বাতাসা (১৭)
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
______________________
বেঞ্চের সঙ্গে ঠেসে বসে আছে দিশা। কান্নারত চোখ দু’টো বিরতি পেয়ে আরো লালাভ রঙ ধারণ করেছে। শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুকণাগুলো গালে কেমন দাগ কেটে আছে। অনুভূতি শূণ্য লাগছে তাকে। শূণ্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সবুজ,সতেজ গাছের দিক। তার পাশেই বসে আছে জেন। মুখে গম্ভীর্য তার। গম্ভীর মুখে প্রশ্ন ছুঁড়লো সে, ‘আমাকে আগে বলো নি কেন দিইইশা?’
সঙ্গে সঙ্গে প্রাণহীন গলায় দিশা জবাব দিলো, ‘তোমার মা মানা করেছিল তাই।’
জেনের মেজাজ গরম হয়ে গেল। রুক্ষ গলায় চেঁচালো সে, ‘মানা করলে করবে। আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজন বোধ করবে না? এতটাই তুচ্ছ আমি তোমার কাছে?’
জেন রাগে ফুঁসছে। দিশা নিশ্চুপ। ভুল করেছে সে। স্বীকার করছে! কিন্তু ভুলটা সুধারাবে কিভাবে? দিশার বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। জেনের দিকে মুখ তুলে তাকালো সে। বললো, ‘আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে হ্যান্ডসাম বাতাসা? একটু?’
জেন চমকালো। ভীষণ ভাবে চমকালো। বুকের পাহাড়সহ পাথরটা আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগলো যেন। সময় ব্যয় না করে জড়িয়ে ধরল দিশাকে। বুকের সঙ্গে চেপে ধরল। একদিকে শান্তিতে মনটা ভরে গেলেও, অন্যদিকে মস্তিষ্ক পুরো বিষিয়ে গেছে তার। অস্থির, অস্থির অনুভূত হচ্ছে! জেন বিড়বিড় করে বললো, ‘কেন করলে এমন দিইইইশা? শুধু শুধু এতদিন কেন কষ্ট দিলে? কিছুক্ষণ আগেও আমার অনুভূতি কেমন ছিল জানো? মনে হচ্ছিল আমি নরকের যন্ত্রণায় ভুগছি। এই বুঝি মরে যাবো!’
জেন থামলো। দিশা তার দু’হাতের বাঁধনে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো জেনকে। মৃদু কম্পিত গলায় বললো, ‘I am sorry Zen! I am really really sorry! And I love you so much!’
কথার উল্টো পিঠে জেন আর কিছু বললো না। দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো মাত্র!
——————————-
ভার্সিটি শেষে দিশাকে হোস্টেলে পৌঁছে দিচ্ছে জেন। রাফসান আগে আগেই চলে গেছে তার হোস্টেলে। গাড়িতে পিনপতন নীরবতা। জেন গম্ভীরমুখে ড্রাইভ করছে। তার দিকে বারংবার আড়চোখে দেখছে দিশা। কিছু বলার জন্য উসখুস করছে। জেন বাঁকা চোখে খেয়াল করে ব্যাপারটা। কণ্ঠে গভীর গাম্ভীর্য ঢেলে জিজ্ঞেস করে, ‘কি হয়েছে? এমন করছো কেন? কিছু বলবে?’
দিশা মাথা নাড়িয়ে নাকচ করলো ঠিকই, কিন্তু সত্যি বলতে তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। জেনের রাগ ভাঙ্গাতে ইচ্ছে করছে। কিছুক্ষণ নিজের মাঝে আড়াআড়ি করে শেষে দিশা বলেই ফেললো, ‘তুমি কি এখনো রেগে আছ জেন?’
জেন কণ্ঠে শীতলতার শ্লেষ মাখিয়ে বললো, ‘আমি কখনো তোমার উপর রেগে ছিলাম না দিইইশা। যা আছে তা শুধুই অভিমান।’
দিইইশা অবাক হওয়ার ভান করে বললো, ‘আছে? মানে এখনো অভিমান করে আছ?’
‘হ্যাঁ।’ জেনের স্পষ্ট জবাব। জবাবটা দিয়েই আর কথা বলে নি জেন। এমনকি দিশা কথা বলতে চাইলেও না। দিশার আবারো কান্না পেয়ে যায়। অশ্রুকণাগুলো বাঁধ মানছে না কেন যেন! অশ্রু লুকাতে জানালার দিকে ফিরে বসে দিশা। তবুও জেনের চোখে ফাঁকি দিতে পারে না। জেন দেখেও না দেখার ভান করে। মন দিশাকে কাছে টানতে চাইলেও সূক্ষ্ণ অভিমানগুলো বাঁধা দিচ্ছে। অটল রইছে নিজের সিধান্তে।
দিশাকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে নিজ বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয় জেন। তার মেজাজ তখনো গরম। মায়ের প্রতি ভীষণ রকমের রাগ হচ্ছে। তাকে না জানিয়ে তিনি এমন কিভাবে করতে পারলেন? কিভাবে? ছেলের কষ্ট দেখেও কি একটু মায়া হয়নি?
জেনের মা ইলিনা এন্ডারসন ড্রইংরুমে বসে ল্যাপটপে কি যেন করছিলেন। জেনকে সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। উঠে দাঁড়ালেন তিনি। কিছু বলবেন তার আগেই জেন ইলিনা এন্ডারসনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে খুবই গম্ভীর ভাবে কাঠকাঠ গলায় বললো, ‘তোমাকে বলা হয় নি মম। কিছুদিন হলো দিইইশা এসেছে লান্ডানে। এন্ড আই ডিসাইডেড টু মেরি হার এস সুন এস পসিবল!’
ইলিনা এন্ডারসনের মুখের হাসি মুহুর্তেই বিলিন হয়ে গেল। কি বলবেন ভেবে পেলেন না। একরাশ চিন্তা আর ভীতি কাজ করতে লাগলো সারা মুখশ্রী জুড়ে। তা দেখে জেন ঠোঁট এলিয়ে হাসলো।
_____________________________
চলবে…
★