বাদলা দিনের কৃষ্ণচূড়া পর্ব -০৮

#বাদলা_দিনের_কৃষ্ণচূড়া❤️
#লেখনীতে:সারা মেহেক

ভিজে চুপচপে পোশাকের ফলে প্রবাহমান হাওয়া স্বাভাবিকের তুলনায় যথেষ্ট শীতল বোধ হলো সুহানার নিকট। ভ্যানের চলার বিপরীত দিক হতে শোঁ শোঁ বহমান হাওয়ায় সুহানা শীতে চুপসে এলো যেনো৷ নাজের অগোচরে শীতে দাঁতে দাঁত মিলিয়ে কিটকিট শব্দ করতে লাগলো সে। নাজ যে তার এ কান্ড দেখেনি এমনটা নয়। সে দেখেছে। তবে সুহানা যেনো লজ্জায় না পড়ে সেজন্য সে চুপচাপ বিষয়টি অগ্রাহ্য করে গিয়েছে।

দ্রুতই বাড়ি পৌঁছে গেলো সুহানা। ভ্যান থামলো ঠিক তাদের বাড়ির সামনে। ভ্যান থামতে না থামতেই সে নাজকে কিছু না বলেই বাড়িতে প্রবেশ করলো। তাড়াহুড়ায় ভুলবশত নাজের শার্টটাও নিজের সাথে নিয়ে গেলো সে। আর আমের থলিটাও ভুলবশত রেখে গেলো ভ্যানে। তার এ তাড়াহুড়ো ভাবের কারণে নাজও আগ বাড়িয়ে শার্টটি আর চেয়ে উঠতে পারেনি।
নাজ ভ্যানওয়ালা চাচাকে বললো,
” চাচা, আপনি সরদার বাড়ি চিনেন?”

” চিনি বাজান। ঐহানে যাইবা?”

” হ্যাঁ চাচা। ”

ভ্যানওয়ালা চাচা ভ্যানে প্যাডেল মারলো।
সবুজ সবুজ ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে কাঁচাপাকা গ্রাম্য রাস্তা। সে রাস্তা ধরেই আপন গতিতে ছুটে চলছে ভ্যান। নাজ মুগ্ধ চোখে বর্ষণ পরবর্তী পরিবেশ দেখে চলছে। ক্ষেতের ধানগুলোর উৎফুল্ল নাচন দেখতে তার ভীষণ ভালো লাগছে। তার কানে এসে বাড়ি খাচ্ছে বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ। এই গ্রাম্য পরিবেশে শীতল মাতাল হাওয়া আপন মনে উপভোগ করছে সে। মনে হচ্ছে সে বুঝি চলে গিয়েছে কোনো অপার্থিব বস্তু ও পরিবেশের জগতে।
হঠাৎ ভ্যানওয়ালা চাচার প্রশ্নে নাজ সম্বিত ফিরে পেলো। ভ্যানওয়ালা চাচা জিজ্ঞেস করলেন,
” ঐডা ওমর মোল্লার মাইয়া না?”

নাজ বললো,
” জি চাচা। ”

” ওয় আপনার কিছু হয়?”
ভ্যানওয়ালা চাচার কণ্ঠে ক্ষীণ সন্দেহের ছাপ। নাজ এবার পড়লো বিশাল ভাবনায়। সুহানা আসলে তার কি হয়? ফুপাতো ভাবীর বোন? এই তাদের সম্পর্ক? নাজ এ নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলো৷ অতঃপর জবাব দিলো,
” আসলে কিভাবে বলবো…… ওর ছোট বোন আমার ফুপাতো ভাই মানে রায়হান সরদারের হবু বউ। সে সুবাদেই দেখাসাক্ষাৎ। ”

” তাইলে ঘুরাফিরার করার মতন কিছু হোন না আপনেরা, তাই তো?”

ভ্যানওয়ালা চাচার এ প্রশ্নের জবাবে বিপাকে পড়ে গেলো নাজ। কি জবাব দিবে সে? ‘হ্যাঁ’ বলতে কেমন বিবেকে বাঁধে। আবার ‘না’ বলা অর্থ আরেক প্রশ্নের জবাব দেওয়া। তাই কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে সে ক্ষীণ কণ্ঠে বললো,
” হ্যাঁ।”

ভ্যানওয়ালা চাচা কান খাড়া করে নাজের ক্ষীণ কণ্ঠের জবাবও শুনে ফেললেন। মনে মনে ঠিক করলেন, আজই ওমর মোল্লার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবে সে। মূলত ওমর মোল্লা ও এ ভ্যানওয়ালা চাচা রহিম মিয়া পাশাপাশি জমিতে কাজ করে। যদিও রহিম মিয়া বর্গা চাষ করেন আর ওমর মোল্লা নিজ জমিতে চাষাবাদ করেন। সে সুবাদেই তাদের পরিচয়। আর দরিয়া গ্রাম ছোট হওয়ায় এখানকার প্রায় প্রতিটি মানুষই একে অপরের পরিচিত। সে হিসেবে ওমর মোল্লার মেয়ে হিসেবে সুহানাকে চিনতে খুব একটা সময় নেয়নি রহিম মিয়া।

.

চুপিসারে বাড়িতে প্রবেশমাত্রই গোসলখানায় ঢুকে পড়ে সুহানা। গোসলখানার দরজার আড়াল দিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে পুরো উঠোনটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলো সে। নাহ, মা নেই৷ বোধহয় ঘুমিয়ে আছে। তাহলে নিশ্চয়ই তাকে বাইরে থেকে আসতে দেখেনি। এই ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। গোসলখানার নিকটেই নিজেদের ঘর থাকায় গলা খাদে নামিয়ে সাগরিকাকে ডাকতে লাগলো সুহানা। দু ডাকেই রুম থেকে চলে এলো সাগরিকা। সুহানাকে এ সময়ে গোসলখানায় দেখে চোখ কপালে তুললো সাগরিকা। জিজ্ঞেস করলো,
” বুবু! এ সময়ে গোসলখানায় কেনো তুই?”

সুহানা সতর্ক কণ্ঠে বললো,
” সে পরে বলছি। আগে আমার সালোয়ার কামিজ এগিয়ে আমাকে। ”
সাগরিকা আর বাড়ালো না। ঘর হতে সুহানার পোশাক এনে তার হাতে ধরিয়ে দিলো।

গোসলখানা হতে বের হতে না হতেই সুহানাকে ঘিরে ধরলো সাগরিকা। জিজ্ঞেস করলো,
” কোথায় ছিলি তুই এতোক্ষণ? আম্মা তোকে কতক্ষণ ধরে খুঁজছিলো! ”

সুহানা এসবের তোয়াক্কা করলো না। বললো,
” পরে বলছি তোকে। আগে একটু জিরিয়ে নেই। ”

এরই মধ্যে সাগরিকার নজর পড়লো চেক চেক একটা পোশাকের উপর। সুহানার হাতের কাচা কাপড়গুলোর মধ্যে থেকে সে একটানে সেই পোশাক বের করে মেলে ধরলো সে। একি! এটা তো শার্ট! সুহানার কাছে ছেলেদের শার্ট দেখে চোখ কপালে তুললো সাগরিকা। কণ্ঠে আকাশসম বিস্ময় মিশিয়ে বললো,
” এ কার শার্ট নিয়ে এসেছিস বুবু!”

সাগরিকার এমন উচ্চ কণ্ঠ শুনে সুহানা তাকে সতর্ক করলো। বললো,
” আরে বলছি বলছি। তুই গলার স্বরটা একটু নিচে নামা। নাহলে এবার পাক্কা ফেঁসে যাবো। ”

সাগরিকা সতর্ক হলো। এরই ফাঁকে সুহানা কেচে দেওয়া কাপড়গুলো নেড়ে দিলো। ফাঁকে ফাঁকে সাগরিকাকে শুনালো প্রতিটি ঘটনা৷ সুহানার মুখে ঘটনাপ্রবাহ শুনে সাগরিকার যেনো হুঁশই উড়ে গেলো।

.

কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে আছে সুহানা ও নাজ। বাতাবরণে মৃদুমন্দ সমীরণের উপস্থিতি। মাঝে মাঝে এক ঝাঁক দমকা হাওয়া এসে বৃক্ষের পত্রপল্লবকে নিজের সুরে নাচিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সে সুরে রক্তিমাভাব কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষও নৃত্য করছে। নৃত্যের আনন্দে বর্ষিত করছে নিজের একান্ত সৌন্দর্যের ফুলগুলো। বৃক্ষ হতে ঝড়ে ঝড়ে সে ফুলগুলো গিয়ে পড়ছে পুকুরের পানিতে, ঘাটের চারপাশে।
সুহানা ও নাজ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। সুহানার হাতে নাজের শার্ট আর নাজের হাতে আমের থলে। নাজই বিকেলের দিকে বেরিয়েছিলো সুহানাকে আমের থলেটা দিতে। সে গিয়ে প্রথমেই সুহানার ঘরের বাইরের জানালায় করাঘাত করে। সুহানা চমকে জানালা খুলতেই নাজকে দেখে আরো চমকে যায়। নাজ তাকে আমের থলে দেওয়ার কথা বলে বেরিয়ে আসতে বললে সেও নাজের আধভেজা শার্ট নিয়ে বেরিয়ে পরে। রশিদা বেগম পাশের গ্রামে নিজের বোনের বাড়িতে যাওয়ায় সুহানার তখন বাড়ি হতে বের হতে অসুবিধা হয়নি।

আলতো হাওয়ার ঝোঁকে সুহানার মাথার উপর হতে ওড়না সরে গেলে সে দ্রুত ওড়না ঠিক করে মাথায় নিয়ে নেয়। অতঃপর নাজের দিকে শার্টটা এগিয়ে ধরে বললো,
” মাফ করবেন, আপনার শার্টটা এভাবে নিয়ে গিয়েছিলাম বলে। আসলে…..”

নাজ মাঝপথে সুহানাকে থামিয়ে বললো,
” মাফ করার কি আছে। তখন তোমার দরকার ছিলো বলেই শার্টটা দিয়েছিলাম। ”
এই বলে সে সুহানার দিকে আমের থলেটা এগিয়ে দিতেই সুহানা তা নিয়ে নেয়। আর নাজ নিয়ে নেয় নিজের শার্টটা। অতঃপর জিনিসপত্রের আদান-প্রদান হতেই দুজনে মৌনব্রতে চলে যায়। কেটে যায় ক্ষণিক সময়। সুহানা পাশ ফিরে দেখতে থাকে কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষটি আর নাজ দেখতে থাকে সুহানাকে। সুহানা স্পষ্ট টের পাচ্ছে নাজ তাকে দেখছে। কিন্তু এ ব্যাপারটি সরাসরি বলে নাজকে নিষেধ করতে পারছে না সে। দৃষ্টিকটু দেখায় বলে। এদিকে সে চলে যেতেও পারছে না। যেনো
এক অদৃশ্য শক্তি তার চলন শক্তি থমকে দিয়েছে।

নাজ সুহানাকে দেখছে। নিষ্পলক দেখছে। আজ যেনো সুহানার এ সাধারণের মাঝে অসাধারণ স্নিগ্ধ রূপ তাকে বেশি আকৃষ্ট করছে। সুহানার প্রতি তার এ মুগ্ধতা আরো বাড়িয়ে দিতেই যেনো হাওয়ায় উড়ে এসে দুটো কৃষ্ণচূড়া ফুল সুহানার মাথার উপর পড়লো। যেনো আজ প্রকৃতিও চাইছে সুহানার প্রতি নাজের এ মুগ্ধতা মাত্রা ছড়িয়ে যাক, ভালোলাগা অচিরেই ভালোবাসায় পরিণত হোক।

সুহানা বেশ কিছুক্ষণের প্রচেষ্টায় নিজের মাঝে অনুবল সঞ্চার করতে পারলো যেনো। সে পা বাড়িয়ে স্থান ত্যাগ করতে উদ্যত হলো। কিন্তু এর পূর্বেই নাজ তার মাথায় হাত দিলো। চুলে আটকে থাকা কৃষ্ণচূড়া ফুলটি আলতো করে টেনে নিজের হাতের তালুয় নিয়ে নিলো। অতঃপর সুহানার দিকে হাত বাড়িয়ে মুচকি হেসে বললো,
” এটা তোমার কানে গুঁজে নাও। ভীষণ সুন্দর লাগবে তোমায়। ”

নাজের হেন কথায় সুহানা শিউরে উঠলো। নাজ যে নিজের সীমা অতিক্রম করে চলছে তা ঢের টের পাচ্ছে সে। নাহ, এখানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। হঠাৎ সুহানার মনে ভয় জাপটে ধরলো। লোকমুখের কথার ভয়। দুজন অবিবাহিত ছেলেমেয়ে একসাথে দাঁড়িয়ে আছে, এ ঘটনাকে তিল থেকে তাল বানাতে সময় নিবে না গ্রামবাসী। এ ভাবতেই সুহানার বুক ধক করে উঠলো। গলা শুকিয়ে এলো। সে এখনই চলে যেতে উদ্যত হলো।

সুহানা নাজকে কিছু না বলে ঘাট হতে নামতে নিলো। কিন্তু তখনই সেখানে সিরাজ মাস্টারের আগমন ঘটলো। কাজে শিক্ষক হলেও সিরাজ মাস্টারের কাজ অন্যের বিষয়ে নাক গলানো। গ্রামের ছোটবড় ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঝামেলা সৃষ্টি করাই যেনো তার প্রধান ও একমাত্র কাজ। স্কুলে কাজ শেষে ছাতা হাতে হেটেঁ আসছিলেন তিনি। দূর হতেই ঘাটে সুহানাও নাজকে লক্ষ্য করেন তিনি। তার মনে সন্দেহ জেগে উঠে সুহানাকে নিয়ে। এজন্যই দ্রুত ঘাটের কাছে এসেই সুহানাকে একপ্রকার পাকরাও করে ফেললেন সিরাজ মাস্টার। চট করে প্রশ্ন করে বসলেন,
” তোমার সাথেই এই পোলাডা কে গো মাইয়া?”

সিরাজ মাস্টারকে দেখে এবং এ প্রশ্ন শুনে কলিজার পানি যেনো শুকিয়ে এলো সুহানার। চেহারায় দেখা মিললো তীব্র আতঙ্ক। মনে মনে বার কয়েক কপাল চাপড়ে নিলো সে। ইস,শেষ রক্ষাটাও হলো না তার!
সুহানা সিরাজ মাস্টারের প্রশ্নের জবাব দিলো না। বরং নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলো। সিরাজ মাস্টার নাকের ডগা হতে চশমাটা আরো একটু উপরে উঠিয়ে নিলেন। এক নজর নাজের দিকে চেয়ে পুনরায় তীক্ষ্ণ সন্দেহের সুরে সুহানাকে জিজ্ঞেস করলেন,
” তুমি ওমর মোল্লার মাইয়া না? বড়ডা?”

সুহানা এবারও জবাব দিলো না। বরং এক দৌড়ে ঘাট পেরিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুট লাগালো। এদিকে নাজ নির্বাক দাঁড়িয়ে সুহানা ও সিরাজ মাস্টারের এক পাক্ষিক কথোপকথন দেখলো। সিরাজ মাস্টারের এরূপ সন্দেহজনক প্রশ্নের তোড়ে সে ধরেই নিলো সিরাজ মাস্টার তাদের সন্দেহ করেছে। এজন্য সে আগ বাড়িয়েই বললো,
” চাচা, আপনি যা ভাবছেন এমন কিছুই হয়নি এখানে৷ আপনি শুধু শুধু ভুল বুঝবেন না আমাদের।”
নাজের এ আগ বাড়িয়ে বলা আত্মরক্ষামূলক কথা শুনেই সিরাজ মাস্টারের সন্দেহ দ্বিগুণ হলো। তিনি ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত করে নাক সিঁটকে বললেন,
” এর মানে আমি যা ভাবছি তাই হইছে।
তুমি কার পোলা? দেইখে তো মনে হইতেছে এ গ্রামের মানুষ না তুমি। ”

নাজ বেচারা গেলো ফেঁসে। এ কথা বলে সে যে নিজ পায়েই নিজে কুড়াল মেরেছে তা সময়মতো বুঝে উঠতে পারেনি সে। তার এ বুঝ এসেছে সিরাজ মাস্টারের করা প্রশ্নে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নাজ তখন জবাব দিলো,
” আমি রায়হান সরদারের মামাতো ভাই। ওর বিয়েতে এসেছি। ”

সিরাজ মাস্টারের সন্দেহ আরো গাঢ় হলো। তিনি এক চোখ উঁচিয়ে বললেন,
” ওমর মোল্লার ছোট মাইয়ার সাথে রায়হান সরদারের বিয়ে না?”

” জি হ্যাঁ।”

“হইছে। যা বুঝার বুঝে গেছি।”
এই বলে সিরাজ মাস্টার সে স্থান ত্যাগ করলেন। নাজের মনে ঢুকিয়ে গেলেন অদৃশ্য ভয়।
®

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here