে কাপড় নিয়ে গোছাতে লাগলো।
এতে যেন জেন আরও রেগে গেল। ফুঁসে উঠে বললো,
—“আমি যে রেগে এখানে বসে আছি, তুমি দেখছ না?”
—“দেখছি।”
—“তাহলে রাগ ভাঙাচ্ছো না কেন?”
কাপড় রেখে দিশা জেনের দিকে তাকালো,
—“কেন ভাঙ্গাবো? তুমি সকালে আমার রাগ ভাঙ্গিয়েছিলে? উলটো কত ধমকাধমকি করলে!”
—“তাই বলে তুমি আমার রাগ ভাঙ্গাবে না? আমি না তোমার হ্যাসবেন্ড?”
—“হও। তবুও আমি তোমার রাগ ভাঙ্গাবো না।”
জেন কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো দিশাকে। যখন বুঝলো দিশা আসলেই রেগে আছে তখন আর দেড়ি না করে এগিয়ে এলো দিশার কাছে। চট করে পাজাকোলে তুলে নিলো। তারপর বারান্দার রেলিংয়ের সঙ্গে একদম ঘেঁষে দাঁড় করালো দিশাকে। সে দাঁড়ালো তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে চুপ করে রইলো অনেক্ষণ। দু’জনের অভিমান নিমিষেই গলে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। কিন্তু দিশা কেমন মন খারাপ করে তাকিয়ে আছে বিস্তর নভস্থলে। তা দেখে জেন প্রশ্ন ছুঁড়লো,
—“কি হয়েছে? মন খারাপ কেন? রাগ এখনো কমে নি?”
—“কমেছে।”
—“তাহলে?”
দিশা মন খারাপ করে জবাব দিলো,
—“তুমি কি শুধুমাত্র আমার জন্যই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছ জেন? আল্লাহ্-কে ভয় পেয়ে করো নি?”
প্রতিউত্তরে দিশাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জেন বললো,
—“আমি কারো জন্য নিজের ধর্ম এমনি এমনি ছাড়বো না দিইইসা। ইসলাম ধর্মের প্রতি আমার প্রথম থেকেই অনেক ইন্ট্রেস্ট ছিল। রাফসান থেকে প্রায় সবসময় নবী-রাসূলের গল্প শুনতাম। এভাবে আগ্রহটা আরও বেড়ে যায়। তবে তোমাকে দেখার পর আমার মনে ধর্ম নিয়ে আসলেই দ্বিধা জন্মেছিল। মিথ্যা বলব না। তোমার জন্যই আমি একবার মসজিদ ঘুরে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মসজিদে ঢোকার পর আমি যে শান্তি অনুভব করেছিলাম আর মুসল্লিদের নামাযের প্রতি যে গুরুত্ব, আল্লাহ্-র ইবাদতে মশগুল বান্দাদের দেখে আমি আলাদা এক প্রশান্তি পাচ্ছিলাম দিইইসা। আল্লাহ না করুক, তুমি যদি আমার নাও হতে তবুও আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতাম এবং তা সঠিক ভাবে পালন করতাম এবং করছি। ইসলাম ধর্ম আমার কাছে আমার প্রাণ দিইইসা।”
জেনের উত্তর শুনে বিমোহিত হলো দিশা। ওষ্ঠে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
জেন ভ্রু কুঁচকালো। জিজ্ঞেস করলো,
—“হাসছো কেন?”
—“উত্তর পেয়ে গেছি, তাই।”
নিজেদের মাঝের অবশিষ্ট দুরত্বটাও ঘুচিয়ে জেন বললো,
—“আচ্ছা। আমি তো তোমার রাগ ভাঙ্গালাম। এবার তুমি আমার রাগ ভাঙ্গাও।”
গাল জোড়া লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো তার। সেকথার উত্তর না দিয়ে বললো,
—“রাফসান ভাইয়া কাল আমাদের সাথে যাবেন না?”
জেন রাগ দেখালো,
—“চুপ! কথা বলবে না। চুপচাপ রাগ ভাঙ্গাও।”
স্পর্শের প্রগাঢ়তা বেড়ে গেল। বাড়লো নিশ্বাসের আনাগোনা।
_____________
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
আল্লাহ হাফেজ❤