#বাসন্তীগন্ধা
|১৩| [কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
লাবিবা ওয়াহিদ
———————-
জ্যুতি এই অসময়ে একদমই আশা করেনি সাইয়ানের ফুপিকে। ফুপির ডানপাশে সাইয়ান। এটা সেই ফুপি যে প্রতিদিন খাবার পাঠাতো সাইয়ানকে। বর্তমানে ফুপি সাইয়ানের কান ধরে বেশ তেঁজী নজরে চেয়ে আছে জ্যুতির দিকে। সাইয়ান বারংবার ফুপিকে তাঁর কান ছেড়ে দিতে বলছে। সে হচ্ছে পরিবারের বড়ো ছেলে। তাকে এই অবস্থায় ছোটরা দেখলে কী মনে করবে? কিন্তু ফুপি কিছু শুনলে তো! জ্যুতি এতক্ষণে ফুপির বামপাশে খেয়াল করলো। এক সুন্দরী মেয়ে তার পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
নিচে চাপা গুঞ্জন শুনে রোকসানা ব্যতীত একে একে সবাই-ই নেমে আসলো। মাঝ রাতে ওদের দেখে সকলেই চমকালো। বড়ো ভাই আইয়ুবকে দেখতে পেয়ে সাইয়ানের কান ধরেই ভেতরে প্রবেশ করলো ফুপি। মেয়েটি সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। আইয়ুব সাহেব কিছু বলার প্রস্তুতি নিতে না নিতেই ফুপি বলে ওঠে,
–“ছেলেকে দূরে পাঠিয়েছেন অথচ ছেলে কী করছে না করছে সেই খবর আদৌ রেখেছেন ভাই?”
চিন্তায় ভ্রু কুচকে গেলো আইয়ুব সাহেবের। সাইয়ান আবার কী করতে যাবে? সাইয়ান তখন চাপা স্বরে বলে ওঠলো,
–“ফুপি, প্লিজ কান ছাড়ো!”
–“কেন ছাড়বো? লজ্জা করছে বুঝি? না বলে বিয়ে করার সময় লজ্জা লাগলো না?”
উপস্থিত সকলেই বাকরুদ্ধ হয়ে যায় ফুপির কথায়। জ্যুতি তো বিমূঢ় হয়ে মেয়েটির দিকে তাকালো। মেয়েটি হাত দুটো শক্ত করে মুঠোবদ্ধ করে রইলো। নজর তাঁর পায়ের দিকে। সে একবারও মাথা উঁচু করে তাকানোর সাহস পায়নি! আইয়ুব সাহেবের পাশে দাঁড়ানো সোহেল সাহেব ভ্রু কুচকে বললো,
–“বিয়ে মানে?”
–“বিয়ে মানে বিয়ে। সাইয়ান বিয়ে করেছে দরজার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির সাথে। ভাগ্যিস আমি নিজ হাতে ধরেছিলাম, নাহলে তো তোমার ছেলে এখন কিছু জানাতোই না!”
সব শুনে আইয়ুব সাহেব কঠিন চোখে চাইলো সাইয়ানের দিকে। সাইয়ান নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আইয়ুব গলার স্বরে অত্যন্ত শান্ত রেখে বললো,
–“সাইয়ান, তোমার ফুপি যা বলছে তা কী সত্য?”
সাইয়ান নীরব থেকে বললো,
–“হুট করে সব হয়ে গেছে বাবা। জানানোর সময় পর্যন্ত পাইনি!”
পীনপতন নীরবতায় ছেয়ে গেলো পুরো লিভিংরুম। স্তব্ধ সকলে সাইয়ান এবং মেয়েটির দিকে চাওয়া-চাওয়ি করছে। জ্যুতি কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলো মেয়েটির দিকে। চাপা স্বরে বললো,
–“তুমি তাহলে আমার সাইয়ানের বউ?”
রোজা নতমুখে মাথা নাড়ায়। রোজার চিবুক ছুঁতেই জ্যুতি অনুভব করলো মেয়েটি ভীষণরকম কাঁপছে। জ্যুতি কিছুটা উত্তেজিত হলো। কিছু বলার পূর্বেই রোজার চোখ বুজে এলো, জ্ঞান হারিয়ে সেখানেই পরে গেলো। মেহের রোজাকে পরে যেতে দেখে অস্ফুট স্বরে চেঁচালো,
–“ভাইয়া, আপুটা লেন্সলেস হয়ে গেছে!”
রোজাকে সেন্সলেস হতে দেখে আইয়ুব সাহেব কিছু বলার আর সুযোগ পেলেন না। সকলে রোজাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো।
———————
রোজা চোখ মেলে চাইতেই নিজেকে এক অচেনা রুমে আবিষ্কার করলো। তার পাশেই বসে আছে আরেকজন অচেনা মেয়ে। রোজা আস্তে-ধীরে উঠে বসলো। উঠে বসাতে অপেক্ষা করলো মেহের। মেহের মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলে,
–“এখন কেমন লাগছে ভাবী?”
মেহেরের মুখে ভাবী ডাক শুনে রোজা কিছুটা লজ্জা অনুভব করলো। আলতো স্বরে বললো, “ভালো!”
মেহের হেসে বললো,
–“লজ্জা পাচ্ছো কেন ভাবী? আমি তো তোমার-ই ননদ। ভাইয়া তো নই!”
রোজা নজর নামিয়ে ফেললো এমন কথা শুনে। মেহের আবার বললো,
–“আমার নাম মেহের। তুমি এখন আমার রুমেই আছো!”
রোজা আশেপাশে তাকালো। রুমে মেহের ছাড়া কাউকে দেখতে পেলো না। মেহেরের আচরণে রোজা সন্তুষ্ট। তাই রোজা মনে সাহস জুগিয়ে বললো,
–“সকলে…”
–“সারিম ভাইয়া, মাহিম এবং সামি আপু মিলে তোমাদের বাসর সাজাচ্ছে। আমি এসব পারি নক বলে আমাকে তোমার দায়িত্ব দিয়ে দিলো। ওদের সবার সাথে পরিচয় হলেই তুমি চিনতে পারবে। আর সাইয়ান ভাই বড়োদের মাঝে রিমান্ডে আছে।”
শেষোক্ত কথা বলেই মেহের হাসতে শুরু করলো। রোজার মেহেরের প্রথম কথাগুলোতে গাল গরম হলেও পরে সাইয়ানের কথা শুনে রোজার খারাপ লাগলো। রোজা মুখ ঘুচে বললো,
–“উনি কী বেশি বকা খাচ্ছে?”
–“না। তবে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে বোধহয়। আচ্ছা তুমি বলো তো ভাবী, সাইয়ান ভাইয়ার সাথে তোমার বিয়ে কী করে হলো? আমি যতদূর জানি ভাইয়ার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই, ইভেন কাউকে পছন্দও না। তাহলে হঠাৎ এসব?”
রোজা কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে তাঁর। মেহের রোজার অস্থিরতা বুঝতে পেরে বললো,
–“শান্ত হও ভাবী। কিছু বলা লাগবে না। ডক্টর বলেছে তোমাকে কোনোরকম ট্রেস না নিতে।”
—————–
–“আমাদের জানানো উচিত ছিলো তোমার সাইয়ান!” আইয়ুব সাহেবের কাঠ কাঠ গলা।
সাইয়ান বড়োদের মাঝে বসে বললো,
–“সত্যি সময়, সুযোগ হয়ে ওঠেনি বাবা। নয়তো তোমাদের না জানিয়ে এত বড়ো পদক্ষেপ কখনোই নিতে পারতাম না!”
ফুপি তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
–“কী এমন কান্ড ঘটেছে যে তুমি সময় পেলে না?”
সাইয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
–“রোজার বাবা জোর করে রোজার সৎ ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেওয়ার মতো বড়ো পাপ করতে যাচ্ছিলো!”
সাইয়ানের মুখে এমন এক রুচিহীন কথা শুনে জ্যুতি অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
–“”নাউজুবিল্লাহ। উনি কী আদৌ মানুষ? ইসলামের নিয়ম-কানুন কী ভুলে গেছেন?”
ফুপি গালে হালকা চড় দিতে দিতে বললো,
–“তওবা, তওবা। আল্লাহ্ রহম করো, এমন জা*liম বাপের মেয়েকে তুই বিয়ে করেছিস সাইয়ান?”
আইয়ুব সাহেব হতভম্ভ চোখে চেয়ে রইলো ছেলের দিকে। কিছু বলার ভাষা পাচ্ছেন না তিনি। সাইয়ান আবার বললো,
–“রোজার এখানে কী দোষ ফুপি? আমি ওকে ওই অবস্থায় দেখতে চাই না বলেই বিয়ে করেছি!”
–“সিম্প্যাথি দেখিয়ে এভাবে জীবন নষ্ট করলি? সব মেয়েরা এভাবে বিপদে পরলে কী তুই সব মেয়েকেই বিয়ে করবি? আশ্চর্য!”
–“অন্যান্য মেয়েদের ব্যাপারে কথা উঠাচ্ছো কেন ফুপি? সব মেয়ে একদিকে আর রোজার ব্যাপার অন্যদিকে। আই লাইক হার, কে তার পছন্দের মানুষকে বিপদে দেখতে পারে?”
সাইয়ানের মুখে পছন্দের কথা শুনতে পেয়ে ফুপির থোতা মুখ ভোতা হয়ে গেলো। পছন্দের উপরে আর কথা বলার সাহস নেই। কেউ আর কিছুই বললো না। নীরব রইলো। সারিম উপরে দাঁড়িয়ে সবকিছু শুনলো। তবে বাকিদের মাঝে যাওয়ার চেষ্টা করলো না। বরং ভেতরে গিয়ে সামিরার উদ্দেশ্যে বললো,
–“ছোট মার থেকে একটি শাড়ি নিয়ে নতুন ভাবীকে পরিয়ে সাজিয়ে দে। আর এখানকার কাজ আমি দেখছি!”
সামিরা ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে বাধ্য মেয়ের মতো রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। মাহিম ফুল দিয়ে বাসর সাজাতে সাজাতে বললো,
–“এত কম সময়ে এই মাঝ রাতে ইমার্জেন্সি ফুল পেয়েছি কী করে ভাইয়া?”
সারিম মুখটা থমথমে করে বললো,
–“বন্ধুর এক পরিচিত লোক ছিলো। ইমার্জেন্সিতে সে জোগার করে দিলো!”
–“অবিশ্বাস্য! মাঝরাতে ফুল!”
পপরমুহূর্তে মাহিম আবার বললো,
–“কই আমরা ভাবলাম চট্টগ্রামে গিয়ে সাইয়ান ভাইয়াকে চমকে দিবো, এদিকে সাইয়ান ভাইয়া-ই আমাদের চমকে দিলো। কপাল!”
সারিম কোনো উত্তর দিলো না। সে তো অন্য ভাবনায় ব্যস্ত।
—————————
বাসরঘরে ঢোকার পূর্বে মাহিম এবং মেহেরকে একসাথে দেখে কিছুটা হতভম্ভ হয় রোজা। মেহের রোজার চমকানো বুঝতে পেরে হেসে বলে,
–“মাথায় চাপ নিও না ভাবী। আমরা জমজ!”
বাসর ঘরে প্রায় দশ মিনিট অপেক্ষা করার পর সাইয়ান রুমে প্রবেশ করলো। গায়ে তাঁর নতুন কমলা রঙের ঝকঝকে পাঞ্জাবি। কপালে কিছু চুল লেপ্টে আছে। পাঞ্জাবিও ঘাড়ের দিকে কিছুটা ভেঁজা। নিশ্চয়ই গোসল সেরে এসেছে? রোজার মাথায় এলো সাইয়ানের তো জ্বর। জ্বরে ভুগে আজ কতো ধকল গেলো তাঁর উপর দিয়ে। রোজার বলতে ইচ্ছে করলো সাইয়ানকে। কিন্তু লজ্জা এবং সংশয়ে গলায় কথা দলা পাকিয়ে আছে। সাইয়ানের সাথে চোখাচোখি হতেই রোজা নজর সরিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো।
সাইয়ান এগিয়ে এসে বিছানার একপাশে বসলো। সাইয়ান বিব্রতবোধ নিয়ে আলতো স্বরে বললো,
–“কিছু খাবেন?”
রোজা আড়চোখে সাইয়ানের দিকে চেয়ে বলে,
–“না! আপনি খেয়ে নিন।”
–“তুমিও তো কিছু খাওনি। সারাদিনে খাওয়া-দাওয়ার মতো অবস্থায় তো কেউ-ই ছিলাম না। ছোট মাকে বলবো খাবার পাঠাতে?”
সাইয়ানের মুখে হঠাৎ “তুমি” সম্বোধনটা শুনে রোজার সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে। সে নিজেকে ধাতস্থ করে ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। সাইয়ান উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই দরজায় নক পরলো। গলা শোনা গেলো জ্যুতির।
–“সাইয়ান বাবা। খাবার নিয়ে এসেছি। দুজনে খেয়ে নাও!”
———————
ছাদের এক কোণায় সারিমের পাশে মেহের দাঁড়িয়ে আছে। দুজনে নীরব থাকলেও মেহের আকাশ-পাতাল ভাবনায় ব্যস্ত। মেহের ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
–“আমি তো ভাবতেই পারছি না সাইয়ান ভাইয়ার বিয়ে হয়েছে, আজ তাঁর বাসর রাত!”
–“কেন? তোর-ও কী বিয়ে করে বাসর করার ইচ্ছে নাকি?”
মেহেরের কান গরম হয়ে গেলো সারিমের এরূপ বাক্যে। তড়িৎ সারিমের দিকে চেয়ে বলে,
–“তওবা সারিম ভাই। এসব ইচ্ছে হবে কেন?”
–“ভের্যি গুড। এসবের চিন্তা মাথাতেও আনিস না। তোর এখন পড়াশোনার বয়স!”
মেহের মুখ ফিরিয়ে শূন্যে চাইলো। কী মনে করে বললো,
–“আপনার তো পড়াশোনার বয়স নেই। মোটামুটি সেটেল্ডও। তাহলে আপনি কেন বিয়ে করছেন না?”
সারিম মেহেরের মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
–“তোকে বলতে বাধ্য নই। যার যার ইচ্ছা তাঁর, তাঁর।”
মেহের মুখ বাঁকিয়ে বললো,
–“হ্যাঁ, ওটা তো সাইয়ান ভাইয়াও বলতো। কিন্তু নমুনা দেখেন, নিজেই হুট করে বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে এসেছে। আপনিও যে এমন কিছু করবেন না তাঁর গ্যারান্টি কী?”
–“বেশি বকছিস কিন্তু। চোখে ঘুম নেই? এত রাতে ছাদে কী? যা, নিচে যা!”
মেহের এক চুলও নড়লো না। সারিম ভ্রু কুচকে বললো,
–“সাহস বেশি বেড়েছে?”
মেহের দায় সাড়া ভাব নিয়ে বললো,
–“তাতে কী? আপনি করুন গিয়ে বিয়ে!”
–“কেন আমি বিয়ে করলে তোর সমস্যা কী?”
–“আমার কিসের সমস্যা থাকবে? আপনি বিয়ে করলে আমিও প্রেম করতে পারবো!”
মেহের কিছু বলার পূর্বেই হঠাৎ হাতে টান খেলো মেহের। মেহের হতভম্ভ সারিমের দিকে চাইলো। কিছু বোঝার পূর্বেই মেহেরের হাত মুঁচড়ে মেহেরের পিঠে ঠেকালো। মেহের চাপা আর্তনাদ করে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলো। সারিমের দিকে তাকাতেই মেহেরের গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ হয়ে গেলো। সারিম অত্যন্ত রেগে আছে। সারিম প্রচন্ড গম্ভীর স্বরে বললো,
–“বাচ্চা আছিস বাচ্চার মতো থাক। নয়তো মে* হাত-পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে দিবো। তখন বিয়ে আর প্রেমের ভূত সঙ্গে সঙ্গে মাথা থেকে নেমে যাবে।”
———————–
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রোজা বিছানায় বসেই সারিমের দিকে তাকালো। দূরে দাঁড়িয়ে টিস্যুর দ্বারা হাত মুছিতে ব্যস্ত সে। রোজা হঠাৎ বলে ওঠে,
–“ওষুধ নিয়েছেন?”
সাইয়ানের ওষুধের কথ মনে পরলে হালকা হাসলো। চটপট মেডিসিন বক্স বের করে এক্সটিন খেয়ে নিলো। রোজা আবার আলতো স্বরে বললো,
–“জ্বরের মধ্যে এত রাতে গোসল করলেন কেন?”
–“কেমন অস্থির অনুভব হচ্ছিলো, তাই বসে থাকতে পারিনি। কিছু হবে না তুমি চিন্তা করো না!”
বলতে বলতেই সাইয়ান বিছানার এক কোণে এসে বসলো। রোজা হঠাৎ বলে ওঠে,
–“আপনি কী আমায় দয়া দেখিয়ে বিয়ে করেছেন স্যার?”
———————-
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।