বাসন্তীগন্ধা পর্ব -১২

#বাসন্তীগন্ধা
|১২|
লাবিবা ওয়াহিদ

——————-
সারিম গাড়ি চালানোর পাশাপাশি আড়চোখে মেহেরকে লক্ষ্য করছে। মেহেরের এরূপ বেশ কেন যেন হজম হচ্ছে না সারিমের। সারিম থমথমে সুরে বললো,

–“কালো বোরকায়, কালো হাত-পক মোজায় এমন প্যাকেট হয়ে এসেছিস কেন?”

মেহের কোনো উত্তর দিলো না। সারিমের ভ্রু কুচকানো থামলো না। মেহেরের হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক লাগছে তাঁর। কী মতলব মগজে এঁটেছে কে জানে? সারিম আবার প্রশ্ন করলো,

–“মেরু! কিছু জিজ্ঞেস করেছি!”

মেহেরের এবারও হেলদোল নেই। সারিম এবার কিছুটা রেগে গেলো, তাই রাস্তার একপাশে গাড়ি ব্রেক করলো। যেই মেহেরের কান ধরতে যাবে তখনই মেহের সতর্কতার সাথে সরে গিয়ে বলে,
–“ডোন্ট টাচ মি!”

সারিম ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো।
–“কী সমস্যা?”
–“কোনো সমস্যা থাকার দরকার ছিলো?”
–“ত্যাড়া উত্তর দিলে দাঁত ভেঙে দিবো ইডিয়েট!!”

মেহের মুখ বাঁকিয়ে বলে,
–“আপনি মাহিম নন যে আপনাকে আমার দাঁত ভাঙতে দিবো!”

ভ্রু কুচকে গেলো সারিমের! থমথমে সুরে আবার বললো,
–“এমন করছিস কেন?”
–“কেমন করছিস কেন?”
–“এভাবে বোরকা পরেছিস। আবার তর্ক করছিস! সাহস বেড়েছে ভালোই!”

মেহের হাতের মোজা ঠিক করতে করতে বললো,
–“আমি কাউকে পেট, কোমড় দেখিয়ে চলাফেরা করি না। এজন্য-ই কারো আমার প্রতি এট্রাকশন কাজ করে না!”

কথাগুলো বলার পরপর মেহেরের সম্বিৎ ফিরে। কীসব বলে ফেলেছে ভাবতেই মুখে হাত চেপে ফেললো। ঘন ঘন পলক ফেলে চোরা চোখে সারিমকে পরখ করে নিলো। লজ্জায় মেহেরের ইচ্ছা করলো গাড়ি থেকে বেরিয়ে দূরে কোথাও পালাতে। সে আবার মাথা ঘুরিয়ে জানালার দিকে ফিরলো। জানালার কাচ নামিয়ে কথা ঘুরিয়ে বললো,

–“আজ গরম পরেছে তাই না?”

সারিম তাঁর হাসি আটকে মেহেরের থেকে সরে আসলো। অতঃপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে শহরের থেকে কিছুটা বাইরে এক মেলায় আসলো তারা। সারিম কিছু বলেনি দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

মেহের গাড়ি থেক নেমে দাঁড়ালে সারিম তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিঁসফিঁস করে বললো,
–“মেলায় কেউ জিজ্ঞেস করলে, তোকে নিজের বউ বললে কোনো আপত্তি নেই তো মেরু?”

আত্মা কেঁপে উঠলো সারিমের এরূপ শীতল কন্ঠস্বরে। কথাগুলোও কম্পন ধরিয়ে দিলো মেহেরকে। মেহের ছিটকে সরে দাঁড়ালো। চোখ বড়ো বড়ো করে চাইলে সারিম আলতো হেসে বলে,
–“আই লাইক ইট!”

বলেই মেহেরের হাত ধরে ওরা মেলার ভেতরে প্রবেশ করলো। মেহের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে,
–“ছাড়ুন আমার হাত।”

সারিম আরও শক্ত করে হাতটি ধরে বলে,
–“ভীড় অনেক। হারিয়ে যাবি।”

–“আমি বাচ্চা নই যে হারিয়ে যাবো!”
–“আচ্ছা? তাই? বড়ো হলি কবে?”

মুখ বাঁকালো মেহের৷ সারিম ইচ্ছে করে তাঁর মজা নিচ্ছে সেটা তার বুঝতে বাকি নেই! চারপাশে মানুষে গিজগিজ করছে। বিভিন্ন আলোয় পুরো মেলাটা আলোকিত। একদিকে বসেছে পিঠার মেলা অন্যদিকে নানান সরঞ্জামের মেলা। শীতের শেষ পিঠা মেলা চলছে। গরম পরতে শুরু করেছে কিন্তু মানুষদের পিঠার প্রতি আগ্রহ একদমই কমেনি।

সারিম মেহেরকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
–“তখনকার কথাটা তুই কাকে উদ্দেশ্য করে বললি?”

মেহেরের খেয়ালে এলো না কোন কথা? মেহের ভ্রু কুচকে বললো,
–“কোন কথা?”

সারিম থেমে মেহেরের দিকে ফিরে চোখে চোখ রেখে বললো,
–“ওই যে পেট, কোমড়! ছেলেদের খুব এট্রাকশন পেতে চাস?”

মেহেরের চোখ উপচে বেরিয়ে আসার উপক্রম সারিমের কথা শুনে। মেহের ঘনঘন নেতিবাচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
–“না, না! কখনোই না। বরং ওদের কুনজর থেকে বাঁচতেই তো এই বেশে বেরিয়েছি! বিশ্বাস করুন!”

সারিম সব বুঝেও না বোঝার ভান ধরে অধর জোড়া প্রসারিত করে বললো,
–“একদিন এই বেশ ধরে বেরিয়ে তো কোনো কাজ হবে না। রেগুলার এভাবে বের হতে হবে! যাইহোক, তোর ইচ্ছা!”

বলেই আবার হাঁটতে শুরু করলো। সারিম থামলো একটি চুড়ির দোকানে। শত শত চুড়ি দেখে মেহেরের চোখ চিকচিক করে উঠলো, তবে মুখে কিছু বললো না। নীরব থাকলো। সারিম এক ডজন চুড়ি হাতে নিয়ে মেহেরের হাত টেনে নিয়ে নিজেই এক দুইটা করে পরিয়ে দিতে লাগলো। খুব স্লোলি, যেন সারিমের কোনো তাড়া নেই। সারিমের এই আবেদনময় স্পর্শ মেহেরের সর্বাঙ্গে শিহরণ খেলিয়ে দিচ্ছে। এক অদ্ভুত, অন্যরকম অনুভূতি।

ইশ! কেউ যদি এই মুহূর্তটুকু ক্যামেরা বন্দি করতো? তাহলে মন্দ হতো না। মেহের রোজ চেয়ে থাকতো। তবে মেহেরের লজ্জা অনুভব হচ্ছে ভীষণ। কোথায় যেন অভিমানের মেঘগুলো দমকা হাওয়ার সাথে মিলিয়ে গেলো। দমকা হাওয়া কী সারিমের দেয়া এই সময়গুলো? সময়টা যেন একান্তই মেহেরের এবং সারিমের।

——————
আজকাল নিজেকে চাতক পাখি উপাধি দিচ্ছে সাইয়ান। কেমন এক অস্থিরতা, ব্যাকুলতা কাজ করে তার ভেতর জুড়ে। কেমন হাসফাস, দম বন্ধময় অবস্থা। রোজা তার চোখের সামনে থেকেও দূরে। আজকাল বড্ড দূরে দূরে থাকছে রোজা। সাইয়ানের সাথে আগের মতো কথা বলে না, শুধু কাজ নিয়েই তাদের কথা হয়।

সেদিন রোজা তাঁর সৎ ভাইয়ের বিষয়টি ধোঁয়াশা রেখেছে। এখনো খোলাসা করে বলেনি, এড়িয়ে যাচ্ছে। যা সাইয়ানকে বাজেরকম ভাবে বিধ্বস্ত করছে। পারছেও না নিজে গিয়ে রোজার সাথে কথা বলতে। চেষ্টা করেছিলো একবার, কিন্তু এক, দুই কথার পর তাদের কথোপকথন সেখানেই ইতি টেনেছে।

হঠাৎ রোজার এরূপ পরিবর্তন সাইয়ানের মানতে কষ্ট হচ্ছে। রোজা দূর থেকে সাইয়ানের আকুল আবেদন দেখেও না দেখার ভান ধরে চলাফেরা করছে। সে জানতে চায় সাইয়ানের অনুভূতি। নয়তো তার এই একপাক্ষিক অনুভূতি তাকে আজীবন অসুখেই বেঁধে রাখবে। অনিশ্চিত ভালোবাসার চেয়ে দূরে থাকা ভালো। তবে রোজা নিজেও থাকতে পারছে না দূরে।

কেন যে সে তার বান্ধুবীর দেয়া বুদ্ধি শুনছে? অবশ্য এই বুদ্ধি যথার্থ-ই মনে করছে রোজা। এভাবে চলতে চলতে একদিন সাইয়ান খুব অসুস্থ হয়ে পরলো। অফিসে আসেনি। রোজা খবর পেয়ে তখন-ই অফিস থেকে বেরিয়ে পরে। নিজেকে সহস্র গাল-মন্দ করতে করতে সে সিএনজিতে উঠে পরে। না জানি সাইয়ান কেমন আছে?

কলিংবেল চাপলে কিছুক্ষণ পর অসুস্থ সাইয়ান দরজা খুলে দিলো। সাইয়ানের শুকনো মুখশ্রীর দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইলো রোজা। একদিনের মধ্যে সাইয়ানের এ হাল হবে কে জানতো? রোজাকে দেখে সাইয়ান শুকনো হাসি দিয়ে বললো,

–“আরেহ! মিস রোজা যে!”

রোজা ঠোঁট কামড়ে চুপ রইলো। সম্বিৎ ফিরতেই সাইয়ানের কপালে হাত রাখলো। সাইয়ান নীরবে রোজার কান্ড-কারখানা দেখলো। রোজা হাত সরিয়ে নিচু স্বরে বললো,

–“জ্বর এলো কী করে?”

–“কাল হালকা বৃষ্টি হলো না? একটু ভিঁজে গিয়েহিলাম। এজন্য-ই বোধহয় জ্বরটা আসলো!”

রোজা সাইয়ানের পাশ কেটে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বললো,
–“খেয়েছেন কিছু?”

সাইয়ান হালকা হেসে বললো,
–“নাহ। ফুপি আজ খাবার পাঠাবে না!”

রোজার বেশ মায়া লাগলো সাইয়ানের প্রতি। ছেলেটা একা একা জ্বরে ভুগছে। তার উপর খাবারও পাঠায়নি। কী এক জ্বালাতন। রোজা মাথা ঠান্ডা করে বললো,
–“ঠিকাছে। আমি রান্না করে দিবো। এখন আপনার জন্যে বাজার করে আনি!”

সাইয়ান খুব খুশি হলো। কতদিন রোজার এই কোমল কথাগুলো শুনতে পায়নি, সাইয়ানের জন্যে চিন্তিত হতে দেখেছি। আজ যেন জ্বর আসায় সে স্বার্থক। সাইয়ান হেসেই বললো,
–“একা যাবেন?”
–“সমস্যা কী?”

———————-
মেহের অতি আনন্দের সাথে ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত। আগামীকাল চট্টগ্রাম যাচ্ছে তাঁরা। সাইয়ান অসুস্থ থাকায় সারিম ঠিক করেছে তাঁরা চট্টগ্রাম গিয়ে সাইয়ানকে হুট করে চমকে দিবে।

এজন্যে সামিরা, মাহিম এবং মেহের নিজেদের রুমে নিজ নিজ ব্যাগ গোছানো শুরু করেছে। সারিম অফিস থেকে ফিরে গোছাবে।

সেদিনের পর সারিমের প্রতি মেহেরের অনুভূতি আরও দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে। আজকাল এক বান্ধুবীর সাহায্যে বেশ কিছু কাজিন লাভের মুভি দেখে ফেলেছে সে।

সারিমের প্রতি মেহেরের অনুভূতিগুলো দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। যেই সারিমকে মেহের ভয় পেত সেই সারিমকে দেখলে এখন লজ্জা অনুভব হয়।

চোখ তুলে তাকাতে পারে না। মেহেরের এই লাজ সারিমেরও নজরে আসে। তাই আজকাল একটু কম-ই বকা দেয় মেহেরকে। মেহেরও সারিমের সঙ্গ ভীষণ অনুভব করে।

ব্যাগ গুছিয়ে সব ফিটফাট হয়ে রাতে যখন সকলে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখনই হঠাৎ কলিংবেল বেজে ওঠে। জ্যুতি গিয়ে দরজা খুলতেই থমকে যায়!

———————
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here